Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

টাইটানিকের আট সুর-বীর :আশিস কুমার পণ্ডা

টাইটানিকের আট সুর-বীর :আশিস কুমার পণ্ডা

বিশ্বের ইতিহাসে টাইটানিকের করুণ পরিণতির কথা কারো অজানা নেই। ১৯১২ সালের ১৪/১৫ এপ্রিলের মাঝরাতে বিশাল এই যাত্রীবাহী জাহাজটি আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় ১৫০০-এর বেশি প্…

 




টাইটানিকের আট সুর-বীর :আশিস কুমার পণ্ডা


 


বিশ্বের ইতিহাসে টাইটানিকের করুণ পরিণতির কথা কারো অজানা নেই। ১৯১২ সালের ১৪/১৫ এপ্রিলের মাঝরাতে বিশাল এই যাত্রীবাহী জাহাজটি আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় ১৫০০-এর বেশি প্রাণ। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র, লেখা হয়েছে অগণিত বই, প্রবন্ধ, কবিতা ও তৈরি হয়েছে অনেক ডকুমেন্টারি ও প্রদর্শনী। তবে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এক অনন্য ও মর্মস্পর্শী অধ্যায় হলো — জাহাজটির আট সদস্যের একটি ছোট সঙ্গীতদলের আত্মবলিদানের কাহিনী।


টাইটানিকের এই সঙ্গীতদলের সদস্যরা এর আগে একে অপরকে চিনতেন না বা একসঙ্গে কখনো বাজাননি। তারা টাইটানিকের স্থায়ী কর্মচারীও ছিলেন না, লিভারপুলের এক প্রাইভেট সঙ্গীত সংস্থার মাধ্যমে প্রায় শেষ মূহুর্তে ভাড়া করা হয়েছিল তাদের। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী প্রতিভাবান বেহালাবাদক ওয়ালেস হার্টলি। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের বিনোদনের জন্য প্রতিদিন তারা জাহাজের লাউন্জে, ডেকে কিংবা ডাইনিং হলে সংগীত পরিবেশন করতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, বরফের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিশাল জাহাজটি যখন ধীরে ধীরে ডুবে যেতে শুরু করে, তখন যাত্রীদের মাঝে শুরু হয় হাহাকার আর চরম বিশৃঙ্খলা। সবাই জীবন বাঁচাতে ছুটে যান ডেকের দিকে, মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকেন কোন এক লাইফবোটের উপরে একটুখানি জায়গা। তবে এই আতঙ্কের মাঝেও কিছু মানুষ নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে অন্যদের শান্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নেন। ওয়ালেস হার্টলি এবং তাঁর সঙ্গীরা—ছিলেন ঠিক তেমনই কিছু মানুষ। কোনও নির্দেশ ছাড়া, কোনও বাধ্যবাধকতা ছাড়া, তারা স্বেচ্ছায়, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়েন জাহাজের ডেকে। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে, আতঙ্কিত যাত্রীদের মনে সাহস, শান্তি আর স্থিরতা ফিরিয়ে আনার জন্য তারা বাজিয়ে চলেন শান্তিময় সুর। শেষ পর্যন্ত, টাইটানিকের সঙ্গে তারাও তলিয়ে যান মহাসাগরের বরফ-ঠান্ডা জলে।  


আট সদস্যের সঙ্গীতদলের কেউই বাঁচেননি। তাদের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন বিশের কোঠার যুবক। কেবল তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যান্ড মাস্টার ওয়ালেস হার্টলি। তার বুকের সঙ্গে বাঁধা ছিল তার প্রিয় বেহালা—যা তার বাগদত্তা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। নিজেদের নিরাপত্তার কথা এক মুহূর্তের জন্যও না ভেবে যারা অন্যদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের এই আত্মত্যাগের কাহিনী গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়। মানুষ গভীর বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় নত হন তাঁদের সাহসিকতার সামনে।


বিভিন্ন সম্পাদকীয়, ভাষণ, ধর্মীয় উপদেশ আর অসংখ্য কবিতার মাধ্যমে এই সঙ্গীতশিল্পীদের বীরত্বকে সম্মান জানানো হয়েছিল। শোকাহত পরিবারদের কাছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পৌঁছেছিল সহানুভূতির চিঠি; শোকাহত বিশ্বের মানুষ বাহবা দিয়েছিলেন তাদের অতুলনীয় সাহসিকতাকে। তবে এই গৌরবময় কাহিনীর সবচেয়ে নির্মম এবং বেদনাদায়ক দিক হলো, দুর্ঘটনার পর সংগীতশিল্পীদের পরিবারদের যেভাবে উপেক্ষিত ও নিষ্ঠুরতা শিকার হতে হয়েছিল।


