Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

কালাতীতা’ রানা চক্রবর্তী

‘বিশুদ্ধ বাংলায় বিবাহিত ‘স্ত্রী’কে বলা হয় ‘সহধর্মিণী’। ‘স্ত্রী’ বা ‘বউ’ শব্দটিকে একটু সম্মানিত করা - এই আর কি। ‘সহধর্মিণী’ শব্দটির মধ্যে ‘ধর্ম’ শব্দটি থাকলেও স্ত্রী-এর ধর্ম যা তাই থাকে, সেটাতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এ…

 




                                   

বিশুদ্ধ বাংলায় বিবাহিত ‘স্ত্রী’কে বলা হয় ‘সহধর্মিণী’। ‘স্ত্রী’ বা ‘বউ’ শব্দটিকে একটু সম্মানিত করা - এই আর কি। ‘সহধর্মিণী’ শব্দটির মধ্যে ‘ধর্ম’ শব্দটি থাকলেও স্ত্রী-এর ধর্ম যা তাই থাকে, সেটাতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এই শব্দটিকে জীবন্ত করে রেখে গিয়েছেন মা সারদা। বলা ভালো যে শব্দটির মধ্যে তিনি বিদ্যুৎ ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কথাটা সেদিন তাঁর মুখ থেকে বেরিয়েছিল বিদ্যুৎরেখার মতো। আকাশের গায়ে যেমন বিদ্যুৎ চিরে যায়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস। শ্রীমা তখন ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির নহবতে। তাঁর বয়স তখন ছিল মাত্র ১৯ বছর। সেই প্রথম তিনি দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন। রামকৃষ্ণ ঠাকুর একদিন একান্তে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কি গো, তুমি কি আমায় সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ?’’ শ্রীমা সামান্যতম ইতস্তত না করে ঝটিতে তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘না, আমি তোমাকে সংসার পথে টানতে যাব কেন? তোমার ইষ্ট পথেই সাহায্য করতে এসেছি। আমি তোমার সহধর্মিণী৷’’ সেইদিন এই শব্দটিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন মা সারদা, দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দিরে। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে দেবীর কাছে ভক্তের পরিষ্কার, স্পষ্ট প্রার্থনা রয়েছে - ‘‘ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্তনুসারিণীম্’’। অর্থাৎ, হে দেবী, ‘‘আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী। অর্থাৎ অনুকূল আচরণকারিণী মনোরমা ভার্যা দাও।’’ এই ‘ভার্যা’ শব্দটির আবার দ্বিবিধ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ‘ভরণীয়া’ অর্থাৎ ‘ভার্যা’, অথবা ‘ভক্তি’। পরিবার, সংসার, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তার বিষয় ছিল। এটি আমাদের ধর্মেরও বিষয়। সব মহাপুরুষই এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ‘বেদ’, ‘উপনিষদ’, ‘পুরাণ’ সর্বত্রই এই বিষয়ে নানা কথা পাওয়া যায়। স্বামী-স্ত্রী অদ্ভুত একটি সম্পর্ক। রামকৃষ্ণকে মা সারদা বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমার সহধর্মিণী।’’ সে কি শুধু কথার কথা! না, রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘ও যদি এত ভাল না হত, আত্মহারা হয়ে আমাকে আক্রমণ করত, তাহলে আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসত কি না কে বলতে পারে?’’ তিনি রামকৃষ্ণের ‘সহধর্মিণী’ সারদা দেবী। তাঁর সম্পর্কে একটি বিখ্যাত সংস্কৃত স্তুতিতে বলা হয়েছে, ‘‘রামকৃষ্ণ গতপ্রাণাং তন্নামশ্রবণপ্রিয়াম্ তদ্ভাবরঞ্জিতাকারাম্।’’ অর্থাৎ, তিনি রামকৃষ্ণ-গতপ্রাণ, রামকৃষ্ণের নাম তাঁর পরম ভালোবাসার, তিনি রামকৃষ্ণ ভাবের বিগ্রহ, রামকৃষ্ণের ভাব ও আদর্শ তাঁর মধ্যে শরীর ধারণ করেছে। এই বর্ণনাগুলির কোনওটিই অতিশয়োক্তি নয়, বরং একেবারেই যথাযথ বর্ণনা। ‘মহাকবি কালিদাস’ তাঁর বিখ্যাত ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের সূচনায় ‘জগৎজননী পার্বতী’ ও ‘জগৎপিতা মহাদেবের’ বন্দনা করেছিলেন। সেই বন্দনা করতে গিয়ে ‘কালিদাস’ একটি অপূর্ব উপমা ব্যবহার করেছিলেন। ‘কালিদাস’ বলেছিলেন, ‘‘বাগাথৌ ইব সংপৃক্রৌ৷’’ অর্থাৎ, বাক্য এবং বাক্যের অর্থ যেমন একের সঙ্গে অন্যে অচ্ছেদ্যভাবে সংপৃক্ত বা সংযুক্ত, পার্বতী ও মহাদেবও তেমনি একে অন্যের সঙ্গে অভিন্ন। রামকৃষ্ণ ও সারদা ছিলেন তেমনি একে অন্যের সঙ্গে একাঙ্গ। বাক্য এবং বাক্যের অন্তর্গত অর্থ যদি পরস্পরের সম্পূরক না হয়, তাহলে বাক্য এবং তার অর্থ কখনও সার্থক হতে পারে না। রামকৃষ্ণ এবং সারদা এমনভাবেই একে অন্যের সম্পূরক ছিলেন ও আছেন। একজন ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ। শাস্ত্র বলছে, স্বামী ও স্ত্রীর এই সম্পূরণ ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা। হিন্দুশাস্ত্র বলছে, চৈতন্যপুরুষ এবং চিন্ময়ী প্রকৃতির মিলনেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিকাশ। এই বিকাশে উভয়েরই সমান ভূমিকা, সমান গুরুত্ব। সাধকেরা বলেছেন, শক্তিই ‘শবত্ব’ থেকে শিবের ‘শিবত্বে’ উত্তরণ ঘটান। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ বলেছিলেন, ‘‘ও (সারদা) যদি অমন না হতো তাহলে রামকৃষ্ণ ‘রামকৃষ্ণ’ হতে পারত না।’’ আর ‘সারদা’ বলেছিলেন, ‘‘আমি কেউ নই, সব তিনি (রামকৃষ্ণ)। আমি তাঁর দাসী। তিনি দয়া করে পায়ে স্থান দিয়েছিলেন তাই জীবন ধন্য হয়ে গেছে।’’ দাম্পত্যজীবন তখনই সার্থক যখন স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের প্রতি এমনভাবে সম্পর্কিত হন। অষ্টাদশী সারদা যখন তাঁর পিতার সঙ্গে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসছিলেন তাঁর স্বামীর কাছে, তখন তিনি পথে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জ্বরের ঘোরে তিনি ‘তারকেশ্বরের’ কাছে একটি চটিতে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, তাঁর আশা বুঝি আর পূর্ণ হল না, অসুস্থতার জন্য তাঁর বাবা হয়তো মাঝ রাস্তা থেকেই আবার তাঁকে জয়রামবাটি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। এমন সময় তাঁর একটি দর্শন হয়েছিল। সেটাকে স্বপ্নও বলা চলে। সারদা দেখেছিলেন, তাঁরই বয়সি একটি মিষ্টি কালো মেয়ে, মাথায় এক ঢাল কালো চুল, চোখ-মুখ যেন প্রতিমার চোখ-মুখ, তাঁর মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সেই কোমল করস্পর্শে সারদার যেন জ্বরের সব জ্বালা দূর হয়ে গিয়েছিল। সারদা জ্বরের ঘোরেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কে গা তুমি?’’ মেয়েটি বলেছিল, ‘‘আমি তোমার বোন হই।’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘তা, তুমি কোত্থেকে আসছ?’’ মেয়েটি কোমল স্বরে তাঁকে বলেছিল, ‘‘দক্ষিণেশ্বর থেকে।’’ সারদা বলেছিলেন, ‘‘দক্ষিণেশ্বর থেকে? আহা! আমি ভেবেছিলুম দক্ষিণেশ্বরে যাব, তাঁর কাছে যাব, তাঁর সেবা করব। কিন্তু তা বুঝি আর হল না। এত জ্বর আমার, বাবা বোধহয় আমাকে আবার দেশেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।’’ সারদার দুর্বল কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়েছিল। মেয়েটি তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, ‘‘চিন্তা করো না, তুমি ভালো হয়ে যাবে। আর তুমি দক্ষিণেশ্বরে যাবে বইকি! তোমার জন্যই তো আমি তাঁকে সেখানে আটকে রেখেছি।’’ এরপরে সারদা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে দেখা গিয়েছিল যে তাঁর জ্বর ছেড়ে গিয়েছে। পিতার সঙ্গে সারদা স্বামী সকাশে দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল - দক্ষিণেশ্বর থেকে আসা ওই কালো মেয়েটি আসলে কে ছিলেন? ভক্তের বিশ্বাস, তিনি ছিলেন স্বয়ং মা ভবতারিণী। কিন্তু একটি অসাধারণ কথা তিনি সারদা দেবীকে বলে গিয়েছিলেন - ‘‘তুমি সেখানে অবশ্যই যাবে। তোমার জন্যই তো তাঁকে সেখানে আটকে রেখেছি।’’ অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ ইতিমধ্যে জগজ্জননীর দর্শন পেলেও, তন্ত্র ও বেদান্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেও তাঁর আসল লীলা তখনও সম্পূর্ণ হতে বাকি ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সহধর্মিণী সারদা তাঁর লীলাক্ষেত্রে এসে না পৌঁছচ্ছেন! সহধর্মিণী ভিন্ন অবতারবরিষ্ঠের সাধনা ও ব্রত অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তা সম্পূর্ণ করার জন্য যেন মা ভবতারিণী স্বয়ং সারদাকে পতিসন্নিধানে নিতে এসেছিলেন এবং যতক্ষণ তা না হয়েছিল ততক্ষণ পর্যন্ত রামকৃষ্ণকে তিনি ‘আটকে’ রেখেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মহাব্রতের পূর্ণাহুতি স্থগিত রেখেছিলেন। সারদা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, এতটাই অনিবার্য ছিলেন রামকৃষ্ণের ‘মিশন’-কে সম্পূর্ণ করার জন্য! এরপরেই শুরু হয়েছিল রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদার ক্রমবিকাশ। আগেই বলা হয়েছে যে, অষ্টাদশী সারদা তাঁর স্বামী রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘‘না, আমি তোমাকে সংসারপথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথেই আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।’’ এখানে - ‘‘ইষ্টপথে সাহায্য’’ - অসাধারণ নিষ্কম্প এক উত্তর। আধুনিক যুগে আবার বুঝি ‘যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী’র সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল৷ ‘সাহায্য’ কে, কাকে করতে পারে? যে সাহায্য করবে তাঁকে অবশ্যই সাহায্য যাঁকে করা হবে তাঁর চেয়ে বেশি সামর্থ্যসম্পন্ন হতে হবে, অন্ততঃ তাঁর সমকক্ষ হতে হবে! শ্রীরামকৃষ্ণ তো ইতিপূর্বেই দক্ষিণেশ্বরের বিচারসভায় সাধক ও পণ্ডিতবর্গের বিচারে ‘ভগবান’ বা ‘ভগবানের অবতার’ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। সাধনার সর্বোচ্চ সিদ্ধি তাঁর করায়ত্ত হয়েছিল। অথচ ‘সাধন-অনভিজ্ঞ’ এক অষ্টাদশী কী করে বলেছিলেন যে তিনি তাঁকে তাঁর ‘ইষ্টপথে’ সাহায্য করবেন! স্বামী অপেক্ষা তিনি অধিকতর সামর্থ্যের অধিকারী কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও, তিনি যে তাঁর সমকক্ষ সে বিষয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ তিনি রাখেননি। এই ঘটনার উপরদিয়ে আরেকটি ঘটনাও গিয়েছিল। সেখানে, অষ্টাদশী পত্নীকে স্বামী ষোড়শীরূপে পূজা করেছিলেন, তাঁর চরণে তাঁর সর্বসিদ্ধির ফল ও জপমালা সমর্পণ করেছিলেন, তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন। স্বামীর সেই পূজা, চরণে সাধনফল ও জপমালা সমর্পণ এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত তিনি নির্বিকারভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এমন ঘটনা কেউ কি কখনও আগে শুনেছিল? সহধর্মিণীকে এত বড় সম্মান ও মর্যাদা কোনও স্বামী কি কখনও এর আগে দিয়েছিলেন? শোনা যায় ষোড়শী পূজার সময়, সারদা ও রামকৃষ্ণ উভয়েই সমাধিস্থ ছিলেন। দু’জনেরই তখন ভাবরাজ্যে অবস্থান করছিলেন। পূজা শেষ হলে রামকৃষ্ণের ইঙ্গিতে সারদা চলে গিয়েছিলেন নবহতে। তখন পর্যন্ত সকলেই জানতেন যে, সারদা সেই সময় কোনও কথা বলেননি। কিন্তু পরে রামকৃষ্ণশিষ্য ‘স্বামী অভেদানন্দ’র সূত্রে একটি অজানিত ঘটনা জানা গিয়েছিল। ‘স্বামী অভেদানন্দ’র প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, রামকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সারদা সেদিন একটি আশীর্বাদবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন - ‘‘তুমি দেবতা হও, দেবতার চেয়েও যদি কিছু বড় থাকে তুমি তাই হও।’’ বস্তুতঃ, সারদা যা চেয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ সেটাই হয়েছিলেন, আর রামকৃষ্ণ কী চেয়েছিলেন? তিনি চেয়েছিলেন সারদার ‘দেবীত্বে’ উত্তরণ, নিখিল ‘মাতৃত্বে’ উত্তরণ। সারদাও তাই হয়েছিলেন। সেই পূজার মূলকথা ছিল – রামকৃষ্ণের চাওয়া আর সারদার হওয়া এবং সারদার চাওয়া আর রামকৃষ্ণের হওয়া। অবতারের ঐতিহ্যে ‘সীতা’, ‘রুক্মিণী’, ‘যশোধরা’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ এই চার মহান সহধর্মিণীর কথা সকলেই জানেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই তাঁদের মহান স্বামীদের ইষ্টপথে সাহায্য করতে দেখা যায়নি। কিন্তু সারদা কী করেছিলেন - ইতিহাস সেটার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তাঁদের উভয়ের জীবন-ইতিহাসে আছে যে, তাঁরা উভয়ে উভয়কে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচনও করেছিলেন। ইতিহাসে সেটা নতুন কিছু নয়। নতুন যেটা ছিল, সেটা হল যে, সারদার তখন ‘বিবাহ’ সম্পর্কে কোনও ধারণাই গড়ে ওঠেনি! দু’বছরের বালিকা তাঁর চেয়ে বয়সে আঠারো বছরের বড় এক তরুণকে আরও অনেকের মধ্যে আলাদা করে অভ্রান্তভাবে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন যে তাঁকেই তিনি বিয়ে করবেন। বুদ্ধিতে এর উত্তর পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, আগের ঘটনার বেশ পরে, ‘গদাধরের’ জন্য পাত্রী খুঁজে হয়রান মা ‘চন্দ্রমণি’ ও দাদা ‘রামেশ্বর’কে বিবাহ সম্পর্কে উদাসীন চব্বিশ বছরের এক যুবক ছয় বছরের এক কন্যার হদিশ দিয়ে জানিয়েছিলেন যে - ওই মেয়েটি তাঁর জন্য ‘কুটোবাঁধা’ হয়ে রয়েছে! বোধহয় একেই বলে ‘দৈববিধান’। ‘কুটোবাঁধা’ অর্থাৎ বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করে রাখা। আজও বাংলার গ্রামে, গাছের ফল বা বাগানের সবজি যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, তখন বাড়ির লোকেরা সেটিকে খড় দিয়ে বেঁধে দেন এটি বোঝাতে যে, সেটি আগে দেবতার ভোগে অর্পিত হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জননী ও অগ্রজকে বলেছিলেন যে অন্যত্র তাঁর জন্য পাত্রী খোঁজা অবান্তর। কারণ, ওই বালিকার সঙ্গেই তাঁর বিবাহ পূর্বনির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। একে অন্যকে এভাবে দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী নির্বাচন করা, পুরাণকথার বা উপন্যাস বা কাব্য বা নাটকের উপজীব্য। কিন্তু বাস্তবে কি কখনও এভাবে হতে শোনা গিয়েছিল? সারদা ক্রমে বুঝছিলেন যে, তাঁর স্বামী আর পাঁচজন স্বামীর মতো নন, তিনি ‘যুগগুরু’, ‘যুগাবতার’ এবং জগতে নতুন এক ভাবান্দোলনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠিতা। একসময় তাঁকেও সেই গুরুদায়িত্ব নিতে হবে, নিতে হবে ‘যুগজননী’র ভূমিকা এবং ‘সংঘজননী’র স্থান। তাই এক স্খলিত নারীর স্পর্শদুষ্ট অন্ন যখন শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রহণ করতে অসম্মত হয়েছিলেন, তখন সকাতরে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন - ‘‘তুমি তো শুধু আমার একলার ঠাকুর নয়, তুমি যে সকলের ঠাকুর।’’ শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, অমন অশুদ্ধ মানুষের স্পর্শদুষ্ট অন্ন - সারদা যেন তাঁকে আর কখনও না দেন, কারণ সেই অন্ন গ্রহণ করলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। স্বামীগতপ্রাণা সারদা তখন করজোড়ে তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন - ‘‘তা তো আমি পারব না, ঠাকুর। আমাকে ‘মা’ বলে কেউ কিছু চাইলে আমি তো তাঁকে ফেরাতে পারব না।’’ শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কথায় খুশি হয়ে ওই অন্নই গ্রহণ করেছিলেন। সারদা জানতেন যে, রামকৃষ্ণ তাঁর ছেলেদের ভবিষ্যতে সন্ন্যাসের জন্য গড়ে তুলছেন। তাঁদের আহার-বিহার সব ব্যাপারে তাই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ছেলেরা রাত্রে কে কয়টা রুটি খাবে, কতটা ভাত খাবে, সব রামকৃষ্ণ নিজে স্থির করে দিয়েছিলেন, সারদাকে তা তিনি জানিয়েও দিয়েছিলেন। ‘মা’ সারদা কিন্তু যথারীতি সেটার অন্যথা করতেন। একদিন এই বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে সতর্ক করলে, সারদা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলেদের খাওয়ার ব্যাপারটি আমি দেখব। ওসব নিয়ে তুমি কোনও কথা বলবে না।’’ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘এরকম করলে ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।’’ সারদা আবার নিষ্কম্পকণ্ঠে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তা আমি দেখব।’’ ‘সকলের মা’ ও ‘সংঘজননী’র পূর্বাভাষ সারদার উত্তরে পেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসন্ন হয়েছিলেন। কারণ তিনিও তো তাই চাইছিলেন। তিরোধানের আগে নিজেকে দেখিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন - ‘‘এ আর কি করেছে? তোমাকে এর অনেক বেশি করতে হবে৷’’ তিনি আরও বলেছিলেন - ‘‘শুধু কি আমারই দায়? তোমারও দায়।’’ পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীমা বলেছিলেন - ‘‘যখন ঠাকুর চলে গেলেন, আমারও ইচ্ছা হলো চলে যাই। তিনি দেখা দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি থাক। অনেক কাজ বাকি আছে।’ ...’’ ইতিহাস আজও বলে, সহধর্মিণীরূপে তিনি কী করেছিলেন। ‘রামকৃষ্ণলীলা’ রামকৃষ্ণ-সহধর্মিণী সারদা ছাড়া সম্পূর্ণ হত না।

