পোমোডোরো (টমেটো) পদ্ধতি: সময় ব্যবস্থাপনার এক অনন্য উপায়--আশিস কুমার পণ্ডা
১৯৮৭ সালের এক মেঘলা সেপ্টেম্বরের বিকেল। রোম শহরের এক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফ্রান্সেস্কো চিরিল্লো গালে হাত দিয়ে বসে আছেন তার পড়ার টেবিলের সামনে। চার…
পোমোডোরো (টমেটো) পদ্ধতি: সময় ব্যবস্থাপনার এক অনন্য উপায়--আশিস কুমার পণ্ডা
১৯৮৭ সালের এক মেঘলা সেপ্টেম্বরের বিকেল। রোম শহরের এক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফ্রান্সেস্কো চিরিল্লো গালে হাত দিয়ে বসে আছেন তার পড়ার টেবিলের সামনে। চারপাশে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে বই, নোট আর সমাজবিদ্যার পরীক্ষার জন্য অসমাপ্ত কাজের (assignment) স্তূপ। পরীক্ষার তারিখ এগিয়ে আসছে, কিন্তু ফ্রান্সেস্কো কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসাতে পারছেন না। একটানা কয়েক মিনিটের বেশি মনোযোগ ধরে রাখা যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বই খুলে বসেন, কিন্তু কখনও চোখ চলে যায় জানালার বাইরে, কখনও বা মন উড়ে বেড়ায় অজানার উদ্দেশে।
হঠাৎ একদিন, বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে নিজেকেই চ্যালেঞ্জ করলেন ফ্রান্সেস্কো, “আমি কি অন্তত ১০ মিনিট পুরো মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না? মাত্র ১০ মিনিট?”
টাইম মাপার জন্যে কিছু উপকরণ খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ রান্নাঘরের এক ড্রয়ারে তার চোখে পড়ল—একটি উজ্জ্বল লাল রঙের, টমেটোর আকৃতির কিচেন টাইমার। তিনি সেটিকে ১০ মিনিটে ঘুরিয়ে দিয়ে বই-এর পাতায় মন দিলেন। ঠিক দশ মিনিট পরে, নির্ধারিত সময়েই টাইমার বেজে উঠল। ফ্রান্সেস্কো একটু চমকে উঠলেন। তার চোখ চলে গেল ডেস্কের কোণে রাখা ছোট্ট টাইমারের দিকে। কী আশ্চর্য! সময় শেষ! এবার তার অবাক হওয়ার পালা। বহুদিন পরে,এই প্রথম, তিনি পুরো দশ মিনিট মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন। নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেননি, চোখ চলে যায়নি জানালার দিকে, মন ছুটে যায়নি কোন পুরানো চিন্তায় বা ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায়। সময়টা যেন থেমে ছিল শুধুই তারই জন্যে।
"আমি ও পারি!"—এই শব্দগুলি দৃঢ প্রত্যয় নিয়ে তার মাথায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। সেই ছোট্ট, অপ্রত্যাশিত সাফল্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। পরের কয়েক দিনে তিনি ধীরে ধীরে পড়াশোনার সময় বাড়িয়ে চললেন —১০, ১৫, ২০, শেষে ২৫ মিনিট। ফল মিলল। আবার করলেন, আবার ফল পেলেন। ফ্রান্সেসকো বুঝতে পারলেন, বড় কাজ কখনই এক লাফে শেষ করার চেষ্টা করা উচিত নয়; ধাপে ধাপে এগিয়ে চলাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। মনোযোগী পর্বগুলি ছোট হওয়ার দরুন ফ্রান্সেস্কোকে মানসিকভাবে সতেজ করে রাখতো এবং ছোট্ট বিরতিটাও ছিল তার পরিকল্পনারই একটি অংশ যা তাকে “কাজ না করার” অপরাধবোধ থেকেও মুক্তি দিত। অল্প সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে কাজ ও তার পরে এক ছোট বিরতি—এই সহজ এবং ছন্দময় চক্রের পুনরাবৃত্তি তাকে দীর্ঘ সময় ধরে স্থিরভাবে কাজ করে যাওয়ার শক্তি যোগাতে লাগলো এবং ধাপে ধাপে তিনি নিজেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তুললেন।
টমেটো-আকৃতির রান্নাঘরের এক টাইমারকে ব্যবহার করে ফ্রান্সেসকো গড়ে তুললেন সময়কে ঠিকভাবে কাজে লাগানোর সহজ ও কার্যকর এক পদ্ধতি। প্রথম ২৫ মিনিট মনোযোগ দিয়ে কাজ এবং তার পরে ৫ মিনিটের একটি বিরতি- এই দুই মিলে ৩০ মিনিটের পর্বের নাম দেওয়া হল এক ‘পোমোডোরো’। ‘পোমোডোরো’ শব্দটি এসেছে ইতালীয় ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘টমেটো’। এই নামটি তিনি রেখেছিলেন একটি ছোট টমেটো-আকৃতির টাইমার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, যেটি দিয়ে তিনি প্রথম এই পদ্ধতি শুরু করেছিলেন। এই পদ্ধতির ধাপগুলো খুব সরল:
