আজ দৈনিক সুখবর পত্রিকার বইঘর পাতায় প্রকাশিত। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অশেষ ধন্যবাদ জানাই আলোচক শ্রী আশিস মিশ্র মহাশয়, পত্রিকার সম্পাদক ও বিভাগীয় সম্পাদক মহাশয়কে।
কবিতার সব ছোঁয়াই স্পর্শ হয় আশিস মিশ্র
কবে, কখন, কোন মুহূর্ত থেকে তিনি কবি…
আজ দৈনিক সুখবর পত্রিকার বইঘর পাতায় প্রকাশিত। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অশেষ ধন্যবাদ জানাই আলোচক শ্রী আশিস মিশ্র মহাশয়, পত্রিকার সম্পাদক ও বিভাগীয় সম্পাদক মহাশয়কে।
কবিতার সব ছোঁয়াই স্পর্শ হয়
আশিস মিশ্র
কবে, কখন, কোন মুহূর্ত থেকে তিনি কবিতায় নিজে সমর্পিতা হলেন, সে-কথা গোপন থাকলেও কবিতাই যে তাঁর একান্ত অন্তর-ভাষ্য, তা আর গোপন থাকেনি। যে কোনো কবিবাক্যই যে আত্মজৈবনিক, তা কখনো বর্ণনা, কখনো সাংকেতিক, কখনো গল্প, কখনো রহস্যময়তার ভেতর থেকেই সাদা পাতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান, সেই ইমেজ বা বাকপ্রতিমা---ছন্দে বা গদ্যের অসমান চলনে চরণগুলি সম্পূর্ণ করে তোলাই কবির কাজ। কবি পম্পা মণ্ডল তেমনই একজন কবি , যিনি নানা অনুষঙ্গকে নানাভাবে অনুভবে ধরেছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে। এক একটি কবিতাকে মনে হয় কবির অনুভবের আলাদা আলাদা সোপান। কখনো ছকভাঙা ছন্দে, কখনো অসমান পংক্তির চলনে জীবনের প্রেম, প্রকৃতি, স্মৃতি, বিষাদ, বিপন্নতা থেকে প্রতিবাদ -- তাঁর কবিবাক্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এবং এই গ্রন্থে কবিতার অনুষঙ্গ অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে কবিতাগুলি সাজানো, যা বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে সহজ করে ধরা দেয়। আমরা ডুব দিই আসুন পম্পা মণ্ডলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ' সব ছোঁয়া স্পর্শ হয় না ' গ্রন্থে। যে কবিতাগুলি গ্রন্থিত হওয়ার আগে বাংলা ভাষার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে প্রকাশিত হয়েছে।
সাত ফর্মায় গ্রন্থিত কবিতাগুলি পম্পা তিনটি পর্বে সাজিয়েছেন। প্রতিটি পর্বের শিরোনামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছবি এঁকেছেন বিষ্ণু সামন্ত। তিনটি পর্ব হল-- সব ছোঁয়া স্পর্শ হয় না, বসন্ত ডিপ্রেশনে আছে ও তোমার প্রিয় জলতরঙ্গ। কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য অনুযায়ী এই ভাগ। তাতে পাঠকের মনের সঙ্গে লেখকের মনের নিবিড় হওয়া সহজ। এবং কবিও সহজ করে তাঁর প্রতিটি চরণ লিখে গেছেন। একটি কবিতাও দুর্বোধ্য নয়। এটিই এই গ্রন্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন সহজ এই বাকপ্রতিমা --'' প্রেম হলো ইছামতীর সিঁথি জুড়ে / গোধূলির চুমুর মতো উদ্দাম,/ স্থলপদ্মের পাপড়িতে বসা মথটার মতো একগুঁয়ে, / খেজুর গুড়ে বসা মৌমাছিটার মতো নেশাখোর। '' এই ইমেজ আসলে কবির ফেলে আসা মানচিত্রের রূপ। ইছামতীর নিকটে বেড়ে ওঠা, মহানগরের পথে হেঁটে ছাত্রীবেলা কাটানো, প্রকৃতির রঙ গায়ে মাখা এক কিশোরীর মনে কাব্যের আলো- অন্ধকার ফুটে উঠলো কখন , সে নিজেই জানে না! এক নদী ছেড়ে আসার পরও আর এক নদী তাকে সঙ্গ দেয় এখন। তার নাম হলদী। যে শিল্পনগরীতে থেকে তিনি তাঁর বেশিরভাগ পংক্তি রচনা করেছেন। তাঁর মীরা ও ঈশ্বরকে তিনি কীভাবে মেলালেন --" পার্কের নির্জন বেঞ্চে বসে হলদী নদীতে / বসন্তকালীন সূর্যাস্ত দেখবো আর ভাববো! / আসলে ইহজীবনেই কেউ ঈশ্বর হয়ে ওঠেন, / ইহজীবনেই কেউ বা হয়ে ওঠে মীরা! "