                                    ©️রানা©️

রামকৃষ্ণ বলেছিলেন - লজ্জা-মান-ভয় তিন থাকতে নয়, আর শ্রীশ্রীমা জানিয়েছিলেন - লজ্জা-মান-ভয় তিন থাকলে হয়। দু’জনেই ধর্মপথিকের উদ্দেশ্যে তাঁদের বার্তাদুটি দিয়েছিলেন। তবে যাঁরা ধর্মপথকে তোয়াক্কা করেন না, লজ্জা মান ভয়ের মুখোমুখি তাঁদেরও কখনও কখনও হতে হয় বইকি। সময়ের উপহার হয়ে সামনে আসা এই লজ্জা ভয়ের কথা রামকৃষ্ণ ও সারদা দেবী কেউই বলেননি, তাঁরা বলেছিলেন তিনটি বৃত্তির কথা। যে বৃত্তির সদ্ব্যবহার করতে পারলে সময় কাউকে লজ্জা দেবে না। মান সম্মান খোয়ানোর ভয়ও থাকবে না। উপরন্তু লজ্জা মান ভয়ের হাত ধরে ধর্মের দুর্গম পথে পাড়ি দিলে পদস্খলনের শঙ্কা থাকে না, আর শেষ পর্যন্ত অদ্বৈতভূমির স্পর্শে প্রিয়তম প্রাণে ওই তিনটি বৃত্তি-ই একীভূত হয়ে যায়। এটা হল শেষ কথা। ধর্মপথে পদস্থাপনের শুরুটা কেমন হবে? সে কথাই বলেছিলেন সারদা দেবী। তিনি লজ্জা, মান ও ভয় থাকা ভালো বলে মনে করতেন - এটা যদি মেনে নেওয়া যায় তাহলে তাঁকে কি আর ‘আধুনিকা’ শব্দবন্ধে আনা যাবে? ‘আধুনিক’ শব্দের অর্থ ‘অধুনাভব’, ‘ইদানীন্তন’, ‘অধুনাতন’ ও ‘সাম্প্রতিক’। ‘অর্বাচীন’ ও ‘নব্য’ অর্থেও শব্দটির ব্যবহার হয়। এখনকার লজ্জা মান ভয়ের যে বোধ ও ব্যবহার সাধারণ জনজীবনে দেখতে পাওয়া যায়, সেটার ছিটেফোঁটাও সারদা দেবীর ধারে পাশে খুঁজে পাওয়া কখনও সম্ভব নয়। পোশাক-আশাক, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস রুচির গতিপ্রকৃতি এখন যা, সারদা দেবী তো তার ঠিক বিপরীতই ছিলেন। সারদা দেবী ছিলেন, রামকৃষ্ণের শক্তি। রামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। ঠাকুরও চিরকাল মাকে সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন। ‘ফলহারিণী কালীপুজো’র দিন সারদা দেবীকে যে তিনি জগজ্জননী রূপে পুজো করেছিলেন - এখনকার নারীবাদী, যুক্তবাদী, আধুনিক সুধীজন, নিজের স্ত্রীর প্রতি এই মর্যাদা প্রদানটি আস্বাদনই করতে কুণ্ঠিত হবেন, প্রদানসামর্থ্য অর্জনের তো প্রশ্নই ওঠে না। যদি তিনি অধুনাতন নারী হতেন তাহলে স্বামীর চাওয়াকে মর্যাদা দেওয়ার উচ্চতা তাঁর কাছে কতটা সম্মানিত হত তা বলা মুশকিল, কারণ আধুনিক মানুষ নিজের চাওয়ার প্রতি নিশ্ছিদ্র একাগ্র। নিজের প্রতি আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা! অপরের কান্নাহাসি-গোপন কথা শোনার জন্য আমাদের তো আর হৃদয় গহন দ্বারে কান পাতা নেই। কিন্তু সারদা দেবীর সেটাই ছিল, তাই তিনি আর্ত-পীড়িত-অবহেলিতের ‘মা’ হতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন বরাভয়দায়িনী, একজন যথার্থ জননী। রামকৃষ্ণ পরমহংস তাই অপ্রকট হবার আগে একটা গুরুদায়িত্ব সারদা দেবীর ওপরে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন – ‘‘কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিবিল্ করছে। তুমি তাঁদের দেখো।’’ এরপরে সারদা দেবী তিনটি শক্তি অভিমুখে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন - ‘মাতৃশক্তি’, ‘জ্ঞানশক্তি’ ও ‘গুরুশক্তি’। তিনি যে জ্ঞানস্বরূপিণী, স্বয়ং রামকৃষ্ণ সেটা স্পষ্ট ভাষায় ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন - ‘‘ও সারদা সরস্বতী জ্ঞান দিতে এসেছে।’’ জ্ঞান বা লোকশিক্ষা তো বক্তৃতা দিয়ে হয় না, তাঁর জন্য প্রয়োজন হয় একটি শুদ্ধ ও সিদ্ধ জীবন। যে শিক্ষা তিনি মানুষকে দেবেন, প্রথমে সেই তত্ত্বটি তিনি নিজের দিব্য জীবনে অনুবর্তন করেছিলেন। সেই সূত্রে সারদা দেবীর জীবন ও বাণী - উভয় অবলম্বনেই পথের আলো খুঁজে পাওয়া যায়। আজ আমরা অর্থ উপার্জনের নিরিখে নিজের সন্তান কতটা মানুষ হয়েছে সেটার মূল্যায়ণ করি। সংসারে অর্থ সংগ্রহের জন্য, অধিকাংশ সংসারের - কর্তা ও গিন্নি - দু’জনেই সকাল সকাল পথে বেরিয়ে পড়েন। আধুনিক যুগের মানুষ নানা উপকরণের মধ্যে আনন্দ হাতড়ে বেড়ায়, কিন্তু তাঁদের হাতে আসে বড়জোর আরাম! যা কিছুক্ষণ বা কিছুকাল পরেই আবার পুরনো হয়ে যায়! তবুও আধুনিক জীবন তো উপকরণের জন্য বলিপ্রদত্ত হয়ে আছে। এই প্রবৃত্তির ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ছিলেন মা সারদা। সীতা বনবাসের সময় রামচন্দ্রের সাথেই ছিলেন, তিনি কিন্তু স্বামীর সঙ্গেই আহার করতেন। কিন্তু সারদা দেবী তো দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নহবতের ছোট্ট কক্ষে নিয়মিত নুন-ভাতও পাননি। একটা সময় তাঁকে স্রেফ শাক-ভাত খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছিল। ছেঁড়া কাপড় সেলাই করেও তাঁকে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনও রামকৃষ্ণের কাছে জাগতিক অপ্রাপ্তির অসন্তোষ ব্যক্ত করেননি, কারণ সেটা তাঁর অনুভবেই ছিল না। আধুনিক সমাজ তো অপ্রাপ্তি অনুভবেই কষ্ট পাচ্ছে। সারদা দেবীকে আমরা তাই আজকের মতো মনে করি না। রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন - ‘‘কারও কাছে চিতহাত করো না। তুমি কামারপুকুরে থাকবে। শাক বুনবে - শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।’’ অর্থাৎ মর্যাদা নষ্ট করে ভালো থাকার চেষ্টা করবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আজ তো সারদা দেবীর যুগ নেই, গৃহস্থের নিত্যপ্রয়োজনীয় সমিধ সংগ্রহেই কাল অতিবাহিত হয়ে যায়। কথাটা ঠিক, তবু মনে হয় পুরো সময় যদি না থাকে, তবু যা আছে তারই বা সদ্ব্যবহার হবে না কেন? নইলে যে আমাদেরই ভালো থাকাটা আর হবে না। আয়ুর বিনিময়ে কিছু জিনিস হয়তো জোগাড় করা যাবে, কিন্তু ভালো থাকা, আনন্দ তো আর জোগাড় করা যাবে না। বাজারে কিনতেও পাওয়া যাবে না। আনন্দ কারও কাছে কিছু বেশি থাকলেও সেটা অন্য কাউকে দিতে পারা যায় না! তাই শুধু ভালো থাকব বলে মাকে ভালোবেসে তাঁর আদর্শের যদি ছায়াটুকুও কেউ স্পর্শ করতে পারেন, তাহলেই তাঁর ইদানীন্তন কালটি কৃতার্থ হতে পারে। শুধু এই সূত্রে মা সারদা দেবী একালের জন্য উপযোগী। তাই তিনি আধুনিক – এমনটা কেউ মনে করেন না, বরং বিশ্বাস করেন যে সাম্প্রতিক সময়কে হতে হবে মায়ের অনুগামী! ‘সচ্চিদানন্দরূপিণী’ মা সারদা আসলে সনাতনী। নিত্য নতুন। সকল সময়ে তিনি প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তা, উপদেশ ও আচরণও চিরন্তন - এখানেই তিনি ইদানীন্তন। সাম্প্রতিক। মায়ের সার শিক্ষা হল ‘ত্যাগ’। দুঃখ তো কেউ চান না, সেটা আপনিই আসে। আর সুখের জন্য মানুষ হাঁসফাঁস করে! এই সুখের আরেক নাম দুঃখ! তাই সুখকে উপেক্ষা করা, আকাঙ্ক্ষা না করার মধ্য দিয়েই মানুষের প্রাপ্তি হয় আনন্দের চাবিকাঠি, যার জন্য জন্ম জন্মান্তর হাপিত্যেশ করে ছোটাছুটি করে মানুষ। আসলে সুখ দুঃখকে অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করতে জানেন না, মা সেই ব্যবহারটি হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন, তাই তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। আরও প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, তিনি ভাবনায়, সমাজসংস্কার কর্মে তাঁর কালের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। সারদা দেবী হলেন ‘কালাতীতা’, তিনি সমকালে সমাজের কথা মন ও কাজের মালিন্য মোচন করেছিলেন। তাঁর সেই মঙ্গল করটি আজও মানুষের মলিন মর্ম মুছিয়ে দেবার জন্য ‘বরদা’ হয়ে রয়েছে। কুঠিবাড়ির পশ্চিম দিকেই দোতলা নহবত বাড়ি। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মা ‘চন্দ্রমণিদেবী’ ঠাকুরের দাদার মেয়ে ‘লক্ষ্মী’কে নিয়ে সেই নহবতের দোতলার একটি ঘরে থাকতেন। আর সারদা দেবীর ছিল বাস নহবতের নীচের তলার একটি ঘরে। ঘরখানির গঠন ‘অষ্টভুজাকৃতি’ বা ‘আটকোনা’। মেঝের সাকুল্যে পরিসর বেশি হলে পাঁচ ফুট। ওইটুকু জায়গার মধ্যে মা সারদার থাকা, খাওয়া, শোয়া করতেন; সেখানেই চাল, ডাল, তেল, নুন, রান্না-বান্নার হাঁড়ি-কলসি, বাসন-কোসন, খাবার জলের জালা থাকত। তাঁর মাথার উপর শিকেয় ঝুলত ঠাকুরের জন্য নানা ওষুধ-পথ্য, এমনকি মাটির হাঁড়িতে জিয়নো মাছ। ওখানে রান্নার জায়গা আর ছিল না। তাই তিনি রান্না করতেন সিঁড়ির নীচে। অতএব সেজন্য বার বার তাঁকে ঘরবার করতে হত। আর সেই ঘরের দরজাটা এত নীচু যে তাতে তাঁর মাথা ঠুকে যেত। সারদা দেবীর কপালে সেই দরজার কাঠ ঠুকে ক্ষতও হয়েছিল। এর মধ্যে আবার তাঁর ‘ভাসুরঝি’ ‘লক্ষ্মীদেবী’ও দোতলা ছেড়ে সেখানে এসে শুতে শুরু করেছিলেন। শুধু কি তাই? দক্ষিণেশ্বরে আসা ঠাকুরের মহিলা ভক্তদেরও বসার ঘর ছিল সেটি, এমনকী ধর্মালোচনার আসরে রাত হয়ে গেলে মহিলাদের রাত্রিবাসের জন্য সেখানেই পাঠিয়ে দিতেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর। তাঁদের অনেককে ফের রান্না করে খাওয়াতে হত সারদাদেবীকে। তার মধ্যে আবার কোনও বিধবা থাকলে এবং যা থাকতই, তাঁর বা তাঁদের জন্য নতুন করে হাঁড়ি-বাসন মেজে রান্না করে খাওয়াতে হত তাঁকে - সে যত বেলা বা রাত হোক না কেন। তাতে অনেক সময় তাঁর নিজেরই আর খাওয়া হত না এবং অতিথিদের শোওয়ার জায়গা দিয়ে তাঁকে নিজে সারা রাত বসে থাকতে হত। ‘নটীর মা’, ‘মেয়ে যোগেন’, ‘গোলাপ’, যিনিই সেই সময় তাঁকে দেখেছিলেন, তিনিই বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘মা, এইটুকু ঘরে কী করে থাক?’’ পরে মা নিজেই গল্প করতেন - ‘‘ঘর তো দেখেছ, ওপরে সব শিকে ঝুলছে, গেরস্ত ঘরে মানুষের যা যা দরকার - মশলা-টসলা সব, এমনকী ঠাকুরের জন্য মাছ পর্যন্ত জিয়নো আছে। সিধে হয়ে দাঁড়াবার উপায় ছিল না, দাঁড়াতে গেলেই মাথায় লাগত - মাথাটা আমার লেগে লেগে ফুলে গিয়েছিল। মেঝেয় আবার চাল, ডাল, হাঁড়িকুড়ি, শিল-নোড়া, চাকি-বেলুন, ঊনুন সবই আছে। বাকি কতটুকুই বা জায়গা থাকে! তাতেই উঠতুম, বসতুম। আবার কোনও মেয়েকে ঠাকুর যদি বলতেন থাকতে, সেও আমার সঙ্গে সেইটুকুর ভেতর শুতো, হয়তো তাঁকে শুইয়ে আমায় বসে রাত কাটাতে হয়েছে।’’ ওই ঘরটিকে রামকৃষ্ণ ঠাকর নিজেই বলতেন ‘খাঁচা’। মা নিজেই বলেছিলেন, ‘‘তখন কী দিনই গেছে। দিনান্তে হয়তো একবার ঝাউতলায় যেতে ঠাকুরকে দেখতে পেতুম, নয়তো নয়। তাও দূর থেকে। তাতেই সন্তুষ্ট থাকতুম। কখনও কখনও দু’মাসেও হয়তো একদিন ঠাকুরের দেখা পেতুম না। মনকে বলতুম, মন, তুই এমন কী ভাগ্য করেছিস যে রোজ রোজ তাঁর দেখা পাবি।’’ সেই নহবতের দরমা ঘরে একচিলতে বারান্দায় যে বাঁশের চেটাইয়ের আড়াল ছিল, তাতে ফুটো করে শ্রীরামকৃষ্ণকে যদি মুহূর্তের জন্যও দেখা যায় সেই আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সারদা দেবী। ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর পায়ে ‘বাত’ ধরে গিয়েছিল। সেই ‘বাতযন্ত্রণা’ সারাজীবন তাঁকে বহন করতে হয়েছিল। পুরনো সেই সব দিনের কথা বলতে গিয়ে সারদা দেবী পরে বলতেন - ‘‘ঠাকুর কীর্তন করতেন, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা নহবতের ঝাপড়ীর ভিতর দিয়ে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতুম, হাতজোড় করে পেন্নাম করতুম। ... দিনরাত লোক আসছে আর ভগবানের কথা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কীর্তনের আখর শুনতুম। পায়ে বাত ধরে গেল।’’ কীর্তনের আসরে রামকৃষ্ণের মেয়ে-ভক্তরাও বসতেন। তাই দেখে মায়ের মনে হত - ‘‘আমিও যদি ওই ভক্তদের একজন হতুম তো বেশ ঠাকুরের কাছে থাকতে পেতুম, কত কথা শুনতুম।’’ সারদা দেবী সম্পর্কে একজনের প্রশ্নের উত্তরে একবার ‘দক্ষিণেশ্বরের খাজাঞ্চি’ বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, তিনি এখানে আছেন শুনেছি, তবে দেখিনি কখনও।’’ নহবত থেকে বেরনোও কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে। এমনকি তাঁকে প্রাকৃতিক প্রয়োজনও চেপে রাখতে হত। সেই করে করে তাঁর স্থায়ী পেটের অসুখও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর সেসব কষ্টের কথা হয়তো মাঝে মাঝে মনে পড়ত রামকৃষ্ণ ঠাকুরের। তখন তিনি বলতেন, ‘‘বুনোপাখি খাঁচায় রাতদিন থাকলে বেতে যায়।’’ সারদাদেবী বলেছিলেন, ‘‘দুপুরে কালীবাড়ির সকলে যখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করত তখন ঠাকুর পঞ্চবটীর দিকে গিয়ে দেখে আসতেন, কেউ আছে কিনা। যদি দেখতেন কেউ নেই তখন বলতেন, এই সময় যাও কেউ নেই। ... পাঁড়ে গিন্নিদের ওখানে বেড়াতে যেতুম। সমস্ত দিন কথাবার্তা কয়ে, সন্ধ্যার পর যখন আরতি হত, আর সব লোক আরতি-টারতি দেখতে যেত, আমি সেই সময় আসতুম।’’ তাছাড়া সারদা দেবী যেমন শাশুড়ির মতো যত্ন করেছিলেন ‘গোপালের মা’কে, ভক্তি করেছিলেন ‘ভৈরবী ব্রাহ্মণী’কে, সন্তানসম স্নেহ দিয়েছিলেন ‘রাধু’কে - তেমনটি কি এখন কেউ নিজের বলে চিহ্নিত জনের প্রতিও করে উঠতে পারেন? মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যেই তো তাঁর সত্তা ও সময়ের সার্থকতা। তাই আধুনিক তাঁকেই বলা যেতে পারে যাঁর মেধা ‘ভূমা উন্মুখ’। অন্ততপক্ষে যিনি কর্তব্যপরায়ণ, শুভ মূল্যবোধযুক্ত তাঁকেও এ বিষয়ে খানিকটা অগ্রবর্তী বলে মেনে নেওয়া যায়। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন মান আর হুঁসের কথা, সারদা দেবী শিখিয়েছিলেন - যে নামে, যেভাবে আমাকে অপরে চায় কীভাবে আমি সেটাই হয়ে উঠব। তাঁর দিব্যজীবনের দিকে তাকালে জানা যায় যে, সারদা দেবী তাঁর আশ্রিত সন্তানদের মঙ্গলের জন্য সারারাত না ঘুমিয়ে সাধন করতেন। সন্তানদের না করা জপ তিনি নিজে করতেন। প্রয়োজনে শিষ্যের পাগলামিকে তিনি প্রতিরোধ করেছিলেন। শিষ্যের পাপ ঠাকুরের মতোই গ্রহণ করে তিনি অসহ্য যন্ত্রণা পেলেও সন্তানকে কখনও তাঁর হাসিমুখ থেকে বঞ্চিত করেননি। সাধে কি আর ‘স্বামীজি’ বলেছিলেন - ‘‘যাঁর মায়ের ওপর ভক্তি নেই, তাঁকে ধিক্কার দাও।’’ মা কালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন না, কালই তাঁকে অনুসরণ করে চলেছিল, তাই সারদা দেবী হলেন সর্বকালে সমাদৃতা। সব সময়ই তাঁর সময়। এখন বা তখন বলে তাঁকে মাপা যাবে না। রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন অপ্রকট হয়েছিলেন - ‘সত্যস্বরূপিণী’ মা সারদা - ‘‘আমার ঠাকুর নিত্য বিরাজ করছেন’’ - এই উপলব্ধিকে মর্যাদা দিয়ে, নিজের হাতের বালা খোলেননি, সরু পাড় শাড়ি পরেছিলেন। সত্যের সম্মানে সমকালে সমাজে প্রচলিত ধারা অতিক্রম করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। ‘নিবেদিতা’ যখন তাঁর গুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতে এসেছিলেন তখন সহস্র ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে মা সারদা তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। একশো বছর আগে ‘নারীশিক্ষা’র পক্ষে প্রথম যে কণ্ঠস্বরটি শোনা গিয়েছিল সেটি মা সারদার। ‘নিবেদিতার স্কুলে’ তিনি অনেককে লেখাপড়া শেখার জন্য পাঠাতেন, এবং একই সঙ্গে তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে খাদ্যতালিকাও তৈরি করে দিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। এইরকম নানা লীলার সূত্রে মা সারদা কখনও কালকে উপেক্ষা করেননি। বরং অগ্রসর করেছিলেন। ত্যাগ বৈরাগ্যে প্রদীপ্ত তাঁর জীবনদর্শনের মধ্য তিনি বুঝিয়ে গিয়েছিলেন - ত্যাগ মানে দাসত্ব নয়, ত্যাগের সুখ অপরিসীম। ভক্তদের জন্য তাঁর স্নেহের আঁচল আজও পাতাই আছে। কেউ তাঁর পর নয়। এখন মানুষ ‘আমি’ আর ‘আমার’ নিয়ে অস্থির। সারদা দেবী সেই ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে একটি নিরুচ্চার বিপ্লবের প্রতীক। তাঁর অহংশূন্য জীবনবোধ আধুনিক সমাজের সর্বদুঃখহর মহৌষধ। তাঁর প্রসন্ন সত্তার সামনে কোনও অভাব অনটনই কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আবার তিনি ঐশ্বর্যও হজম করে ফেলেছিলেন তাঁর নিরুত্তাপ পরিণত ব্যক্তিত্বে। ‘নলিনীদিদি’ দেখেছিলেন যে মা সারদা ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছেন, আর সারদা দেবী তাঁকে বলেছিলেন - ‘‘সব আমার, ছত্রিশ কোথায়?’’ - এর থেকে আর অধুনাতন বোধ এবং ব্যবহার কোথায় পাওয়া যাবে? মানুষের অতিপ্রাচীন চরিত্রের ক্ষত নিরাময় করার জন্য সারদা দেবী ‘যোগীন মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছিলেন - ‘‘দোষ কারও দেখো না, শেষে চোখ দূষিত হয়ে যাবে।’’ নিজের শান্তির জন্য শান্ত হবার জন্য তাঁর এই শাশ্বত শিক্ষা তাঁর সমকালের মতোই এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। যা কালের পরিধিতে প্রাসঙ্গিক তা-ই তো এখনকার বা অধুনাতন৷ সমস্ত পরিস্থিতিকে সহজ স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারার যে উচ্চতা - সেটাই তো আসল আধুনিকতা। বহতা নদীর মতো এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পিছনের অস্তিত্বকে সামনে এনে বরণ করে নেওয়া - এটাই তো আধুনিকতা। আধুনিকতায় বর্জন নয়, গ্রহণ থাকবে, তবে সেটা মানুষের মতো। সারদা দেবী এটা তাঁর জীবনে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘নহবত’ নামক স্বল্প পরিসরে, ‘শ্যামপুকুরের ভাড়া বাড়ি’তে, ‘কাশীপুরের বাগানে’ এবং শেষ পর্যন্ত ‘জয়রামবাটী’র গ্রাম্য পরিবেশে ফিরে সংসারে বহুজনের জ্বালা-যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সারদা দেবী যখন কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের ধারাটিকে স্বমহিমায় সমৃদ্ধ করেছিলেন, তখনই তাঁর ব্যক্তিত্ব যথার্থ আধুনিক হয়েছিল। তাঁর মতো সময়ের সম্মান আর ক’জন করতে পারেন? তাই মা সারদা আজও যথার্থ আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ প্রতীকরূপে সুধী ও সাধু সমাজে স্বীকৃত।

