Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ইতিহাসে বাঙালির রথ দেখা ও কলা বেচা’রানা চক্রবর্তী

কালের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে বাঙালির জীবন, আর একই সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে বাঙালির প্রিয় রথযাত্রা উৎসব। অতীতের কলকাতা শহরে রথের যে আনন্দ ও উৎসব দেখা যেতো, আজ আর তা নেই। অথচ কিছু কাল আগেও রথের মেলায় ভেঁপু বাজানো, পাঁপড় ও তে…

 





                                  

কালের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে বাঙালির জীবন, আর একই সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে বাঙালির প্রিয় রথযাত্রা উৎসব। অতীতের কলকাতা শহরে রথের যে আনন্দ ও উৎসব দেখা যেতো, আজ আর তা নেই। অথচ কিছু কাল আগেও রথের মেলায় ভেঁপু বাজানো, পাঁপড় ও তেলেভাজা খাওয়া ও মাটির তৈরি খেলনার রথ কিনে রথটানা - শিশুদের খুব আনন্দ দিত। অন্যান্য আর পাঁচটা পরবের মত রথের সেই আনন্দ আজ ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে, বাঙালির উৎসব পার্বণে খুব একটা সরকারি ছুটি পাওয়া যেত না। বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বণের’ ছুটি দিতে হলে কাজকর্ম যে শিকেয় উঠবে, সেটা সম্ভবতঃ ইংরেজরা বুঝে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার সেই ছোট্ট ছুটির তালিকাতেও রথযাত্রা উৎসব ছিল। এমনকি, আজ থেকে মোটামুটি ষাট-সত্তর বছর আগেও রথযাত্রা (বেসরকারি অফিসে ‘পুনর্যাত্রা’ও) ছুটির দিন বলে গণ্য হত। আজ আর তা হয় না। সেকালের রথযাত্রায় কলকাতায় খুব সমারোহ হ’ত। কলকাতার রথযাত্রা সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন সংবাদ - যেটা এখনও পর্যন্ত গবেষকদের হস্তগত হয়েছে, সেটা হল ‘শোভারাম বসাকের রথ’। ওই রথটা গঙ্গার ধারে যেখানে রাখা হত, তার সামনের ঘাটটা এখনও ‘রথতলা ঘাট’ নামে প্রখ্যাত। কলকাতার ‘হাটখোলা’র ‘মানিকচন্দ্র বসুর রথ’ও খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ১৮৩৪ সালের ২৬শে জুলাই তারিখের ‘চন্দ্রিকা’ পত্রিকা থেকে জানতে পারা যায় যে, ওই সালে ‘শিবনারায়ণ ঘোষ’ একটা রথ নির্মাণ করিয়ে সেটা নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ওই উপলক্ষে কলকাতা ও প্রসিদ্ধ স্থানসমূহের চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকদের নিমন্ত্রণ করে, তাঁদের প্রত্যেককে একটা করে পিতলের ঘড়া ও নগদ আট টাকা করে ‘বিদায়’ দিয়েছিলেন। কোথাও খুব ভিড় হলে এখনও বঙ্গদেশের আগেকার দিনের মানুষেরা বলেন যে, ওখানে ‘রথদোল’ পড়ে গেছে। সেই যুগে কলকাতার রথে এত ভিড় হত যে ১৮৩৪ সালে ‘মাঝের রাস্তা’ দিয়ে রথ নিয়ে যাওয়া পুলিস কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৮৩৮ সাল থেকে কলকাতায় ‘রাণী রাসমণির রূপার রথ’ও ছিল বিখ্যাত রথ। ১৯৭২ সাল থেকে মার্কিন বৈষ্ণবদের রথেও যথেষ্ট সমারোহ শুরু হয়েছিল। কলকাতার ‘পাইকপাড়ার রাজাদের রথ’ও খুব প্রাচীন। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মন্ত্রী ‘বিমল সিংহ’র আমল থেকেই ‘পাইকপাড়ার রাজবাড়ি’ পরিত্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার ঠাকুরদেবতা ও ধর্মানুষ্ঠান পরিত্যক্ত হয়নি। এখনও সেখানে তাঁদের রথযাত্রা অনুষ্ঠান হয় ও তাঁদের বাড়ির সামনে ‘বি. টি. রোডের’ ওপরে মেলা বসে। তবে আগেকার জৌলুস আর নেই, কিন্তু ভিড় যথেষ্ট হয়। রথের একটা প্রধান অঙ্গ হচ্ছে ‘রথের মেলা’। সেজন্য বলা হয় - ‘‘রথ দেখা ও কলা বেচা’’। অতীতে কলকাতার ‘শিয়ালদহের রথের মেলা’ই প্রসিদ্ধ ছিল। সেখানে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে নানারকম গাছের চারা বিক্রি হত - আম কাঁঠালের চারা থেকে লঙ্কা লবঙ্গ, এলাচের চারা পর্যন্ত। কিন্তু সেই মেলার আগেকার গৌরব এখন আর নেই। তাছাড়া, মেলা স্থানচ্যুতও হয়েছে। স্বাধীনতালাভের শর্ত হিসাবে দেশবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত লোকেরা ওই জায়গাটা দখল করে নিয়ে ওই জায়গায় চালাঘর বানিয়ে কাপড়ের দোকান খুলে ফেলেছিলেন। তারপর একদিন কর্তৃপক্ষ সেই চালাঘরগুলো ভেঙে দিয়েছিলেন৷ তা নিয়ে বিস্তর গণ্ডগোলের পরে কর্তৃপক্ষ সেখানে পাকা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পাকা ঘরেই এখন বস্ত্রব্যবসায়ীদের অবস্থান। আর তার আশপাশের ছিটেফোঁটা খালি জমিতে শিয়ালদহের মেলার সহবস্থান৷ কলকাতা ছাড়া বাঙলার অন্যত্রও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ও হ’ত। ‘কাঁঠালপাড়া’য় ‘বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি’তেও রথযাত্রা উৎসব হ’ত। সেই রথযাত্রাকে উপলক্ষ করেই বঙ্কিম তাঁর ‘রাধারাণী’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন। ‘শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ তাঁর ‘বঙ্কিম জীবনী’র তৃতীয় সংস্করণের ৩০১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, ‘‘গৃহবিগ্রহ রাধাবল্লভ জীউর রথযাত্রা প্রতি বৎসর মহাসমারোহে সম্পন্ন হইত। পূজনীয় যাদবচন্দ্র তখন জীবিত। বঙ্কিমচন্দ্র ১২৮২ সালে রথযাত্রার সময় ছুটি লইয়া গৃহে বসিয়াছিলেন৷ রথে বহু লোকের সমাগম হইয়াছিল৷ সেই ভিড়ে একটি ছোট মেয়ে হারাইয়া যায়৷ তাঁহার অনুসন্ধানার্থ বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনার দুই মাস পরে ‘রাধারাণী’ লিখিত হয়। সেটা ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের কথা।’’ ‘হুগলি’র ‘গুপ্তিপাড়া’র ‘বৃন্দাবন মঠের রথ’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি ‘তেরো চূড়া রথ’। সেই রথের ১৬টা চাকা ছিল। এখন ওই রথ ভঙ্গুর হয়ে গেলেও ওই তাবস্থাতেই টানা হয়। সেই রথের মেলায় হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটত। ঊনবিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্রসমূহে ‘হুগলি’র ‘মাহেশের রথযাত্রা’র বিবরণ পাওয়া যায়। খুব সাড়ম্বরে সেই রথযাত্রা হত, এবং কলকাতাবাসী ইংরেজরাও সেটা দেখতে যেতেন। কলকাতার বাঙালি ‘বাবু’রা তো যেতেনই - সেটা ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ বলে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। কলকাতার বাঙালি ‘বাবু’রা সেখানে তাঁদের সঙ্গে ‘বারাঙ্গনা’দেরও নিয়ে যেতেন। ‘মাহেশের রথ’ সম্বন্ধে, ১৮১৯ সালের ১৯শে জুন তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এ লেখা হয়েছিল, ‘‘অনেক অনেক স্থানে রথযাত্রা হইয়া থাকে, কিন্তু তাহার মধ্যে জগন্নাথক্ষেত্রে রথযাত্রাতে যেরূপ সমারোহ ও লোকযাত্রা হয় মোকাম মাহেশের রথযাত্রাতে তাহার বিস্তর ন্যূন নহে। এখানে প্রথম দিনে অনুমান দুই লক্ষ লোক দর্শনার্থে আইসে এবং প্রথম রথ অবধি শেষ রথ পর্যন্ত নয়দিন জগন্নাথদেবের মোকাম বল্লভপুরে রাধাবল্লভ দেবের ঘরে থাকেন। তাহার নাম গুঞ্জবাড়ি। ঐ নয়দিন মাহেশ গ্রামাবধি বল্লভপুর পর্যন্ত নানাপ্রকার দোকানপসার বসে এবং সেখানে বিস্তর বিক্রয় হয়। ইহার বিশেষ কত কি লিখা যাইবেক। এমত রথযাত্রার সমারোহ জগন্নাথক্ষেত্র ব্যতিরিক্ত অন্যত্র কুত্রাপি নাই।’’ তবে অতীতের ‘মাহেশের রথযাত্রা’য় যে কেবলমাত্র দোকান পসার বসত, তা কিন্তু নয়। অনেক জায়গা থেকে অনেক লোক সেখানে গিয়ে ‘জুয়া’ খেলতেন। জুয়ায় লোকে এমন মত্ত হয়ে উঠত যে, হেরে গিয়ে তাঁরা নিজেদের যুবতী স্ত্রীকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে পিছপা হত না। ১২২৬ বঙ্গাব্দের ৬ই আষাঢ় তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এ লিখিত হয়েছিল - ‘‘দুই জন জুয়া খেলাতে আপন যথাসর্বস্ব হারিয়া পরে অন্য উপায় না দেখিয়া আপন যুবতী স্ত্রী বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল এবং তাঁহার মধ্যে একজন খানকীর নিকটে দশ টাকাতে বিক্রয় করিল। অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বিক্রীতা হইতে সম্মত হইল না। তদপ্রযুক্ত ঐ ব্যক্তি খেলার দেনার কারণ কয়েদ হইল।’’ ‘মাহেশের রথ’ এখনও হয়, তবে তাতে আগেকার সেই সমারোহ নেই, যদিও বিপুল সংখ্যক লোক এখনও ‘মাহেশের রথ’ দেখতে যান। ‘মাহেশের’ কাছাকাছি ‘চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জের’ ‘যাদু ঘোষের রথ’ও খুব সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত।                               