টাইটানিকের মালিক কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইন এবং সঙ্গীত এজেন্সি C.W. & F.N. Black; দু’জনের  কেউই এই বীর সঙ্গীতশিল্পীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের প্রতি কোনরকম  সহানুভূতি দেখায়নি। তারা সাফ জানিয়ে দেয়, যেহেতু এই শিল্পীরা স্ব-নিযুক্ত কর্মী ছিলেন, তাই তাঁদের মৃত্যুর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। যখন মনে হচ্ছিল, পরিবারদের হেনস্থা একেবারে চরম সীমায় পৌঁছেছে, ঠিক তখনই নেমে আসে এক চূড়ান্ত আঘাত! দুর্যোগের দু’সপ্তাহ পরে,  যেদিন সংগীতশিল্পী, জক হিউমের মরদেহবাহী জাহাজ বন্দরে এসে পৌঁছায়, সে’দিনই জকের বাবা সংশ্লিষ্ট এজেন্সির কাছ থেকে একটি বিল এবং একটি চিঠি পান। চিঠিতে জানানো হয়, যেহেতু টাইটানিক জাহাজটি ১৫ই এপ্রিল ২-২০ মিনিটে ডুবে গিয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই জকের পারিশ্রমিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত জমে থাকা বেতন তার পোশাক, লায়ার, ল্যাপেল, ব্যাজ এবং টিউনিকে লাগানো হোয়াইট স্টারের বোতামের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই সংস্থাটি পরিবারের কাছে অনুরোধ করে, বাকি থাকা ৫ শিলিং ৪ পেনি পরিশোধ করতে। এই ছোট্ট অথচ কঠিন চিঠিতে কোথাও কোনো সহানুভূতির ভাষা ছিল না—ছিল না সামান্যতম দুঃখপ্রকাশ। পরে যখন পরিবার জানতে চায়, জকের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা যাবে কি না, তখন তাদের জানানো হয় যে সাধারণ পণ্যের পরিবহন অনুযায়ী ভাড়া দিলে তা সম্ভব হবে। জক হিউমের বাবা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে পুরো ঘটনাটি আমালগামেটেড মিউজিশিয়ানস ইউনিয়ন (AMU)-কে জানিয়ে দেন। তারা কোনরকম মন্তব্য ছাড়াই ঘটনাটি তাদের মাসিক পত্রিকায় প্রকাশ করে দেয়, যা পড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় তীব্র জনরোষ ও ধিক্কার। মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে এই নির্মম আচরণ—সেই মানুষদের সঙ্গে, যারা টাইটানিকের শেষ মুহূর্তেও সংগীতের মাধ্যমে অন্যদের শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত, নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। এই ঘটনা টাইটানিকের করুণ ইতিহাসে এক অন্যতম কলঙ্কজনক পর্ব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।


সংগীতজগত এতদিন নীরবে এই অপমান সহ্য করে যাচ্ছিলেন, এবার তারা একজোট হলেন। হৃদয়বিদারক এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এক অসাধারণ সংহতির নজির তৈরি করলেন তারা। দুর্ঘটনার মাত্র চার সপ্তাহ পরে, ১৯১২ সালের ২৪শে মে, লন্ডনের ঐতিহাসিক রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে আয়োজিত হয় এক নজিরবিহীন অনুষ্ঠান। সাতজন সবচেয়ে খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালকের নেতৃত্বে, সাতটি শীর্ষস্থানীয় অর্কেস্ট্রা থেকে ৪৭৩ জন শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল —টাইটানিকের সঙ্গীতশিল্পীদের স্মরণে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং তাঁদের পরিবারকে সাহায্য করা।


রয়্যাল অ্যালবার্ট হল সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়; এমনকি দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সামান্যতম জায়গাও ছিল না। শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার মানুষ, যাদের অনেকেই ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিলেন না, তবুও তাঁরা এসেছিলেন শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে এবং এক স্মরণীয় ঐক্যবদ্ধ মুহূর্তের সাক্ষী হতে।


আজও সেই অনুষ্ঠানটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অসাধারণ অর্কেস্ট্রা পরিবেশনার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। অনুষ্ঠানটি কেবল এক সংগীতানুষ্ঠান ছিল না; এটি ছিল আত্মত্যাগ, মানবতা এবং সংহতির প্রতীক। যেমন করে ব্যান্ড-মাষ্টার হার্টলি এবং তাঁর সঙ্গীরা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যদের শান্তি দিতে চেয়েছিলেন, তেমনই এই সংগীতানুষ্ঠান ছিল তাদের প্রতি বিশ্বের কৃতজ্ঞতার নিবেদন।


টাইটানিকের সেই আটজন সঙ্গীতশিল্পীদের কেউই ছিলেন না কোন অস্ত্রধারী সৈনিক বা কোন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী—তবুও তারা ছিলেন সৎ, সাহসী ও গভীর মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা বেছে নিয়েছিলেন অন্যকে শান্তি দেওয়ার পথ। তাদের সুর আজও বাজে ইতিহাসের পাতায়, আমাদের হৃদয়ের অন্তরে। তারা আমাদের দেখিয়ে গেছেন যে, অসাধারণ কাজের জন্য অসাধারণ মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র বুকভরা সাহস, সহানুভূতিময় একটি হৃদয় এবং অটুট কর্তব্যবোধই একজন সাধারণ মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে অসাধারণ উচ্চতায়।

No comments