Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

নষ্ট প্রতিভার শেষ অঙ্ক’ রানা চক্রবর্তী

‘রামমোহনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “Inaugurator of Modern Age in India” - “ভারতে আধুনিক যুগের প্রবর্তক”। তেমনই মাইকেল মধুসূদন ছিলেন ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। আধুনিক বাংলা সাহিত্য যে গরিমায় আজ বিশ্ব সাহিত্যে সুপ্রতিষ্…

 




                                     

রামমোহনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “Inaugurator of Modern Age in India” - “ভারতে আধুনিক যুগের প্রবর্তক”। তেমনই মাইকেল মধুসূদন ছিলেন ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। আধুনিক বাংলা সাহিত্য যে গরিমায় আজ বিশ্ব সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, মাইকেল মধুসূদনই সেটার সূচনা করেছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবসম্পদ ও আঙ্গিককে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে গ্রহণের পথ সর্বপ্রথম তিনিই দেখিয়েছিলেন। বিশ্ব সাহিত্যের মহাসমুদ্রকে মন্থন ক’রে অমৃত সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজনীয় দৈবী ও দানবিক দুই শক্তিরই অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর শক্তি ছিল দৈবী, কারণ, তাতে ছিল অতুলনীয় নিষ্ঠা, সাধনা ও আত্মপ্রত্যয়; তাঁর শক্তি ছিল দানবিক, কারণ, তাতে ছিল শক্তির অতুলনীয় দম্ভ এবং গগনস্পর্শী উচ্চাশা। তিনি কেবল ইংরেজী, গ্রীক, লাতিন, ইতালীয়, ফরাসী, জার্মান ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সমুদ্রকে মন্থন করেন নি, ঐসব সাহিত্যের মহাকবিদের সমকক্ষ হওয়ার উচ্চাশা ও অহংকারও তিনি পোষণ করতেন। তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির রচনাকে কেবল আকণ্ঠ পান করেন নি; তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির সমকক্ষ হয়ে তাঁদের সমান আসনে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবার উচ্চাশা ও অহংকার পোষণ করতেন। তাই তিনি বাল্যকালেই তাঁর প্রিয় বন্ধুকে বলতে দ্বিধা করেন নি - “Oh! how should I like to see you write my 'Life,' if I happen to be a great poet, which I am almost sure I shall be ...” নিজের কবিত্ব শক্তি সম্পর্কে দম্ভ ও তাঁর উচ্চাশা তিনি কৈশোরেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। মধুসুদনের মধ্যে যে দৈবী ও দানবিক শক্তির মিলন ঘটেছিল, সেটাই তাঁকে একদিকে যেমন কবিত্বের উত্তঙ্গ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি তাঁকে একদা দুঃখের অতল গহবরেও নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর জীবনে যেমন ঐশ্বর্য ও ভোগবিলাসের রাজসিকতা, দৈন্য-দুঃখের চরম অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই দেখতে পাওয়া যায় দেবোপম বন্ধুপ্রীতি, পত্নীপ্রেম, সন্তান বাৎসল্য, ক্ষুরধার বুদ্ধি, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য - আবার এগুলোর সাথে দেখতে পাওয়া যায় চরম হৃদয় হীনতা, হঠকারিতা, ঔদাসীন্য, অবহেলা, নির্বুদ্ধিতা, অবিবেচনা, এমনকি স্বার্থপরতা। যে স্বর্গ ও নরকের মিলন ঘটেছে মর্ত্যলোকের সীমানায়, সেই স্বর্গ ও নরকের দুই কোটিকেই প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর জীবনে। তাই তাঁর জীবন আমাদের যেমন উল্লসিত করে, তেমনই পীড়াও দেয়৷ মধুসূদনের জীবন-আলেখ্য আলোকে, অন্ধকারে, ঔজ্জ্বল্যে, কালিমায় এমন পরিপূর্ণ যে, তাঁকে বৈপরীত্যের সমাবেশও বলা চলে।