রথযাত্রা উৎসবে লোকের এত ভিড় হয় কেন? তার কারণ, ‘‘রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’’। শাস্ত্র অনুসারে, রথের এমন মাহাত্ম্য যে রথে দেব দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। তবে রথ বলতে আমরা ‘আষাঢ় মাসের’ শুরুর ‘দ্বিতীয়া’তে অনুষ্ঠিত ‘জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা’ই বুঝি। কিন্তু রথযাত্রা মাত্রই জগন্নাথের নয়। অন্যান্য দেবতাদেরও রথযাত্রা আছে। কলকাতার লোকেরা তো ‘কার্তিক’ মাসের ‘পূর্ণিমা’য় অনুষ্ঠিত ‘জৈন’দের ‘পরেশনাথের রথযাত্রা’র সঙ্গে পরিচিত আছেনই। ‘জগন্নাথদেবের রথের’ মত এরও ‘পুনর্যাত্রা’ আছে। ‘জৈন’দের এই রথযাত্রা ছাড়া, ‘বৌদ্ধ’দেরও রথযাত্রা ছিল। খ্রীষ্ট্রীয় পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ায়, ‘চৈনিক পরিব্রাজক’ ‘ফা-হিয়েন’ যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন তিনি ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’য় অনুষ্ঠিত ‘বুদ্ধদেবের রথযাত্রা’ দেখেছিলেন। সেজন্য সিংহভাগ গবেষকরা মনে করেন যে, হিন্দুদের রথযাত্রা বৌদ্ধদের অনুকরণে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া আরও যে-সব রথযাত্রা আছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে - ‘পৌষমাসের শুক্লা একাদশী’তে দক্ষিণ ভারতের ‘চিদাম্বরে’ অনুষ্ঠিত ‘নটরাজের রথযাত্রা’, ‘চৈত্রমাসের শুক্লা অষ্টমী’তে অনুষ্ঠিত ‘উড়িষ্যা’র ‘ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা’, ‘শারদীয়া বিজয়া দশমী’তে পশ্চিমবঙ্গের ‘মেদিনীপুর’ জেলার ‘রঘুনাথ বাড়ি’তে অনুষ্ঠিত ‘শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউর রথযাত্রা’। ‘চব্বিশ পরগনার ঘোষপাড়া’য় (কল্যাণীর কাছে) ‘কর্তাভজা’ সম্প্রদায়ের ‘বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত রথযাত্রা’। তবে বঙ্গদেশে রথযাত্রা বলতে ‘জগন্নাথদেবের রথযাত্রা’ই বোঝায়। এটা কবে থেকে শুরু হয়েছিল সেটা বলা কঠিন, তবে ষোড়শ শতাব্দীর ‘স্মার্ত রঘুনন্দনের’ সময়ও এর প্রচলন ছিল। কালের আবর্তনের সঙ্গে রথযাত্রার অঙ্গ হিসাবে সম্পর্কিত রথের মেলার রূপ পালটে গেছে। আগে রথের মেলায় গৃহস্থালীর যাবতীয় দ্রব্যাদি, যেমন - ধামা চুবড়ি, চাল ঝাড়ার জন্য কুলো, চাল ধোয়ার জন্য ধুচুনি, বর্ষার দিনে মাথায় দেবার জন্য টোকা, মাছ ধরার ছিপ ইত্যাদি প্রভূত পরিমাণে বিক্রি হত। এখন রথের মেলায় সেসব জিনিস বিরল। একালের শহুরে মানুষ জগন্নাথের রথযাত্রার সঙ্গে যতটা পরিচিত ‘স্নানযাত্রা’র সঙ্গে ততটা নয়। ‘জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমাতিথি’তে জগন্নাথদেবের স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে যে অনুষ্ঠান, সেটাই ‘স্নানযাত্রা’! অতীতে কলকাতা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে, স্নানযাত্রা উপলক্ষে বড় বড় মেলা বসত। দেবতার পুজোও হতো ঘটা করে। তখন রথের মেলার চেয়ে ‘স্নানযাত্রার মেলা’র আকর্ষণও কিছু কম ছিল না। কিছু কিছু এলাকায় তো রথ উপলক্ষে কোনো উৎসবই হ’ত না - যত ঘটা, জাঁকজমক সবই হ’ত ‘জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমা’য় জগন্নাথের ‘স্নানযাত্রা’ উপলক্ষে৷ মাহেশের রথের মেলার মতন, মাহেশে ‘স্নানযাত্রা’র সমারোহ যে কিছু কম ছিল না সে কথা জানা যায় ১৮১৯ সালের ৫ই জুন (২৪শে জ্যৈষ্ঠ ১২২৬ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণে’র সংবাদ থেকে - ‘‘আগামী মঙ্গলবার ৮ জুন ২৭ জ্যৈষ্ঠ মোং মাহেশে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হইবেক। এই যাত্রা দর্শনার্থে অনেক ২ তামসিক লোক আবালবৃদ্ধবনিতা আসিবেন ইহাতে শ্রীরামপুর ও চাতরা ও বলভপুর ও আকনা ও মাহেশ ও রিসিড়া এই ক-এক গ্রাম লোকেতে পরিপূর্ণ হয় এবং পূর্বদিন রাত্রিতে কলিকাতা ও চুঁচুড়া ও ফরাসডাঙ্গা প্রভৃতি শহর ও তন্নিকটবর্তী গ্রাম হইতে বজরা ও পিনিস ও ভাউলে এবং আর ২ নৌকাতে অনেক ধনবান লোকেরা নানাপ্রকার গান ও বাদ্য ও নাট ও অন্য ২ প্রকার ঐহিক সুখসাধনা সামগ্রীতে বেষ্টিত হইয়া আইসেন পরদিন দুই প্রহরের মধ্যে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হয়। যে স্থানে জগন্নাথের স্নান হয় সেখানে প্রায় তিন চার লক্ষ লোক একত্র দাঁড়াইয়া স্নান দর্শন করে পুরুষোত্তমক্ষেত্র ব্যতিরেকে এই যাত্রার এমন সমারোহ অন্যত্র কোথাও হয় না।’’

