Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

১৮৫৪ সাল ১৫আগস্ট— ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক ৯৩বছর আগে,

১৮৫৪ সাল ১৫আগস্ট—ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক ৯৩বছর আগে,বাংলায় আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল চলাচলের প্রথম দিন হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে ব্যবসায়ী এক ভদ্রলোক রেলের গতির ঝড়ে কার্যত বিষ্মিত হয়ে হুগলি স্টেশনে নেমে অনেকের কাছে জানতে চাইছিলেন তিনি স…

 




১৮৫৪ সাল ১৫আগস্ট—ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক ৯৩বছর আগে,বাংলায় আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল চলাচলের প্রথম দিন হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে ব্যবসায়ী এক ভদ্রলোক রেলের গতির ঝড়ে কার্যত বিষ্মিত হয়ে হুগলি স্টেশনে নেমে অনেকের কাছে জানতে চাইছিলেন তিনি সত্যিই হুগলি পৌঁছেছেন কিনা!

 উনি অনেকের কাছে জায়গার নাম জিজ্ঞেস করছিলেন,আসলে তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না,এত কম সময়ে হাওড়া থেকে হুগলি পৌঁছে গিয়েছেন!


গাড়ি কোনো জায়গায় হেলে নি বা দোলে নি বা ঝাঁকুনি দেয়নি,সমান ভাবে চলেছে৷


ইঞ্জিনের প্রধান সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিস্টার হজসন বললেন, আরো কিছু দিন চলার পর গতি আরো ভালো হবে৷


আসলে যে সেদিনও আরেক দফা পরীক্ষামূলক ভাবে রেল চালিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি,শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে বাংলায় আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল চালানোর৷


গল্প বলছি দেশের লাইফ লাইন রেলের বাংলায় ট্রয়াল রান ও আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথমবার চলার স্মরণীয় সেই সব দিনগুলির ৷


একটু ফ্লাশব্যাকে যেতেই হবে আমাদের,

 দিনটা ছিল ১১-৮-১৮৫৪ -এর প্রায় সকাল,

বাংলায় সেদিন হাওড়া  থেকে হুগলির উদ্দেশ্যে রেলের চাকা আবার গড়ালো৷

তার আগে অবশ্য হজসন সাহেব ১৮৫৪সালের ২৮জুন পাণ্ডুয়া পর্যন্ত রেলগাড়ি চালিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা,অর্থাৎ সেটি ছিল আরেকটা ধাপের ট্রয়াল রান ৷


১১আগস্ট,১৮৫৪ — এর সকাল,

আর কিছুক্ষনের মধ্যে বাংলায় যাতয়াত ব্যবস্থার একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার আগে শেষ দফায় রেলগাড়ি নিয়ে পরীক্ষামূলক দৌড় শুরু করবেন ইঞ্জিনের প্রধান সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিস্টার হজসন সাহেব৷


ট্রেন ছুটবে হাওড়া স্টেশন থেকে হুগলি৷


এদিন অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির রেলের প্রথম রেল ইঞ্জিন (Locomotive) এর প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হজসন সাহেবের সঙ্গী হয়েছেন একদল ইংরেজ সাংবাদিক৷


১৪আগস্ট ১৮৫৪—,

 ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির হাওড়া ও হুগলির মধ্যে ১১আগস্টের ট্রয়াল রানের খবর প্রকাশিত হয়েছিল 'বেঙ্গল হরকরা'ও 'ইন্ডিয়া গেজেট' পত্রিকায়৷


কেমন ছিল সেদিনের সংবাদপত্রগুলির খবর?