মধুসূদন দত্তকে নিঃসন্দেহে এক নষ্ট প্রতিভা বলা চলে। তাঁর মধ্যে যে প্রতিভার বিস্ফোরণ দেখা দিয়েছিল, তিনি নিজেই সেটাকে অকালে গলা টিপে খুন করেছিলেন বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। বাংলা সাহিত্যে ‘দারিদ্র‌্যের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ’ বুঝি বা এক ‘মিথ্যে, অলীক কৌলীন্যের প্রতীক’ হয়ে উঠেছে, যার শুরু হয়েছিল ‘শ্রীমধুসূদনের প্রয়াণের’ মধ্যে দিয়ে। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের জনকও তো ‘কপর্দকহীন অবস্থায়’ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন! তাঁকে যখন ‘জেনারেল হাসপাতালে’ ভর্তি করা হয়েছিল (যে হাসপাতালে সে সময়ে ‘ইউরোপিয়ান’ ছাড়া অন্য কারও চিকিৎসা হত না) তখন আর তাঁকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। ‘মধুসূদনের’ দারিদ্র‌্যের জন্য অবশ্য অনেকেই তাঁর ‘অমিতব্যয়ী স্বভাব’কে দায়ী করেন। ‘ঠাটে-বাটে’ কাটানো তাঁর জীবন, ‘বেহিসেবি খরচ’ করার অভ্যাস, ‘অপরিমেয় বন্ধু-বাৎসল্য’ - এ সব তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল - এমনটা অনেকেই বলে থাকেন। ‘ইংল্যান্ড’ থেকে ‘ব্যারিস্টারি’ পাশ করে দেশে ফেরার পর তিনি কীভাবে ‘জীবনযাপন’ করতেন তার একটি ‘খণ্ডচিত্র’ পাওয়া যায় ‘নগেন্দ্রনাথ সোম’‌-এর ‘মধুস্মৃতি’–তে। ‘নগেন্দ্রনাথ সোম’‌ লিখেছিলেন - “স্পেন্‌সেস্‌ হোটেলে মাইকেল মধুসূদন একাকী বাস করিতেন; কিন্তু তিনখানি বড় বড় ঘর তাঁহার অধিকৃত ছিল। তিনি বন্ধুবান্ধবদিগকে সতত পানভোজনে পরিতৃপ্ত করিতেন। দেশী, বিলাতী, যিনি যেরূপ খানা খাইতেন, তিনি তাঁহাকে সেইরূপ খাদ্যদানে তৃপ্ত করিতেন। তাঁহার মদ্যের ভাণ্ডার (cellar) সতত উন্মুক্ত ছিল।” তবে সবসময় যে ‘অমিতব্যয়ী জীবনযাপনের’ জন্যই ‘মধুসূদন’ ‘আর্থিক সমস্যায়’ পড়েছিলেন তাও ঠিক নয়। যেমন, ১৮৬২ সালের ৯ই জুন ‘ক্যান্ডিয়া’ জাহাজে চেপে ‘ইউরোপ’ পাড়ি দেওয়ার আগে তিনি ‘আর্থিক সঙ্কট’ থেকে নিজেকে অনেকখানি মুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৮৬০ সালে জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে মামলা জিতে তিনি ‘পিতৃসম্পত্তি’ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। ‘ক্ষেত্র গুপ্ত’ লিখেছিলেন - “খিদিরপুরের বাড়ি তিনি সাত হাজার টাকায় বিক্রয় করলেন কবি রঙ্গলালের ভাই হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সুন্দরবনের ভূসম্পত্তি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মোক্ষদা দেবীকে পত্তনী দিলেন। চুক্তি হল, তাঁরা চার দফায় মোট তিন হাজার টাকা য়ুরোপে পাঠাবেন। এবং কবির স্ত্রীপুত্রকে কলকাতায় মাসিক দেড়শতটাকা হিসেবে দেবেন। এই চুক্তির প্রতিভূ ছিলেন বিখ্যাত রাজা দিগম্বর মিত্র এবং কবির পিসতুতো ভাই বৈদ্যনাথ মিত্র।” এই চুক্তির শর্ত কিন্তু রক্ষা করা হয়নি। ‘ফ্রান্সে’‌ থাকাকালীন ‘মধুসূদন’‌ ‘নিদারুণ অর্থকষ্টের’‌ মুখোমুখি হয়েছিলেন। ‘বিদ্যাসাগর’‌কে সেই সময় বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। তার প্রথমটিতে তিনি নিজের এই ‘ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য’‌ স্পষ্টতই দায়ী করেছিলেন ‘Babu D-’কে।  চিঠি পেয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ নিজে তো দেড় হাজার টাকা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়েছিলেনই, পরে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে বিশাল অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে সে যাত্রা ‘মধুসূদন’কে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। দেশে ফেরার পর ‘মধুসূদনের’ ‘ব্যারিস্টারির পসার’ যে একদম জমেনি তা নয়। যে ক’টি চাকরি করেছিলেন, সেই সময়ের বিচারে মাইনেপত্রও খারাপ ছিল না। ১৮৭০ সালে যখন তিনি ‘হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিল আপিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের কাজে’ যোগ দিয়েছিলেন তখন তাঁর ‘মাইনে’ ছিল ‘হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা’। কিন্তু সেই টাকায় যে জীবন তিনি যাপন করতেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ‘হেনরিয়েটা’ ততদিনে পুত্রকন্যা–সহ দেশে ফিরে এসেছিলেন। হোটেল ছেড়ে ‘মধুসূদন’ ‘লাউডন স্ট্রিটে’ যে ‘বাগান ঘেরা দোতলা বাড়ি’ ভাড়া করেছিলেন, তখনকার দিনে তার ‘মাসিক ভাড়া’ই ছিল ‘চারশো টাকা’! ১৮৬০ সালে মাইকেল বিলেতে গিয়েছিলেন  ব্যারিস্টার হবেন বলে। অমিতব্যয়িতা, বড়লোকি চাল দেখানো মাইকেলের বহু দিনের স্বভাব ছিল - বলা ভালো বদ-স্বভাব ছিল। এ জন্য তিনি মাদ্রাজ, কলকাতা, লন্ডন, ভার্সাই কোথাও শান্তি পাননি। পাওনাদারদের অভিযোগে তাঁকে পুলিশ-থানা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষ পর্বে, বিশেষ করে