‘এ এক অন্য কলকাতার গল্প। অন্য কলকাতার ইতিহাস। যে কলকাতা তখন ছিল একটা গ্রাম। কলকাতার সাথে তখন ছিল আরও দুটি গ্রাম - ‘সুতানুটি’ ও ‘গোবিন্দপুর’। তখন সেগুলোর সীমানা ছিল এইরকম - বর্তমান ‘বাগবাজার’ থেকে ‘বড়বাজার’ পর্যন্ত ছিল ‘সুতানুটি’…
‘
এ এক অন্য কলকাতার গল্প। অন্য কলকাতার ইতিহাস। যে কলকাতা তখন ছিল একটা গ্রাম। কলকাতার সাথে তখন ছিল আরও দুটি গ্রাম - ‘সুতানুটি’ ও ‘গোবিন্দপুর’। তখন সেগুলোর সীমানা ছিল এইরকম - বর্তমান ‘বাগবাজার’ থেকে ‘বড়বাজার’ পর্যন্ত ছিল ‘সুতানুটি’, ‘বড়বাজার’ থেকে ‘এসপ্ল্যানেড’ পর্যন্ত ছিল ‘কলকাতা’, আর ‘এসপ্ল্যানেড’ থেকে ‘হেস্টিংস’ পর্যন্ত ছিল ‘গোবিন্দপুরের’ অবস্থান। এদের পূর্ব দিকে ছিল ‘লবণ হ্রদ’, ‘চৌরঙ্গীর জঙ্গল’।
১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে ‘জোব চার্ণক’ যখন তৃতীয় বা শেষবারের মত ‘সুতানটি’তে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই চৌরঙ্গীর জঙ্গলে ছিল ‘দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত’ সাধু ‘জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী’ (যাঁর নাম থেকে জায়গাটার নাম হয়েছে চৌরঙ্গী) প্রতিষ্ঠিত মহাদেবের এক মন্দির ও আশ্রম। সেখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বঙ্গদেশের এক রানী। স্বামী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে চৌরঙ্গীর সেই মহাদেবের আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন ‘রানী অজিতাসুন্দরী’। রানী অজিতাসুন্দরী ছিলেন ‘চেতুয়া-বরদা’র ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘রাজা শোভা সিংহের প্রথমা রানী’। ‘চেতুয়া-বরদা’ ছিল ‘মন্দারন সরকারের’ (বর্তমান মেদিনীপুর) পাঁচ নম্বর মহল। রাজা শোভা সিংহ ছিলেন অত্যন্ত চরিত্রহীন, লম্পট ও অত্যাচারী জমিদার। তাঁরই সময়ে ‘বরদার যদুপুর গ্রামে’ বাস করতেন ‘রামেশ্বর ভট্টাচার্য’, যিনি পরবর্তীকালে ‘কর্ণগড়ের রাজা’ ‘রাম সিংহের’ পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেছিলেন ‘শিবায়ন’ কাব্য।
যদুপুরে বরদা-বর্ধমান রাজপথের পাশে ছিল এক মস্ত দিঘি। একদিন ‘রামেশ্বরের স্ত্রী সুমিত্রা’ যখন স্নান করতে যাচ্ছিলেন সেই দিঘিতে, তখন সেই পথে অশ্বারোহণে যাচ্ছিল রাজা শোভা সিংহ। সুমিত্রার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে শোভা সিংহ বলপূর্বক তাঁকে তুলে নিয়েছিলেন ঘোড়ার ওপরে। সুমিত্রা প্রাণপণে আত্মরক্ষার প্রয়াস করেছিলেন। তাতে বিব্রত হয়ে শোভা সিংহ তাঁকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলেন পথের ধারে। শোভা সিংহের সেই কুকীর্তির কথা তরুণ কবি রামেশ্বরের কানে গিয়ে পৌঁছেছিল। রামেশ্বর ছিলেন ‘তান্ত্রিক সাধক’। তাঁর বাসভবনের অনতিদূরেই ছিল তাঁর তন্ত্রসাধনার স্থান, পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেখানে রামেশ্বর আরম্ভ করেছিলেন এক ‘মারণযজ্ঞ’, যার আহুতি সম্পন্ন হলে অনিবার্য হত শোভা সিংহের মৃত্যু! কাকতলীয়ভাবে, এরপরে শোভা সিংহ নিদারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছিল সুমিত্রার ওপর শোভা সিংহের অত্যাচার ও রামেশ্বর কর্তৃক মারণযজ্ঞ আরম্ভের কথা। কথাটা শুনে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন শোভা সিংহের প্রথমা রানী অজিতাসুন্দরী। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন রামেশ্বরের পঞ্চমুণ্ডির আসনের দিকে। লুটিয়ে পড়েছিলেন রামেশ্বরের পদপ্রান্তে। অনুনয় করে তাঁকে বলেছিলেন - “ফিরিয়ে দাও ঠাকুর আমার স্বামীর প্রাণ, তাঁর অপরাধ মার্জনা কর, এমন কুৎসিত কাজ ভবিষ্যতে সে আর কখনও করবে না।” পতিপ্রাণা নারীর করুণ ক্রন্দন বিগলিত করেছিল রামেশ্বরের রুষ্ট মনকে। ‘ক্ষণে রুষ্ট, ক্ষণে তুষ্ট’ রামেশ্বর তাঁকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তাঁর স্বামী যেন অন্য কোন নারীর ওপরে বলপ্রয়োগ না করেন। অজিতাসুন্দরী রামেশ্বরের কাছে কথা দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর স্বামী এরূপ কুকার্য আর কখনও করবেন না। রামেশ্বরের অভয়দানে আশ্বস্ত হয়ে রানী ফিরে এসেছিলেন রাজপ্রাসাদে। এরপরে শোভা সিংহ শীঘ্রই নিরাময় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু প্রতাপশালী শোভা সিংহ যখন শুনেছিলেন যে রানী অজিতাসুন্দরী একজন সামান্য ব্রাহ্মণের পায়ে পড়ে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা করে নিয়ে এসেছেন, তখন রুষ্ট হয়ে তিনি রানীকে বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে রানী আশ্রয় নিয়েছিলেন চৌরঙ্গীর জঙ্গলে চৌরঙ্গীশ্বরের মন্দিরে। লোকমুখে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘চৌরঙ্গী জঙ্গলের রাণী’। এ সবই ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা।
সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া গিয়ে পড়েছিল ‘বর্ধমানের রাজবাটী’তে। সেই ঘটনার কিছু আগে শোভা সিংহ প্রস্তাব পাঠিয়েছিল ‘বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরামের’ কাছে যে, তিনি তাঁর মেয়ে ‘সত্যবতী’র পাণিপ্রার্থী হতে চান। তখন কৃষ্ণরাম সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অজিতাসুন্দরীকে বিতাড়িত করবার খবর যখন বর্ধমানে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন বেঁকে বসেছিলেন সত্যবতী ও তাঁর পিতা কৃষ্ণরাম। শোভা সিংহকে কন্যাদান করতে অসম্মত হয়েছিলেন কৃষ্ণরাম। বাগদত্তা কন্যাকে কৃষ্ণরাম শোভা সিংহের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃত হয়েছে, একথা যখন লোকমুখে প্রচারিত হয়েছিল, শোভা সিংহ তখন নিজেকে অপমানিত বোধ করে, কৃষ্ণরামের ওপর সেটার প্রতিহিংসা নেবার সঙ্কল্প করেছিলেন। কৃষ্ণরামকে শিক্ষা দেবার জন্য তিনি বর্ধমান আক্রমণ করবার মতলব করেছিলেন। যদিও তখন মোঘল আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তা হলেও তিনি একা সেই কাজ করতে সাহস করেননি। তিনি সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন ‘উড়িষ্যার আফগান সরদার’ ‘রহিম খানের’ কাছে। রহিম খান ও শোভা সিংহের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দের শেষদিকে বর্ধমান অভিমুখে যাত্রা করেছিল। কৃষ্ণরাম আশঙ্কিত হয়ে নিজ পুত্র ‘জগৎ রায়’কে স্ত্রী-বেশে শিবিকা করে ‘নবদ্বীপাধিপতি’র কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে কৃষ্ণরাম নিহত হয়েছিলেন। কৃষ্ণরামের পরিবারের মেয়েরা ‘জহর-ব্রত’ অবলম্বন করে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কেবল সত্যবতী ধৃত ও বন্দী হয়েছিলেন। বলা ভালো তিনি নিজেই ধরা দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাঁর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ তিনি নেবেন। সত্যবতীকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলের কোন এক গোপন আস্তানায়। ওদিকে জগৎ রায় নবদ্বীপ থেকে ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে নবাবের কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। কিন্তু