Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বর্গী হাঙ্গামার ইতিকথা’ - রানা চক্রবর্তী

‘(প্রথম পর্ব: আলিবর্দি খাঁ বনাম ভাস্কররাম কোলহটকর)                         ‘‘ছেলে ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?’’এই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি আমাদের দেশে চালু হয়েছিল মারাঠা সর্দার ভাস্কর প…

 





(প্রথম পর্ব: আলিবর্দি খাঁ বনাম ভাস্কররাম কোলহটকর)                         

‘‘ছেলে ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে। 

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?’’

এই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি আমাদের দেশে চালু হয়েছিল মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর পরে। ভাস্করকে ফাঁদে ফেলে বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খাঁ হত্যা করেছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডের জায়গা ছিল ‘পলাশী’র প্রায় ২৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ‘মানকরা’ নামক জায়গা। বর্তমানে ‘বহরমপুর ক্যান্টনমেন্ট’ থেকে জায়গাটির দূরত্ব প্রায় ৬.৪ কিলোমিটার। হত্যার তারিখ ছিল ৩১শে মার্চ, ১৭৪৪ সাল। ওই সময়টায় ভাস্কর পণ্ডিত বাঙালীর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। তবে শিশুদের ঘুমে তিনি ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেননি। কেন না, তাঁদের মৃত্যুভয় নেই! তা সত্ত্বেও তিনি বেঁচে থাকতে এরকম ঘুমপাড়ানি ছড়া সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ এ ছড়া শিশুরা সৃষ্টি করেনি, করেছিল তাঁদের মা-ঠাকুমাদের কেউ। সন্ত্রাস আর অনিদ্রায় পঙ্গু কোনো মা-ঠাকুমার মুখে ঘুমপাড়ানি ছড়া আসে না। ভাস্কর পণ্ডিত নিহত হলে বাঙালী শান্তিতে ঘুমোতে পেরেছিল। ছড়াটি সৃষ্টি হয়েছিল সেসময়। তবে বাঙালীর শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর এক বছর তিন মাস বাদে বাংলায় আবার বর্গীর উৎপাত শুরু হয়েছিল। ১৭৪৫ সালের জুন মাসে ‘নাগপুরের মারাঠা রাজা’ ‘রঘুজী ভোঁসলে’ বর্ধমানে উপস্থিত হলে বাঙালীর চোখের ঘুম আবার উবে গিয়েছিল, বাঙালী সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। বর্গীর হাঙ্গামার সময় বহু বড়োলোক বাঙালী ধন-প্রাণ-মান রক্ষার তাগিদে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কলকাতায় এসে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। কলকাতাবাসী ইউরোপীয় আর এদেশীয়দের মিলিত চেষ্টায় কলকাতাকে বর্গীর উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্যে তিন দফা কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল। যথা - (১) খাল কেটে বর্গীদের ঠেকিয়ে রাখা, (২) দুশো বন্দুকধারী ‘বসরিয়া’ প্রহরী নিয়োগ এবং (৩) পুরনো দুর্গকে মেরামত করা। পরে সেই কর্মসূচী কিছুটা রূপায়িত হওয়ার পরে পরিত্যক্ত হলেও প্রথমটি এখনো আংশিকভাবে টিকে আছে, যেন সেদিনের বর্গীর হাঙ্গামার সাক্ষি দিতে! বর্গীর হাঙ্গামার সময় কলকাতা কতটা সম্ভ্রস্ত হয়ে উঠেছিল, সেই হাঙ্গামার ফলে কলকাতার লাভ হয়েছিল, না লোকসান হয়েছিল, সেসব কথায় আসার আগে বর্গীদের সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার।

