Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বিধান যখন পৌরসভায়’ রানা চক্রবর্তী

‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে ‘মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসনসংস্কার’ প্রবর্তিত হলে, ১৯২১ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ‘সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ মন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের ভার তাঁর উপরে ন্যস্ত ছিল। সংশোধিত ‘ক্য…

 




                                    

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে ‘মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসনসংস্কার’ প্রবর্তিত হলে, ১৯২১ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ‘সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ মন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের ভার তাঁর উপরে ন্যস্ত ছিল। সংশোধিত ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট’ তাঁর মন্ত্রিত্বকালের একমাত্র প্রশংসনীয় কাজ বলা যেতে পারে। ‘বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা’র ১৯২৩ সালের ৭ই মার্চ তারিখের অধিবেশনে সেই আইন চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছিল। সেই আইনের বিধানমতে কলকাতা শহরের শহরতলীর কয়েকটি অঞ্চল কলকাতা কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর লণ্ডনের মতো কলকাতাকেও পৌর মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রদান করে উন্নত করবার ব্যবস্থা পূর্বোক্ত নতুন আইনে ছিল। পৌর জনগণের ভোটদানের অধিকারও প্রসারিত করা হয়েছিল। লণ্ডন শহরের পৌরসঙ্ঘের মতো কলকাতা পৌরসভাতেও (কর্পোরেশনে) ‘মেয়র’ এবং ‘অল্ডারম্যান’ নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল সেই নতুন আইনে। অল্ডারম্যানের সংখ্যা ছিল পাঁচজন, তাঁদের নির্বাচন করতেন কাউন্সিলাররা। সেই পাঁচজনের দ্বারাই নির্বাচিত হতেন মেয়র বা মহানাগরিক। সেই সময় কলকাতা কর্পোরেশনের আয় ছিল অখণ্ড বঙ্গের সরকারী রাজস্বের প্রায় পাঁচভাগের এক ভাগ। পদমর্যাদায় অল্ডারম্যানদের জায়গা ছিল মেয়রের পরেই। মেয়রের পদমর্যাদা ছিল ব্যবস্থাপক সভার স্পীকার বা সভাপালের অনুরূপ। সেই নবরচিত আইনের বিধান অনুসারে কর্পোবেশনের যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে গঠিত হওয়া স্বরাজ্য দল জয়লাভ করেছিল। ১৯২৪ সালের ১৬ই এপ্রিল, ‘স্বরাজ্য দলের’ নেতা ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’ প্রথমে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরের বছর (১৯২৫ সালের ১লা এপ্রিল) সেই পদে দ্বিতীয় বার তিনিই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ তাতে দুঃখিত হয়েছিলেন বললে ভুল বলা হবে না। তাঁর আত্মচরিত ‘A Nation in Making’ গ্রন্থে (৩৪তম অধ্যায়ে) তিনি লিখেছিলেন যে, মিঃ সি. আর. দাশের (চিত্তরঞ্জনের) মেয়রের পদে নিয়োগ ছিল স্বরাজ্য দলের প্রথম গুরুতর ভুল। মিঃ দাশের কর্মকৌশল ও বিচারবুদ্ধির উপরে তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। সেই সম্পর্কে স্বরাজ্য দলের কর্মনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন যে, ওই পদে সাধারণতঃ অধিষ্ঠিত হতেন সেই সব সম্মানিত নাগরিকেরাই, যাঁরা পৌরসভার কাজ করতে করতে ‘পক্ককেশ’ হয়ে যেতেন। ‘গ্ল্যান্ডস্টোন’কে, ‘পামারস্টন’কে কিংবা ‘ডিস্রেইলি’কে ওই পদ কখনও দেওয়া হয়নি, কেননা সেই পদ পৌরসেবার খ্যাতি ও বৈশিষ্ট্যের জন্য একটা প্রাপ্য সম্মান ছিল। মিঃ দাশ তাঁর নিজের সমগ্র জনজীবনের মধ্যে কোনদিন মিউনিসিপ্যাল অফিসের কয়েক মাইলের মধ্যেও যাননি। কিন্তু তাঁর দলের হাতে ক্ষমতা থাকায় এবং তিনি নেতা হওয়ায় পৌরকার্যের এতটুকু অভিজ্ঞতা ছাড়াই রাতারাতি তাঁকে মহানাগরিকের (মেয়রের) পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল৷ সুরেন্দ্রনাথের সমালোচনা থেকে বোঝা যায় যে, স্বরাজ্য দলের পক্ষে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে মিউনিসিপ্যালকার্যে অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মেয়রের পদের ন্যায্য দায়িত্বপূর্ণ পদে স্বরাজ্য দলের বসানো উচিত কাজ হয়নি। তাঁর সেই আপত্তি খণ্ডন করবার যুক্তি এবং দৃষ্টান্ত তাঁর আত্মচরিতের পরবর্তী অধ্যায়েই পাওয়া যায়। সংশোধিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট প্রবর্তনের আগে কলকাতা কর্পোরেশনের কার্য্য পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার একজন ‘সিনিয়র আই. সি. এস.’কে ‘চেয়ারম্যান অব দি কর্পোরেশন’ পদে নিয়োগ করত। ওই লোভনীয় পদটি ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জন্যই সংরক্ষিত থাকত। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মচরিতে (৩৫তম অধ্যায়ে) তাঁর মন্ত্রিত্বকালের উল্লেখযোগ্য কাজের বিবরণ দান-প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে, তিনিই সর্বপ্রথম সেই পদে ‘বাঙ্গালী সিভিলিয়ান’ ‘মিঃ জে. এন. গুপ্ত’কে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর পরবর্তী চেয়ারম্যান নিয়োগ করার বেলায় সুরেন্দ্রনাথ পূর্বপ্রচলিত রীতির ব্যতিক্রমে মনোনীত করেছিলেন একজন বেসরকারী ব্যক্তিকে। তিনি ছিলেন আলিপুরের একজন প্রসিদ্ধ উকিল, কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলার এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচিত সদস্য ‘সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক’। শাসন-কর্তৃমণ্ডলীর কেউ কেউ তাতে আপত্তি করেছিলেন এই বলে যে, মিউনিসিপ্যালিটির শাসনকার্যে মিঃ মল্লিকের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং সেটার অভ্যন্তরীণ শাসনযন্ত্র কিভাবে পরিচালিত হয়, সেটাও তিনি জানতেন না। সেই আপত্তির উত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন - ‘‘মি: লয়েড জর্জ যখন ‘চ্যান্সেলার অব দি এক্সচেকার’ (অর্থমন্ত্রী) হইলেন, তখন তিনি ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কি জানিতেন? মিঃ মল্লিককে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যোগাইয়া সাহায্য করার জন্য কর্পোরেশনের স্থায়ী কর্মচারীরাই রহিয়াছেন। কর্পোরেশনের মতো একটা বৃহৎ বিভাগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির পক্ষে প্রয়োজন হইল প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী, কর্মনীতি নির্ধারণের ক্ষমতা এবং তথ্যাদি সম্পর্কে এরূপ জ্ঞান যদ্দ্বারা স্থায়ী কর্মচারিগণকে পরিচালিত করা ও উপদেশ দেওয়া যাইতে পারে।’’ তাঁর সেই যুক্তি মেনে নিয়ে বাংলার গভর্ণর মিঃ মল্লিকের নিয়োগ অনুমোদন করেছিলেন। একই যুক্তি কি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মেয়র পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল না? সুতরাং দেখা যায় যে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন প্রবীণ বহুদর্শী জননায়কও দলাদলির সংকীর্ণ মনোভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি।                                

