Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জানা অজানা প্রফুল্ল চন্দ্র রায় :

জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি কাটান বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছোট এক কামারায়। মাথার উপর পাখাকেও তিনি বিলাস দ্রব্য মনে করে ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান। তখনকার দিনে একটি নিয়ম ছিল শিক্ষক যখন ক্লাস নিবেন তার আগে একজন কর্মচারী এসে ব্ল্যাকবোর্ড, টেবল মুছ…

 




জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি কাটান বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছোট এক কামারায়। মাথার উপর পাখাকেও তিনি বিলাস দ্রব্য মনে করে ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান। তখনকার দিনে একটি নিয়ম ছিল শিক্ষক যখন ক্লাস নিবেন তার আগে একজন কর্মচারী এসে ব্ল্যাকবোর্ড, টেবল মুছে দেবে। এক শীতের দিনে দেখা গেল এক কর্মচারী কোট পরে ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে এল। কিছুক্ষন পর প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও একি রকম একটি কোট পরে ক্লাসে প্রবেশ করলেন পরে জানা যায় যে তিনি একই কাপড় থেকে দুটি কোট বানিয়েছিলেন, একটি তার জন্য আরেকটি ওই কর্মচারীর জন্য। ...

● জানা অজানা প্রফুল্ল চন্দ্র রায় : 


রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়! ছোটবেলা থেকে ডাল্টন, রাদারফোর্ড, বোর, অ্যাভোগেড্রোর নাম শুনে আসা আমরা কজন জানি বিখ্যাত এই বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম ?

১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রাটুলি গ্রামে জন্ম নেন মহান এই বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি মা ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতা হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র। হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন। পড়াশুনা শুরু করেন নিজের গ্রামে নিজের বাবার প্রতিষ্ঠা করা এম.ই স্কুলে। জমিদার বংশের সন্তান হলেও অত্যন্ত সাধাসিধে জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় তার অন্যতম শখ ছিল স্কুল পালিয়ে পাতাঘেরা গাছের মগডালে বসে থাকা!


১৮৭২ সালে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কলকাতা হেয়ার স্কুলে। কিন্তু হঠাত করেই অবনতি ঘটে শারীরিক অবস্থার। রক্ত আমাশয়ের কবলে পড়ে ২ বছর ভুগেন তিনি। তবে এই রোগ অন্য আরেক দিক দিয়ে তার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। এই ২ বছর নিয়ে প্রফুল্ল চন্দ্র তার ব্যাক্তিগত ডায়রীতে লিখেন, 

     

   “স্কুলের শুকনো বইখাতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম নিজের পছন্দানুযায়ী বই পড়ার”। 


এই ২ বছরে তিনি তার বাবার বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালায় ডুবে ছিলেন। আর অর্জন করেছিলেন নানা বিষয়ে অগাধ জ্ঞানভান্ডার।


১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতায় ফিরে যেয়ে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন।


প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় কলেজে তৎকালীন রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন আলেক্সান্ডার পেডলার।  পেডলার মূলত তার পাঠদান পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক দিকের চেয়ে ব্যবহারিক দিককেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। রসায়নের মনোমুগ্ধকর এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে অতি সহজেই তিনি আকৃষ্ট করতেন তার শিক্ষার্থীদের। তরুণ প্রফুল্ল ছিলেন তার মুগ্ধ শ্রোতা।  পেডলার যেসব এক্সপেরিমেন্ট করতেন তিনি বাড়ি ফিরে তার নিজের বানানো রসায়ন ল্যাবে একই পরীক্ষাগুলো পুনরায় করতেন। মূলত রসায়নের প্রতি তার ভালোলাগার শুরু ওখান থেকেই। যদিও তার প্রথম ভালোবাসা ছিল সাহিত্য। যার ধারাবাহিকতায় তিনি ঘরে বসেই ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ ভাষা রপ্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রসায়নেই পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সম্মানসূচক গিলক্রিস্ট বৃত্তি(সারা ভারত থেকে সেবছর মাত্র দুজন এই বৃত্তির জন্য উত্তীর্ণ হন) নিয়ে পাড়ি জমান স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবারগে। সেখান থেকে নেন বিএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রী। তার থিসিসের বিষয় ছিল, “কনজুগেটেড সালফেট অফ কপার ম্যাগনেসিয়াম গ্রুপ”। অসাধারণ এক গবেষনার জন্য তিনি সে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের “হোপ পুরষ্কার” লাভ করেন এবং আরো একবছর থিসিস করার অনুমতি পান। তার জ্ঞানের গভীরতা, দায়িত্বশীলতা , সুন্দর আচরণে তার সহপাঠী ও শিক্ষকগণ এতোই মুগ্ধ ছিলেন যে তাকে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকেল সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। অশিক্ষা , কুসংস্কারে ঘেরা উপমহাদেশের কোন শিক্ষার্থীর এমন বিরল নিদর্শন সত্যিই সেসময় ছিল প্রশংসার দাবিদার।