ইউরোপ বাসকালে বিদ্যাসাগর তাঁকে যে ভাবে বারবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। ১৮৬৬ সালের ১৭ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যারিস্টারির স্বীকৃতি পান মাইকেল। সেই সুখের খবর তিনি সবার আগে জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে - “আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গত রাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বার-এ ডেকে পাঠিয়েছিল এবং আমি অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এর সব কিছুর জন্য আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর এবং তাঁর নীচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড় উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করব। আপনি না হলে আমার যে কী হতো। ... প্রিয় বিদ্যাসাগর, আপনি ছাড়া আমার কোনও বান্ধব নেই।” কিন্তু তারপর? দেশে ফিরে প্রথমে যে মধুসূদনের হাতে বিশেষ মামলা ছিল না তা কিন্তু নয়। গোড়ার দিকে তিনি যথেষ্ট মামলা পেতে শুরু করেছিলেন। তা থেকে তাঁর যে বেশ আয়ও হচ্ছিল সেটা ঐ সময়ে ‘গৌরদাস বসাক’কে লেখা তাঁর একটি চিঠি থেকে বেশ বোঝা যায়। মধুসূদন তাঁকে লিখেছিলেন, “I am afraid, old Fellow, I shall not be able to go to your part of the world this time, unless very dearly paid for. I have work (criminal) almost everyday and you know I am bound to make as much money as I can and not to neglect work for pleasure.” কিন্তু আইনব্যবসায়ে মধুসূদনের সূচনা আশাপ্রদ হ’লেও তিনি এই ব্যবসায়ে আশানুরূপ উন্নতি করতে পারেন নি। যে ‘মনোমোহন ঘোষ’ ইংল্যাণ্ডে মধুসূদনের সহচর ছিলেন, তিনি ‘আই. সি. এস.’ পরীক্ষায় বিফল হওয়ায় তাঁর ব্যারিস্টারি শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন, “I suppose poor Monu will have to take to the Bir; but then the question is-has he abilities enough to succeed in that? Does he know English enough to address an English jury for hours in the teeth of English opposition without breaking down?” একথা সত্যি যে, সে যুগে মধুসূদনের মতো ইংরেজী-জানা ভারতীয় অতি অল্পই ছিলেন। কিন্তু ইংরেজী জানাই যে ব্যারিস্টারি ব্যবসায়ের প্রধান কথা নয়, তা মনোমোহন ঘোষই প্রমাণ ক’রে দেখিয়েছিলেন। মনোমোহন ঘোষ ব্যারিস্টারি ব্যবসায়ে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় সুপণ্ডিত ও সুবক্তা মধুসূদন তাতে সাফল্য লাভ করেন নি। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টের’ সম্পাদক লিখেছিলেন, “nurshed on the lap of poetry he (মধুসূদন) was not the man to suck the moisture of life from the dry bones of law.” তাঁর ব্যারিস্টারি-ব্যবসায়ের প্রধান অন্তরায় ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। মধুসুদনের কৈশোর ও যৌবনের সেই মধুর কণ্ঠস্বর আর ছিল না - দূর মাদ্রাজ প্রবাসেই বসন্ত রোগের ফলে বা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে সেটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা করার সময় তাঁর ভগ্ন কণ্ঠস্বর বিচারকদের কাছে প্রীতিকর মনে হতো না। তাছাড়া বিচারকদের মনস্তুষ্টি সাধনের চেষ্টা করা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। তিনি অনেক সময় বিচারকদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক ও বাদানুবাদ করতেন এবং তাঁদের মুখের উপর রূঢ় সত্য কথা বলতেও কুণ্ঠিত হতেন না। একবার বিচারপতি ‘জ্যাসন’ তাঁর উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা করা নিয়ে বিরক্ত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “The Court orders you to plead slowly, the Court has ears.” মধুসূদন সঙ্গে সঙ্গে সেটার জবাব দিয়েছিলেন, “But pretty too long, my Lord.” (ইংরেজীতে “লম্বা কান আছে” বলার অর্থ গাধার সঙ্গে তুলনা করা)। তাঁর বন্ধু ‘গৌরদাস’ তাঁকে বিচারকদের সঙ্গে বাদানুবাদ না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “Michael can neer brook anybody’s bullying.” তার ওপরে ছিল মধুসুদনের সাহিত্য ও নাটকের নেশা। সাহিত্যালোচনা বা নাট্যাভিনয় সম্পর্কে আলোচনা পেলে মধুসূদন মামলার কথা ভুলে যেতেন৷ তখন তিনি নিজের সাহিত্যিক ও নাট্যরসিক বন্ধুদের নিয়ে মেতে উঠতেন। এইসব নানা কারণে মধুসূদন ব্যারিস্টারি ব্যবসায়ে আশানুরূপ উন্নতি করতে পারেন নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যদি অমিতব্যয়ী না হতেন, তবে তিনি যা আয় করতেন, তাতে তাঁর অসুবিধা হ’তো না কিন্তু তিনি যে রাজোচিত মন নিয়ে জন্মেছিলেন, তাতে ‘মিতব্যয়িতা’ ব’লে কোনও শব্দের স্থান ছিল না। তাই অর্থচিন্তা তাঁর অন্যান্য চিন্তাকে সর্বদাই আচ্ছন্ন