বেলগাছিয়া থেকে দমদম,বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন এক ডাক্তার। সম্বল বলতে একটা সাইকেল, মাথায় একটা টুপি আর সাইকেলে ঝোলানো ক্যামবিসের ব্যাগ। বেশিরভাগ রোগীই গরীব। পথ্য কেনারই পয়সা নেই আবার ডাক্তারের ফিস! তাই রোগী দেখার সাথে সাথে প্রয়োজনে পথ্য কেন…
বেলগাছিয়া থেকে দমদম,বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন এক ডাক্তার। সম্বল বলতে একটা সাইকেল, মাথায় একটা টুপি আর সাইকেলে ঝোলানো ক্যামবিসের ব্যাগ। বেশিরভাগ রোগীই গরীব। পথ্য কেনারই পয়সা নেই আবার ডাক্তারের ফিস! তাই রোগী দেখার সাথে সাথে প্রয়োজনে পথ্য কেনার পয়সাও দিচ্ছেন ডাক্তার। ভাবছেন কোনও অজ গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তারের গল্প বলতে বসেছি! শুনলে আশ্চর্য হবেন এ ডাক্তার ততদিনে বিলেতফেরৎ। ভাবতে অবাক লাগে আজ একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারেরও যখন গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করায় অনীহা তখন বিলেতের ডিগ্রি নিয়েও এই ডাক্তার স্বেচ্ছায় তাঁর কর্মস্হল বেছেছিলেন অস্বাস্থ্যকর গ্রাম। বলছি হাওড়া জেলার এক চিকিৎসক পরিবারের সুযোগ্য সন্তান ডা.রাধাগোবিন্দ করের কথা। তাঁর পিতার নাম ডাক্তার দুর্গাদাস কর। তাঁর ভাই রাধামাধব কর ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক এবং সফল নাট্য-অভিনেতা। রাধাগোবিন্দ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ গ্রহণের জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন – ১৮৮৩ তে পাস করেন ও ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ড যান। ১৮৮৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রী প্রাপ্তির পর স্বদেশে ফিরে আসেন। ভারতে আগমনের পর তিনি কলিকাতায় একটি জাতীয় চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সচেষ্ট হন ও স্বদেশী মনোভাবাপন্নদের নিয়ে কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি তে ছিলেন ডঃ মহেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ডঃ অক্ষয় কুমার দত্ত, ডঃ বিপিন বিহারী মৈত্র, ডঃ এম্. এল. দে, ডঃ বি. জি ব্যানার্জী ও ডঃ কুন্দন ভট্টাচার্য্যের মত কলিকাতার বিখ্যাত চিকিৎসকরা। সেখানে ঠিক হয় এমন হাসপাতাল স্থাপন করা হবে যা ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে হবে না এবং পরিচালিত হবে দেশীয় পরিচালকদের দ্বারা – সেই ফল স্বরূপ ১৬১, বৈঠকখানা বাজার রোডে ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শীঘ্রই ১১৭, বৌবাজার স্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয়। ডঃ রাধাগোবিন্দ কর প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল রাখা হয় এবং ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে ডঃ রাধাগোবিন্দ কর ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯০৪ খৃষ্টাব্দে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল ও অপর একটি বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কলেজ অব ফিজিসিয়ানস অ্যান্ড সার্জেন্স অব বেঙ্গল একত্রী করে ‘- দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অব ফিজিসিয়ানস অ্যান্ড সার্জেন্স অব বেঙ্গল’- তৈরী করেন এবং তা ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের ৫ই জুলাইএ শ্যামবাজার ও বেলগাছিয়া মধ্যেবর্তী স্থানে “বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ” নামে উদ্বোধন করা হয় ও ডঃ রাধাগোবিন্দ কর এই হাসপাতাল ও কলেজের সম্পাদক হন। স্বাধীনতার লাভের পরে এই কলেজ তাঁর নামানুসারে রাধাগোবিন্দ কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল রূপে প্রকাশ পায়, যা আজ আর.জি.কর হাসপাতাল নামে পরিচিতি লাভ করেছে। যা স্থাপন করেছিলেন ডা. নীল রতন সরকার।
রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন সুলেখক ,তিনি সরল সুন্দর বর্ণনার মধ্য দিয়ে চিকিত্সা সম্মন্ধে বই রচনা করেন, উল্লেখযোগ্য – ধাত্রীসহায়, – ভিষক সুহৃদ, – ভিষক বন্ধু, – শারীরতত্ত্ব, – কর সংহিতা, সংক্ষিপ্ত ভৈষজ্যতত্ত্ব, – প্লেগ, – স্ত্রীরোগচিকিৎসা,গাইনিকল্যাজি, – শিশু ও বাল চিকিৎসা ইত্যাদি। ডা.কর কোনও লিখিত সম্পত্তি, বিষয়-আশয় রেখে যাননি। ঘুরে ঘুরে মানুষের চিকিৎসা করতেন দিনের বেশিরভাগ সময় তাই নিজের পৈতৃক বাড়িতে থাকা হয়ে ওঠেনি তাই মাএ বছর তিনেক আগে আর.জি.কর হাসপাতালের একদল উৎসাহি ছাএ-শিক্ষকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় তাঁর পৈতৃক বাড়ির খোঁজ মেলে হাওড়ার বেতোড় এ। ২০১৫ সালে ডা.করের আঁতুড়ঘর সেই ভগ্নবাড়িতেই তারা ‘স্যার’ এর জন্মদিন উদযাপন করেন। স্হানীয় প্রশাসনের তরফে আশ্বাস মেলে হাওড়ার গর্ব এই মানুষটির নামে রাস্তা ও মূর্তি নির্মাণের।
আমৃত্যু রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন ডা.কর।স্বামী ব্রক্ষানন্দজির নিয়মিত চিকিৎসাও করতেন। আমরা হাওড়াবাসী হয়ে অনেকেই জানিনা হাওড়ার এই মহান চিকিৎসকের কথা। বিশেষকরে আজকের দিনে ডাক্তারি পেশাটা যখন সেবার বিপরীতার্থে শোষনের সমার্থক হয়ে উঠেছে তখন ডা.আর. জি.. করের এই জীবনবোধের আদর্শ আমাদের আদর্শচ্যুত অসাড় সমাজে অনুসরণ যোগ্য দৃষ্টান্ত। ১৯১৮ সালে ১৯ডিসেম্বর তিনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন।
রণতোষ
No comments