হুজুর তখন ‘গুলিস্তান’ পড়তেই মশগুল ছিলেন। তাই জগৎ রায়ের নালিশ তাঁর কানেই যায়নি। সেই সুযোগে শোভা সিংহের সৈন্যদল চতুর্দিকে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছিল৷ সেই সময় শোভা সিংহের দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ‘চন্দ্রকোনার জমিদার রঘুনাথ সিংহ’। চতুর্দিকেই তাঁরা লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালিয়েছিলেন। ‘হুগলি’কে কেন্দ্র করে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী ১৮০ মাইল ব্যাপী অঞ্চলে শোভা সিংহ নিজ আধিপত্য স্থাপন করে ‘নৌবাণিজ্যের শুল্ক’ আদায় করতে শুরু করেছিলেন। ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য তাঁরা যথাক্রমে কলকাতা, চন্দননগর ও চুঁচুড়ায় দুর্গ নির্মাণ করবার প্রার্থনা নবাবের কাছে পেশ করেছিলেন। বিদ্রোহ দমনে তাঁরা নবাবকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। নবাব তাঁদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। এর ফলেই ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণের অনুমতি পেয়েছিল।
ওদিকে শোভা সিংহ কৃষ্ণরামের মেয়ে সত্যবতীকে বন্দী করে রেখেছিলেন। ভাগীরথীর পশ্চিম অঞ্চলে নিজ আধিপত্য স্থাপনের পরে একদিন শোভা সিংহ প্রণয়প্রার্থী হয়ে সত্যবতীর কাছে গিয়েছিলেন৷ সেদিন সত্যবতী নিজের বসনের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন একখানা ছুরিকা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ তিনি অতর্কিতে শোভা সিংহকে আক্রমণ করে ছুরিকাঘাত করে নিহত করেছিলেন। শোভা সিংহের মৃত্যুসংবাদ যখন যদুপুরে গিয়ে পৌঁছেছিল, রামেশ্বর তখন উল্লসিত হয়ে এক কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। সেই কবিতার মর্মার্থ ছিল, নারীর প্রতি অত্যাচারীর এরূপই স্বাভাবিক পরিণতি ঘটে, যেমন ঘটেছিল রাবণ ও দুর্যোধনের। ক্রমে লোকের মুখে মুখে সেই কবিতা আবৃত্তি হতে শুরু হয়েছিল। এতে তুমুল চটে গিয়েছিলেন শোভা সিংহের স্থলাভিষিক্ত তাঁর ভাই ‘হেমন্ত সিংহ’। তিনি রামেশ্বরকে যদুপুর থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। বিতাড়িত রামেশ্বর আশ্রয় পেয়েছিলেন ‘কর্ণগড়ের রাজা রাম সিংহের’ কাছে। যদিও রানী অজিতাসুন্দরীর বিতাড়ন ইতিহাসের ওপরে সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখে গেছে, তথাপি চৌরঙ্গীর জঙ্গলে রানী অজিতাসুন্দরীর শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল, সে সম্বন্ধে ইতিহাস নীরব। কৃষ্ণরামের মেয়ে সত্যবতীর শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল সেটাও আর জানা যায় না। তবে রাজাকে হত্যা করার জন্য তাঁর যে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, সেটা বোঝাই যায়। আজ সেই ইতিহাস সকলেই বিস্মৃত হয়েছে। বাঙালি নারীরা দুর্বল ছিলেন না, তাঁরা যে চিরকাল পতিসেবা করে, তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে নিজেদের দিন কাটাতেন না - সত্যবতী তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। রাণী অজিতাসুন্দরী যদি পতিব্রতার একনিষ্ঠ উদাহরণ হন, তাহলে রাজকন্যা সত্যবতী অবশ্যই বাঙালি নারীর বীরত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
(তথ্যসূত্র:
১- কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ মিত্র।
২- Lives of the Indian Princes, Charles Allen.
৩- মহারাণী, জারমানি দাস (দেওয়ান) ও রাকেশভান দাস, অনুবাদক: চিরঞ্জীব সেন।)
No comments