সেসময়কার আরো একটি ঘটনা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের তেজস্বীতার পরিচয় বহন করে। ১৮৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর স্যার স্টারফোরড নর্থকোর্ট এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন যার বিষয়বস্তু ছিল “ব্রিটিশ দাসত্বের আগে ও পরে উপমহাদেশের চালচিত্র।" প্রফুল্ল চন্দ্র এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেন কিভাবে উপমহাদেশীয় ব্রিটিশ শাসকরা শিক্ষা সংস্কার এর দিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যায় অবিচার লুটপাটের দিকে অধিক ঝুকে পড়ছে। যদিও তিনি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতেন নি, তারপরও তার উচ্চমার্গীয় ও সোজাসাপ্টা কথা বিচারকদের মুগ্ধ করে। প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর প্রবন্ধের একটি কপি ভারতীয় ছাত্র সংগঠন গুলোর কাছে প্রেরণ করেন ও উপমহাদেশীয় শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে বলেন। এছাড়া তিনি প্রবন্ধটি বিভিন্ন ব্রিটিশ গণমাধ্যমেও প্রচারের ব্যাবস্থা করেন। প্রথম দিককার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এমন পদক্ষেপ সত্যিই ছিল প্রশংসার দাবিদার।

১৮৮৮ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র নিজ ভূমির শিক্ষা ও গবেষণার প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেসময়ে ব্রিটিশরা শিক্ষক সমাজের জন্য দুটি আলাদা স্তরের সৃষ্টি করেছিল। ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ও প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস । ইম্পেরিয়ালের অধীনে থাকতো ব্রিটিশ শিক্ষকরা। তারা উচ্চ বেতন ও গবেষনার আধুনিক সুযোগসুবিধা পেত। যার ফলে এডিনবার্গের মত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করে এসেও প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মাত্র ২৫০ টাকার নাম সর্বস্ব বেতনে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান করেন। তখনকার আরেক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুও ছিলেন একই বৈষম্যের শিকার। তবে প্রফুল্ল চন্দ্র থেমে থাকেন নি সব বাধা মেনে নিয়েই তিনি পাঠদান শুরু করেন। সীমাবদ্ধতাকে শক্তি হিসেবে রূপান্তর করেন তিনি। হাতের কাছের যেকোন কিছু দিয়েই তিনি রসায়নের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারতেন ও শিক্ষার্থীদের কাছে মনোমুগ্ধকর ভাবে উপস্থাপন করতেন। তবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন রসায়নকে শুধু শ্রেণী কক্ষে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। একে কাজে লাগাতে হুবে, গবেষনা করতে হবে। ভারতের উন্নয়ন নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ গবেষনার উপর এটা তিনি ভালো করেই জানতেন। তাই তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার বীজ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন । যারা প্রতিনিধিত্ব করবে সমগ্র দেশের। তিনি বলে যান, 

    “ভালো ছেলেরা হল পুতুলের মত। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তারা দেখবে না। কান আছে কিন্তু শুনবে না। তাদের কোন ব্যক্তিত্ব নেই , নিজস্ব স্বকীয়তা নেই। তারা তাদের ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবে না, তারা সবাইকে অনুকরণ করে মাত্র” 