‘বর্গী’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ফরাসী শব্দ ‘বার্গীর’ থেকে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘প্রাচীন মহারাষ্ট্রীয় সৈন্য’। ‘মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের’ জীবনকালেই ‘শিবাজী’র নেতৃত্বে মোঘলদের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে মারাঠা-শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে সেই শক্তি সংগঠিত আকারে ‘চৌথ’ আদায়ের নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তাঁরা নিজেদের মনে করতো সারা দেশের অধিপতিরূপে। পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’য় হাঙ্গামাকারী বর্গীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ‘নাগপুরের অধিপতি’ ‘রঘুজী ভোঁসলে’র প্রধানমন্ত্রী ‘ভাস্কর পণ্ডিত’। ভাস্কর পণ্ডিতের আসল নাম ছিল ‘ভাস্কররাম কোলহটকর’। বাঙালীর মুখে ‘কোলহটকর’ উচ্চারণ কষ্টকর ছিল বলে সেটার বদলে ‘পণ্ডিত’ এসেছিল! আর তাঁর নামের মাঝখান থেকে ‘রাম’ উঠে গিয়েছিল! এহেন ভাস্কর পণ্ডিত আলিবর্দিকে তাঁর জীবনের শেষ দিকটায় সুখে রাজত্ব করতে দেননি। সেই বৃদ্ধ নবাবকে তিনি ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। যেটাকে বলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো, ভাস্কর পণ্ডিত ঠিক যেন তাই করেছিলেন! এবারে ১৭৪১ সালে যাওয়া যাক। আলিবর্দির পূর্বসূরি ‘নবাব সুজা খাঁ’র জামাইয়ের নাম ছিল ‘রুস্তম জঙ্গ’। সেই রুস্তম জঙ্গ যখন ‘কটকের শাসনকর্তা’ ছিলেন, ‘মীর হবিব’ তখন ছিলেন তাঁর ‘নায়েব’। মীর হবিবের জন্মভূমি পারস্য হলেও কর্মভূমি ছিল ভারতবর্ষ। তিনি আর তাঁর মনিব দু’জনেই ছিলেন নবাব আলিবর্দির বিরোধী। তাঁরা আলিবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ১৭৪১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে আলিবর্দি ‘বালেশ্বরের’ কাছে ‘ফুলবাড়ি’তে রুস্তম জঙ্গকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে কটক দখল করেছিলেন। এর পর মুর্শিদাবাদে ফেরার পথে জয়গড়ে থাকাকালে তিনি খবর পেয়েছিলেন যে নাগপুরের মারাঠা রাজা রঘুজী ভোঁসলে বাংলা জয় করার জন্যে ভাস্কর পণ্ডিতের অধিনায়কত্বে একদল সৈন্য পাঠিয়েছেন৷ সেই খবর শুনেই আলিবর্দির কটক জয়ের আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয়েছিল। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে দ্রুতবেগে বাংলার দিকে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৭৪২ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে আলিবর্দি ‘বর্ধমানে’ এসে ‘রানীর দীঘি’র ধারে শিবির স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে তিন-চার হাজার ঘোড়সওয়ার আর চার-পাঁচ হাজার বরকন্দাজ ছিল৷ ১৬ই এপ্রিল ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আলিবর্দি দেখেছিলেন বিপদ তাঁকে ঘিরে ফেলেছে চারদিক থেকে! ভাস্কর পণ্ডিতের মারাঠা বাহিনীর দ্বারা তিনি ঘেরাও হয়ে পরেছিলেন! মারাঠারা সংখ্যায় ছিল পঁচিশ হাজার কিংবা তারও বেশি! ভাস্কর পণ্ডিতের অধীনে ছিলেন চব্বিশজন সেনাপতি! তাঁদের মধ্যে থেকে দশজনকে তিনি পাঠিয়েছিলেন আশপাশের গ্রাম থেকে খাদ্য খাবার লুঠ করে আনতে। বাকি চোদ্দজনকে নিয়ে তিনি ঘিরে ছিলেন আলিবর্দিকে৷ আলিবর্দি আর তাঁর লোকজনদের খাদ্য সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই আলিবর্দির শিবিরে খাবারের জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। আলিবর্দি তখন বাধ্য হয়ে দূত মারফত ভাস্কর পণ্ডিতের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। আলিবর্দির দূতকে ভাস্কর পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘‘ভারতবর্ষ আমাদের, সমস্ত প্রদেশ আমাদের চৌথ দিচ্ছে, কেবল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ছাড়া। নবাবকে বল, এখুনি আমাকে দশ লাখ টাকা দিতে। আমি চলে যাচ্ছি।’’ আলিবর্দি চিন্তা করে দেখেছিলেন, শুধু একবার দশ লাখ টাকা দিলেই সেই আপদ বিদেয় হবে না। বছর বছর তাঁদের সেই টাকা দিতে হবে। তার চেয়ে সেই টাকাটা যদি নিজের সেনাপতি আর সৈন্যদের তিনি ভাগ করে দেন, তাঁদের উৎসাহ বাড়বে, রাজভক্তি বাড়বে। ফলে বর্গীদের দেশছাড়া করা সম্ভব হবে। তিনি তাঁর সেই মনোভাব সেনাপতিদের কাছে প্রকাশ করতেই তাঁরা তাতে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, সেনাদল নিয়ে আলিবর্দি একদিন বর্গীব্যূহ ভেদ করতে গিয়ে মাঠের মাঝখানে বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন! তাঁর সামনে ছিল বর্গী, পেছনেও ছিল বর্গী! ফলে তিনি না পারছিলেন এগোতে, না পারছিলেন পিছোতে! এর ওপরে একটা নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। তাঁর অধীনস্থ আফগান বাহিনী যুদ্ধ করতে চাইছিল না! এক প্রকার বাধ্য হয়ে আলিবর্দি তাঁর ‘আফগান সেনাপতি মুস্তাফা খাঁ’র সঙ্গে একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। আফগান বাহিনী যুদ্ধ করতে রাজী হয়েছিল। শেষে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অনেক কষ্টে আলিবর্দি কোনোরকমে ‘কাটোয়া’য় পৌঁছেছিলেন, ১৭৪২ সালের ৩০শে এপ্রিল তারিখে। কিন্তু সেখানেও খাদ্য পাওয়া যায়নি। মারাঠারা তার আগেই গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল! শেষ পর্যন্ত ‘আলিবর্দির দাদা হাজী আহমদ’ খবর পেয়ে রসদ আর সৈন্য পাঠিয়ে আলিবর্দিকে কাটোয়া থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। আলিবর্দি সে যাত্রা প্রাণে বেঁচেছিলেন। তবে তাঁর ফাঁড়া কিন্তু কাটেনি। কেন না, তখন আবার গোদের ওপর দেখা দিয়েছিল একটা মারাত্মক বিষফোঁড়া, যেটার নাম ছিল ‘মীর হবিব’।