কবির পথ বদল হলেও পৃথিবী বদল হয়নি। তিনি কিন্তু ভোলেননি পদ্মাপারের শাহানূরদাকে --" শাহানূরদাকে তাঁর কবিতায় আইবুড়ি নদী নিয়ে / আদিখ্যেতা করতে দেখেছি বহুবার ; / শাহানূরদা পদ্মাপারের মানুষ ;/ তার স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আইবুড়ি। " পম্পার কবিতাগুলি পড়তে পড়তে কবি প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি চরণ মনে পড়ে --" একদিন একসময় অজস্র শরীর থেকে / অজস্র শরীরের স্পর্শ থেকে / ইতিকথার কুসুমদের অজস্র / অপার মন মুখ তুলে তাকায় / নিদারুণ জেগে ওঠে! / মনোময় শরীরের ভাষারা / উদ্দেশ্য থেকে নিরুদ্দেশের পথে হাঁটতে থাকে! " পম্পা মণ্ডলের কবিতার শরীরি ভাষার উদ্দেশ্য থাকে আবার সেই শরীরের ভাষা কখনো কখনো নিরুদ্দেশের পথেও হেঁটে যায়। তাঁর পথ এমনই --" একদিন সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো আকাশে / পূর্ব পুরুষের মতো / ভাগাভাগি করে দেবো সব। / বাসনকোসনের মতো ভাগ করবো মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর "।
এতোগুলি চরণ লেখার পর পম্পার কবিপ্রতিভা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু বীতশোক ভট্টাচার্য কী বলেছেন তাঁর ' কবিকাহিনী ' প্রবন্ধে --" মাতৃগর্ভে থেকে বেদপাঠ করার মতো সহজাত প্রতিভা নিয়ে কোনো বাঙালি কবিকে জন্মাতে দেখা যায় না। এ মন্দের ভালো যে অন্যান্য চর্চার তুলনায় কাব্যরচনার জায়গায় শিশুপ্রতিভা অনেক কম। রবীন্দ্রনাথ শৈশবে আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি-র মতো কবিতা যদি রচনা না করতেন তাহলেও বাঙালি কবিতা পাঠকের রস উপভোগে কোন ঘাটতি হতো না। ছেলেবেলায় প্রায় সব বাঙালি ছেলে কমবেশি পদ্য লেখে আর তাদের ভেতর এক আধজনই সত্যকারের কবি হয়। " পম্পার ভেতর কবিসত্তার যে ঢেউ, তা কখনো জোয়ারের, কখনো ভাটার মতো। কখনো সে শিশুর মতো সরল, মেঠো পথে হেঁটে যাওয়া শান্ত বালিকা। তিনি লিখেছেন --" সেই প্রভাতে সেই মেয়েটি গীতাঞ্জলি পড়ে / কতক শুভ্র কিছু ধূসর মেঘে নভ ভরে। "
তাঁর কবিতার আঙ্গিক কখনো গদ্যের অসমান চলনে, কখনো ছন্দে। এ প্রসঙ্গে সুজিত সরকারের প্রবন্ধ
' কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য ' থেকে একটি অংশ কোড করছি --" দীর্ঘদিনের একজন কবিতাপাঠক হিসেবে এটুকু বলতে পারি, কবিতা মূলত নতুন হয়ে ওঠে দু' ভাবে --বিষয়ের দিক থেকে, আঙ্গিকের দিক থেকে। আমরা জানি, ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত কবি অরুণ মিত্র একসময় টানা গদ্যে কবিতা লেখার রীতিটির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। ষাট দশকের শ্রুতি- আন্দোলনের কবিরাও কবিতায় ' দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যঞ্জন ' আনার প্রয়াস থেকে ফরাসি কবিদের অনুসরণে কবিতার আঙ্গিকে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। " পম্পার আমনের ইতিকথা, গাঁয়ের নাম কাজললতা সহ বেশ কিছু কবিতায় টানা গদ্যের চলনটি রয়েছে।
যেমন -- " আমাদের কাজললতা গাঁয়ের বাড়িটার পশ্চিমের ঝুল বারান্দার কথা তোর মনে পড়ে ময়ূরাক্ষী? সেগুন মেহগনির জঙ্গল আর শালুক দিঘি? "
মনে তো পড়েই। মনে হয় সে কত আবশ্যিক --" হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে / নিঃশ্বাসের থেকেও তুমি
আবশ্যিক। " হেমন্তের অনুষঙ্গে বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে তাঁর। বাংলা ভাষার কবিরা প্রায় সব ঋতুকে স্পর্শ করেছেন। হেমন্তকে যেন একটু বেশি। তা আমরা জীবনানন্দ, শক্তি, বিনয় পড়লে জানতে পারি। সে যাই হোক, পম্পার কাজ শুধু কবিতা লেখা। যা কবির কাজ। কবির কাজ নিয়ে শম্ভু রক্ষিত যা বলেছেন --
" কবির কাজ দাম্ভিক মূর্খদের সঙ্গে লড়াই নয়। লড়াই এবং হারজিতের খেলায় কবি তাই কখনও জড়িয়ে পড়েন না। কবি সত্তায় পরিস্কার ও অকলঙ্ক, সুকুমার, অক্ষত... "
বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছে কবির আত্মজা সমৃদ্ধি মণ্ডল।
No comments