Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রসুলপুর নামটা প্রথম জেনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর "কপালকুন্ডলা

রসুলপুর নামটা প্রথম জেনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর "কপালকুন্ডলা"  উপন্যাসে। প্রথম পরিচ্ছেদ সাগরসঙ্গমের  উল্লেখ আছে ----একদিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে একখানি নৌকা গঙ্গাসাগরে থেকে প্রত্যাগমন করেছিলো। রাত্রিশেষে ঘোরতর …

 




রসুলপুর নামটা প্রথম জেনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর "কপালকুন্ডলা"  উপন্যাসে। প্রথম পরিচ্ছেদ সাগরসঙ্গমের  উল্লেখ আছে ----একদিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে একখানি নৌকা গঙ্গাসাগরে থেকে প্রত্যাগমন করেছিলো। রাত্রিশেষে ঘোরতর কুজঝটিকা নাবিকেরা দিক নির্নয় করতে না পেড়ে পথ হারায়। যখন সূর্যের আলো নাবিকগন দেখতে পেলেন তখন প্রায় বেলা এক প্রহর। আরোহিরা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত করেন যে তার মাহাসমদ্রের পশ্চিম তটে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিছু দূরে একটি নদী দেখে রসুলপুরের নদী বলে নির্নয় করেন। রসুলপুর নদী হল ভারতের পশ্চিমঙ্গের উপকূলবর্তী একটি নদী। এই নদী হুগলি নদীর একটি উপনদী। নদীটি পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাগদা নদীটি কালিনগর পর্যন্ত প্রবাহের পর এটি রসুলপুরের নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি কাওয়াখালি লাইট হাউজ বা বাতিঘরের কাছে সাগর দ্বীপের বিপরীতে হুগলি নদীতে মিলিত হয়েছে। তবে রসুলপুর যে কোথায় এবং কি কারনে রসুলপুর নদী নাম হয় তা আমার জানা নেই। 'কপালকুন্ডলা' উপন্যাসে সপ্তমগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায় সেটি বর্তমানে হুগলি জেলায় অবস্থিত কিন্তু অখণ্ড হুগলি জেলায় অনেক গুলি রসুলপুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিঙ্গুর থানার অন্তর্ভুক্ত নসিবপুর স্টেশন দক্ষিন দিকে রসুলপুর আছে এটি সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত। আবার মেরারী থানার অন্তর্ভুক্ত রসুলপুর আছে এটি বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলায়।  কিন্তু আজ যে রসুলপুরের কথা বলবো সেটি হুগলি জেলার পুড়শুড়া থানার অন্তর্ভুক্ত দামোদর পশ্চিম প্রান্তে দেউলপাড়ার বৌদ্ধ মন্দির থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামটি কৃষি প্রধান গ্রাম চারিদিকে সবুজে ঘেরা এক মরোরম পরিবেশ। রসুলপুর নামটা কবে হয়েছে তা সঠিক জানা যায় না। বর্তমানে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বাস করেন।

অতীত কালে এই গ্রামের নাম ছিলো ভাগীরথপুর। 

প্রায় ছয় সাত বছর পূর্বে  জয়হরি চক্রবর্তী নামে এক ব্রহ্মণ রাজা এখানে রাজত্ব করতেন,তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কে কত কাল রাজত্ব করে ছিলো তা ঠিক জানা যায় না। জয়হরি চক্রবর্তী বামুন রাজা নামে পরিচিত ছিলেন। এই রাজার গড়,বাড়ি তার অন্তঃপুর মধ্যস্থিত জয়হরি পুকুর (বর্তমানে জলহরি পুকুর নামে পরিচিত) এবং বিধবা কন্যা নীলাবতী প্রতিষ্ঠিত লীলাপুকুর এখনো তাদের স্মৃতি রক্ষা করছে।জয়হরি চক্রবর্তীর কুলদেবতা এখনো রসুলপুর গ্রামে আছেন। রাজা জয়হরি স্বর্ধম্ম নিষ্ঠা সহকারে পালন করতেন। তিনি সদব্রাহ্মণ ছিলেন। তার কোনো পুত্রসন্তান ছিলো না।