                             ©️রানা©️

মীর হবিবের পরিচয় আগেই দেওয়া হয়েছে। রুস্তম জঙ্গের পতনের পরে তিনি আলিবর্দির বাহিনীতে যোগ দিলেও তিনি ছিলেন ঘোরতর আলিবর্দি-বিরোধী। সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবেন, এটাই ছিল তাঁর মনের ইচ্ছে। তাঁর কাছে সেই সুযোগও এসেও গিয়েছিল বর্ধমানের কাছে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মারাঠাদের হাতে বন্দী হওয়ার ফলে। তিনি মারাঠা বাহিনীতে তক্ষুণি যোগ দিয়েছিলেন। সন্দেহ করা যেতে পারে, তিনি মারাঠা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়াটা ছিল তাঁর একটা কৌশল মাত্র! ঘরশত্রু মীর হবিব তখন হয়ে উঠেছিলেন ভাস্কর পণ্ডিতের ডান হাত। তাঁকে নিয়েই আলিবর্দির ভয় বেড়েছিল বেশি। কেন না, বাংলার পথ-ঘাট সব তো ছিল তাঁর মুখস্থ! আলিবর্দির সামরিক শক্তিও ছিল তাঁর জানা! মে মাসের প্রথম দিকে, আলিবর্দি যখন কাটোয়ায় ছিলেন, মীর হবিব তখন সাতশো ঘোড়সওয়ার নিয়ে মুর্শিদাবাদের কাছে গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত ‘দাহাপাড়ার বাজার’ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গঙ্গা পার হয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকে নিজের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেসময় মুর্শিদাবাদ ছিল অরক্ষিত। ফিরে যাওয়ার আগে ৫ই মে তারিখে তিনি‘ ফতেচাঁদ’ ‘জগৎশেঠের’ বাড়িসহ আরো কয়েকজন ধনীলোকের বাড়ি লুঠ করেছিলেন। আলিবর্দি খবর পেয়ে মুর্শিদাবাদে আসতেই মারাঠারা কয়েকটি গ্রাম লুঠ করে ৭ই মে তারিখে কাটোয়ায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এর পর গঙ্গার পশ্চিমপারে তাঁরা অবাধে লুঠতরাজ ও অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল। তাঁদের সেই অত্যাচারের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের’ ‘চিত্রচম্পু’ কাব্যে আর ‘কবি গঙ্গারাম’ রচিত ‘মহারাষ্ট্র-পুরাণে’। ‘গঙ্গারাম’ লিখেছিলেন -


‘‘ছোট বড় গ্রামে জত লোক ছিল।

বরগির ভএ সব পলাইল৷৷

চাইর দিগে লোক পলাএ ঠাঞি ঠাঞি।

ছর্ত্তিস বর্ণের লোক পলাএ তার অন্ত নাঞি৷৷

এই মতে সব লোক পলাইয়া জাইতে।

আচম্বিতে বরগি ঘেরিল আইসা তাথে৷৷

মাঠে ঘেরিয়া বরগি দেয় তবে সাড়া৷

সোনা রূপা লুটে আর নেএ সব ছাড়া৷৷

কারূ হাত কাটে কারূ নাক কান।

একি চোটে কারূ বধএ পরাণ৷৷

ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত ধইরা লইয়া জাএ।

আঙ্গুষ্টে দড়ি বাধি দেয় তার গলাএ৷৷

একজনা ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।

রমণের ভরে ত্রাহি সব্দ করে৷৷

এই মতে বরগি কত পাপকৰ্ম্ম কইরা।

সেই সব স্ত্রিলোকে জত দেয় সব ছাইড়া৷৷

তবে মাঠে লুটিয়া বরগি গ্রামে সাধাএ।

বড় বড় ঘরে আইসা আগুন লাগাএ৷৷’’