‘‘রথ দেখা ও কলা বেচা’’-র মধ্যে, উপরে ‘কলা’ বেচা হল, তাই এবারে ‘রথ’ও, বা রথগুলো দেখে নেওয়া যাক। শাস্ত্রে লিখিত, ‘‘রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।’’ রথের উপরে খর্বাকৃতি বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তার ‘পুনর্জন্ম হয় না। তাই ‘রথরজ্জু’ ধরে রথটানা ‘মহাপুণ্য কর্ম’ বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভারত বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে পালন করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্ভরণের পরবর্তীতে রথে থাকেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা যা খর্বাকৃতি। ভক্তবৃন্দ ভক্তি সহকারে রথরজ্জুর মাধ্যমে রথকে টেনে এগিয়ে নিয়ে যান। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ ও ‘পদ্মপুরাণে’ও এই রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। রথযাত্রার মূলে রয়েছে ‘বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব’। কালের পরিক্রমায় হিন্দু সভ্যতার উত্থানকালে এ রথযাত্রা ‘শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা’ হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ ধামের রথযাত্রা জগদ্বিখ্যাত। ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ বলতে পুরীকেই বোঝায়। জ্যৈষ্ঠে স্নান-যাত্রায় ও আষাঢ়ে রথের সময় বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজিত হন। ‘চৈতন্য মহাপ্রভু’ই মূলত নীলাচলে ‘ভক্তিবাদের প্রবর্তন’ করেছিলেন। তাঁর ‘প্রেম’, ‘ভক্তি’, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ - এসব মূলমন্ত্রই তাঁর জীবন-দর্শন। মহাপ্রভুর জীবন-দর্শন শ্রী জগন্নাথের জীবন-দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাই পুরীকে বলা হয় ‘বৈষ্ণবের ধাম’। ‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় ‘সত্যযুগে’। সে সময় আজকের উড়িষ্যার নাম ছিল ‘মালবদেশ’। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ‘ইন্দ্রদ্যুম্ন’ নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার ‘স্বপ্নাদেশ’ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর ‘জগন্নাথ মন্দির’ নির্মাণ ও ‘রথযাত্রা’র প্রচলন করেন। ‘স্কন্দপুরাণে’ সরাসরিভাবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়। সেখানে ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য’ কথাটি উল্লেখ করে ‘মহর্ষি জৈমিনি’ ‘রথের আকার’, ‘সাজসজ্জা’, ‘পরিমাপ’ ইত্যাদির বর্ণনা দিয়েছেন। ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ বলতে আসলে পুরীকেই বোঝায়। পুরীতেই যেহেতু জগন্নাথ দেবের মন্দির স্থাপিত, তাই এই মন্দিরকে পবিত্রতম স্থান বলে মনে করা হয় এবং এর অন্যতম আকর্ষণ রথযাত্রা। প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার ‘রাজা’। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরা ক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। সেই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনিই পুরীর রাজা। রাজা ‘জগন্নাথ’, ‘বলরাম’ ও ‘সুভদ্রা’দেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে ‘পুষ্পাঞ্জলি’ প্রদান করেন এবং ‘সোনার ঝাড়ু’ ও ‘সুগন্ধী জল’ দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। তিনজনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই রথ তিনটি। তিনটি রথ যাত্রার কিছু ‘নিয়ম’ রয়েছে এবং ‘রথের আকার’, ‘রঙে’ও ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন - প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম ‘তালধ্বজ’। রথটির চৌদ্দটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ ‘নীল’। তারপর যাত্রা করে বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম ‘দর্পদলন’। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় ‘পদ্মচিহ্ন’ আঁকা রয়েছে, তাই রথটিকে ‘পদ্মধ্বজও’ বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ ‘লাল’। সর্বশেষে থাকে শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম ‘নন্দীঘোষ’। পতাকায় ‘কপিরাজ হনুমানের মূর্তি’ আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম ‘কপিধ্বজ’। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। রথটির আবরণের রঙ ‘হলুদ’। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগটি লাল রঙেরই হয়ে থাকে। রথ তিনটি সমুদ্রোপকূলবর্তী জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ‘গুণ্ডিচা’ মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সাতদিন থাকার পর আবার ‘উল্টো রথে’ জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসে। বর্তমানে তিনটি রথ ব্যবহৃত হয়। তবে আজ থেকে আনুমানিক সাতশো বছর পূর্বে রথযাত্রার যাত্রাপথ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আর সেই দুটি ভাগে তিনটি-তিনটি করে মোট ছ’টি রথ ব্যবহৃত হতো। কেননা, সেসময় জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা আসার পথটির মাঝখান দিয়ে বয়ে যেতো এক প্রশস্ত ‘বলাগুণ্ডি নালা’। তাই জগন্নাথ মন্দির থেকে তিনটি রথ বলাগুণ্ডি নালার পার পর্যন্ত এলে পরে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করে অপর পাড়ে অপেক্ষমাণ অন্য তিনটি রথে বসিয়ে ফের যাত্রা শুরু হতো। ১২৮২ খ্ৰীস্টাব্দে, ‘রাজা কেশরী নরসিংহ’ পুরীর রাজ্যভার গ্রহণের পর তাঁর রাজত্বকালের কোনো এক সময়ে এই ‘বলাগুণ্ডি নালা’ বুজিয়ে দেন। সেই থেকে পুরীর রথযাত্রায় তিনটি রথ। অনেক ঐতিহাসিক ও পন্ডিত মনে করেন যে, জগন্নাথদেবের মূর্তি ‘বুদ্ধদেবেরই রূপান্তর’। আবার অনেকে মনে করেন যে, ‘জগন্নাথদেব’ কোনো ‘অনার্য জাতির দেবতা’। বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা ‘বিষ্ণু’ এবং সব শেষে ‘জগন্নাথদেব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ‘স্বামী অভেদানন্দ’ তিব্বতের ‘লাদাখ’ অঞ্চল ভ্রমণকালে ‘বৌধখুর্ব’ নামক গ্রামে ‘ত্রিরত্মের যে মূর্তি’ দেখেছিলেন, সেই মূর্তিগুলোকে তিনি ‘জগন্নাথদেবের মূর্তির প্রতিরূপ’ বলে গণ্য করেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুসারে, ‘‘... লামাদের একটি ত্রিরত্ন বা ‘পরমেশ্বরা’ রহিয়াছে। আমাদের দেশের ইট দিয়ে গাঁথা তুলসী মন্দিরের মতো ইহারা তিনটি ক্ষুদ্র নিরেট মন্দির নির্মাণ করিয়া প্রথমটিতে কালো, দ্বিতীয়টিতে হলদে ও তৃতীয়টিতে সাদা রঙ লাগাইয়া বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক নির্মাণ করিয়া তাহাদের পূজারতি করেন। ইঁহারা এইগুলিকে ‘পরমেশ্বরা’ বলেন। ‘পরমেশ্বরা’ শব্দ ‘পরমেশ্বর’ শব্দের অপভ্রংশ। এইগুলোতে চোখ অাঁকিয়া দিলে প্রথম কালোটিকে হস্তপদহীন জগন্নাথ, দ্বিতীয় হলদেটিকে সুভদ্রা ও তৃতীয় সাদাটিকে বলরাম মনে হয়।’’ উড়িষ্যার অনেক বৈষ্ণব ভক্তকবি জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের মূর্তি বা অবতার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীকৃষ্ণই বুদ্ধরূপে জগন্নাথ নামে অধিষ্ঠিত। জগন্নাথ দাসের ‘দারুব্রহ্ম’ ও অচ্যুতানন্দ দাসের রূপান্তর ‘শূন্য সংহিতা’য় এই তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর দাস ও অচ্যুতানন্দ জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের অবতার এবং শ্রীচৈতন্যদেবকেও বুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন।