তাই তিনি শুধু ভালো মেধাবী শিক্ষার্থীই চান নি চেয়েছিলেন একদল দেশপ্রেমী মেধাবী। তিনি কিছু ত্যগী মেধাবীকে এক ছাদের নিচে জড়ো করেছিলেন এবং তাদের নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক দল গড়ে তুলেন । এই দলের অনেক মেধাবী (পঞ্চানন নিয়োগী, নিল রতন ধর, প্রিয়াদা রঞ্জন রায়, বিরেশ চন্দ্র গুহ, এস এস ভাটনগর প্রমুখ) পরবর্তীতে সারা ভারতবর্ষে বিজ্ঞান গবেষনার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছিলেন।

তৎকালীন সময়ে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় নিজে প্রায় রসায়নের ১৫০টি গবেষনা পত্র প্রকাশ করেছিলেন, যার ৬০ টি প্রকাশ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সংস্থা রয়েল সোসাইটির সংবাদপত্রে।

তিনি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।

১৯১৬ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র প্রেসিডেন্সী ছেড়ে বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে ৬০ বছর বয়সে তিনি তার পরবর্তী সমস্ত বেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যানে উৎসর্গ করেন। যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেলোশিপকারীদের ২ লাখ ভারতীয় রুপি প্রদান করা হয়। এভাবে তিনি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষাদান করে গেছেন।


জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি কাটান বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছোট এক কামারায়। মাথার উপর পাখাকেও তিনি বিলাস দ্রব্য মনে করে ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান। তখনকার দিনে একটি নিয়ম ছিল শিক্ষক যখন ক্লাস নিবেন তার আগে একজন কর্মচারী এসে ব্ল্যাকবোর্ড, টেবল মুছে দেবে। এক শীতের দিনে দেখা গেল এক কর্মচারী কোট পরে ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে এল। কিছুক্ষন পর প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও একি রকম একটি কোট পরে ক্লাসে প্রবেশ করলেন। পরে জানা যায় যে তিনি একই কাপড় থেকে দুটি কোট বানিয়েছিলেন, একটি তার জন্য আরেকটি ওই কর্মচারীর জন্য। দৈনিক আহারে তিনি কখনও ১ পয়সার বেশি খরচ করতেন না, কিন্তু কেউ কিছুর সাহায্য চাইলে হাজার টাকা দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেন না তিনি। তাঁকে নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীর বানী উল্লেখযোগ্য ....

বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন :

  “আচার্য নিজের জয়কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাঙালির অহংকার, বিশ্বের গর্ব। তার র্কীতি বিশ্বে থাকবে চির বহমান। এ মহামানবকে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।"

আচার্য সম্পর্কে গান্ধীজি বলেছেন :

  “এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে সাধারণ ভারতীয় পোশাক পরিহিত একজন মানুষ, যার আচার- ব্যবহার আরও সাধারণ, আসলে এক বড় মাপের বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক হিসাবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃত। আমি রূদ্ধ নি:শ্বাসে শুনলাম যে আচার্য রায় তার রাজচিত বেতন থেকে সামান্য কিছু টাকা        নিজের জন্য রেখে বাকি সবটাই জনহিতকর কাজে বিশেষ করে দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্যদানে নিয়োজিত করতেন। ভারতের এই মহান সেবক এই তিরিশ বছরে একটুও বদলাননি। বিরামহীন সেবা, উদ্দীপনা এবং আশাবাদের যে দৃষ্টান্ত তিনি আমাদের সামনে রেখেছেন তা নিয়ে অবশ্যই আমরা গর্ব করতে পারি”।

সারা জীবন বিজ্ঞান, দেশ , মানুষের উৎকর্ষ সাধনকারী এই মহান বিজ্ঞানী ৮৩ বছর বয়সে ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন না ফেরার দেশে গমন করেন। আমরা কি পেরেছি তাকে যোগ্য সম্মান দিতে ? 



No comments