জুন মাসে মীর হবিব হুগলি দখল করেছিলেন। ফলে কলকাতার ইংরেজরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন। নিজেদের আর আশ্রিতদের ধন-প্রাণ রক্ষাই তখন তাঁদের কাছে প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল। তাঁরা বাণিজ্য ভুলে গিয়েছিলেন। আলিবর্দি আর নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা রাখতে না পেরে তাঁরা মীর হবিরের সঙ্গে আগাম একটা চুক্তি করেছিলেন। তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় সবার মনে ধারণা হয়েছিল যে কলকাতায় গেলে প্রাণ বাঁচবে, ধন বাঁচবে, মান বাঁচবে। বিশেষ করে ধনীলোকেরা, যাঁদের হারানোর ভয় ছিল বেশি, তাঁরাই বেশি করে এসে ভিড় জমিয়েছিলেন কলকাতায়। ধরতে গেলে বর্গীরাই কলকাতার নবজন্ম দিয়েছিল, কলকাতাকে ধনী শহরে পরিণত করেছিল। সমৃদ্ধির পথে তাড়াতাড়ি এগোতে শুরু করেছিল কলকাতা৷ তবে বর্গীরা বাংলার বর্ষাকে যমের মতন ভয় পেতো। তাই বর্ষা পড়লেই তাঁরা দেশে ফিরে যেতো, আবার বর্ষা শেষ হলেই এসে জাঁকিয়ে বসতো। বর্ষা আসছে দেখে ১৭৪২ সালের জুন মাসে ভাস্কর পণ্ডিত দেশের পথে রওনা হয়ে বীরভূম পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু মীর হবিব তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কাটোয়া হয়েছিল মারাঠাদের আঞ্চলিক রাজধানী। রাজমহল থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত গঙ্গার পশ্চিমপার হয়েছিল তাঁদের নতুন রাজ্য। ভাস্কর পণ্ডিত হয়েছিলেন নতুন শাসক আর মীর হবিব হয়েছিলেন তাঁর নতুন প্রধানমন্ত্রী তথা প্রধান সেনাপতি। মীর হবিব কিভাবে হুগলি দখল করেছিলেন, সেই বিষয়ে একটি গল্প আছে। গল্পটি হল - তখন হুগলির ফৌজদার ছিলেন ‘মোহম্মদ রেজা’। ফৌজদারি বলতে তিনি কেবল বুঝতেন কেবল মদ, মাংস আর মেয়েছেলে। দিনরাত তিনি নেশায় চুর হয়ে থাকতেন। সেই সময় হুগলিতে থাকতেন মীর হবিবের এক বন্ধু। তাঁর নাম ছিল ‘মীর আবুল হাসান’। তিনি হুগলিতে ব্যবসা করতেন। তাঁর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মীর হবিব মারাঠা সেনাপতি শেষ রাওয়ের শরণ নিয়েছিলেন। শেষ রাও মোহম্মদ রেজাকে শেষ করতে রাজী হয়েছিলেন। এক রাত্রে হুগলি দুর্গের মধ্যে মোহম্মদ রেজা নেশায় বুঁদ হয়ে বাইজির নাচ দেখছিলেন। এমন সময় আবুল হাসান এসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার পুরনো দোস্ত মীর হবিব আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। জরুরী বার্তা আছে।’’ রেজা সাহেব তখন ঘোরের মধ্যে ছিলেন। মীর হবিব তাঁর বন্ধু না শত্রু সেটা বিবেচনা না করেই তিনি হুকুম দিয়েছিলেন, ‘‘নিয়ে এস।’’ মীর হবিব তো আসার জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। দুর্গের গেট খুলে যেতেই তিনি আর শেষ রাও দু’হাজার অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন দুর্গের ভেতরে। দুর্গের সবাইকে তাঁরা বন্দী করেছিলেন। হুগলি দুর্গের পতন হয়েছিল। হুগলি থেকে কয়েকটি কামান আর একটি ‘সুলুপ’ - যেটাকে বলা হতো যুদ্ধজাহাজ, সেটা নিয়ে মীর হবিব কাটোয়ায় রেখেছিলেন আর সেখানে সেগুলো দিয়ে তিনি মারাঠাদের শক্তি বাড়িয়েছিলেন। এরপরে তিনি মারাঠাদের পক্ষে থেকে দেওয়ানের কাজ করেছিলেন। তাঁর মূল কাজ ছিল জমিদারদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা।

