মানসিক প্রতিবন্ধকতা : এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও বেলিন্ডা ক্লার্ক -আশিস কুমার পণ্ডা
সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ধারণা একেবারে অচেনা ছিল না। ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমবার সীমিত ওভারের একটি ঘরোয়া ম্যাচও হয়। কিন্তু একদিনের আন্তর্জাত…
মানসিক প্রতিবন্ধকতা : এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও বেলিন্ডা ক্লার্ক -আশিস কুমার পণ্ডা
সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ধারণা একেবারে অচেনা ছিল না। ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমবার সীমিত ওভারের একটি ঘরোয়া ম্যাচও হয়। কিন্তু একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট (ODI) শুরু হয়েছিল একেবারে হঠাৎ করে, বলতে গেলে দুর্ঘটনাবশত। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে মেলবোর্নে টেস্ট ম্যাচ চলছিল। একটানা বৃষ্টি, ম্যাচ ড্র হওয়ার সম্ভাবনা, আর আর্থিক ক্ষতির ভয়—সব মিলিয়ে টেস্টের পঞ্চম দিনে আয়োজন করা হয় এক বিশেষ ৪০-ওভারের ম্যাচ। এটাই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। সেদিন যা ছিল কেবল এক জরুরি বিকল্প, তাই-ই হয়ে ওঠে এক ঐতিহাসিক সূচনা। মহিলাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু হয় আরও দুই বছর পরে—২৩ জুন, ১৯৭৩ সালে। বদলাতে শুরু করে ক্রিকেটের রূপরেখা।
তবে, শুরুর দিকে ক্রিকেটাররা বিভক্ত ছিলেন—কেউ কেউ এর মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, আবার কেউ এই নতুন চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু দর্শকরা একে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। খেলার দ্রুত গতি, রঙিন জার্সি, দিনের আলো আর রাতে ফ্লাড লাইটে খেলা দেখার মজা, এক দিনের মধ্যেই নিশ্চিত জয় বা হার—সব মিলিয়ে ক্রিকেট আরও রোমাঞ্চকর ও আরও কাছের হয়ে ওঠে। স্পনসর এবং সম্প্রচারকারী সংস্থাগুলি আগাম বুঝতে পারেন —এই ক্রিকেটের এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা—বেশি ম্যাচ, বেশি দর্শক, বেশি আয়। তবে সবাই কিন্তু এতটা আশাবাদী ছিলেন না। সমালোচকরা সরাসরিই বললেন, “এই খেলায় না আছে ধৈর্যের পরীক্ষার সুযোগ, না আছে গভীরতা। এটি ক্রিকেটের পুরোনো সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতাকে নষ্ট করছে।” পরিসংখ্যানবিদরা যুক্তি দিলেন, “৫০ ওভারে তো সময়ই কম—রেকর্ড গড়ার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ নেই।” এমনকি, কেউ কেউ তো কোন রকম রাখঢাক না রেখেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিলেন, “এই ছোট্ট ফরম্যাটে ডাবল সেঞ্চুরি? অসম্ভব!”
বিচিত্রভাবে, সেই দেয়াল ছাব্বিশ বছর ধরে অক্ষতই রয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেটাররা কয়েকবার, কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। ওভার কম, চাপ বেশি, সময় নেই—প্রায় সকলের ধারণা হয়ে গিয়েছিল, সত্যিই এ অসম্ভব!
আর তখনই এলেন ২৭ বছরের বেলিন্ডা ক্লার্ক—অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। ১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মুম্বাইয়ের MIG গ্রাউন্ডে, ডেনমার্কের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ১,৫২০তম (পুরুষ এবং মহিলা মিলিয়ে) একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তিনি গড়লেন ইতিহাস। মাত্র ১৫৫ বলে তিনি করলেন অপরাজিত ২২৯ রান—প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি—যা টেস্ট ক্রিকেটেও এত কম সংখ্যক বলে কেউ তখনো করে উঠতে পারেননি। এটি ছিল সময়জ্ঞান, শট নির্বাচনের নিখুঁততা, ধৈর্য, মনোসংযোগ, পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস—এই সবকিছুর এক দুর্দান্ত ও অনন্য প্রদর্শনী। গ্যালারি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। “অসম্ভব” এখন সম্ভব হয়ে গেল। আর তখনই এক প্রজন্মের মানসিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বেলিন্ডার পর, একে একে দশজন পুরুষ আর একজন মহিলা ক্রিকেটার ওডিআই-তে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রোহিত শর্মা, যিনি করেছেন তিন তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি, আর যাঁর নামের পাশে আছে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড—২৬৪!
ইতিহাস এবং এই গল্প আমাদের বারবার শেখায়—সীমা আসলে এক ধরনের মনের কল্পনা। যেটাকে আমরা “অসম্ভব” বলি, সেটা হয়তো শুধু "কেউ এখনও বিশ্বাস করেননি" বা "কেউ এখনও করে দেখাননি। বেলিন্ডা ক্লার্ক যদি সমালোচকদের কথা শুনে থেমে যেতেন, তাহলে হয়তো আজও আমরা প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। কিন্তু তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন—নিজের দক্ষতা, প্রস্তুতি, অধ্যবসায়, আর নিজের স্বপ্নের উপর। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ব্যাটসম্যানদের পথ দেখিয়েছিলেন। “অসম্ভব”কে “সম্ভব” করে তোলার এই শিক্ষা শুধু ক্রিকেটেই নয়—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হোক তা ব্যবসা, পড়াশোনা, শিল্প বা গবেষণা—যারা মানসিক সীমারেখা ভাঙতে জানে, তারাই ইতিহাস তৈরি করে।
তাই, শেষ কথা হোল, যখন কেউ তোমাকে বলেন, “এটা সম্ভব নয়,” তখন বুঝে নিও—ওরা হয়তো ভয়, অভ্যাস, বা কল্পনার সীমাবদ্ধতা থেকে বলছেন। ওদের বলতে দাও। তুমি চলতে থাকো। আর যখন তুমি অনেক দূর এগিয়ে যাবে, ওরাই বলবেন, ‘ওটাই তো পথ!’
No comments