তবে ইতিহাসে বাংলায় রথ প্রচলনের আবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট পাওয়া যায়। পুরাবিদদের মতানুযায়ী, পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা থেকে বাংলায়ও রথযাত্রার সূচনা৷ চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলায় নিয়ে আসেন৷ চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। এখন বাংলার বহু জায়গাতেই এই রথযাত্রা অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ বাংলা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ উৎসব হয়ে থাকে। এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে ‘গুন্ডিচা মন্দিরে’ যান জগন্নাথ। সেখান থেকে সাতদিন পর নিজ মন্দিরে ফিরে আসেন। যাওয়ার দিনকে বলে ‘সোজা রথ’ এবং একই পথে নিজ মন্দিরে ফিরে আসাকে বলে ‘উল্টো রথ’। পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। গুন্ডিচা মন্দির ভ্রমণকেই আবার মাসির বাড়ি যাওয়া মনে করেন অনেকে। পুরাবিদেরা বলেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী’ই ছিলেন ‘গুণ্ডিচা’। তবে এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিভেদ দেখা যায়।

ভারতবর্ষ তথা ‘বিশ্বের ২য় প্রাচীন’ (প্রথম- পুরীর রথ যাত্রা) ও পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন রথযাত্রা হল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা উৎসব। ঐতিহাসিক মতে খ্ৰীস্টিয় ১৬ শতকে, ‘শ্রী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী’র হাতে এই রথ যাত্রা উৎসবের সূচনা হয়। ‘শ্রী ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী’ ছিলেন একজন ‘বাঙালি সন্ন্যাসী’, যিনি পুরীতে গিয়েছিলেন ‘তীর্থ’ করতে। সেখানে তিনি, পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে, শ্রী জগন্নাথ দেবকে স্বহস্তে ‘ভোগ’ অর্পন করতে চান। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পূজারীদের বাধায় তা হয়ে ওঠে নি। ভগ্ন হৃদয়ে ধ্রুবানন্দ অনশনে মৃত্যু বরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। অনশনের তৃতীয় দিনে তিনি স্বপ্নে শ্রী জগন্নাথ দেবকে দেখতে পান ও তাঁর বাণী শুনতে পান। শ্রী জগন্নাথ তাঁকে বলেন বঙ্গে ফিরে, ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ বলে একটি স্থানে উপাসনা করতে। সেখানে তিনি ধ্রুবানন্দকে একটি বৃহৎ ‘দারু-ব্রহ্ম’ (নিম গাছের গুঁড়ি) পাঠাবেন। যা দিয়ে ধ্রুবানন্দ যেন ‘জগন্নাথ’, ‘বলরাম’ ও ‘সুভদ্রা’র মূর্তি নির্মাণ করে ‘ভোগ’ প্রদান করেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধ্রুবানন্দ মাহেশে চলে আসেন ও উপাসনা করতে থাকেন। অবশেষে এক ভয়ানক ঝড়-জলের রাত্রে, নদীতে ভেসে এক বিশাল দারু-ব্রহ্ম সেখানে আসে ও ধ্রুবানন্দ জলে ঝাঁপিয়ে পরে সেটিকে ডাঙায় তোলেন। সেই দারু-ব্রহ্ম দিয়ে তিনি মূর্তি নির্মাণ করেন ও মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরে ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’ সন্ন্যাস নিয়ে পুরী যাবার পথে মাহেশে আসেন। সেখানে জগন্নাথ মন্দির দর্শন করেন ও মাহেশের জগন্নাথ বিগ্রহ দেখে প্রথমে অজ্ঞান হয়ে যান ও পরে গভীর সমাধী নেন। ধ্রুবানন্দ তাঁকে মন্দিরের দায়িত্ব নিতে বলেন। মহাপ্রভু তাঁর বদলে ‘শ্রী কমলকার পিপলাই’ কে মন্দিরের দায়িত্ব দিতে বলেন। ‘শ্রী কমলকার পিপলাই’ ছিলেন ‘মহাপ্রভুর ১২ জন গোপালের ৫ম’। ধ্রুবানন্দ, মহাপ্রভুর নির্দেশ মেনে তাই করেন এবং এর কিছু দিন পরেই ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর মৃত্যু হয়। ‘শ্রী কমলকার পিপলাই’ বংশগত পরিচয়ে ছিলেন, ‘সুন্দরবনের খালিজুলির জমিদারের পুত্র’। তিনি নীতি শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য নবদ্বীপ যান ও শ্রী মহাপ্রভুর শিষ্য হন। তিনি ‘মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের ৬৪জন মহান্তের প্রথম মহান্ত’। শ্রী কমলকার পিপলাই ১৫১০ খ্ৰীস্টাব্দে ভারতের ও বিশ্বের ২য় প্রাচীন ও বাংলার সর্ব প্রাচীন, মাহেশের রথ যাত্রার সূচনা করেন। শ্রী কমলকার পিপলাই, যে রথ নির্মাণ করিয়েছিলেন ও যে জগন্নাথ মন্দিরের মূল সেবায়েত ছিলেন, তার কোনটাই এখন আর নেই। বর্তমানে থাকা, মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরটি ১৭৫৫ সালে, কলকাতার ‘পাথুড়িয়াঘাটা’র ‘শ্রী নয়নচাঁদ মল্লিক’, ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করিয়ে দেন। ১৫১০ খ্ৰীস্টাব্দে হওয়া মাহেশের প্রথম রথ যাত্রা সম্পর্কে ‘কোন তথ্য’ পাওয়া যায় না। শোনা যায় যে, ‘বৈদ্যবাটি’র কোন এক ব্যক্তি তার পরে সেখানে একটি রথ দান করেছিলেন। ১৭৯৭ খ্ৰীস্টাব্দে, ‘শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্য বলরাম বসুর পিতামহ’, ‘শ্রী শ্রী কৃষ্ণরাম বসু’ সেখানে একটি রথ দান করেন। ১৮৩৫ খ্ৰীস্টাব্দে, তাঁর পুত্র ‘শ্রী গুরুপ্রসাদ বসু’, পুনরায় একটি রথ মাহেশের মন্দিরে দান করেন। কিন্তু আগুন লেগে সেই রথটি ‘ভস্মিভূত’ হয়। এরপরে ‘শ্রী কালাচাঁদ বসু’, ১৮৫২ খ্ৰীস্টাব্দে, মন্দিরের জন্য পুনরায় একটি রথ বানিয়ে দেন। কিন্তু সেই রথের ভিতরে কোন এক ব্যক্তি ‘আত্মহত্যা’ করেন। সেই ঘটনা কে অশনি সংকেত বর্ণনা করে, ‘শ্রী বিস্মভর বসু’, ১৮৫৭ খ্ৰীস্টাব্দে পুনরায় একটি নতুন রথ বানিয়ে দেন। কিন্তু সেটিও আগুন লেগে ‘ভস্মিভূত’ হয়। বর্তমানে মাহেশের রথ যাত্রায় ব্যবহৃত লোহার রথটি, ‘দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু’, ‘মার্টিন-বার্ন’ কোম্পানি কে দিয়ে নির্মাণ করান। ‘বাংলা নবরত্ন স্থাপত্যশৈলী’তে নির্মিত এই লোহার রথটিতে, ১২টি চাকা আছে ও রথটি ৫০ ফুট উঁচু। ‘শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ রচিত ‘রাধারানী’ উপন্যাসে, মাহেশের প্রাচীন রথ যাত্রার অলংকৃত বর্ণনা পাওয়া যায়।

কলকাতার বেশ কিছু ‘বনেদি বাড়ির রথযাত্রার উৎসব’ যথেষ্ট বিখ্যাত৷ একটা সময় ‘মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চল’ থেকে বের হত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় গোটা তিরিশেক রথ। কোনওটা ‘পিতলের’, কোনওটা ‘রূপোর’, আবার কোনওটা ‘কাঠের উপর লোহা’ দিয়ে সাজিয়ে৷ এর মধ্যে ‘উত্তর কলকাতার তারক প্রামাণিক রোডের’ ‘প্রামাণিক বাড়ির পিতলের রথ’টি আনুমানিক ২৫০ বছরের পুরোনো৷ তারক প্রামাণিকের বাবা ‘গুরুচরণ প্রামাণিকের আমলে’ হুগলির ব্যান্ডেলে পারিবারিক কাঁসা-পিতলের কারখানাতে তৈরি হয়েছিল ১৪ ফুট উচ্চতার পিতলের এই রথ, যার ওজন প্রায় ২২ টন৷ রথের দিন এই রথটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হত বড়বাজারের কারখানায়৷ সেখানেই থাকত সাত দিন৷ তার পর আবার উল্টোরথের দিন টেনে নিয়ে আসা হত বাড়িতে৷ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য সাবেকি প্রথা মেনে তাকে টানা হয় বাড়ির উঠোনেই৷ শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মতোই বাংলার বিভিন্ন স্থানের রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘শ্রীরামপুরের মাহেশ’, ‘গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের রথের’ পাশাপশি ‘মহিষাদলের রাজবাড়ির গোপালজিউর রথ’ প্রসিদ্ধ। পুরনো কলকাতার বাসিন্দা ‘শেঠ-বসাকদের গৃহদেবতা’ ‘গোবিন্দজি’র রথযাত্রা ছিল উল্লেখযোগ্য। শোনা যায় ‘বৈঠকখানা থেকে লালদিঘি’ পর্যন্ত এই রথ টানা হত। ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে ‘প্রাণকৃষ্ণ দত্ত’ এর উল্লেখ করেছেন। এর পাশাপাশি সেকালে ‘পোস্তার রথ’ও ছিল নাম করা।