শেষ পর্যন্ত সব কিছু মনে হয় আলিবর্দির সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল। তিনিও চুপ করে বসেছিলেন না। তিনি কি করতে পারেন সেটা ভাস্কর পণ্ডিত টের পেয়েছিলেন ১৭৪২ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে। জায়গাটা ছিল ‘ডাঁইহাট’, ‘কাটোয়া’। সেদিন সেখানে ভাস্কর পণ্ডিত দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। তিথির হিসাবে দিনটা ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লা নবমী। তখন সবে ভোর হয়েছিল। ভস্কর পণ্ডিত দেখেছিলেন দুর্গাপুজো করতে গিয়ে তাঁর সর্বনাশ হয়েছে! সপ্তমী-অষ্টমী দু-দিন দু-রাত্তির উৎসবে মেতে থাকার ফলে অষ্টমীর ভোর রাত্তিরে তাঁর সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছিল মূর্তিমান সর্বনাশ! কাটোয়ার উত্তরে ‘উদ্ধারণপুরের’ কাছে বড়ো বড়ো নৌকোর সাহায্যে সেতু তৈরি করে সেটার ওপর দিয়ে বর্গীদের অগোচরে নিজের সৈন্যবাহিনীকে গঙ্গার পশ্চিমপারে নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন আলিবর্দি। তারপর ‘অজয়ের’ ওপরে আরেকটা নৌকো-সেতু তৈরি করে অষ্টমীর রাত্তিরে সেই বাহিনীকে সেটার ওপর দিয়ে তিনি এনে ফেলেছিলেন কাটোয়ায়। ভোর হতেই তিনি তাঁর বাহিনীকে হুকুম করেছিলেন বর্গীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে। ভাস্কর পণ্ডিতের বাহিনী যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রথমে ‘পাচেটে’, পরে ‘রামগড়ে’ পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে ‘বিষ্ণুপুর-চন্দ্রকোণা-মেদিনীপুর-রাধানগর-নারায়ণগড়’ হয়ে কটকে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন! কটকের কাছে ‘জাজপুরে’ মারাঠা সৈন্যদের সঙ্গে ‘সুবেদার শেখ মাসুমের’ বাহিনীর ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে শেখ মাসুম মারা পড়েছিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত কটক দখল করে সেখানে জাঁকিয়ে বসেছিলেন। আলিবর্দি কটকের সংবাদ পেয়ে সেদিকে রওনা হয়েছিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত আলিবর্দির গতিরোধ করার জন্যে কটক ছেড়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মেদিনীপুরের কাছে দু’পক্ষের দেখা হয়েছিল। যুদ্ধ বেঁধেছিল। সেই যুদ্ধে বাজে ভাবে হেরে গিয়ে ভাস্কর পণ্ডিত পালিয়ে গিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। আলিবর্দি একেবারে ‘চিল্কাহ্রদ’ পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলেন মারাঠাদের।


১৭৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে আলিবর্দি যখন উড়িষ্যায় বর্গীদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন আলিবর্দির বন্ধুবেশী এক শত্রু ‘অযোধ্যা’ থেকে ‘বিহারে’ এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ‘অযোধ্যার সুবেদার’ ‘সফদার-জঙ্গ’৷ তাঁর সঙ্গে এসেছিল ছ’হাজার পদাতিক, দশ হাজার অশ্বারোহী আর বড়ো বড়ো তোপ! বর্গীদের রুখতে আলিবর্দি দিল্লির সাহায্য চেয়েছিলেন। মোঘল বাদশাহ তখন সফদার-জঙ্গকে বিহার রক্ষার ভার দিয়েছিলেন। কিন্তু বিহারে পৌঁছে সফদার-জঙ্গ রটিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাদশাহ তাঁকে বাংলা-বিহারের সুবেদারির সনদ দিয়েছেন। আলিবর্দি দেখেছিলেন ব্যাপার বেগতিক। তাই সফদার-জঙ্গকে ভালোয় ভালোয় বিদেয় করার জন্য তাঁকে দূত মারফত তিনি লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘‘বর্গীদের ঠেকাবার জন্যে আমার সৈন্যবলই যথেষ্ট। আপনার সাহায্যের দরকার নেই।’’ আলিবর্দির সেই চিঠিতে হয়তো কাজ হতো না। কিন্তু ইতিমধ্যে বর্গী হটানোর জন্যে ‘পেশোয়া বালাজী রাও’ বাদশাহের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিহারের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সফদার-জঙ্গের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। কাজেই তাঁকে পিছু হটতে হয়েছিল। ১৭৪৩ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সফদার-জঙ্গ ফিরে গিয়েছিলেন নিজের প্রদেশে। সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ন-দশ তারিখে নবাব আলিবর্দি উড়িষ্যা থেকে ফিরে এসেছিলেন নিজের রাজধানী মুর্শিদাবাদে। সেই সময়টা বাংলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুটি পরস্পরবিরোধী মারাঠা বাহিনীর রণাঙ্গন। তাতে বাংলা আর বাংলার নবাব আলিবর্দির বিপদ আরও বেড়ে গিয়েছিল। তাই আলিবর্দি ঠিক করেছিলেন যে দুই শত্রুর একজনের সঙ্গে তিনি হাত মেলাবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বালাজীকেই বেছে নিয়েছিলেন। ‘পলাশী’তে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন বালাজীর সঙ্গে। মতান্তরে জায়গাটি ছিল ‘দাউদপুর’ কিংবা ‘মানকরা’৷ সেই সাক্ষাতের তারিখ ছিল ৩১শে মার্চ, ১৭৪৩ সাল। বার্ষিক চৌথ আর সৈন্যদের খরচ বাবদ বাইশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আলিবর্দি বালাজীর বন্ধুত্ব পেয়েছিলেন৷ বালাজী তাঁকে কথা দিয়েছিলেন যে রঘুজীকে তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা থেকে উৎখাত করবেন। ওদিকে রঘুজী তখন ছিলেন কাটোয়া আর বর্ধমানের মাঝখানে। বালাজী আর আলিবর্দি মিলিতভাবে তাঁকে আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হয়েছিলেন। রঘুজী দেখেছিলেন যে পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। তাই তিনি বীরভূমে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বালাজী আলিবর্দিকে বলেছিলেন, ‘‘মারাঠার গতিবেগ বাঙালীর চেয়ে বেশি। কাজেই রঘুজীকে ধরতে হলে আমাকে আলাদা হয়ে ছুটতে হবে। আপনি বরং আমার পেছনে আসুন।’’ আলিবর্দি তাতে আপত্তি করেননি। ১৬ই এপ্রিল তারিখে বালাজী আলাদা হয়ে রঘুজীকে তাড়া করে তাঁকে দূরে হটিয়ে দিয়েছিলেন। ২৪শে এপ্রিল ১৭৪৩ সালে, আলিবর্দি কাটোয়ায় ফিরে এসেছিলেন। এর কিছুদিন পরে বালাজীর দূত এসে তাঁকে খবর দিয়েছিলেন যে, রঘুজী সম্বলপুরের দিকে পালিয়ে গিয়েছেন। আলিবর্দি সেই খবরে স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বস্তি স্থায়ী হয়নি।