সারদা দেবীই যে ‘শক্তি’, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই করা চলে না। বিশেষ করে তাঁর ‘জন্মতিথির উৎসবের’ দিকে তাকালে। এটা সেই সময়ের ব্যাপার, যখন ‘ঠাকুর’ দেহ রেখেছিলেন। প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ও। ঠাকুরের অবর্তমানে মাকে ঘিরেই চলছিল ছেলেদের যাবতীয় কাজকর্ম। তাঁদের কাজ, আনন্দ - সবেরই মধ্যমণি তখন ছিলেন ‘সারদা’। ‘দেবী’ আর ‘মাতৃত্ব’ - এই দুই অনায়াসে দুই হাতে বহন করে চলেছিলেন তিনি। ফলে, সেই সময়ে তাঁর ‘জন্মতিথি’ ঘিরেও চলেছিল সাড়ম্বর প্রস্তুতি। তখন নিজের ‘জন্মতিথি’র বেশির ভাগ সময়েই মা থাকতেন নিজের বাপের বাড়ি ‘জয়রামবাটি’তে। ‘জগদ্ধাত্রী পুজো’র কিছু দিন পরেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ও দিকে, ‘স্বপ্নাদেশ’ পেয়ে তাঁর মা ‘শ্যামাসুন্দরী দেবী’ শুরু করেছিলেন ‘জগদ্ধাত্রী আরাধনা’। তাই ওই সময়টা সচরাচর ‘জয়রামবাটি’ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেন না তিনি। সেখানে যখন তাঁর ‘জন্মতিথি’ পালনের তোড়জোর চলত, তখন তাতেও মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনিই। আত্মীয়রা যাতে তাঁর ‘জন্মতিথি’তে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট না হয়, সে দিকে সজাগ নজর রাখতেন মা। আবার, গ্রামবাসীরাও যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি রেখে সাধ্যমতো আয়োজন করতে হত উৎসবের। সামান্য মানুষের সাধ্য কী, এমন ভাবে সব দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করা! যেমন, ‘স্বামী ঈশানানন্দ’র লেখা থেকে জানা যায়, মায়ের ভাই, যাঁকে সবাই ‘কালীমামা’ বলেই চিনতেন, তিনি ছিলেন ‘কলহপরায়ণ’। মায়ের ‘জন্মতিথি’র সব আয়োজনের ভার তিনি নিজেই বহন করতে চাইতেন। একাধিকবার দেখা গিয়েছিল তিনি যাতে কলহ না করেন, সেই দিকে বিশেষ সজাগ থাকতেন মা। সেই জন্য একবার ‘বরদা মহারাজ’কে ছোট করে উৎসব করার ভার দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছিলেন মা স্বয়ং। ‘বরদা মহারাজ’কে ডেকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘দেখ বরদা, এবারে কোতলপুরের হাট কালীকে দিয়েই করাতে হবে, কদিন থেকে এর জন্য সে ঘোরাঘুরি করছে … শেষে চটেমটে একটা কাণ্ড বাধাবে।’’ এটা শুধুই মায়ের তুখোড় বুদ্ধির নিদর্শন নয়, সেই সঙ্গে তাঁর অপার করুণাও নিদর্শন। তিনি ভালই জানতেন, তাঁর ভাইয়ের উৎসবের ‘সর্বময় কর্তা’ হওয়ার বাসনা যতখানি, তার চেয়ে ঢের বেশি ইচ্ছা দিদির ‘জন্মতিথি’টি নিজের উদ্যোগে সুসম্পন্ন করা। বুঝতে পেরে সেই ইচ্ছাও পূরণ করেছিলেন মা। তবে ব্যক্তিগত ভাবে ‘জন্মতিথি’তে বিশেষ আয়োজন করা তেমনভাবে কোনদিনই মনঃপূত ছিল না মায়ের। জানা যায়, ১৯০৭ সালে ‘জয়রামবাটি’তে জন্মদিনে কী হবে জানতে চাইলে মা বলেছিলেন, ‘‘আমি একখানা নতুন কাপড় পরব, ঠাকুরকে একটু মিষ্টান্নাদি করে ভোগ দেওয়া হবে, আমি প্রসাদ পাব। এই আর কি।’’ এই ‘অনাড়ম্বড় মনোভাব’ নিয়েই নিজের জন্মতিথিটি বরাবর কাটিয়ে গিয়েছিলেন মা। মাঝে মাঝে তাঁর আবার ‘নিজের জন্মতিথির কথা’ খেয়ালও থাকত না। সেই প্রসঙ্গও পাওয়া যায় ‘স্বামী নির্লেপানন্দ’র লেখায়। সেবার নিজের ‘জন্মতিথি’তে মা ছিলেন কলকাতায়। গঙ্গাস্নান সেরে, ‘উদ্বোধন কার্যালয়ের’ বাড়িতে ফিরে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন ‘যোগীন-মায়ের’ ব্যস্ততা। মা অবাক হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘এসব কি গো যোগীন?’’ মায়ের দিকে একটু চেয়ে থেকে, গভীর প্রীতির সঙ্গে মার চিবুক স্পর্শ করে ‘যোগীন-মা’ বলেছিলেন, ‘‘আজ যে তোমার জন্মতিথি, মা!’’ ভুবনভোলানো হাসি হেসে মা বলেছিলেন, ‘‘ও মা তাই?’’ এরকমই ছিল তাঁর উদাসীনতা! আর পুজো হয়ে গেলে এক ভক্তের দেওয়া ‘তসরের কাপড়’ আর ‘রুদ্রাক্ষের মালা’ পরে মা বসেছিলেন তাঁর ঘরে খাটের দক্ষিণ দিকে মাটিতে পা রেখে। ভক্তরা একে একে এসে তাঁকে ‘পুষ্পাঞ্জলি’ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা মায়ের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করছিলেন। যা ছিল তাঁর ‘জন্মতিথি’ পালনের দস্তুর। তবে সেটুকুতেই লুকিয়ে ছিল ‘দৈবী মহিমা’। যা মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যেত নিজের ‘জন্মতিথি’তে তাঁর ‘ভাবসমাধি’ হলে। ‘জয়রামবাটি’র ‘যামিনী দেবী’, নিজের স্মৃতিকথায় মায়ের সেই ‘ভাবসমাধির বর্ণনা’ দিয়েছিলেন, ‘‘মা স্নান করিয়া ভক্তদের দেওয়া অনেকগুলি কাপড়ের ভিতর হইতে শরৎ মহারাজের দেওয়া কাপড়খানি বাহির করিয়া পরিলেন। আমি মার কপালে সিঁদূর, চন্দন, গলায় ফুলের মালা ও পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়া প্রণাম করিয়া মুখের দিকে চাইতেই দেখি, তাঁহার আগেকার রূপ যেন নাই, চকিতের মধ্যে এক ভীষণ সুন্দর, অপূর্ব, অপার্থিব রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে রূপের বর্ণনা ভাষায় দিতে পারি না। খানিক পরেই তিনি পূর্বের মত হইয়া গেলেন, আমাকে বলিলেন, এস মা, প্রণাম কর।’’ সন্দেহ কী, ভক্তদের বিশেষ অবলম্বন ছিল মায়ের সেই ‘দৈবীভাব’। মা-ই যেন ছিলেন তাঁদের সব সমস্যার প্রতিকার। তাই এক ‘জন্মতিথি’তে ছেলেরা চেয়েছিলেন, মা আগে খেয়ে নিলে তবেই তাঁরা খাবেন। সাধারণতঃ ছেলেদের আগে খাইয়ে তার পর মা মেয়েদের নিয়ে খেতে বসতেন। সেদিন প্রথম সেই নিয়মের অন্যথা হয়েছিল। কিন্তু, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর ‘মাতৃত্ব’ই! মাকে খেতে ডাকা হলে তিনি যেন যন্ত্রচালিতের মতো আসনে গিয়ে বসেছিলেন, যা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সামনের থালা-বাটিতে, সেগুলো থেকে একটু একটু করে তুলে মুখে দিয়েছিলেন। আর তারপরেই ‘স্বামী সারদেশানন্দ’কে বলেছিলেন, ‘‘ছেলেদের খাওয়ার আগে গলার নিচে যায় না, তাড়াতাড়ি তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা কর।’’ ব্যস! এরপরেই তিনি উঠে পড়েছিলেন খাওয়া ছেড়ে! তদারকি করতে শুরু করেছিলেন ছেলেদের খাওয়ার। জানা যায়, সেদিন না কি আর কিছুই খাননি মা! এমনকি তাঁর শেষ ‘জন্মতিথি’টিতেও দেখা গিয়েছিল সেই ‘মাতৃসত্তা’রই প্রকাশ। সেটা ছিল ১৯১৯ সাল। সেবার মায়ের শরীর ভাল ছিল না। ‘স্বামী পরমেশ্বরানন্দ’ লিখেছিলেন, ‘‘তাঁর শুভ জন্মতিথির দিন উপস্থিত হইলে শ্রীশ্রীমা বেশি ঝঞ্ঝাট করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, ভক্ত ছেলেগুলি যাঁরা আছে আর প্রসন্ন, কালীদের বাড়ির সবাইকে বলিয়া দাও।’’ তাঁর সেই ‘শেষ জন্মতিথির উৎসবে’ও দেখা গিয়েছিল যে, তাঁর মধ্যে সমান ভাবে মিশে ছিল ‘দেবী আর মাতৃত্বের রসায়ন’। সেদিন অল্প তেল মেখে সামান্য গরমজলে গা মুছে, ‘শরৎ মহারাজের’ পাঠানো শাড়ি পরে মা চৌকিতে বসার পরে একে একে সবাই তাঁর পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করতে শুরু করেছিলেন। ‘স্বামী পরমেশ্বরানন্দ’ মাকে একটি ‘গাঁদাফুলের মালা’ পরিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, যে ভক্তরা তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পান না, তিনি যেন তাঁদেরও মঙ্গল করেন। তখনও কেউ জানতেন না, মা অচিরেই চলে যাবেন সকলের চোখের আড়ালে। কেউই আর তাঁর ‘সাক্ষাৎ দর্শন’ পাবেন না। ‘স্বামী সারদেশানন্দ’ লিখেছিলেন, ‘‘সাধুভক্ত সকলেই পূজার আয়োজন, দ্বিপ্রহরে ভোগের জন্য রন্ধন, ভজন-কীর্তন ইত্যাদিতে ব্যস্ত। অদ্য তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া উৎসব চলিতেছে। কিন্তু তাঁহার নিজের দৃষ্টিতে তিনি যেন কিছুই নহেন। তিনি স্বাভাবিক, শান্ত ধীরভাবে মাছ কুটিয়া ঘাটে ধুইয়া আনিলেন, রান্নাঘরের বারান্দায় স্বয়ং ঝোল রান্না করিয়া সেজমামীর বাড়িতে গিয়া দিয়া আসিলেন। এইসব কাজের জন্য তাঁহার সদাপ্রফুল্ল মুখে একটুও বিরক্তির চিহ্ন দেখা গেল না।’’ সে দিন বিকেলবেলাতেই তাঁর জ্বর এসেছিল। জ্বরে সেই যে তিনি শয্যা নিয়েছিলেন, তার পরে আর কোনদিন ওঠেননি। কিন্তু একটি ‘আদর্শের প্রদীপ’ তিনি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সেই আলোতেই আজও পথ চিনে চলছে ‘রামৃষ্ণ মিশন’। কেন না, তিনিই তো ছিলেন ‘পরমহংসের শক্তি’। ছেলেরা তাঁদের জীবনে চলার ভাবটুকুই শুধু ‘ঠাকুরের’ কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাঁদের বাকিটুকু ছিল ‘মায়ের দেওয়া শক্তি’। যার প্রকাশ কখনও হয়েছিল তাঁর ‘দেবীর রূপে’, আর বেশির ভাগ সময়েই ‘মা’ হিসেবে। স্বাভাবিক! মা যেমন করে শিশুকে পথে হাঁটার উপযুক্ত করে তোলেন, তেমনটা কি আর কেউ করতে পারেন?

                                  

(তথ্যসূত্র:

১- বিশ্বরূপিণী মা সারদা, শ্রীমতী শুক্লা ঘোষ।

২- শতরূপে সারদা, পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল।

৩- দিব্যজননী সারদা, স্বামী আত্মবোধানন্দ, রূপকথা।

৪- মমতাময়ী শ্রী শ্রীমা সারদা, অঞ্জনকুমার রায়, বুলবুল প্রকাশন।

৫- সেকালের সারদা মা একালের স্নেহময়ী মা, সুভাষ চন্দ্র সোম, ছায়া পাবলিকেশন।

৬- রামকৃষ্ণ-সারদা: জীবন ও প্রসঙ্গ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।)

                          

No comments