কলকাতা কর্পোরেশনের পরিচালনার ভার কংগ্রেস দলের হস্তগত হবার পরে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রায় আট বছর অল্ডারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এবং দুইবার কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে কলকাতা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরে কংগ্রেস দলের হাতে কেবল কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালনার ভারই আসেনি, তেইশ বছর পরে (১৯৪৭ সালে) খণ্ডিত ভারতের শাসন পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্বও এসেছিল। কলকাতা মহানগরীর পৌর শাসনক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে থাকায়, স্বাধীনতা লাভের আগেই বাইশ বছরের (১৯২৪– ১৯৪৬ সাল) মধ্যে সেটার নব রূপায়ণ হয়েছিল। সেই সময় কত দিক দিয়ে যে কলকাতার উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল, সেটা বিস্তারিতভাবে পুনরল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন৷ তবে একটা কিংবদন্তী আছে যে, জনস্মৃতিশক্তি ক্ষণস্থায়ী - ‘Public memory is short’, সুতরাং কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা দানের ব্যাপক ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা, কর্পোরেশনের অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মী ও শ্রমিকগণেব বেতন বৃদ্ধি ও কতগুলি বিষয়ে ন্যায্য সুবিধা দান, পৌরস্বাস্থ্যের বিবিধ উন্নতিসাধন এবং নির্যাতিত দেশসেবকগণের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এই সব ছাড়াও সেই সময়ের মধ্যে কলিকাতা পৌরসঙ্ঘের অনুরূপ প্রশংসনীয় অবদান আরও ছিল। সুরেন্দ্রনাথ স্বরাজ্য দলের সমালোচনা প্রসঙ্গে সতর্ক বাণী করেছিলেন যে, ‘‘ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং সেই ক্ষমতা তাঁহাদের হস্তগত থাকে ততদিন পর্যন্তই, যতদিন তাঁহারা ন্যায়নিষ্ঠার সৎপথ হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া না পড়েন। সমস্ত ইতিহাসের তাহাই শিক্ষা।’’ (‘‘Power 18 given to the righteous; and is held by the righteous so long as they do not deviate from the golden track of right dealing. That is the lesson of all history.’’) সেই সতর্কবাণী সম্পর্কে ‘রাষ্ট্রগুরু’র সঙ্গে কারও দ্বিমত হবার সঙ্গত কোন কারণ নেই। কংগ্রেসপন্থীগণ যে একটানা এত দীর্ঘকাল যাবৎ কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালনার ক্ষমতা অধিকার করেছিলেন, সেটা থেকে সেই সময়ে তাঁদের লোকপ্রিয়তার পরিচয়ই পাওয়া যায়; এছাড়া সেটা থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, সেই সময়ে অন্ততঃ তাঁরা পৌর-শাসন ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় স্বরাজ্য দলের তৎকালীন নেতা ‘যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত’। তিনি ১৯২৫ সাল থেকে (মাঝে ১৯২৮ সাল ছাড়া) ১৯৩০ সাল পর্যন্ত পর পর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের শেষে কংগ্রেস, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করলে ঐ সংগ্রামের কর্মসূচী অনুসারে স্বরাজ্য দল আইনসভা বর্জন করেছিল৷ ১৯৩০ সালের গোড়াতেই মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ‘লবণ আইন অমান্যের’ জন্য সারা দেশ প্রস্তুত হয়েছিল এবং মহাত্মা গান্ধী ‘লবণ সত্যাগ্রহের’ সূচনা করে ‘ডাণ্ডি’ অভিযান করেছিলেন। ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ আরম্ভ হবার অল্পকাল পরেই কলকাতা পৌরসভার তৎকালীন মেয়র ‘জে. এম.