 একটু শুনি আমরা৷


গাড়ি থেকে সংবাদদাতারা দেখলেন ,লাইনের দু'ধারে এদেশী লোকেরা দাঁড়িয়ে নতুন অগ্নিরথকে সেলাম করছেন৷

সংবাদদাতারা অনুধাবন করলেন অচিরেই রেল ভারতে অন্য পরিবহনের মাধ্যমকে হটিয়ে দেবে,বড় কারন গতি,সঙ্গে সস্তা৷

পুনশ্চ- হাওড়া ও কলকাতার মধ্যে একটা পুল হওয়া একান্তই দরকার৷রেল ধরতে হলে খুব বেশি কষ্ট ও অসুবিধে ভোগ করতে হবে৷

বর্ষাকালে দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছবে৷


১১আগস্ট,১৮৫৪ — এর সকাল,

ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা বেজে তিরিশ মিনিট,

হাওড়া থেকে রেলের চাকা গড়াল,

 গন্তব্য হুগলি স্টেশন৷

হাওড়া থেকে বালী স্টেশন সাড়ে পাঁচ মাইল সময় লেগেছিল ১১মিনিট ৷

বালী থেকে শ্রীরামপুর সাড়ে ছয় মাইল সময় লাগে ১৪মিনিট৷

শ্রীরামপুর থেকে চন্দননগর স্টেশন সাড়ে আট মাইল

সময় কুড়ি মিনিট৷


চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া স্টেশন(এই স্টেশন কে রেলের টাইম টেবিলে হুগলি স্টেশন বলে উল্লেখ করা হয়েছে) তিন মাইল সময় ৮মিনিট৷


সেদিন রেল হাওড়া থেকে চুঁচুড়া সাড়ে তেইশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করেছিল ৫৩মিনিটে ৷

বেশ জোর গলায় বলা যায় গতি ও যাত্রী নিরাপত্তার পরীক্ষায় সেদিন সব কিছু সাফল্যের সঙ্গে পাশ করেছিল রেল৷


স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল ৩৮মিনিট৷


সকাল ৮টা বেজে ৩০মিনিটে হাওড়া থেকে ছেড়ে যাওয়া সেদিনের ট্রেন হুগলি পৌঁছেছিল দশটা বেজে ১মিনিটে৷

ট্রেন ছুটল বেশ গতিতে, হেলে নি বা দোলে নি বা ঝাঁকুনি দেয়নি অর্থাৎ

যাত্রী নিরাপত্তার পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উতরে গিয়েছিল, কিন্তু প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে সরব হয়েছিলেন এক ব্যাক্তি৷


১২-৮-১৮৫৪ ,

 কলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক 'রেকর্ডার' ছদ্মনামে চিঠি লিখলেন 'সিটিজেন' পত্রিকায়৷

তিনি লিখলেন—

কলকাতা থেকে হুগলি পর্যন্ত মাত্র ২৮মাইল(আসলে প্রায় ২৪মাইল) প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য ৪টাকা ভাড়া বড্ড বেশি৷

এই ভাড়া অনায়াসে তিন টাকা করা যায়৷

শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি সেই চিঠি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় এবং চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ৩টাকা ধার্য করা হয়৷


১৪-৮-১৮৫৪ সালে 'বেঙ্গল হরকরা' ও "ইন্ডিয়া গেজেট' পত্রিকায় সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়৷


একটু দেখি কেমন সেই বিজ্ঞাপন—


ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে—


এমাসের ১৫তারিখ মঙ্গলবার থেকে ট্রেন হাওড়া ও হুগলি ছাড়বে নিন্মলিখিত সময়ে—

হাওড়া থেকে সকাল ১০-৩০মিনিট,বিকেল ৫-৩০মিনিট ৷

হুগলি থেকে সকাল ৮-২৩মিনিট.বিকেল ৩-৩৮মিনিট ৷

ট্রেন থামবে বালী,শ্রীরামপুর,ও চন্দননগর স্টেশনে৷


১সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেন হাওড়া ও পান্ডুয়ার মধ্যে চলবে,আর সব স্টেশনে দাঁড়াবে৷

যাঁরা কম ভাড়ায় মাসিক টিকিট চান,তাঁদের অনুরোধ করা হচ্ছে,তাঁরা যেন যে কোনো স্টেশনে ফর্মের জন্য দরখাস্ত করেন ও ফর্মগুলি ভর্তি করে যত শীঘ্র সম্ভব ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দেন৷