করে রাখতো। আইন-ব্যবসায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যে দীর্ঘ ধৈর্য্য ও সংযমের প্রয়োজন হয়, সেটাও মধুসূদনের মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না। ইংল্যাণ্ডে কয়েক বৎসর অত্যন্ত উদ্বেগ ও অশান্তির মধ্যে কাটানোর ফলে মধুসুদনের শারীরিক ও মানসিক শক্তিও অত্যধিক পরিমাণে হ্রাস পেয়েছিল। ‘ভূদেব মুখোপাধ্যায়’ বিলাত-প্রত্যাবৃত মধুসূদন সম্পর্কে লিখেছিলেন - “বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া মধু একবার আমার সহিত চুঁচুড়ার বাটীতে দেখা করিতে আসিয়াছিল। তখন তাঁহার পূর্বের মত চেহারা ছিল না। চক্ষু আর সেরূপ সমুজ্জ্বল ছিল না, পূর্বের মত সেই অতি সুমিষ্ট স্বর এক্ষণে অন্যরূপ ধারণ করিয়াছিল, ঠোট পুরু এবং শরীরও স্থূল হইয়াছিল। মধুর পোশাক সাহেবী, কিন্তু আমার সহিত কথাবার্তার পর কিরূপ মনের ভাব উপস্থিত হওয়ায় মধু কাপড় চাহিল, বলিল, ‘আমাকে কাপড় দেও, আমি কাপড় পরিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া খাইব।’ ঐ সময়ে মধুর মনে কি ভাব উপস্থিত হইয়াছিল তাহা ঠিক বলা যায় না। বোধ হয়, আমার মনে তখন যাহা হইয়াছিল তাঁহার মনেও তাহাই হইয়া থাকিবে। আমার মার কথা মধুর স্মরণ হইয়া থাকিবে, কিন্তু আমি সে সময়ে মুখ ফুটিয়া তাঁহার নিকট আমার মার নাম আনিতে পারিলাম না, কারণ এ মধু আর সে মধু ছিল না। সে মধু প্রকৃতির হস্ত-বিনির্মিত প্রোজ্জ্বল প্রতিভাসম্পন্ন এবং যশো লিপ্স পবিত্র মানবরত্ন ছিল, কিন্তু এ মধু এক্ষণে বিজাতীয় শিক্ষা ও সংসর্গে বিকৃত, অনুকরণাধিক্যে মলিনীকৃত এবং কবির চক্ষে ‘নিমে দত্তের’ আদৰ্শীভূত।” ভূদেববাবুর এই বর্ণনা অতীব সত্যি ছিল। যে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে মধুচক্র রচনা করেছিলেন, বিলাত-প্রত্যাগত মধুসূদন আর সেই মধুসূদন ছিলেন না। তাঁর সৃজনীশক্তি তখন সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছিল, তবে পূর্বের মতো তিনি এখনও নাট্যামোদী ছিলেন। বিলাত থেকে ফেরার পরে মধুসূদন আইন ব্যবসায়, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাহিত্য-চর্চা, হোটেলে বন্ধুদের প্রীতিভোজে আপ্যায়ন, বন্ধুদের বাড়িতে বা বাগানবাড়িতে প্রীতিভোজ, সমাদর নংবর্ধনা লাভ এবং নাট্যাভিনয় নিয়ে মেতে থাকতেন৷ এক বছরের মধ্যে তাঁর মাসিক আয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। তিনি মফস্বলেও মামলা চালাতে যেতেন, ফলে বঙ্গদেশের নানা জায়গাতেই বিপুলভাবে অভ্যর্থিত হতেন৷ কিন্তু যে কারণেই হোক, এর বেশি আর তাঁর আয় বাড়েনি। বরং তাঁর পশার ও আয় ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল। অন্য পক্ষে, আয় হিসাবে ব্যয় করতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি যা আয় করতেন, তাতে তাঁর হোটেলের ব্যয়, ফ্রান্সে পত্নী ও পুত্রকন্যাদের নিয়মিত টাকা পাঠানো, অরুপণ দান ও বকশিস প্রভৃতির জন্যে বিপুল অর্থ সঙ্কুলান সম্ভব ছিল না। তিনি স্পষ্টই বলতেন, বছরে চল্লিশ হাজার টাকার কমে কোন ভদ্রলোকের চলা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যারিস্টারি ব্যবসায়েও তাঁর সর্বোচ্চ আয় কখনো বছরে বিশ হাজার টাকার উপরে ওঠেনি। ফলে তিনি সর্বদাই ঋণ সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্যে বিদ্যাসাগরের দ্বারস্থ হতেন। বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে এতটাই স্নেহের চোখে দেখতেন যে, তাঁর সকল অবিবেচনাই তিনি ক্ষমা করতেন। তিনি মধুসূদনের জন্যে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির বাইরের অংশ সজ্জিত ক’রে রেখেছিলেন। কিন্তু মধুসূদন সাহেব-পাড়ায় সাহেবী কেতায় হোটেলে ওঠায় যে অবিবেচনা এবং বিদ্যাসাগরের পরামর্শের প্রতি যে উপেক্ষা দেখিয়েছিলেন, তা যে কোন সাধারণ মানুষকে মধুসূদনের প্রতি বিরূপ করতে যথেষ্ট ছিল। মধুসূদনের অমিতব্যয়িতা, তাঁর পাশ্চাত্য সমাজের অনুকরণের আধিক্য, তাঁর অপরিমিত মদ্যপান, সব কিছুই বিদ্যাসাগর অত্যন্ত ক্ষমার চক্ষেই দেখতেন । বিদ্যাসাগরের সেই মনোভাব সম্পর্কে গৌরদাস লিখেছিলেন, “In writing this part of Modhu’s account in relation to Vidyasagar I can say that Vidyasagar’s goodness of heart was not the only cause of his kind offices to Modhu. He knew that Modhu was a genius and was no ordinary character. He was a man far above his countrymen. He was sure to leave a stamp behind, and to die in competency, if not in rolling wealth.” কিন্তু বিদ্যাসাগরের সেই ধারণা ও আশা পূর্ণ হয় নি। পরে তিনি তাই হতাশ হয়ে বলেছিলেন, “তাঁকে ঈশ্বরচন্দ্র কেন, ঈশ্বরও রক্ষা করতে পারবেন না।” তবে মধুসূদনের অমিতব্যয়িতা তাঁর নিজের ভোগবিলাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর দানশীলতাও ছিল অপরিসীম। তিনি