বালাজী দেশে ফিরতেই রঘুজী আবার মেদিনীপুরে উপস্থিত হয়ে আলিবর্দির কাছে দূত মারফত চৌথ চেয়েছিলেন। আলিবর্দিকে বিপদ তখন একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। আবার বাংলায় শুরু হয়েছিল লুঠ, ধ্বংস, হত্যা! শুধু বর্গীরাই যে সেসব করেছিল তাই নয়, নবাবের সৈন্যরাও মওকা বুঝে নিজেদের পকেট ভারি করেছিল, তাঁরা অগণিত গ্রাম-শহর জ্বালিয়ে দিয়েছিল! বাংলায় সন্ত্রাসরাজ কায়েম হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়েছিল। কলকাতাতেও ‘‘ত্রাহি ত্রাহি’’ রব উঠেছিল। ১৭৪৩ সালের মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত বাংলায় কারও ধন-প্রাণ নিরাপদ ছিল না। তবে হেমন্ত আর শীত মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কেটেছিল। ১৭৪৪ সালে আবার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। সেবারে তাঁর মূর্তি ছিল আরও রুদ্র-ভয়ঙ্কর! তখন তাঁর মনে দয়া-মায়ার লেশমাত্র ছিল না! ধরো, কাটো, লোটো - এগুলোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর নীতি! বর্গীরা বাংলায় সেবারে যেরকম ভয়ানক অত্যাচার শুরু করেছিল, তাঁরা আগে কখনো সেরকম কখনও করেনি! ‘কবি গঙ্গারামের’ ভাষায় -


‘‘আশ্বিন মাসে ভাস্কর গেল পলাইয়া।

চৈত্র মাসে পুনরূপি আইল সাজিয়া৷৷

জেই মাত্রে পুনরূপি ভাস্কর আইল৷

তবে সরদার সকলকে ডাকীয়া কহিল৷৷

স্ত্রি পুরুষ আদি করি যতেক দেখিবা।

তলয়ার খুলিয়া সব তাহারে কাটিবা৷৷

চতুদিগে লুটে কাটে বলে মারমার৷৷

এতেক বচন জদি বলিল সরদার।’’


কোন রকমের বিতর্কের অবকাশ না রেখে স্পষ্ট ভাষায় বলে রাখা দরকার, বর্গীরা ছিল অতি চরিত্রহীন। সুন্দরী রমণী দেখলেই তাঁরা কুকুরের মতন কামড়াকামড়ি শুরু করতো। গণধর্ষণে কত যে নারীর প্রাণ নিয়েছিল তাঁরা সেটার সীমাসংখ্যা ইতিহাসে নথিবদ্ধ নেই। ১৭৪৪ সালে বর্গীর হাঙ্গামায় সন্ত্রস্ত বাঙালীর বর্ণনা পাওয়া যায় কবি ‘বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের’ ‘চিত্রচম্পু’ কাব্যে। তাতে বলা হয়েছে যে, মারাঠারা কৃপায় ছিল কৃপণ; গর্ভবতী এবং শিশু, ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের তাঁরা তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলত; সমস্ত নিষিদ্ধ আচরণে তাঁরা ছিল নিপুণ; তাঁরা বাংলার জনপদে যেন ছোটো প্রলয় ঘটিয়ে ছেড়েছিল; তাঁরা সমস্ত ধন এবং সাধ্বী স্ত্রীলোকদের হরণ করেছিল। গঙ্গারাম লিখেছিলেন -


‘‘ভাল ভাল স্ত্রিলোক জত ধইরা লইয়া জাএ।

আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাধি দেয় তার গলাএ৷৷

একজনা ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।

রমণের ভরে ত্রাহি সব্দ করে৷৷’’