সেনগুপ্ত’ কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ শুরু হবার আগেই ‘রাজদ্রোহের অপরাধে’ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডানহাত ‘সুভাষচন্দ্র’ কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। এরপরে ‘সুভাষচন্দ্র’ কারামুক্ত হলে, তিনি ১৯৩০-৩১ সালে অবশিষ্ট কয়েক মাসের জন্য কলকাতার মেয়রের পদ অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর যে কোনও মুহূর্তে আবার কাবারুদ্ধ হবার আশঙ্কা থাকায় কলকাতা পৌরসংস্থার পরিচালনার জন্য একজন উপযুক্ত নেতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তখন ‘সুভাষচন্দ্র’ই সেই বিষয়ে যোগ্যতম ব্যক্তিরূপে বিধানচন্দ্রের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ঐ সময় কংগ্রেসের কর্মসূচী অনুসারে স্বরাজ্য দল আইনসভা বর্জন করায় বিধানচন্দ্র সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন এবং ১৯৩১ সালের ১৫ই এপ্রিল সর্বসম্মতিক্রমে কলকাতা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিধানচন্দ্র ১৯৩০-৩১ সালে কলকাতা পৌরসভার অল্ডারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন, এবং ঐ সময় থেকে ১৯৩২-৩৩ সাল পর্যন্ত একাধিকবার অল্ডারম্যান ছিলেন। পরে তিনি ১৯৩৮-৩৯ সালে পুনরায় অল্ডারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং একটানা ১৯৪৩-৪৪ সাল পর্যন্ত অল্ডারম্যান ছিলেন। তিনি কলিকাতা মহানগরীর উন্নতিকল্পে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আদর্শ ও পন্থাকেই সর্বান্তঃকরণে অনুসরণ করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আদর্শ ও স্বপ্নকে রূপায়িত করবার পরিপূর্ণ সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন ১৯৩১-৩২ এবং ১৯৩২-৩৩ সালে, পর পর দুই বছর মেয়র পদে অধিষ্ঠিত থাকবার সময়ে। ১৯৩১-৩২ সালে বিধানচন্দ্র সর্বসম্মতিক্রমে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩২-৩৩ সালে মেয়র নির্বাচনে তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঐ বছর মেয়র পদের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন পরবর্তীকালের মেয়র ও মন্ত্রী ‘সন্তোষকুমার বসু’। সেই নির্বাচনে বিধানচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ‘জে. এন. মৈত্র’ এবং পরবর্তীকালের অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী) ‘এ. কে. ফজলুল হক’। বিধানচন্দ্র ৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ‘মৈত্র’ পেয়েছিলেন ২৬টি ভোট এবং ‘এ. কে ফজলুল হক’ পেয়েছিলেন ৮টি ভোট।                            