সেকালে ‘জানবাজারের রাণী রাসমণির বাড়ির রথযাত্রা’ ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। রাণী রাসমণি শক্তির আরাধনা করলেও তিনি মূলতঃ পিতৃসূত্রে ‘বৈষ্ণবভাবাপন্না’ ছিলেন এবং তাঁর শ্বশুরালয়েও ‘রঘুনাথ জীউ’ পরবর্তীকালে গৃহদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। তবে, ‘স্বামী জগদীশ্বরানন্দ তাঁর রচিত ‘দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা- ২১) উল্লেখ করেছেন যে, রাণী রাসমণি বৈষ্ণব বংশে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর ‘শ্বশুরালয়’ ছিল ‘শৈব পরিবার’ এবং সেজন্য তাঁর ধর্মমত ছিল সমুদার। তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র দাসের জীবদ্দশায় বাড়িতে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতি নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও, রথযাত্রা উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান হত না। স্বামীর মৃত্যুর পরে রাণী রাসমণি রথযাত্রা উৎসব করতে এবং সেই রথে গৃহদেবতা রঘুনাথ জীউকে বসাতে মনস্থির করেন। ১২৪৫ বঙ্গাব্দে বা ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে রাসমণি দেবী প্রথম রথযাত্রা উপলক্ষে রথনির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার কাজে, তখনকার হিসেবে প্রায় সওয়া লক্ষ টাকা ব্যয় করেন এবং সেই রথে গৃহদেবতা রঘুনাথ জীউকে বসিয়ে নিজের মানসিক অভিলাষ পূরণ করেন। তখন বঙ্গদেশের নানা স্থানে নানা ধরণের রথ হত, কিন্তু রাণীর ইচ্ছা ছিল যে তিনি কাঠের বদলে রূপার রথ তৈরি করাবেন। সেই সময়ে কলকাতার অভিজাত পরিবারদের কাছে বিলেতি জুহুরী হিসেবে ‘হ্যামিল্টন কোম্পানি’র খুব খ্যাতি ছিল। রাসমণি দেবীর অন্যতম জামাতা শ্রী মথুর মোহন বিশ্বাসের ইচ্ছা ছিল যে, এমন দামি রূপার রথ ঐ বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে তৈরি করানো হোক এবং তিনি সেই মতন তাঁর ইচ্ছা রাসমণি দেবীর কাছে প্রকাশও করেন। কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা শ্রী রামচন্দ্র দাস রাসমণি দেবীকে পরামর্শ দেন যে, উপযুক্ত দেশীয় কারিগর থাকতে বিদেশির হাতে দেবকার্যের ভার দেওয়া উচিত নয়; তাছাড়া এই কাজের পারিশ্রমিক দেশীয় কারিগররা পেলে তাঁদের অভাব কিছুটা লাঘব হবে, তেমনি এই সব কাজের দ্বারা তাঁদের কাজে উৎসাহও বাড়বে। জ্যেষ্ঠ জামাতা রামচন্দ্র দাসের যুক্তি মেনে নিয়ে রাসমণি দেবী দেশীয় কারিগর দ্বারাই রথ তৈরি করা ঠিক বলে মনে করেন এবং সিঁথি, ভবানীপুর প্রভৃতি স্থান থেকে বাছাইকরা কয়েকজন কারিগর এনে, তাঁদের বেতন দিয়ে বাড়িতে রেখে রথ বানানোর কাজ শুরু হয়। তাঁদের দিনরাত পরিশ্রমের ফলে আষাঢ় মাসেই রথ তৈরির কাজ শেষ হয়। উল্লেখ্য যে, রথটি রূপার হলেও রথের চারটি চাকা ছিল কাঠের। এই রূপার রথে কাঠের চাকা কেন, সেই বিষয়ে বিস্তর জনশ্রুতি চালু থাকলেও, কোনটি সঠিক কারণ তা জানা যায় না। রাসমণি দেবী প্রতি বছরই মহা আড়ম্বরের সাথে রথযাত্রা উৎসব পালন করতেন। রথযাত্রার সময়ে ঢাক, ঢোল, সানাই, কাড়া, নাকড়া, বাঁশি, জগঝম্প প্রভৃতি নানা ধরনের বাজনা তিনি আনাতেন, এছাড়া আসত কীর্তনের দল। এই বাজনা ও কীর্তনের দলগুলি রথের পেছনে পেছনে পরপর সব যেত। রূপার রথ ও এত রকমের বাজনা ও গানের দল থাকায়, লোকে দলে দলে ‘রাণীর রথ’ দেখতে আসত। এমনকি কলকাতা ছাড়াও কলকাতার বাইরের বহু লোক এই রথযাত্রা উৎসব দেখতে এসে আনন্দলাভ করত। এই রথযাত্রা উপলক্ষে রাণী রাসমণি তাঁর নিজের নিকট ও দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়-কুটুম্বদের নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়িতে আনাতেন। তাঁরা সকলেই কয়েকদিন রাসমণি দেবীর বাড়িতে বাস করে আনন্দ পেতেন। এইজন্য রাসমণি দেবীর প্রতি বছর রথযাত্রা উপলক্ষে তখনকার হিসেবে প্রায় আট থেকে দশ হাজার টাকা খরচ হত। একবার তিনি তাঁর রথযাত্রা উৎসব দেখার জন্য কলকাতার সব সাহেবদেরও আমন্ত্রণ করেছিলেন। রাসমণি দেবীর এই বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব সম্পর্কে শ্রী ‘প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’র অপূর্ব বর্ণনা উল্লেখ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। তিনি তাঁর ‘রাণী রাসমণি’ গ্রন্থে রথযাত্রার বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘‘স্নান যাত্রার দিন মহা ধুমধামে রথ প্রতিষ্ঠা করা হইল। বহু ব্রাহ্মণ ভোজন ও বিদায় দেওয়া হইল। মোট এক লক্ষ বাইশ হাজার একশত পনেরো টাকা ব্যয় হইল। মহা সমারোহে মহানগরী কলিকাতার রাজপথে জনসাধারণের নয়নান্দকর রৌপ্যময় রথ বাহির হইল। রাণীর জীবনকালে কয়েক বৎসর খুব ধুমধামে উৎসব হইয়াছিল। গোষানে রৌসন চৌকি, সানাই, ঢাক, ঢোল, কাড়া, নাকড়া, বাঁশি, জগঝম্প ইত্যাদি শতাধিক বাদ্যকরগণ দিক মুখরিত করিয়া চলিত। শতাধিক উড়িষ্যা দেশবাসীর সুমিলিত সঙ্গীত ও তৎপশ্চাতে বাউলের দল, যাত্রার দল, বালক সঙ্গীতের দল, সংকীর্তন সম্প্রদায়, ভাঁড়ের দল, নানাবিধ রং তামাসা, পুত্তলিকা নাচনির দল; তৎপরে বাগবাজারের শখের নাম গান। বাগবাজারের হাফ আকড়াইয়ের দলের নামজাদা দোহারগণ আসিতেন। ইহাদের জন্য মাসাবোধি কাল পূর্ব্ব হইতে বাটীতে গান সাধা, যাতায়াতের, জলযোগের, তাম্বুল, তাম্রকূট