ভৃত্যদের সাধারণ কাজের জন্যেও প্রায়ই বকশিস দিতেন এবং সে বকশিস কখনো দশ টাকার নিচে নামতো না। তাঁর মুক্তহস্ততা সম্পর্কে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। একদিন তিনি একটি ঠিকা গাড়িতে ক’রে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে একটি মোহর দিয়েছিলেন। সেই অপব্যয় সম্পর্কে সাবধান হওয়ার জন্যে বিদ্যাসাগর (যিনি দানের জন্য চিরস্মরণীয়) তাঁকে উপদেশ দিলে মধুসূদন তাঁকে বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর, আজ দু’দিন ধরে ঐ গাড়োয়ান আমাকে গাড়িতে ক’রে নানা জায়গা নিয়ে গেছে। ওকে আর এমন কি বেশি দিলাম?” একবার একজন নিজের অভাব অনটনের কথা জানিয়ে মধুসূদনের কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। মধুসূদন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পকেটে যা ছিল, সব তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় ঐ জায়গায় তাঁর এক বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তিনি মধুসূদনকে বলেছিলেন, “ওকে কত দিলেন?” মধুসূদন তাঁকে বলেছিলেন, “Raj Narayan Dutt’s son never counts money.” তৎকালীন ‘সমাজ-দর্পণ’ কাগজের সম্পাদক মধুসূদনের চরিত্র সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি মধুসূদনকে ‘অলিভার গোল্ডস্মিথের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আসলে ‘গোল্ডস্মিথ’ও ঐরূপ অমিতব্যয়ী ছিলেন এবং অমিতব্যয়িতার ফলে তিনি অর্থসংকটে পড়লে ‘ডঃ স্যামুয়েল জনসন’ অর্থ সাহায্য দিয়ে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও তাঁকে উদ্ধার করতে পারেন নি। ‘সমাজ-দর্পণ’ সম্পাদক লিখেছিলেন, “মাইকেল অসাধারণ মুক্তহস্ত ছিলেন। তিনি কখন কখন স্পষ্টই বলিতেন, ৪০,০০০ চল্লিশ হাজার টাকা বৎসরে না হইলে ভদ্রলোকের কিরূপে চলিতে পারে? আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি, মাইকেলের অনেকটা ধরন গোল্ডস্মিথের সহিত এক হয়। গোল্ডস্মিথ কখনও শান্তিভোগ করিতে পারেন নাই। আমোদ প্রিয়তা বিষয়ে মাইকেল তাঁহার অপেক্ষা অতিরিক্ত বলিয়া বোধ হয়। গোল্ডস্মিথ উলঙ্গ হইয়া অর্থীকে সর্বস্ব দান করিতেন; আমাদের মাইকেলও ঐরূপ ছিলেন। ঘরে খাবার নাই, স্ত্রী পরিবারের ভরণ-পোষণ নির্বাহিত হওয়াই ক্লেশকর, অথচ মাইকেলের দানশক্তি কমে না। ... আমরা এস্থলে ইহাও বলি যে, মাইকেল গোল্ডস্মিথের অপেক্ষা উন্নতমনা ছিলেন। যে জনসন তাঁহার এত উপকার করিতেন, গোল্ডস্মিথ তাঁহারই ঈর্ষা ও নিন্দা না করিয়া থাকিতে পারিতেন না৷ আমাদের মাইকেল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট উপকৃত হইয়া চিরকাল তাঁহার আনুগত্য স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।” মাদ্রাজে ও ইংল্যাণ্ডে দীর্ঘকালের দৈন্যদশাও মধুসূদনকে অর্থ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারেনি। তিনি যখন মাদ্রাজে ছিলেন, তখন ছিলেন অপরিচিত যুবক। কিন্তু তিনি যখন ইংল্যাণ্ডে ছিলেন, তখন ছিলেন সুবিখ্যাত কবি এবং জমিদারির মালিক । বিদ্যাসাগরের কৃপায় তিনি বহু হাজার টাকা ঋণ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই ঋণ পাওয়ার সুযোগ এবং ব্যারিস্টারি ব্যবসায় থেকে অদূর ভবিষ্যতে বিপুল অর্থোপার্জনের আশা তাকে আরও অমিতব্যয়ী ক’রে তুলেছিল। তিনি কেবল বিদ্যাসাগরের মারফতই নয়, অন্যান্য যে কোনও সুত্রে ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকলেই ঋণ গ্রহণ করতেন। পুরাতন ঋণ শোধ করাও যে একান্ত প্রয়োজন, সে বোধটুকুও যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি প্রচুর ঋণের বোঝা নিয়েই ইউরোপ থেকে দেশে ফিরেছিলেন। বিদ্যাসাগরের পরামর্শ না শুনে স্ত্রী এবং পুত্র কন্যাকে ইউরোপে রেখে এসেছিলেন এবং এখানে বাসা ভাড়া ক’রে না থেকে হোটেলে উঠেছিলেন। ফলে আর্থিক সংকট, মানসিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা তার চিরসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। দেশে ফেরার প্রথম বৎসর থেকেই তিনি এখানে আবার ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। অন্য কোনও উপায়ে ঋণলাভ সম্ভব না হলে বিদ্যাসাগরের কাছেই ছুটতেন৷ বিদ্যাসাগরকে তাঁর জন্য ঋণ সংগ্রহ ক’রে দেওয়ার জন্যে বার বার অনুরোধ করতে তাঁর বিন্দুমাত্রও দ্বিধা, কুণ্ঠা, সংকোচ, লজ্জা কিছুই ছিল না। বাঙালি জাতি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশের প্রথম থেকেই দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছিল, তবু নিজের অবিবেচনা ও অমিতব্যয়িতা তাঁকে যে বিপদের মধ্যে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সে বিষয়ে সতর্ক না হয়ে তাঁর প্রতি নির্দয়তার দায়ে দায়ী ক’রে বাঙ্গালী জাতিকে তিরস্কার করতেও তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নি।