মাসিক টিকিটের ভাড়া পরে ঠিক করা হবে৷

পরবর্তী ১জানুয়ারির আগে মাসিক টিকিট দেওয়া হবে না৷

আর ম্যাকডোনাল্ড ষ্টিফেনসন

২৯থিয়েটার রোড,কলকাতা

১২আগস্ট,১৮৫৪


ইস্ট-ইন্ডিয়ান কোম্পানির ডিরেক্টররা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন ১৮৫৪সালের ১৫আগস্ট বাংলায় আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথম রেলযাত্রার সূচনা করবেন৷


প্রথমবার ট্রেনে চাপবার জন্য মানুষের কি রকম উৎসাহ,আবেগ থাকতে পারে সেটা বোঝার জন্য আমাদের রকেট সায়েন্স বুঝতে হবে না৷


জীবনে প্রথমবার ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে রেল কোম্পানির কাছে আবেদন করেছিলেন তিন হাজার মানুষ৷

 মাত্র কয়েক'শ মানুষের ললাটে শিকে ছিঁড়েছিল৷


রেল লাইনের পাশে মানুষ অবাক হয়ে দেখলেন লোহার ইঞ্জিন তীব্র গতিতে কামরাগুলো কে টানছে,আর ভক-ভক করে ধোঁয়া আর আগুনের ফুলকি ছাড়ছে৷

আশ্চর্য এই দৃশ্য দেখতে রেল লাইন বরাবর হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন৷


১৫আগস্ট ১৮৫৪, প্রথম ট্রেনটি বিজ্ঞাপিত সময়ের দেড়ঘন্টা আগে সকাল ৮টা ৩০মিনিটে হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়ে,হুগলি পৌঁছে যায় ১০বেজে ১মিনিটে৷


প্রথম দিনের রেলযাত্রায় যাত্রায় এক ব্যবসায়ী হুগলি স্টেশনে নেমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এত কম সময়ে তিনি কী সত্যিই হুগলি পৌঁছেছেন !

গতির ঝড়ে কার্যত বিষ্মিত হয়ে হুগলি স্টেশনে নেমে অনেকের কাছে জানতে চাইছিলেন সত্যিই হুগলি পৌঁছেছেন কিনা৷

অনেকের কাছে জায়গার নাম জিজ্ঞেস করছিলেন ৷

আর একজন পাঁজি-পুঁথি বিচার করে ট্রেনে উঠেছিলেন,কিন্তু আগুনে গাড়িতে আয়ু কমে যাবে, এই ভয়ে আর ট্রেনে ফেরেননি। 

'বেঙ্গল হরকরায়' সেই কাহিনির বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল৷

ট্রেনটিতে তিনটি প্রথম শ্রেণীর,২টি দ্বিতীয় শ্রেণীর, তিনটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরা ও গার্ডের জন্য একটি ব্রেকভ্যান ছিল৷

ইঞ্জিনের নাম ছিল ফেরারি-কুইন৷


হুগলি পর্যন্ত ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ৩টাকা৷

দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া ১টাকা ২আনা৷

তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া ছিল বেশ কম৷

রেল সত্যিই যে দেশের লাইফ লাইন হতে চলেছে বোঝা গিয়েছিল ওই সময়েই ৷

রেলের চাকা গড়ানোর শুরুর পর থেকেই

 রেল দেশের লাইফ লাইন হয়ে উঠেছে অনেক কারনেই৷

আর আজকের দিনে— লোকাল,মেল,এক্সপ্রেস,সুপারফাস্ট ট্রেন যে মানুষের যাতয়াতের সর্বাধিক পছন্দের মাধ্যম সেই বিষয়ে আমাদের মনে বোধহয় বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই৷

গ্রন্থঋণ-কলিকাতা দর্পণ

রাধারমণ মিত্র

ছবি -একটি ফেরারি কুইন ইঞ্জিন

সৌজন্যে- আনন্দবাজার পত্রিকা

No comments