ইত্যাদির ব্যয় বহন করা হইত। তাহার পশ্চাতেই গোয়ালটুলীর শখের দলের নাম গান। মধুসূদন দাস ও লোকনাথ হোড় প্রভৃতির তত্বাবধানে এই শখের দল বাহির হইত। রথযাত্রা ও পুনর্যাত্রা উপলক্ষে প্রতি বৎসর দুই হইতে তিন মণ হিসাবে জুঁই ফুলের মালা (গড়ে) খরিদ করা হইত। উহা হরি সংকীর্তন ও শখের দলের গায়কদিগকেও দেওয়া হইত। তারপর, রথের সম্মুখে রাণীর গুরুদেব স্বর্ণছত্রতলে নগ্নপাদ জামাতাদিগের সমভিব্যাহারে মন্ডলাকারে পরিবেষ্টিত, গরদ ও চেলী পরিবৃত ও উপবিতাকারে উত্তরীয় বক্ষে বিলম্বিত, বদনে কপালে চন্দনচর্চিত, গলায় ফুলমালা, তুলসীমালা, স্বর্ণহার শোভিত হইয়া চলিতেন। তাঁহাদের পশ্চাতে নায়েব, দেওয়ান, সরকার, গোমস্তা এইরূপ যাইতেন; সঙ্গে সঙ্গে দাসগণ আড়ানিতে ব্যজন করিতে করিতে যাইতেন। তাঁহারাও নববস্ত্র পরিহিত, নব উশ্নিষ শোভিত হইয়া প্রসন্নমনে চলিতেন। মধ্যে মধ্যে গোলাপ-পাশ গোলাপ-বারি উদ্গীরণ করিয়া সৌরভে দিক আমোদিত ও দেহে পতিত হইয়া দেহমস্তক স্নিগ্ধ করিত। চার-পাঁচ শত লোক রথরজ্জু ধরিয়া রথ বহন করিত, রঘুনাথ জীউ রথে আসীন হইতেন। তাহারই পশ্চাতে দ্বিচক্র-যান, চতুষ্চক্র-যান, ঘুড়ী-চৌঘুড়ী, নানাবিধ যানে রাণীর দৌহিত্র-দৌহিত্রীগণ নগ্নপাদ, নববস্ত্র-ফুলমালা-শোভিত, তিলক-খচিত, চন্দন-চর্চিত হইয়া যাইতেন। সারি সারি গোষানে করিয়া এরণ্ড তৈল, শুষ্ক নারিকেল শস্য, রাত্রে আলোকের জন্য আলোকাধার, প্রস্তুত তাম্বুল, তাম্রকূট, হুকা, গড়গড়া, ফরসী ও একটি বৃহৎ মৃৎপাত্রে করিয়া অগ্নিবাহিত হইত। এতদর্থে দশ-বারো খানি গোযান চলিত। সকল যানের পার্শ্বেই দৌবারিক উলঙ্গ তরবার, বংশযষ্টি লইয়া সাবধানে প্রহরায় নিযুক্ত থাকিত। পুরোভাগ হইতে অন্তঃসীমা পর্যন্ত স্থূল রজ্জুবদ্ধ বংশদণ্ড সমন্বিত, হরি নামাঙ্কিত লোহিত পতাকা পতপত রবে উড্ডীয়মান থাকিত। এইভাবে অর্ধক্রোশ ব্যাপী পথ জুড়িয়া রথ চলিত। সঙ্গীতে, বাদ্যে, কোলাহলে, হরিবোলে দিক মুখরিত হইত। মধ্যে মধ্যে বিরাম ও শ্রমপোনদন, তাম্বুল ও তাম্রকূট সেবন, নামগান হইত, পুনরায় চলিত। রথ আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও চক্রচতুষ্টয় ব্যতীত সকলই রৌপ্যময় ছিল। সুতরাং অভিনব সামগ্রী দেখিবার জন্য দেশ বিদেশ হইতে লোক সমাগম হইত। তখনকার দিনে রথযাত্রা ও পুনর্যাত্রা উপলক্ষে অষ্টাহকাল ব্যাপী উৎসবে রাণী ন্যূনপক্ষে আট হাজার টাকা প্রতি বৎসর ব্যয় করিতেন। এই উপলক্ষে আত্মীয়-কুটুম্ব সকলকে বাটীতে নিমন্ত্রণ করা হইত ও পরম পরিতোষ সহকারে অষ্টাহকাল পান ভোজনে তুষ্ট করা হইত। এক বৎসর রাণী সহরের সমস্ত সাহেবদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া একটি ভোজ দেন ও পরিপাটিরূপে বাটী সজ্জিত করেন। সাহেব, মেম, সকলে বাটী দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইয়া বলেছিলেন - ‘our eyes never met such a gorgeous, pompous extraordinary Occasion like this.’ ...।’’ রাণীর রূপার রথ নিয়ে পারিবারিক গোলমালের শুরু হয় রাণীর দেহত্যাগের পরে। রাসমণি দেবীর মৃত্যুর পরে, তাঁর সাধের সেই রূপার রথ তাঁর অন্যতম দৌহিত্র শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস (রাণীর কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী জগদম্বা ও মথুরমোহন বিশ্বাসের পুত্র) নিজের বাড়ির অংশে রাখেন। ১৮৮১ খ্ৰীস্টাব্দে রাসমণি দেবীর আর এক দৌহিত্র শ্রী বলরাম দাস (রাণীর জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী পদ্মমণি ও রামচন্দ্র দাসের দ্বিতীয় পুত্র) ২৯৪ নং মামলায় রথ ও দেবোত্তর সম্পত্তির বিষয়ে ত্রৈলোক্যের নামে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। প্রায় বিশ বছর মামলা চলার পরে ১৯০১ খ্ৰীস্টাব্দে রথের মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং ঐ বছরে রথের প্রথম পালা শ্রী বলরাম দাস প্রাপ্ত হন। রাসমণি দেবীর পাঁচজন দৌহিত্রের মধ্যে পালাক্রমে তাঁর রূপার রথটির ভার পড়ে। কিন্তু ১৯১০ খ্ৰীস্টাব্দে রূপার রথের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায়, শ্রী বলরাম দাস অন্যান্য অংশীদারগণকে রথখানি ভেঙে তার পরিবর্তে একটি নতুন রথ প্রস্তুত করার আহ্বান জানান। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর আহ্বানে কেউ সাড়া দেননি। উপায়ন্তর না দেখে, কেবলমাত্র অমৃতনাথ দাস (রাসমণি দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী পদ্মমণি ও রামচন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী সীতানাথের একমাত্র পুত্র) ও শ্রী বলরাম দাস - উভয়ে মিলিতভাবে সত্তর হাজার টাকা ব্যয়ে পুরানো রথের অনুরূপ আরেকটি নতুন রথ নির্মাণ করান এবং নিজেরাই তাঁদের নিজ গৃহদেবতা ‘বামনদেব জীউ’ কে সেই রথে বসিয়ে রথোৎসব পালন শুরু করেন। সেই সময়ে রাসমণি দেবীর পুরাতন রথের সঙ্গেই নতুন রথটি রাজপথে বের হত। পরবর্তীকালে, শ্রী বলরাম দাস ও শ্রী অমৃতনাথ দাসের যৌথ উদ্যোগে তৈরি রথটিও ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয় এবং রাণী রাসমণির তথা তাঁর বংশের রথোৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। রাসমণি দেবীর তৈরি রূপার রথটি বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরে ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে।

