‘১৭৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক অজানা ফরাসি চিত্রকর ও পর্যটক এসেছিলেন বঙ্গদেশ ভ্রমণে। একদিন সন্ধ্যায় ঘুরতে বেরিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন একজন অদ্ভুত দেশীয় মানুষকে। অদ্ভুত, কারণ মানুষটি পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে খালি দৌড়ে চলেছিল। বড় অদ্ভ…
‘
১৭৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক অজানা ফরাসি চিত্রকর ও পর্যটক এসেছিলেন বঙ্গদেশ ভ্রমণে। একদিন সন্ধ্যায় ঘুরতে বেরিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন একজন অদ্ভুত দেশীয় মানুষকে। অদ্ভুত, কারণ মানুষটি পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে খালি দৌড়ে চলেছিল। বড় অদ্ভুত লেগেছিল সেই সাহেবের। এরপরে আরও কয়েকবার সেই দৌড়ে চলা মানুষটির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রত্যেকবার সেই একই দৃশ্য। শেষে একদিন সাহেব এঁকে ফেলেছিলেন তাঁর একটি ছবি (স্কেচ)। সেটাই সম্ভবতঃ ছিল প্রথম কোন রানার বা দৌড়ে চলা ডাকহরকরার ছবি। দৌড়-ই যাঁদের জীবনের একমাত্র কাজ তাঁরাই তো দৌড়বীর। দৌড়বীর তাই রানার। মূলতঃ চিঠিপত্র সঠিক স্থানে পৌঁছে দেওয়াই ছিল যাঁদের কাজ। মোঘলযুগে এর সঙ্গে থাকতো সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যাপারটিও। তাঁদের হাতের লাঠিটি ছিল লম্বায় ছ’ফুট। পেতলের একটা ঘুঙুর বাঁধা থাকতো লাঠিতে। আর থাকতো একটা লণ্ঠন। কবি সুকান্তের ভাষায় - “হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন জোনাকিরা দেয় আলো ...।” এবং থাকতো বল্লমও। ডাক চলাচলের সুবিধার জন্য থাকতো সরাইখানা। সেগুলো সাধারণতঃ বারো কিলোমিটারের ব্যবধান থাকতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ব্যবধান বেড়ে যেত। ডাকহরকরাদের জন্য বলেই হয়তো সরাইখানার অন্য নাম ছিল - ডাকচৌকি অথবা প্রাচীন ডাকঘর৷ ডাকহরকরাদের নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছাতে হতো। ব্রিটিশ যুগের অমানবিক রীতি অনুযায়ী একজন রানারকে ২৪ ঘণ্টায় (একদিন) ১০০ কিমি পথ অতিক্রম করতে হত। আকবরের সময়ে তালিম দেওয়া রানাররা একদিনে ১৫০ কিমি পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারতেন। একজন ডাকহরকরা ডাকচৌকিতে পৌঁছে গেলে অন্য রানার তৎপর হয়ে যেতেন। ঝুমঝুমির আওয়াজে সেখানে অবস্থান রত অন্য রানার সজাগ হতেন। এরপরে তাঁকেই ছুটতে হত। ডাকচৌকিতে পৌঁছেই কিন্তু চিঠির বস্তা ছুঁড়ে দিতেন আগত রানার। তিনি কখনোই অন্য রানারের হাতে তুলে দিতেন না তাঁর চিঠির ব্যাগ। কারণ সেটা তাঁদের সংস্কার অনুসারে ছিল অশুভ ইঙ্গিতবাহী। মেঝে থেকে চিঠির ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে প্রস্তুত হতেন অন্য রানার। তারপরে শুরু হত তাঁর পথ চলা। ঘুঙুর বা লাঠি বা বল্লম নিয়ে এগিয়ে চলতো সে। শুরু হত প্রাণপণ দৌড়।
মোঘল যুগের চেয়েও ব্রিটিশ যুগে রানারদের অনুশীলন ছিল রীতিমতো অমানবিক। সিসা বা অন্য ধাতুর তৈরি ভারী জুতো পরিয়ে দীর্ঘ অনুশীলন করানো হতো রানারদের। এমন কি খালি পায়েও অনুশীলন করানো হত। দু’ভাবেই অনুশীলন চলতো। গুপ্তচর বৃত্তির প্রশিক্ষণ ছিল আরও ভয়াবহ। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের নামে যেটা চলত, এই যুগের নিরিখে সেটাকে অত্যাচার বললেও কম বলা হয়। বিশেষ করে মোঘল যুগে গুপ্তচরের কাজ করানো হতো ডাকহরকরাদের দিয়ে। একটি বিশেষ ধরনের লেফাফায় মোড়া গুপ্ত সংবাদ নির্দিষ্ট রাজার দরবারে ঠিকঠিক পৌঁছে দিতে হত তাঁদের। কখনো কখনো সেই কাজের জন্য তাঁদের বিদেশেও যেতে হত। বিদেশ মানেই পদে পদে বিপর্যয়। ফিরে না আসার অমঙ্গলসূচক ইঙ্গিত। অপেক্ষায় রত মৃত্যুদূত। তাঁদের আত্মীয় পরিবারের ব্যাকুলতা ‘‘যেতে নাহি দিব ...’’ তবুও যেতে হত। আর আদেশ লঙ্ঘন মানেই ছিল অন্য বিপদ। বিদেশে পাড়ি দেওয়া বেশির ভাগ গুপ্তচরেরা মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। অনিদ্রায় অনাহারে অথবা হিংস্র জন্তুর আক্রমণে প্রাণ যেত তাঁদের। আবার তাঁরা শত্রুপক্ষের হাতে পড়লেও কোনরকম রেহাই ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের ভাগ্যে জুটতো বিভৎস যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। আবার কোনক্রমে জীবন ছাড়া পেলেও তাঁদের রেহাই ছিল না। পায়ের দু’দুটো বুড়ো আঙুল কেটে নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হত। গ্রামে পৌঁছে বিউগল বাজাতো রানার। এই ধরনের প্রথার রেওয়াজ ছিল পাহাড়ী গ্রামে। গ্রামবাসীদের হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তাঁদের সেটা পড়েও শোনাতে হত। বিশেষ করে যাঁরা লেখাপড়া জানতেন না তাঁদের। চিঠি পড়াই শুধু নয় উত্তর লেখার কাজ করে দিতো রানার। মোঘল যুগে তো টাটকা ফলও রাজদরবারে পৌঁছে দিতে হতো তাঁদের। ব্রিটিশ যুগে ম্যালেরিয়া মহামারীর আকার নিলে কুইনাইন বড়ি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবার ভার পড়তো ডাকহরকরাদের।
©️রানা©️
নির্ভীক, সৎ, পরিশ্রমী এবং অবশ্যই সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হতো রানারদের। সেই পদে নিয়োগের বিরাট বাধা তাঁদের লঙ্ঘন করতে হতো, তাই অনেকেই সে কাজে আসতে ভয় পেতেন। তবে পেটের দায় চিরকালই বড় দায়। বিশেষ করে আদিবাসী, পাহাড়ি, আসামি, জংলি জাতি, ক্রীতদাসদের রানারের নিয়োগপত্র দেওয়া হত নির্দ্বিধায়। ব্রিটিশ যুগে ১৮৩৫ সালে একজন বাংলার রানারের বেতন ছিল মাসিক ৪ (চার) টাকা। তাঁদের বেতন ঠিক হতো দূরত্ব, দৌড়ের গতি, চিঠির ওজন এবং অবশ্যই রানারের কাজের গুরুত্ব বিচার করে। ১৮৩০ সালে মোট ৮ কিলো চাল একজন রানারের ক্ষেত্রে মোট ভার বা ওজন হিসাবে ঠিক করে দেওয়া হত। আবার কর্মরত অবস্থায় বাঘের দ্বারা বা অন্য কোন হিংস্র জন্তুর আক্রমণে মৃত্যু হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃতের স্ত্রী সন্তানেরা ঠিক ঠিক ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত পেতেন না। তবে বাঁধা মাইনের চাকুরে ছিলেন রানাররা। তবে বিশেষ করে যাঁরা গুপ্তচর ও পত্রবাহক ছিলেন তাঁদের দৌড় করার ক্ষমতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আফিম খাওয়ানোর প্রথা প্রচলিত ছিল। তাই একজন রানারকে চিঠির ব্যাগের সঙ্গে অবশ্যই নিতে হতো আফিম। আজকে যখন খেলোয়াড়দের ড্রাগ নেওয়াটা অপরাধ বলে গণ্য হয়, সেদিন কিন্তু তা ছিল না। বরং জোর করেই তাঁদের আফিম সেবন করানো হত। সেটার ফলাফল কিন্তু রানারদের শেষ জীবনে খুব একটা ভালো হত না। তাঁরা নিজেদের শেষ জীবনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতেন। এছাড়াও রানাররা চলার পথে কিছু চাল এবং জল তোলার জন্য ভাঁড় সঙ্গে রাখতেন।
সাধারণতঃ প্রতি ১২ কি.মি. অন্তর ডাক আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য সরাইখানার মতো নির্মিয়মান বাংলোকে বলা হতো ডাকবাংলো। সেগুলো কোথাও কোথাও ১২ কিমি.-র বেশী ব্যবধানেও থাকতো। সেগুলোর অন্য নাম ছিল - ডাকচৌকি। সেগুলো প্রথমে অবশ্য ডাক চলাচলের সুবিধার জন্যই করা হয়েছিল। ডাকবাংলো আসলে ছিল ডাকহরকরাদের সুবিধার জন্য নির্মিত হয়। প্রাচীনকালে সেগুলোকে অবশ্য ডাকঘরই বলা হত। পরে অবশ্য ভ্রমনার্থীদের থাকার জন্য বিশেষ করে সাহেব ভ্রমণার্থীদের থাকার জন্য, কিছু ডাকচৌকি নিয়ে ছোট বাংলোবাড়ি তৈরি হয়েছিল। সেই বাংলো পরিচালনার ভার থাকতো পোস্ট অফিসের উপর। সেখানে অবশ্য অগ্রিম টাকা আগে দিয়ে ডাকবাংলোয় থাকার ব্যবস্থা হত। থাকা তো বটেই, সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া এমনকি পালকি-বেয়ারারও থাকার একটা বন্দোবস্ত করা যেত। ব্রিটিশ আমলের তৈরি ডাকবাংলো এখনো যততত্র বেশ কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেগুলো নিয়ে রয়েছে সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব ভূতের গল্প। ব্রিটিশ ভ্রমনার্থীদের সুবিধার জন্য ডাকচৌকিতে নির্মিয়মান ছোট বাড়ির আধুনিক নামকরণ ডাকবাংলো। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রানারদের গল্প কাহিনীও।
©️রানা©️
(তথ্যসূত্র:
১- ডাকঘরের ইতিকথা, কিরণ মৈত্র।
২- ডাকটিকিটের ইতিকথা, শচীবিলাস রায়চৌধুরী।
৩- ডাকের কাহিনী, নরেন্দ্রনাথ রায়।)
No comments