                                     ©️রানা©️

মধুসূদনের অমিতব্যায়িতা, তাঁকে বিদ্যাসাগরের সাহায্য, তাঁর বিলাসবহুল জীবন, ধারের টাকায় ঘি খাওয়া - এসব নিয়ে লিখতে বসলে একটা আস্ত বই লিখে ফেলা যায়। কিন্তু স্থানাভাবে এখানে সবকিছু বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। একটা সময়ে মধুসূদন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ করার জন্য বিদেশে টাকা পাঠাতে পারছিলেন না। শেষে ১৮৬৯ সালের মে মাসে তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে দেশে ফেরত চলে আসেন। সেই সময়ে ব্যারিস্টারি-ব্যবসায়ে মধুসূদনের আয়ের কোনও নিশ্চয়তা ও পরিমাণের স্থিরতা ছিল না। তাই কোনও বেশি মাইনের সরকারী চাকরির কথা মধুসূদন মাঝে মাঝে চিন্তা করতেন। হেনরিয়েটা কলকাতা আসার কিছুদিন আগে মধুসূদন ঐ রকম চেষ্টা একবার করেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ঐ সময়ে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিলে আপীলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদ শূন্য হয়েছিল। মধুসূদন ঐ পদে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের গোড়ার দিকে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই পদের বেতন ছিল প্রায় দেড় হাজার টাকা। ব্যারিস্টারিতে তিনি চেষ্টা করলে ঐ টাকা উপার্জন করতে পারতেন একথা সত্যি। কিন্তু তাতে তিনি বিশ্রামের অবকাশ পেতেন না। তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্যে কিছু বিশ্রামের প্রয়োজনও ছিল। সামান্য বিশ্রাম হয়তো তিনি পেয়েছিলেনও। কিন্তু স্বাস্থ্য উদ্ধারের পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল না। দেশে ফেরার প্রথম বছর থেকে, ১৮৬৭ সালের নভেম্বর থেকে, তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, সেই সঙ্গে গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছিল। কিছু অর্থ সংগ্রহের জন্যে তিনি সেই সময় তাঁর গদ্যে লেখা উপাখ্যান ‘হেক্টর-বধ’ ছাপতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর সাহিত্য প্রতিভা একেবারে নিভু নিভু। তাই ‘হেক্টর-বধ’ সাহিত্য জগতে তেমন কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। তাঁর শেষ চেষ্টা ছিল, সংসারে ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা। সে চেষ্টাও তিনি করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার সেটা হয়ে গিয়েছিল। কোন উপায় না দেখে, ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মধুসূদন আবার ব্যারিস্টারি শুরু করেছিলেন। কিন্তু তখন মধুসূদন ছিলেন মধুসূদনের স্মৃতিমাত্র। মধুসূদন আবার যখন ব্যারিস্টারি শুরু করেছিলেন, তখন তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। তখন তিনি কণ্ঠনালীর প্রদাহ, হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা, প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি, জ্বর ও রক্ত বমন প্রভৃতি নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে ব্যারিস্টারি ব্যবসা একেবারে বন্ধ করতে হয়েছিল৷ তাঁর দারিদ্র্য চরমে এসে পৌঁছেছিল। রোগের চিন্তা, ঋণের চিন্তা, অভাব-অনটন তাঁর ভগ্ন দেহ-মনকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে চুরমার ক’রে দিয়েছিল। সেই দুঃসহ অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষা করবার পথ না দেখেই তিনি যেন মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করবার জন্যেই নিজের শরীরের উপরে আরও অত্যাচার করতে শুরু করেছিলেন। একদিন ব্যারিস্টার ‘মনোমোহন ঘোষ’ দুপুরবেলা মধুসূদনের বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলেন যে, মধুসূদন দোর-জানালা বন্ধ ক’রে দিয়ে নির্জলা উগ্র মদ গেলাসের পর গেলাস খাচ্ছেন। মনোমোহন আঁতকে উঠে তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি এ কি করছেন?” মধুসুদন তাঁকে বলেছিলেন, “জানি, এভাবে মদ খাওয়া ও আত্মহত্যা করা একই কথা। কিন্তু অন্য উপায়ে আত্মহত্যার চেয়ে এতে কষ্ট অনেক কম। This is a process equally sure, but less painful.” সেই সময়, মধুসুদনের সংস্কৃত পণ্ডিত রামকুমার বিদ্যারত্ন প্রায়ই তাঁকে দেখতে আসতেন। পরে তিনি বলেছিলেন যে, এক-একদিন মধুসুদন এতো রক্ত বমন করতেন যে, এক-একটা বড় পাত্র ভ’রে যেতো। ডাক্তার ‘গুডিভ চক্রবর্তী’ তাঁকে ‘ব্র্যাণ্ডি’ খেতে নিষেধ করলে তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে, মরলেও তিনি ব্র্যাণ্ডি ছাড়তে পারবেন না। সেই সময় মধুসূদন তাঁর আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি তাঁর সমাধির জন্যে তাঁর বিখ্যাত সমাধিলিপিটি (epitaph) রচনা করেছিলেন -

“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে

(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত

দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসুদন!

যশোরে সাগরদাড়ী কবতক্ষ তীরে

জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি

রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।”

সেই সময়ে মধুসূদনের মনের স্থিরতা একদম ছিল না। তিনি কবিতাটি লিখে একটা ছেঁড়া কাগজের চুপড়িতে ফেলে দিয়েছিলেন। মধুসূদন কন্যা ‘শর্মিষ্ঠা’ সেটা দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে রেখেছিলেন। তাঁর আর একটি সুন্দর কবিতা তিনি একটি খামের উপর লিখে ফেলে দিয়েছিলেন। সেটি তাঁর ক্লার্ক ‘কৈলাসচন্দ্র বসু’ কুড়িয়ে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। সেই কবিতাটি মধুসূদনের মৃত্যুর বহু পরে, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে, ‘আর্য দর্শন’ কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি ছিল -

“ভেবেছিনু মোর ভাগ্য, হে রমাসুন্দরি,

নিবাইবে সে রোষাগ্নি, - লোকে যাহা বলে,

হ্রাসিতে বাণীর রূপ তব মনে জ্বলে; -

ভেবেছিনু হায়! দেখি, ভ্রান্তিভাব ধনি!