বিধানচন্দ্র কলকাতা শহরকে সত্যিই ভালোবাসতেন। তিনি মেডিক্যাল কলেজে পড়বার সময় থেকেই, মাঝখানে বিলাতে দুই বছর শিক্ষালাভের সময় ছাড়া কলকাতায় স্থায়িভাবে বসবাস করেছিলেন। পাছে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে হয়, সেই ভয়ে তিনি ‘ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসে’ (I.M.S.) যোগ দেননি। তিনি কলকাতা শহরকে ভালো করে চিনতেন। চিকিৎসকরূপে তিনি কলকাতার রাজপথ থেকে গলি, প্রাসাদ থেকে বস্তি, সর্বত্রই বিচরণ করতেন। চিকিৎসকরূপে কলকাতার অধিবাসীদের সমস্যাগুলি তাঁর নখদর্পণে ছিল। সুতরাং কলকাতা শহরের উন্নতিকল্পে সবার আগে কি কি করণীয়, সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। তবুও দেশবন্ধুর প্রদর্শিত পথেই তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়ে ১৯৩১ সালে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন যে, ‘‘দেশবন্ধু কলকাতার উন্নয়নের যে রেখাচিত্র অঙ্কন করে দিয়ে গিয়েছেন, সেটাকে পরিপূর্ণ রূপ দিলেই আমরা সাফল্যমণ্ডিত হব’’ - ‘‘The outlines of the canvas are there, we have to fill in the details: the broad features of the scheme are there, we have got to frame and work out a programme; the power, prestige, the men and the money are there, let us utilise them with a set purpose and let us work in unison to bring about the uplift of the poor and the reliet of the sufferer.. Let our service to the rate-payers be guided by a pure heart and an honest effort.’’ বিধানচন্দ্র জীবনে কখনও কোন পদ বা সম্মান লাভের জন্য চেষ্টা করেননি। যখনই কোন কাজের দায়িত্ব এসে পড়ত, তখনই তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সেটা গ্রহণ করতেন এবং অকৃপণভাবে নিজের কর্মশক্তিকে সেই কর্মসাধনে উজাড় করে ঢেলে দিতেন। কলিকাতা পৌরসভার অল্ডারম্যান ও মেয়র থাকাকালেও তিনি সেটাই করেছিলেন। কাউন্সিলর ‘শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়’ বলেছিলেন, ‘‘কর্পোরেশনের ইতিহাসে এই প্রথম দেখিলাম কোনও মেয়র প্রতিদিন দুপুর হইতে বিকাল তিনটা পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করিতেছেন৷’’ বিধানচন্দ্র কাউন্সিলরদের নিজের নিজের কাজে অমনোযোগ ও অবহেলারও তীব্র নিন্দা করতেন, একবার তো তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন - তাঁরা ‘‘behaving not like city-fathers but like children.’’ বিধানচন্দ্রের বিরোধীরাও বিধানচন্দ্রের বিচক্ষণতা, ধৈর্য্য ও সৌজন্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। বিধানচন্দ্রের সঙ্গে অতি সাধারণ নাগরিকও সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেতেন। তিনি কর্পোরেশনের একুশটি কমিটিতে থেকে - কোন কোন কমিটির সভাপতিরূপে এবং কোন কোন কমিটির সদস্যরূপে - মহানগরীর অধিবাসীগণের সেবা করে গিয়েছিলেন। সেই কমিটিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলো ছিল - (১) বাজেট স্পেশাল কমিটি – চেয়ারম্যান: ১৯৩১-৩২, ১৯৩২-৩৩, ১৯৩৯-৪, ১৯৪২ ৪৩, ১৯৪৩-৪৪; (২) ফিনান্স স্ট্যাণ্ডিং কমিটি - চেয়ারম্যান: ১৯৩০-৩১, ১৯৪২-৪৩, ১৯৪৩-৪৪; (৩) সার্ভিসেস স্ট্যাণ্ডিং কমিটি - চেয়াম্যান: ১৯৩১-৩২, ১৯৩৯-৪০; (৪) পাবলিক্‌ হেল্থ স্ট্যাণ্ডিং কমিটি - সদস্য: ১৯৩৯-৪০। অন্যান্য যেসব কমিটিতে তিনি ছিলেন, সেগুলো হল - ডেভেলপমেন্ট স্কিম্ স্পেশাল কমিটি, বেগার প্রব্লেম স্পেশাল কমিটি; বিল্ডিংস ডিভিশান স্পেশ্যাল কমিটি; ড্রেইনেজ ডিপার্টমেন্ট এন্‌কোয়ারি স্পেশ্যাল কামটি, হরিজন স্পেশ্যাল কমিটি; লাইভস্টক অ্যাণ্ড মিল্ক সাপ্লাই স্পেশ্যাল কমিটি, ড্রাফট ভ্যাগেন্সী বিল স্পেশ্যাল কমিটি, স্ট্রে বুলস অ্যাণ্ড ক্যাটল একোয়ারি স্পেশ্যাল কমিটি, আনএমপ্লয়মেন্ট প্রব্লেম স্পেশ্যাল কমিটি, এ. আর. পি স্পেশ্যাল কমিটি; কর্পোরেশনের আর্থিক বিষয়ে মিঃ সি. ডব্লিউ গার্নারের রিপোর্ট বিবেচনার জন্য গঠিত স্পেশ্যাল