কি বীভৎস বর্ণনা! বর্গীরা যে ‘গণধর্ষণে’ অভ্যস্ত ছিল, সেটার উল্লেখ পাওয়া যায় পর্তুগীজ কাহিনীতেও। ১৬৮৩ সালে গোয়ার কাছে ‘ষষ্ঠি’ আর ‘বার্দেশ’ আক্রমণ করার সময় তাঁরা যুবতীদের ‘গণধর্ষণ’ করেছিল। ইতিহাস খুব কঠিন সত্যি বলে। আসলে চরিত্রদোষ মারাঠাদের ভীষণভাবে অধঃপতিত করেছিল। না হলে ভারতবর্ষে মোঘলশক্তির উত্তরাধিকারী ইংরেজ না হয়ে মারাঠারাই হতো! প্রসঙ্গ বদলানোর দরকার নেই, ১৭৪৪ সালের ঘটনায় ফিরে আসা যাক। সেবার ভাস্কর পণ্ডিত ফিরে এসেছিলেন কুড়ি হাজার ঘোড়সওয়ারের প্রধান সেনাপতি হয়ে। তাঁর অধীনে ছিলেন বাইশজন বাঘা বাঘা সেনাপতি। ওদিকে তাঁদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে করে আলিবর্দি আর তাঁর সেনাপতিরা হয়ে পড়েছিলেন শ্রান্ত, রণক্লান্ত। আলিবর্দির সৈন্যরাও বিশ্রাম চাইছিলেন কিছুদিনের জন্য। কিন্তু বর্গীরা বিশ্রাম চাইছিল না! আলিবর্দি বুঝেছিলেন যে তাঁর শিয়রে শমন! তাঁকে কিছু একটা করতে হতোই। অতদিন বর্গীদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করে আলিবর্দি এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে যুদ্ধ করে তাঁদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। তাই তিনি ঠিক করেছিলেন যে ফাঁদে ফেলে বধ করবেন ভাস্কর পণ্ডিত আর তাঁর সেনাপতিদের। তাই তিনি তাঁর আফগান সেনাপতি ‘মুস্তাফা খাঁ’র সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে পলাশীর ঊনত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে মানকরায় ফাঁদ পেতেছিলেন। মুস্তাফাকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, যদি তিনি কৃতকার্য হন, তাহলে তাঁকে তিনি বিহার প্রদেশের নায়েব ‘সুবেদার’ করে দেবেন। তাই মুস্তাফা আলিবর্দির চক্রান্তকে সফল করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সেই চক্রান্ত অনুসারে আলিবর্দি ভাস্কর পণ্ডিতকে দূত মারফত বলে পাঠিয়েছিলেন যে, ‘‘যদি বিনাযুদ্ধে কাজ হাসিল হয়, তাহলে যুদ্ধের দরকারটা কী? আপনি চান চৌথ, আমি চাই শান্তি। আপনাকে চৌথ দিয়ে যদি আমার শান্তি আসে, সেটাই আমার কাম্য। আসুন, আমরা যুদ্ধ ছেড়ে হাতে হাত মেলাই, সন্ধি করি।’’ ভাস্কর প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর অন্যতম সেনাপতি ‘আলিভাই’কে পাঠিয়েছিলেন নবাবের কাছে, সন্ধির বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্যে। নবাব আলিভাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নানারকম উপহার আর ভালো ভালো কথায় তাঁর মন জয় করেছিলেন। তাঁকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভাইসাহেব, আপনারা সবাই একদিন গঙ্গার পূর্বপাড়ে মানকরায় আসুন। সেখানেই পাকা কথা হবে। আপনারা যে শর্ত দেবেন, তাই আমি মেনে নেব। শুধু দেখবেন বাংলায় যেন শান্তি ফেরে।’’ আলিবর্দি সেসময় ছিলেন আমানিগঞ্জে, আর ভাস্কর ছিলেন কাটোয়া-বর্ধমানের মাঝামাঝি জায়গায়, ‘দিগনগরে’। ভাস্করের মনের সন্দেহ দূর করার জন্যে তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতি মুস্তাফা খাঁকে আর দেওয়ান ‘জানকীরাম’কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দিগনগরে, ভাস্করের শিবিরে। তাঁরা দু’জনে কোরান-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁয়ে ভাস্করকে কথা দিয়ে এসেছিলেন যে মারাঠাদের সঙ্গে বেইমানি করা হবে না! মানকরায় আলিবর্দি বড়ো বড়ো তাঁবু খাটিয়ে উপহারের জন্যে হাতি, ঘোড়া, নানারকম দামী জিনিস এনে এমন একটা আবহওয়া সৃষ্টি করেছিলেন যে, সন্ধি যেন হয়েই গিয়েছে, কেবল একটা নিয়মরক্ষা বাকি! ওদিকে ভাস্কর তাঁর সেনাপতিদের সঙ্গে মন্ত্রণায় বসেছিলেন। ‘রঘুজী গাইকোয়াড়’ ছাড়া আর সবাই সন্ধির পক্ষে মত দিয়েছিলেন। ভাস্কর সংখ্যাগরিষ্ঠের মত শিরোধার্য করে ১৭৪৪ সালের ৩০শে মার্চ তারিখে গঙ্গা পার হয়ে পলাশীতে এসে তাঁবু ফেলেছিলেন।