ডুবাইছ, দেখিতেছি, ক্রমে এই তরী,

অদয়ে, অতল দুঃখ-সাগরের জলে

ডুবিনু; কি যশঃ তব হবে বঙ্গ-স্থলে?”

সেই সময়ে, ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে, কলকাতার বিখ্যাত ধনী ‘আশুতোষ ঘোষের’ (‘ছাতুবাবু’) দৌহিত্র ‘শরৎচন্দ্র ঘোষ’ কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে পাশ্চাত্য নাট্যশালার অনুকরণে একটি সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হন৷ সেই রঙ্গমঞ্চের নাম ‘বেঙ্গল থিয়েটার'। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নাট্যাভিনয় ও নাট্যশালা সম্পর্কে মধুসূদনের উৎসাহের সীমা ছিল না। শরৎবাবুরা প্রায়ই মধুসুদনের পরামর্শ নিতে আসতেন। তখন পর্যন্ত নাটকের স্ত্রীভূমিকাগুলিতে পুরুষরাই অভিনয় করতেন। মধুসূদন তাঁদের স্ত্রীভূমিকাগুলি স্ত্রীলোকদের দিয়ে অভিনয় করাতে বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শ অনুসারেই ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এদেশে সর্বপ্রথম স্ত্রীভূমিকাগুলি স্ত্রীলোকদের দিয়ে অভিনয় করাবার ব্যবস্থা করেছিল। মধুসূদন সেই দুরন্ত রোগশয্যায় শুয়ে শুয়েও তাঁদের জন্যে নাটক লিখে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র সেই নাটক লেখার জন্য ও তাঁর চিকিৎসায় সাহায্যের জন্যে অগ্রিম টাকাও দিয়েছিলেন। সেই সময় মধুসূদন বেঙ্গল থিয়েটারের জন্যে ‘মায়াকানন’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন এবং ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ নামে একটি নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন - সেই নাটকখানি তিনি শেষ ক’রে যেতে পারেন নি। মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে নাটক নিয়েই প্রবেশ করেছিলেন। তিনি নাটক দিয়েই বাংলা সাহিত্য থেকে কেন, এই ধরাধাম থেকেই চিরবিদায় নিয়েছিলেন। সাধারণ রঙ্গমঞ্চ ও জাতীয় রঙ্গশালার স্বপ্ন মধুসূদনের বহুদিনের ছিল। কিন্তু ঐ স্বপ্ন যে বাস্তবায়িত হয়েছে তা তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ছ’মাস পরে, ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট, ‘বেঙ্গল থিয়েটার’-এর উদ্বোধন হয়েছিল তাঁর লেখা ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে। ঐ নাট্যাভিনয় মধুসূদনের অনাথ পুত্রদের সাহায্যকল্পেই করা হয়েছিল। ‘মায়াকানন’ নাটকখানি ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ মঞ্চস্থ করেছিল প্রায় ন’মাস পরে, ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল তারিখে। ‘মায়াকানন’ ও ‘বিষ না ধনুর্গুণ’-এর গ্রন্থস্বত্ব ছিল বেঙ্গল থিয়েটারের, তারাই ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে ‘মায়াকানন’ প্রকাশ করেছিলেন। ইউরোপে প্রবাসকালে মধুসূদন তিনটি নীতি-কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলি চতুর্দশপদী কবিতাগুলির সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি আরও কয়েকটি নীতি-কবিতা রচনা করেছিলেন - ‘সিংহ ও মশক’, ‘কুক্কুট ও মণি’, ‘গদা ও সদা’ ‘মেঘ ও চাতক’ ইত্যাদি৷                                 