কমিটি, পলতা পাম্পিং স্টেশন এনকোয়ারি স্পেশ্যাল কমিটি, ট্রেইনিং অব ইণ্ডিয়ান নার্সেস সাব কমিটি, মিউনিসিপ্যাল (অ্যামেণ্ডমেণ্ট) বিল স্পেশ্যাল কমিটি, মেহোমেডান অ্যাণ্ড ব্যাকওয়ার্ড অ্যাণ্ড মাইনরিটি কমিউনিটিজ এমপ্লয়মেণ্ট স্পেশ্যাল কমিটি, রুলস অব বিজনেস স্পেশ্যাল কমিটি, প্লে গ্রাউণ্ড ফেসিলিটিজ স্পেশ্যাল কমিটি। বিধানচন্দ্র কেবল কলিকাতা মহানগরীর উন্নয়নেই মন দেননি, কলিকাতা পৌরসভাকে সব ধরনের কলঙ্ক থেকে মুক্ত রাখতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন৷ ‘স্যার চার্লস টেগার্ট’ বাংলা সরকারের পুলিস বিভাগের স্পেশ্যাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের বড়কর্তা ছিলেন। বাংলার স্বাধীনতাকামী বিপ্লবপন্থী যুবকদের উপরে লাঞ্ছনা-নির্যাতনের জন্য তিনি ও তাঁর সহকর্মী ‘মিঃ লোম্যান’ প্রভৃতি কুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। টেগার্ট সাহেবকে তাঁর কর্মদক্ষতাব জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছিল কলিকাতার পুলিস কমিশনারের পদে নিযুক্ত করে। অবসর নেওয়ার পরে, স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে, তিনি বঙ্গদেশের বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে বিষোদগার শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে লণ্ডনে ভাবতে বিপ্লববাদ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সভার বিবরণ ভারতীয় সংবাদপত্রসমূহে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছিল। যে সভায় টেগার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটা আহ্বান করেছিল ‘রয়্যাল এম্পায়ার সোসাইটি’ এবং তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলার ভূতপূর্ব গভর্ণর ‘স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন’। টেগার্ট যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটার বঙ্গানুবাদ হল, ‘‘একথা বলা যায় যে, বঙ্গদেশে এমন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাই, যেখানে প্রধান প্রধান নেতাদের অধীন কোন একজন বিপ্লবী নাই। ইহার ফল এইরূপ দাঁড়াইয়াছে যে, ওই সকল নেতার আদেশে বিপ্লবী যুবকেরা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করিতেছে, কিন্তু পুলিস উহাদের ধরিতে পারিতেছে না। ওই সমূদয় নেতা পুলিসের দৃষ্টি এড়াইয়া চলে এবং বিপ্লবী দল পরিচালনা করে। যুবকদের প্রতারণা করিয়া দলে আনে এবং উহাদের মনকে গবর্নমেণ্টের প্রতি বিদ্বেষে পরিপূর্ণ করিয়া দেয়৷ বিপ্লবী নেতারা এমন ধরনের লোক যে, জনসাধারণ তাঁহাদের বিরুদ্ধে পুলিসকে সামান্য সাহায্য করিতেও সাহস করে না। ... অনেক রক্তপাত হইয়া গিয়াছে এবং উহার পরিণাম বাস্তবিকই ভয়াবহ হইত যদি সাহসী পুলিস কর্মচারীর দল বিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করাটা জীবনের একটা দুঃসাহসিক কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ না করিতেন। ... আমি তিনটি বিভাগের তিনজন বড়কর্তাকে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হইতে দেখিয়াছিলাম; কিন্তু তৎক্ষণাৎ ওই সকল নিহত পুলিস কর্মচারীর বিপজ্জনক কর্তব্যভার অন্য কর্মচারী বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ... সম্প্রতি একজন ইউরোপীয়ানকে হত্যার অপরাধে যে বিপ্লবী যুবকের ফাঁসি হইয়াছে, তাহাকে প্রশংসা করিতে বাংলার কংগ্রেসকে বিপ্লবী দল বাধ্য করিয়াছে। ... মিঃ দাশ (চিত্তরঞ্জন) কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হইবার পরে এমন সব লোককে চাকরির জন্য আহ্বান করিলেন, যাঁহারা দেশের স্বার্থের জন্য দুঃখকষ্ট স্বীকার করিয়াছে। ইহার ফলে অনেক বিপ্লবী এবং বিপ্লবীদের আত্মীয় কর্পোরেশনে চাকরি পাইয়াছে। বেশির ভাগ বিপ্লবীকে নিযুক্ত করা হইয়াছে শিক্ষকতার কার্যে। প্রথম বৈপ্লবিক আন্দোলন-কালের অপেক্ষা বর্তমান কালে সমগ্র প্রদেশে স্কুল ও কলেজে বিপ্লবীরা অধিক সংখ্যায় প্রবেশ করিয়াছে; সুতরাং গবর্নমেণ্ট আবার ভারত রক্ষা আইনের অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন, এবং ইতঃপূর্বে ওইরূপ ব্যবস্থার দ্বারাই বিভীষিকামূলক কার্যাবলী দমন করা হইয়াছিল। ক্রমে ক্রমে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইল; বিপ্লব দমনের উপযুক্ত আইন রহিত করার কিছুকাল পরেই চট্টগ্রামে চমকপ্রদ ঘটনাবলী অনুষ্ঠিত হইল। ইহা বিপ্লবীদলের তৃতীয় অভিযান বলিয়া ধরা যাইতে পারে।’’ (ডাক্তার বিধান রায়ের জীবন-চরিত, নগেন্দ্রকুমার গুহরায়) টেগার্টের সেই বক্তৃতায় সমগ্র বঙ্গদেশে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা নিয়ে কর্পোরেশনের ৯ই নভেম্বরের সভায় আলোচনা হয়েছিল। ১৯৩২ সালের ১০ই নভেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় সেই সভার কিছুটা বিবরণ ছিল এইরূপ - ‘‘পুজার ছুটির পর গত বুধবার কলিকাতা কর্পোরেশনের প্রথম সভার অধিবেশন হইয়াছিল। কলিকাতার ভূতপূর্ব পুলিস কমিশনার স্যার চার্লস টেগার্ট বিলাতে বসিয়া এক বিবৃতি প্রচার কবিয়াছেন। তিনি নাকি প্রকাশ করিয়াছেন যে, কলিকাতা কর্পোরেশন বিভীষিকা উৎপাদনকারীদিগকে অনেক চাকরি দিয়াছেন, বিশেষতঃ কর্পোরেশন ফ্রী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকপদে ঐরূপ অনেক লোককে নিয়োগ করা হইয়াছে। মিঃ আবদুল রজ্জাক উক্ত বিষয়ে আলোচনা করিবার জন্য মেয়রকে নোটিশ দেন এবং ঐ প্রসঙ্গে বলেন যে উক্ত বিবৃতিতে যে সকল অভিযোগ আছে তাহা ভিত্তিহীন, অন্যায় ও অযাচিত। তিনি বলেন যে, হয় মেয়র মহাশয় স্বয়ং কিছু উক্তি করুন অথবা সভায় এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য একটি দিন স্থির করা হউক। মিঃ ক্যাম্বেল ফবেস্টার বলেন যে, দিন ধার্য্য করায় তাঁহার কোন আপত্তি নাই বটে, তবে এই কথা সত্য কিনা তাহা অবধাবণ করা ভাল। মেয়র ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেন যে, তাঁহারা বহুবার কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযাগ আনীত হইয়াছিল তাহার প্রত্যুত্তব দিয়াছেন। তিনি বলেন যে, স্যার চার্লস্ টেগার্টকে পত্র লিখিয়া তাঁহার বক্তৃতাটি পুরাপুরি আনয়ন করা ভাল, তারপব এই বিষয়ে সভায় আলোচনা করিলেই চলিবে। ঐ বিবৃতিতে কর্পোরেশনেব বিরুদ্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্য নহে। মিঃ ফবেস্টার বলিয়াছেন যে, ঐ বিবৃতি পুরাপুরি পাঠ করিলে অন্যরূপ অর্থ বুঝিতে পারা যাইবে। পরিশেষে মেয়র মহাশয় বলেন যে, এই প্রকার প্রচারকার্যের দ্বারা কর্পোরেশনের কর্তব্য সম্পাদনের কোন বিঘ্ন হইবে না। তিনি সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন যে, তিনি স্যার চার্লস টেগার্ট যে বক্তৃতা দিয়াছেন, তাহার অনুলিপি পাঠাইবার জন্য পত্র লিখিবেন।’’ স্যার চার্লস টেগার্টের বক্তৃতা এবং কর্পোরেশনকে আক্রমণ সম্পর্কে কলকাতা কর্পোবেশনেব অল্ডারম্যান ও কাউন্সিলারদের ৫ই ডিসেম্বরের (১৯৩২ সাল) সভায় ডাঃ বিধানচন্দ্র বায় একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেই সভা ও তাঁর বিবৃতি নিয়ে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল - ‘‘ইংলণ্ডে কিছুদিন পূর্বে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে স্যার চার্লস টেগার্ট বলিয়াছেন যে, কর্পোরেশন বিপ্লবীদিগকে, এবং বিপ্লবীদের আত্মীদিগকে মাস্টারের চাকুরি দিয়া পুষিতেছেন। ঐ বিষয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া সম্পর্কে কাউন্সিলারদের অভিলাষ সমর্থন করিয়া মেয়র গত সোমবারের সভায় ঐ সম্বন্ধে এক বিবৃতি দান করেন। তিনি বলেন: কর্পোরেশন স্থির করিয়াছিলেন যে, স্যার চার্লস টেগার্টের বক্তৃতার একখণ্ড সঠিক অনুলিপি না পাওয়া পর্যন্ত ঐ বিষয়ে কর্পোরেশন বিবেচনা স্থগিত রাখিবেন কিন্তু এখানকার ইউরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েসন ঐ বক্তৃতা এখানে মুদ্রিত করিয়া সাধারণে প্রচার করিয়া দিয়াছেন। সম্প্রতি অদ্যকার কাগজে আবার রয়টারের খবর আসিয়াছে যে, স্যার চার্লস টেগার্ট সংবাদপত্র-প্রতিনিধির নিকট