আজও কলকাতার ‘রামকানাই দত্তের বাড়ি’তে ধুমধাম করে পালিত হয় রথযাত্রা। সেটিও শতাব্দী প্রাচীন। ‘বউবাজার অঞ্চলে’ই ‘যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে’ গত ১১৯ বছর ধরে সাড়ম্বরে হয়ে আসছে রথযাত্রা। শোনা যায়, যদুনাথ ছোটবেলায় জগন্নাথের পুজো করতেন। পরে তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঠাকুরবাড়িতে জগন্নাথ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিবারের গৃহদেবতা জগন্নাথ। এখানে নেই সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ। স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ অসুস্থ থাকেন। রথের আগের দিন তিনি নবযৌবন লাভ করেন। সোজা রথ ও উল্টো রথের দিন আজও সুসজ্জিত রথ রাস্তায় বেরোয়। রথ উপলক্ষে রুপোর সিংহাসনে বসানো হয় দেবতাকে। রথের সময় পরিবারের আত্মীয়রা যাঁরা জগন্নাথকে নিমন্ত্রণ করেন তাঁদের বাড়িতে রথ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশেষ পুজো-ভোগ হয়, একে বলে ‘দ্বারে ভোগ’। সোজা রথের পরের দিন থেকে উল্টো রথের আগের দিন পর্যন্ত বিশেষ পুজো ও ভোগ। হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। থাকে ‘লুচি’, ‘ভাজা’, ‘ফল’, ‘মিষ্টি’, ‘দই’। রথ উপলক্ষে বসে ‘নহবত। ‘রাজবেশ’, ‘পদ্মবেশ’, উল্টো রথের দিন ‘ফলের মালা’ পরানো হয়। উল্টো রথের দিন জগন্নাথ ফিরে আসার পরে রাতে লক্ষ্মীর সঙ্গে মালা বদল করে বিয়ের আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়। একে বলে ‘যুগল মিলন’। বউবাজার অঞ্চলে ‘গোবিন্দ সেন’ লেনে জগন্নাথ বিগ্রহ ও রথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘চুনিমনি দাসী’ প্রায় ১২৫ বছর আগে। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল এই রথে সাবেক শিল্পরীতির নমুনা দেখা যায়। রথের চার দিকে আছে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, এক বার পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট এক খণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহটি। এই বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছে ‘শালগ্রাম শিলা’। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, স্নানযাত্রার পরে হয় বিগ্রহের ‘অঙ্গরাগ’। আগে রথের দিন ও উল্টো রথের দিন পথে রথ বেরতো। এখন আর রথ রাস্তায় বেরোয় না। বাড়ির উঠোনেই টানা হয়। রথ উপলক্ষে আজও জগন্নাথের রাজবেশ এবং বামনবেশ হয়। এই সময় প্রতি দিন বিশেষ ভোগও দেওয়া হয়। তার মধ্যে থাকে ‘খিচুড়ি’, ‘পোলাও’, ‘লুচি’, ‘চচ্চড়ি’, ‘মালপোয়া’, ‘গজা’, ‘রসগোল্লা’ ইত্যাদি। এখনও প্রতি বছর পুরী থেকে পাণ্ডারা আসেন রথ উপলক্ষে। ‘মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসে’ আজও ‘বেলোয়ারি কাচের ফানুসে’, রেড়ির তেলে ও মোমবাতির আলোয় গৃহদেবতা জগন্নাথকে রাখা হয়। স্নানযাত্রার দিন থেকেই শুরু হয় উৎসব। প্রথা অনুসারে স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ ‘অসুস্থ’ হন এবং তাঁকে ‘পাঁচন’ দিয়ে সুস্থ করা হয়। এর পরে হয় ‘অঙ্গরাগ’। রথের দিন মোট ছ’বার পুজো, চার বার আরতি হয়। ‘রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক’ প্রচলিত বৈষ্ণব প্রথা অনুসারে আজও চলে সাবেক আচার অনুষ্ঠান। মা লক্ষ্মীর ঘর থেকে আরতি করে রথযাত্রার শুভ সূচনা হয়। এর পরে রথে বসিয়ে জগন্নাথের মূল পুজো হয়। একে বলে ‘দাঁড়ে ভোগ’। এতে থাকে ‘সন্দেশ’, ‘ফল’ ইত্যাদি ভোগ। তার পরে রথের রশিতে টান পড়ে। রথের মহাপ্রসাদের মধ্যে থাকে ‘জগন্নাথবল্লভ’, ‘খাজা’, ‘গজা’, ‘খয়েরচূড়’, ‘নিমকি’, ‘কটকটি’ ইত্যাদি। আর ৫৬ ভোগের মধ্যে থাকে ‘সাত-আট রকমের ডাল’, ‘ভুনিখিচুড়ি’, ‘শাক’, ‘নারকেলের পদ’, ‘বড়া’, ‘বড়ি’, ‘ঘণ্ট’, ‘ছেঁচকি’, ‘পরমান্ন’ ইত্যাদি। আর থাকে ‘কাসুন্দি’ ও ‘আচার’। এ বাড়ির রথ বাড়ির বাইরে বেরয় না, বাড়ি সংলগ্ন ‘নীলমণি উদ্যানেই’ টানা হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও রথের দিন ও উল্টো রথের দিন মেলা বসে। দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বউবাজার অঞ্চলের ‘রামকানাই অধিকারীর রথ’। পুরনো সাবেক রথটি আজ আর ব্যবহার করা হয় না। তার পরিবর্তে ছোট একটি রথে বসানো হয় জগন্নাথকে। আগের মতো রথ রাস্তায় বেরোয় না। মন্দিরের মধ্যেই হয় রথযাত্রা। রথের দিন দু’বার রথ টানার প্রথা আছে এ বাড়িতে। সকালে পুজোর পরে এবং পরে সন্ধেবেলা। স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন। এই সময় প্রথা অনুসারে তিনি ‘অসুস্থ’ থাকেন। তাঁকে সুস্থ করার জন্য দেওয়া হয় ‘পাঁচন’। এর পরেই হয় ‘অঙ্গরাগ’। তার পরেই রথযাত্রা।