ত্রয়োদশ শতাব্দীর থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ইসলামের সামাজিক প্রতিষ্ঠার অভিযান চলে। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে হুগলি জেলায় বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজা রাজত্ব করত। মুসলিম গাজীরা এই সব অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করতে এসে ধর্মযুদ্ধের নিহত হয়ে পীরত্ব লাভ করেন। এ বিষয়ে স্টেপেলটন সাহেব লিখিয়াছেন---


 দিল্লির সুতলান গাজী ও আউলিয়াদের পাঠিয়ে ভিতর থেকে বঙ্গদেশে জয়করবার চেষ্টা করত। এটি তাদের রাজনীতির একটি কৌশল ছিলো। তার মতে এই গাজীরা ও আউলিয়ারা দিল্লির পঞ্চম বাহিনী। সাধারণত এই সব গাজী সাহেবরা হিন্দুদের এলাকায় প্রবেশ করে সামান্য কারণে ঝগড়া সৃষ্টি করত। তার মধ্যে পান্ডুয়ার পীরেরা উল্লেখযোগ্য। রসুলপুরেও মনসুর নামে এক ফকির এসে রাজা জয়হরি চক্রবর্তীর সাথে ঝগড়ার সৃষ্টি করে। কিংবদন্তি আছে তিনি একটি বিড়ালের গলায় গোমাংস বেঁধে রাজার ভোজনকালে রাজান্তঃপুর মধ্যে ছেড়ে দেন। বিড়াল রাজার ভোজন পাত্রে স্পর্শ করায় রাজা আপনাকে স্বধর্মভ্রষ্ট বলে মনে করেন এবং সপরিবারে জয়হরি পুকুরে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করেন। বস্তুতঃ এইরূপ ঘটনা নিতান্ত অসম্ভব। হিন্দু রাজা সধর্ম পালন ভালোই বুঝতেন। প্রায়শ্চিত করলে এরূপ অনৈচ্ছিক বা অজ্ঞানকৃত আপরাধের মুক্তি লাভ ঘটত। তা না করে তিনি যে আত্মহত্যা মত গুরুতর আপরাধে লিপ্ত হবে এটা বিশ্বাস করা একপ্রকার অসম্ভব। দক্ষিণ রাঢ় নামে গ্রন্থ পাঠ করে জানতে পারি মনসুর ফকির রাজ্য লালসার বশবর্ত্তী না হলে এমন কাজ কখনই করতেন না। মনসুর ফকির সৈন্য সংগ্রহ করে জয়হরি রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজা জয়হরি আপনার সৈন্য নিয়ে শত্রুর সন্মুখীন হবার জন্য বাহির হন। রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগে রানী ও কন্যা লীলাবতীকে বলে যান যে আমি সঙ্গে করে কয়েকটি পায়রা নিয়ে যাচ্ছি। যতক্ষন জীবত থেকে যুদ্ধ করবো তক্ষন  পায়রা গুলো কে যত্নে রক্ষা করবো। আমার মৃত্য হলে পায়রা গুলি উড়িয়ে দেবো তখন তোমাদের যা কর্তব্য তা করবে। গড়ের পূর্ব দিকের ময়দানে মনসুরের সাথে বামুন রাজার যুদ্ধ হয়। জয়হরি এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গড়ের দিকে পায়রা গুলি উড়িয়ে দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। তা দেখে রাণী ও রাজকন্যা জলহরি পুকুরে জলে ডুবদিয়ে আত্মহত্যা করেন। গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারি যেই স্থানে যুদ্ধ হয়েছিলো গ্রামবাসীরা জমি খননের সময় মাথার খুলি মানুষের হাড় ইত্যাদি অনেক উদ্ধার করেছে।


জলে ডুবে আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আর একটি মত প্রচলিত আছে। বামুন রাজা যখন পরাজয়ের উপক্রম হলেন তখন রাজবাটী ফিরে রানী ও রাজকন্যা সহ জলহরি পুকুরের ডুবে প্রাণ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রাজকন্যা লীলাবতী আত্মহত্যা করতে অস্বীকার  করেন। ফলে বামুন রাজা লীলাবতীর মুন্ডু কেটে হত্যা করেন। এই মুন্ডকে উপলক্ষ্য করে রসুলপুরের সংলগ্ন তালপুরে রাজকন্যার পূজা করা হয় এমন শোনাযায়। 