তাঁহার পূর্ব উক্তি সমর্থন করিয়াছেন। রয়টারের তারের ভাষা উল্লেখ করিয়া মেয়র বলেন - অভিযোগের বিষয়ীভূত বিষয় সম্পর্কে আমি পূর্বে বলিয়াছি, এখনও তাহার পুনরুক্তি করিতেছি। ঐ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, নির্লজ্জ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নহে। দেশের এই সঙ্কটসময়ে যাঁহারা সত্য তথ্যের সহিত পরিচিত নহেন, তাঁহাদিগের মনে ভুল ধারণা জন্মাইয়া দিবার জন্য এবং ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বায়ত্ত শাসনাধিকারসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান কলিকাতা কর্পোরেশনের বিরদ্ধে লোকের মনকে বিদ্বিষ্ট করিয়া তুলিবার অভিপ্রায়েই উহা প্রচার করা হইয়াছিল। স্যার চার্লসকে আমরা একজন কৃতী কর্মচারী বলিয়াই জানি, কিন্তু তিনি যে একজন কুটিল তার্কিক তাহা আমরা জানিতাম না। স্যার চার্লস তাঁহার বক্তৃতায় বলিয়াছেন যে, পরলোকগত দেশবন্ধু মেয়র হইয়াই যাঁহারা দেশের জন্য কষ্ট ভোগ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে চাকুরি লইবার জন্য আহ্বান করিয়াছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে দেশবন্ধু সত্যই এরূপ করিয়াছিলেন কিনা, কর্পোরেশনের কাগজপত্রে তাহার প্রমাণ নাই। ধরিয়া লওয়া গেল তিনি তাঁহাদিগকে চাকুরি দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে দোষের কি আছে? দেশবন্ধু মেয়ররূপেও জেল খাটিয়াছেন। দেশের কাজে জেল খাটিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই দেশের কাজে জেল খাটিয়াছেন। দেশের কাজে জেল খাটিয়াছেন এক কথা, আর কর্পোরেশন অনেক বিপ্লবী ও তাঁহাদের আত্মীয়গণকে শিক্ষকতার চাকুরি দিয়া পুষিয়া আসিতেছেন, এ কথা বলার অর্থ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দেশের কাজ করা আর বিপ্লবী হওয়া এক কথা নয়। এই পার্থক্য রাস্তার লোকও বুঝিতে পারে, স্যার চার্লস কি বুঝিতে পারেন না? সময় বুঝিয়া স্যার চার্লস এখন সেই পুরাতন প্রসঙ্গ উত্থাপন কবিলেন কেন, এ বিষয়ে মেয়র বলেন: ইহা যে কর্পোরেশনব বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক প্রচারকার্য, তাহা বুঝিতে কাহাকেও বেগ পাইতে হইবে না। কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ বহুবার আনীত হইয়াছে, প্রতিবারই কর্পোরেশন অভিযোগ খণ্ডন করিয়াছেন। স্যার চার্লস যাহা বলিয়াছেন তাহার মধ্যে যদি সত্য থাকিত, তাহা হইলে ঐ সময়ে কেন তিনি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নাই? ঐ সময় তাঁহার হাতে প্রচুর ক্ষমতা ছিল এবং সরকারেরও তাঁহার উপর যথেষ্ট আস্থা ছিল। আমি শিক্ষা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছি যে, চাকুরি পাওয়ার পর বিপ্লববাদ সম্পর্কে দণ্ডিত হইয়াছে এরূপ কোন লোককে চাকুরি দেওয়া হয় নাই; তবে সেই বৎসর পূর্বে একটি ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিত এক ব্যক্তিকে চাকুরি দেওয়া হইয়াছে বটে, কিন্তু তিনি কোন কালে যদি বিপ্লববাদের সংস্রব ত্যাগ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে চাকুরি দেওয়ার পক্ষে বাধা কি? বাংলার ভূতপূর্ব গভর্নর লর্ড লিটন ব্যবস্থাপক সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের কথা উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে, ঐ ব্যক্তি হাইকোর্টের বিচারে মামলায় দণ্ডিত হইয়াছিলেন, পবে তিনি স্বীকাবোক্তি করায় তাঁহাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং সরকারী চাকুরিতে ভর্তি করিয়া দেওয়া হয়। সবকারের পক্ষে কি ইহা অসঙ্গত হইয়াছে, না হইয়া থাকিলে এই ধরনের অভিযোগের মূল্য কি? মেয়র বলেন - আমি পূর্বেও বলিয়াছি, আবারও বলিতেছি যে, কর্পোরেশন এই সকল অভিযোগ খণ্ডন করিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা বজায রাখিতে পারিবে, নাগরিকদেব স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তাঁহাদের কর্তব্য সম্পাদন করিয়া যাইতে পারিবে। এই বিষয়ে কর্পোরেশনের সাফল্যই সম্ভবতঃ কোন কোন লোকেব মনে হিংসার জ্বালা ধরাইয়া দিয়াছে। আমরা যতদিন পর্যন্ত যথাযথভাবে আমাদের কর্তব্য সমাধান করিয়া যাইতে পারিব, ততদিন পর্যন্ত আমরা সগর্বে সেই প্রসিদ্ধ প্রবচনেব উল্লেখ করিবার অধিকারী থাকিব - উহারা অনেক বলিয়াছে, অনেক বলিবে, যত পারে বলুক।’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৩২সাল) এমন আরও অনেক কাজ বিধানচন্দ্র করেছিলেন, যেগুলো কলকাতা পৌরসভার ইতিহাসে অভিনব ছিল। ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বিপ্লবী ‘দীনেশ গুপ্ত’র ফাঁসি হয়। সেই দিন কলিকাতায় হরতাল পালন করা হয়েছিল। বিকেলে ময়দানে মনুমেণ্টের পাদদেশে এক মহতী জনসভায় বিপ্লবী দধীচির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছিল। কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান ও কাউন্সিলারদের এক সভায় দিনেশচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম, আত্মোৎসর্গ ও আদর্শনিষ্ঠার প্রশংসা করে এবং তাঁর অমর আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন মেয়র ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করে তিনি ইংরেজিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটার অনুবাদ করলে হয় - ‘‘ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দিক হইতে এবং কংগ্রেসের অনুসৃত নীতির দিক হইতে দেখিতে গেলে দিনেশ তাঁহার জীবনাদর্শকে সার্থক করিবার জন্য যে পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন, উহা সমর্থন করিতে পারা যায় না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁহার ব্রতপালনে অন্তিমকাল পর্যন্ত যে সাহস ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছেন, তৎপ্রতি আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন না করিয়া পারি না। এই পর্যন্ত প্রাপ্ত যাবতীয় বিবরণ হইতে জানা যায় যে, দিনেশ প্রফুল্লচিত্তে ফাঁসুড়ের ফাঁস গলায় পরিয়াছেন; এবং তাঁহার কণ্ঠ হইতে যে শেষ বাণী ধ্বনিত হইয়াছে, তাহা ‘বন্দে মাতরম্’। হাইকোর্টের বিচারপতি বাকল্যাণ্ড তাঁহার রায়ে বলিয়াছেন যে, ওই যুবক আত্মস্বার্থ কিংবা ব্যক্তিগত বিদ্বেষবুদ্ধির দ্বারা চালিত হয় নাই। বস্তুতঃপক্ষে বিচারপতি বাকল্যাণ্ড কেবল ইতিহাসের সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করিতেছিলেন। আমরা এই প্রকার বহু দৃষ্টান্ত বহুবার পাঠ করিয়াছি - যেখানে অনুরূপ কার্যের অনুষ্ঠাতা বলিয়া যাঁহারা একপুরুষে দণ্ডিত হইয়াছেন, পরবর্তী পুরুষে তাঁহারা সেই কার্যের জন্যই শহীদ বলিয়া অভিনন্দিত হইয়াছেন। অতএব এই যুবক তাঁহার জীবনাদর্শকে সার্থক করিবার জন্য যে সাহস ও নিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন, আসুন আমরা সকলে মিলিয়া তৎপ্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।’’ যে সব দেশভক্ত জন্মভূমির স্বাধীনতা লাভের জন্য আত্মবলিদান দিয়েছিলেন, তাঁহাদের প্রতি ডাঃ রায়ের শ্রদ্ধা যে কত গভীর ছিল, সেটা তাঁর এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। সেই ভাষণে তাঁর সৎসাহসের পরিচয়ও পাওয়া যায়। গান্ধীজি কলকাতা পৌরসভা কর্তৃক এই ধরণের প্রস্তাব গ্রহণের সংবাদ পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ তিনি হিংসাত্মক কোন কাজকে প্রশংসনীয় বলে মনে করতেন না, সেটা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য হলেও। তাই গান্ধীজি ঐ প্রস্তাবটিকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেছিলেন। কংগ্রেসের অনুগত সৈনিক এবং গান্ধীজির বিশ্বস্ত শিষ্যরূপে বিধানচন্দ্র ঐ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে চাহিলেও সেটা করার আর কোনও উপায় তখন ছিল না। তাই বিধানচন্দ্র তখন প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, সেটা লিপিবদ্ধ করা হোক যে, মহাত্মা গান্ধী তথা কংগ্রেসের নির্দেশ অনুসারে তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তখন প্রত্যাহারের আর কোন উপায় না থাকায় করা হয়নি। এছাড়া ডাঃ রায় মেয়র থাকাকালীন পৌরসভায় ‘কবিগুরু’র সত্তর বছরের জন্মদিন উপলক্ষে ও ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের’ বাহাত্তরতম জন্মদিনের সম্বর্ধনা সভা উপলক্ষে যে ভাষণ পাঠ করেছিলেন সেগুলোও ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু স্থানাভাবে সেগুলো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।


পুবসভায় ডাক্তার রায়ের মহানাগরিকত্বের সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের বেতন বাড়ানো হয়েছিল। জনসেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডাঃ রায়ের কাজ করার দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থাকলেও পুরসভার ব্যাপক ও সমস্যা-সঙ্কুল কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নবাগত। তা সত্ত্বেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে তাঁর কর্তব্য সম্পন্ন করে সমস্ত দলের প্রশংসা লাভ করেছিলেন। পৌরসভায় চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা বিধানচন্দ্রই করেছিলেন। তার ফলে কেবল সুপারিশ ও স্বজনপোষণ দিয়ে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করা সম্ভব হয়েছিল। এতে পৌরসভার কাজকর্মে দক্ষতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।                         

(তথ্যসূত্র:

১- ডাক্তার বিধান রায়ের জীবন-চরিত, নগেন্দ্রকুমার গুহরায়।

২- বিধানচন্দ্র, মনোজিৎ বসু।

৩- ডাঃ বিধান রায়, অশোককুমার কুণ্ডু।)

                        

No comments