                                    ©️রানা©️

জগন্নাথদেবের মূর্তির রূপ নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। কেন ‘হস্তপদবিহীন দেহ’ তাঁর, কেন এমন অদ্ভুত তাঁর ‘অবতার’? এই প্রসঙ্গে স্বয়ং দেবতার কিছু বিশ্লেষণ দেখা যায়। ‘কঠোপনিষদে’ বলা হয়েছে, “না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু”, অর্থাৎ, ‘‘এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী”। ঈশ্বর থাকেন ‘অন্তরে’। তাঁর কোনো ‘রূপ’ নেই। তিনি ‘সর্বত্র বিরাজী’। ‘ঋগ্বেদ’ বলছে, “অবাঙমানসগোচর”, অর্থাৎ, “মানুষ বাক্য এবং মনের অতীত’’। মানুষ তাই তাঁকে ‘মানবভাবে’ সাজায়। এ বিষয়ে ‘কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে’ বলা হয়েছে -

‘‘অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা

পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ।

স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা 

তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্।।’’

অর্থাৎ, ‘‘তাঁর লৌকিক হস্ত নেই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তাঁর পদ নেই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তাঁর চোখ নেই, অথচ সবই দেখেন। কান নেই, কিন্তু সবই শোনেন। তাঁকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা, তাঁর রূপ নেই, আকার নেই।’’ উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপই হলো পুরীর জগন্নাথদেব। তাঁর পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কারণ তাঁর রূপ তৈরিতে মানুষ অক্ষম। শুধু ‘প্রতীক’কে দেখানো হয়েছে মাত্র।

(তথ্যসূত্র:

১- Krishna in History, Thought, and Culture: An Encyclopedia of the Hindu Lord of Many Names by Lavanya Vemsani, ABC-CLIO (২০১৬)।

২- The A to Z of Hinduism by Bruce M. Sullivan, Rowman & Littlefield (২০০১)।

৩- South Asian Religions on Display: Religious Processions in South Asia and in the Diaspora by Knut A. Jacobsen, Routledge (২০০৮)।

৪- The Jagannatha Temple at Puri: Its Architecture, Art, and Cult by O.M. Starza, BRILL (১৯৯৩)।

৫- The Saga of the Land of Jagannatha by Dr Mayadhar Mansinha, Mass Media Pvt. Ltd. (২০১০)।

৬- ৩০০ বছরের কলকাতার পটভূমি ও ইতিকথা, ডঃ অতুল সুর।

৭- রাণী রাসমণি, প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা।

৮- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী।

৯- প্রভু জগন্নাথ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।)

                            

No comments