যাইহোক যুদ্ধে মনসুর জয়লাভ করেন এবং তার হাতেই রাজ্য হস্তগত হয়। আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক শ্রী অম্বিকাচরণ গুপ্ত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন মনসুরের তিন ভাই পরবর্তীকালে এই দেশে এসে পীরত্ব লাভ করেন। তার মধ্যে আঁকড়ি শ্রীরামপুরে একজন পীর, পারাম্বুয়ার সাহাবাজারের গোলাম আলী সাহেব ও মায়াপুরের বাবা গায়েস পীর। রাজ্য জয়লাভ করে মনসুর ফকির একজন শিষ্যকে রসুলপুরে স্থাপিত করেন।তিনি নবাব সরকার হইতে খাঁ চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত হন। কয়েক পুরুষ পরে কেবল মাত্র চৌধুরী উপাধি থাকে। মনসুরের শিষ্যে যারা গড়ের মধ্যে অবস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ডাক্তার শ্রীযুক্ত গোলাম হোসেন চৌধুরী প্রপিতামহের পিতৃব্য বর্ধমান জেলার  খন্ডঘোষ নামক স্থানে। চৌধুরী বংশীয় এক ব্যক্তি মনসুরের চেলার বংশধরের কন্যাকে বিবাহ করে শ্বশুরের অপুল্রুত্ব প্রযুক্ত হয়ে এখানেই বাস করেন এবং তার বিষয়-বৈভবের উত্তরআধীকারি হন। ডাক্তার গোলাম হোসেন এর তথ্য অনুযায়ী গোলাম হোসেন ছিলেন মনসুরে চেলার ২৪/২৫ পুরুষের উত্তরসুরী । এখনো এই গ্রামে তাদের বংশধর বাস করেন। একটি পুকুরের ধারে ফকির মনসুর 'পীর' রুপে অবস্থান করছেন।


এছাড়া জয়হরি পুকুরের অপভ্রংশ হয়ে জলহরি পুকুর হয়। এই জলহরি পুকুর নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। সেকালের দরিদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়ের পিতা বিয়ের জন্য উক্ত পকুরের সামনে প্রার্থনা করলে পুকুর থেকে পিতলের জিনিসপত্র উঠে আসতো। 


বর্ধমান রাজা আমলে রসুলপুর বালীগড়ীর জমিদারের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। রসুলপুর মৌজা ছিলো দুটি জাগিদার এর অন্তর্ভুক্ত কাজি ও চক্রবর্তী বাবুদের। রসুলপুরে ঘোড়া দৌড় মাঠ নামে একটি ফুটবল গ্রাউন্ড রয়েছে পূর্বকালের এখানে ঘোড়া দৌড় হত শোনা যায়। কাজি ও বাবুদের লেঠেলদের মধ্যে অনেক প্রতিযোগিতা হত।


কাজী ও চক্রবর্তী বাবুদের বংশধর এখন এই গ্রামে বসবাস করেন। কাজীদের যে পুরাতন বাড়িটি ছিলো সেটি জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।


যাহোক রসুলপুর যে হুগলি জেলার এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ গ্রাম এ কথা স্বীকার করতেই হয়।


      ©©©  তরুন কোলে  ©©©


পথনির্দেশ----

 

তারকেশ্বর,তালপুর,তকিপুর স্টেশনে নেমে রসুলপুর  যাওয়া যায়।


তথ্যসূত্রঃ- 


১) হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, সুধীর কুমার মিত্র।

২)পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ। 

৩) বাঙলার ইতিহাস, প্রভাসচরন সেন।

৪) দক্ষিণ রাঢ়,অম্বিকাচরণ গুপ্ত।

৫)হুগলি লৌকিক দেবতা, কৌশিক পাল চৌধুরী। 

৬)উইকিপিডিয়া

৭)স্থানীয় বাসিন্দা


No comments