১৮৬৯ সাল থেকে মধুসূদনের জীবন-নাট্যের শেষ দৃশ্যগুলি দ্রুত যবনিকার দিকে এগিয়ে চলেছিল। রোগ, ঋণ ও অভাবের যন্ত্রণায় তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি একবার মাস তিনেকের জন্যে গঙ্গাতীরে উত্তরপাড়ার গ্রন্থাগার ভবনের দোতালায় ছিলেন। মধুসূদনকে সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাকবার জন্যে ‘উত্তরপাড়ার জমিদার’ ‘জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’ আমন্ত্রণ জানালে মধুসূদন উত্তরপাড়ার গ্রন্থাগারে গিয়ে কিছুদিন ছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁর শরীর বা মনের কোনও উন্নতি হয়নি। তিনি দুর্বল ও চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। তার ওপরে ‘হেনরিয়েটা’-ও তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। প্রবল জ্বরে তিনিও শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই সময়কার একদিনের ঘটনা নিয়ে ‘গৌরদাস’ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, “I shall never forget the heart-rending sight I witnessed on the last occasion on which I visited Modhu in the rooms of the Uttarparah Public Library, where he was staying for a change. He was in bed, gasping under the excruciating effects of his disease, blood oozing from his mouth, his wife lying in high fever on the floor. Seeing me enter the room, Modhu sat up a little and burst into tears. The pitiable condition of his wife had unmanned him, he heeded not his own pangs and suffering; ‘afflictions in battalion’ were the words he uttered. I knelt down to feel her pulse and temple; she pointed with her finger towards her husband, heaved a deep sigh and sobbed out in a low voice, ‘Look to him, tend him, leave me alone, I care not to die.’ ...” উত্তরপাড়ায় রোগের কোন প্রশমন হচ্ছে না দেখে মধুসূদন তাঁর বেনিয়াপুকুরের বাসায় ফিরে এসেছিলেন। এখানে তাঁরা মাত্র দু’সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন। বেনিয়াপুকুরের বাসায় মধুসূদনের সুচিকিৎসা হওয়া সম্ভব নয় বুঝে তাঁর বন্ধুরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টার ‘উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’, ব্যারিস্টার ‘মনোমোহন ঘোষ’, মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার ‘সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী’ ও মধুসূদনের অন্যান্য বন্ধুরা পরামর্শ ক’রে তাঁকে আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। জেনারেল হাসপাতালে তখন এদেশীয়দের চিকিৎসা করা হতো না - কেবলমাত্র ইউরোপীয়দেরই চিকিৎসা করা হ’তো। কিন্তু ডাক্তার ‘গুডিভ চক্রবর্তী’ এবং মধুসূদনের কয়েকজন পদস্থ ইংরেজ বন্ধুর চেষ্টায় তাঁকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়েছিল। ঐ সময় বিখ্যাত ডাক্তার ‘জে. ডাব্‌লিউ. পামার’ জেনারেল হাসপাতালের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি আগে মধুসূদনের বাড়িতে চিকিৎসা করতেন এবং মধুসুদনের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট সৌহার্দ্য ছিল। তাই জেনারেল হাসপাতালে মধুসূদনের সুচিকিৎসা ও সেবার কোনও ত্রুটি হয়নি মধুসূদনের জীবনীকার ‘যোগীন্দ্রনাথ বসু’ লিখেছিলেন, “তাঁহারা যদি কোনরূপে মধুসূদনের দাতব্য চিকিৎসালয়ে মৃত্যুবরণ নিবারণ করিতে সক্ষম হইতেন, তাহা হইলে বঙ্গসমাজ একটি গুরুতর লজ্জা হইতে রক্ষা পাইত। বঙ্গদেশের আধুনিক সময়ের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কবি যে অনাথ ও ভিক্ষুকদের সঙ্গে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, পরে কবির স্বর্ণময় প্রতিমূর্তি স্থাপন করিলেও এ কলঙ্ক মোচন হইবে না।” যোগীন্দ্রনাথের এই উক্তি সমীচীন নয়। জেনারেল হাসপাতাল অনাথ ও ভিক্ষুকদের হাসপাতাল ছিল না; সেখানে শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। তাছাড়া ঐ হাসপাতাল তখন এদেশে সর্বাপেক্ষা সুচিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত ছিল। সে যুগে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ মধুসূদনই ঐ হাসপাতালে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। সুতরাং মধুসূদনের সুচিকিৎসার কোনও ত্রুটি হয়নি বা তাঁর সম্মানের কোনও হানি হয়নি। ঐ অবস্থায় তার বন্ধুরা যা করেছিলেন, তার চেয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব ছিল না। তাই যোগীন্দ্রনাথের এই খেদ নিতান্তই যুক্তিহীন। মধুসূদনকে ১৮৭৩ সালের জুন মাসের শেষভাগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সেখানে সর্বপ্রকার সুচিকিৎসার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত জীর্ণ দেহ সুস্থ হয়নি। মধুসূদনের অবস্থা ক্রমেই মন্দের দিকেই গিয়েছিল। ২৬শে জুন হেনরিয়েটা মারা যান। মাইকেল এই সংবাদ এক পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারেন। ২৯শে জুন রবিবার, মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এসেছিল। শেষে বেলা দুটোর সময় চিরঘুমের দেশে চলে গিয়েছিলেন মধুসূদন। তাঁর সেই মৃত্যুর পরেই সবকিছু শেষ হতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি। কবির নশ্বর দেহটা তখনও এই ধরাধামে ছিল। মৃত্যুর পর মাইকেলের শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে সমাহিত করার জন্য মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। ফলে তাঁর মরদেহে পচন ধরেছিল। অবশেষে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন ‘অ্যাংলিকান চার্চের রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো’। বিশপের অনুমতি ছাড়াই, জার্বোর উদ্যোগে, ৩০শে জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এর চার দিন আগে সেখানেই হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির কবর খোঁড়া হয়েছিল তাঁর পাশেই। সে দিন ভক্ত ও বন্ধুবান্ধব মিলে উপস্থিত ছিলেন প্রায় এক হাজার মানুষ। কিন্তু একদিন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করে গিয়েছিলেন, সেই ভিড়ে ছিলেন না তাঁদের একজনও। নিজের জীবনের ‘ছাত্রাবস্থায়’ অঙ্কে ‘মধুসূদনের’ কোনদিন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি যে ‘গণিতে’ও ভাল করতে পারতেন ‘হিন্দু কলেজের ক্লাসে’ একবার তার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্য ছাত্ররা যে অঙ্ক করতে পারেননি, ‘মধু’ সেই অঙ্ক কষে দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছিলেন - ‘‘দেখলে তো শেক্সপিয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেক্সপিয়র হতে পারতেন না।’’ ‘বেহিসেবি মাইকেল’ নিজের ‘জীবনের অঙ্ক’ কোনও দিনই মেলাতে পারেননি, ‘ব্যারিস্টার’ হয়ে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরুর আগেই হোটেলে ‘বিলাসী জীবন’ কাটানো, নিজের পরিবারকে ‘ভার্সাই’তে রেখে আসার মতো ‘হঠকারী সিদ্ধান্ত’, ‘ধার করে ঘি খাওয়া’ - এই সব কিছুই তাঁর জীবনকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। ‘মধুসূদন’ সকলের কাছেই ‘প্রহেলিকা’ ছিলেন, ‘প্রহেলিকা’ হয়েই ‘মৃত্যুর পথে’ পা বাড়িয়েছিলেন, আর আজও ‘প্রহেলিকা’ই রয়ে গিয়েছেন!                            

(তথ্যসূত্র:

১- মধুস্মৃতি, নগেন্দ্রনাথ সোম।

২- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লব বালা।

৩- সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।)

                             

No comments