৩১শে মার্চ, ১৭৪৪ সালে, ভাস্কর গিয়েছিলেন ‘মানকরা’য়। তাঁর সঙ্গে ছিল দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য আর তাঁর বাইশজন সেনাপতি। সৈন্যদের দায়িত্ব রঘুজী গাইকোয়াড়ের ওপর দিয়ে একুশজন সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে ভাস্কর আলিবর্দির শিবিরে ঢুকেছিলেন। সেই শিবির থেকে তাঁর বাহিনীর অবস্থান ছিল কিছুটা দূরে, মাঠের মাঝখানে। আসলে আলিবর্দির শিবিরটা ছিল একটা মরণফাঁদ। সেটার চারধারে ছিল ‘ডবল কানাত’ অর্থাৎ পর্দা। সেই কানাতের ফাঁকে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে দাড়িয়েছিল আলিবর্দির বাছা বাছা সৈন্যরা। ঠিক হয়েছিল আলিবর্দির আদেশ পেলেই তাঁরা ঝাপিয়ে পড়বে মারাঠা তস্করদের ওপরে। আর আলিবর্দির বাকি যেসব শিবির সেখানে ছিল, সেগুলোও ছিল সৈন্য পরিপূর্ণ। তাঁরাও প্রস্তুত ছিল যুদ্ধের জন্যে। ভাস্কর পণ্ডিতের অন্যতম সেনাপতি রঘুজী গাইকোয়াড় এরকমই আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তিনি বারবার ভাস্করকে নিষেধ করেছিলেন আলিবর্দির শিবিরে ঢুকতে। কিন্তু তিনি তা শোনেননি। ভাস্কর তাঁর একুশজন সঙ্গীকে নিয়ে যে-শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন, সেটা ছিল আলিবর্দির দরবার-শিবির, সেটার আকার ছিল বিশাল। তার মধ্যে ভাস্কররা ঢুকতেই নবাবের হুকুমে তাঁর লোকেরা শিবিরের দরজা শক্ত কাপড় বেঁধে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই কাজ শেষ হতেই নবাব তাঁর সেনাপতিদের হুকুম করেছিলেন, ‘‘দস্যুদের জবাই কর।’’ এই বলে তিনি তাঁবুর পেছনে এসে একটি হাতির পিঠে উঠে বসেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে চলে যাননি। তাঁর সেনাপতিরা একটু বাদে তাঁকে এসে বলেছিলেন, ‘‘আপনার হুকুম পালন করা হয়েছে।’’ নবাব তবুও নিঃসংশয় হতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভাস্করের কাটা মুণ্ডু এনে আমাকে দেখাও।’’ একজন সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের কাটা মুণ্ডু এনে তাঁকে দেখানোর পরে নবাব নিশ্চিত-নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন! যেন ঘাম দিয়ে বহুদিনের পুরনো জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল তাঁর শরীর থেকে! এরপরে নবাবের হুকুমে অন্য সব শিবির থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে এসে অদূরে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মারাঠাদের তাড়া করেছিল। রঘুজী গাইকোয়াড় তো পালানোর জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তিনি আগে থেকেই জানতেন পরিণতি কী হতে চলছে। ভাস্কর আর তাঁর একুশজন সেনাপতি মরণফাঁদে পা বাড়িয়েছিলেন গাইকোয়াড়ের নিষেধ সত্ত্বেও। নবাব-বাহিনী এগিয়ে আসতেই ক্ষিপ্রগামী মারাঠা বাহিনী গাইকোয়াড়ের নেতৃত্বে কাটোয়ার দিকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পরে তাঁরা পলাশী আর কাটোয়ায় নিজেদের আস্তানা থেকে মালপত্তর গুটিয়ে নিয়ে দেশে ফেরৎ চলে গিয়েছিল। আলিবর্দি গাইকোয়াড়ের টিকিও ছুঁতে পারেননি। কাজ শেষ করে আলিবর্দি নিজের রাজধানীতে ফিরে এসেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে তিনি দশ লাখ টাকা বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সৈন্যদের মধ্যে। মোঘল বাদশাহের কাছ থেকে সম্মতি এনে সেনাপতিদের পদোন্নতি করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাঁদের খেতাব দিয়েও ভূষিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন আলিবর্দি। এত করেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি!


(পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)

                                 ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- ঐতিহাসিক চিত্র: মুর্শিদাবাদ কাহিনী, শ্রী নিখিলনাথ রায়।

২- মুর্শিদাবাদ ইতিবৃত্ত, অরূপ চন্দ্র।

৩- কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়।)

                             

No comments