· একটি নির্দিষ্ট কাজ বেছে নিন।
· ২৫ মিনিটের জন্য টাইমার সেট করুন।
· যতক্ষণ না টাইমার বেজে ওঠে, সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন।
· কাজ শেষে নিন ৫ মিনিটের একটি ছোট বিরতি—জল পান করুন, বাইরে তাকান, চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিন, বা কোন বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলুন।
· এখানেই একটি পোমোডোরো’র সমাপ্তি।
· প্রতি চারটি পোমোডোরোর শেষে নিন একটি বড় বিরতি (১৫–৩০ মিনিট)। এই সময়ে মোবাইল ঘাঁটতে পারেন, এক কাপ চা খেতে পারেন, বা একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।
স্বভাবতই মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়—২৫ মিনিটের কাজ এবং ঠিক তারপরে ৫ মিনিটের বিরতি- এই ছন্দের পেছনে বিজ্ঞানের কী ব্যাখ্যা রয়েছে? এক নজরে, এটা এলোমেলো বা ব্যক্তিগত পছন্দ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতকালে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ফ্রান্সেস্কোর এই চিন্তাধারার পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক যুক্তি।
স্নায়ুবিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্ক সাধারণত একটানা ২০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় গভীর মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এর মধ্যে ২৫ মিনিট একটি আদর্শ সময়সীমা বা এক ভারসাম্যপূর্ণ সময়, যা কোন কাজের জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ, আবার ক্লান্তি যেন চেপে না বসে সেজন্য যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত। এই সময়সীমা মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ ও বিশ্রামের মধ্যে উপযুক্ত সামঞ্জস্য তৈরি করে। ফলে যখন কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়, তখন মস্তিষ্কের উপর চাপ কমে যায় এবং উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে যায়।
প্রতিটি সফল পোমোডোরো একটি কাজ সম্পন্ন হওয়ার আনন্দ ও সন্তুষ্টির অনুভূতি এনে দেয়, যা মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের ‘সুখ হরমোন’এর নিঃসরণ ঘটায়। এই হরমোন আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে, ফলে আমরা উদ্যমী হই, মনোযোগ বাড়ে এবং কাজের প্রতি আনন্দ অনুভব করি। ৫ মিনিটের বিরতির সময় এই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলি আরও স্পষ্টভাবে ধরা দেয়, যা আমাদের পরবর্তী পোমোডোরোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে।
সবকিছুর শুরু হয়েছিল এক ক্লান্ত ছাত্র, এক সাহসী প্রশ্ন, আর একটি টমেটো-আকৃতির রান্নাঘরের টাইমারের হাত ধরে। যা একসময় ছিল দিশেহারা এক ছাত্রের বাঁচার চেষ্টা, তা-ই আজ রূপ নিয়েছে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত একটি কার্যকর সময় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ—ছাত্র, লেখক, সফটওয়্যার ডেভেলপার, উদ্যোক্তা কিংবা সিইও—সকলেই কাজ করছেন একই সহজ ছন্দে: ২৫ মিনিট মনোযোগী কাজ, ৫ মিনিট বিশ্রাম। এই পদ্ধতির সৌন্দর্য; এর সরলতা, এবং বাস্তব উপযোগিতায়। আপনি চাইলে, খুব সহজেই প্লে-স্টোর বা অ্যাপ-স্টোর থেকে একটি পোমোডোরো অ্যাপ ডাউনলোড করে আজ থেকেই শুরু করতে পারেন। আপনার মূল্যবান সময়ের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিন—পোমোডোরো আপনার দিনটাই বদলে দিতে পারে।
No comments