Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পশুপাখিদের পাঠশালা : আশিস কুমার পন্ডা

পশুপাখিদের পাঠশালা : আশিস কুমার পন্ডা

এক সময়, এক বিশাল জঙ্গলের প্রাণীরা তাদের সন্তানদের নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে তোলার জন্য এক স্কুলের বন্দোবস্ত করলো। পেশাদার শিক্ষক নিয়োগ করা হলো এবং শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য…

 




পশুপাখিদের পাঠশালা : আশিস কুমার পন্ডা


 


এক সময়, এক বিশাল জঙ্গলের প্রাণীরা তাদের সন্তানদের নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে তোলার জন্য এক স্কুলের বন্দোবস্ত করলো। পেশাদার শিক্ষক নিয়োগ করা হলো এবং শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর, পাঠশালার পাঠ্যক্রমে চারটি মাত্র কার্যক্রম রাখা হলো; সাঁতার কাটা, দৌড়ানো, আকাশে ওড়া এবং গাছে চড়া। যেহেতু বেশিরভাগ প্রাণীর মৌলিক আচরণ এইগুলি ছিল, তাই শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত বিষয়ের শিক্ষা নিতে হবে। তারা গুরুত্ব দিলেন, কোন শিশু যেন কোন বিষয়ে পিছিয়ে না থাকে। শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো উন্নতি হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য, শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সময় পরপর পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। প্রথম পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষার পর ছাত্র ছাত্রীদের  কিছু আকর্ষণীয় সমস্যা দেখা দিল।


হাঁসের বাচ্চা চমৎকার সাঁতার কাটতে পারতো, সে মোটামুটি উড়তেও পারতো। কিন্তু দৌড়ে সে খুবই দুর্বল ছিল, তাই তাকে দৌড়ানোর অনুশীলন করার জন্য স্কুল ছুটির পরে অতিরিক্ত সময় থাকতে বাধ্য করা হল। তাকে সাঁতার কাটতে দেওয়া হলো না এবং তার দুর্বলতম বিষয়, দৌড় অনুশীলনের জন্যে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতে হলো।  অবশেষে, তার পায়ের আঙ্গুলের মাঝখানের পাতলা চামড়া ফেটে চৌচির হয়ে গেল এবং সাঁতারের দক্ষতা হারিয়ে ফেলে সে এক গড় সাঁতারুতে পরিণত হলো। স্কুলে গড় গ্রহণযোগ্য ছিল, তাই শিক্ষকরা খুশি হলেন, কিন্তু হাঁসের বাচ্চা তার বিকৃত পা নিয়ে চিন্তায় পড়লো।


বাচ্চা খরগোশ দৌড়ে তার ক্লাসের অন্য অনেকের থেকে এগিয়ে রইলো, কিন্তু সাঁতারকে সে ঘৃণা করতো। শিক্ষকদের আদেশে, তাকে সাঁতার অনুশীলনের জন্যে অনেকটা সময় পুকুরের ঠান্ডা জলে কাটাতে হতো, শেষ পর্যন্ত সে দীর্ঘস্থায়ী সর্দি ও কাশির শিকার হয়ে গেলো এবং তার ঘন ঘন চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন হলো। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীরা তাকে নিয়ে মজা করতে লাগলো, কারণ সে যখন সাঁতারের জন্য জলে লাফ দিত, তার সমস্ত চুল লেপ্টে গিয়ে তাকে ইঁদুরের মতো দেখাতো।


গাছে চড়ার ক্লাসে, বাচ্চা ঈগল অন্য সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে গাছের ডগায় উঠে গেলো এবং সে গাছের ডগায় পৌঁছানোর জন্যে  তার নিজস্ব পদ্ধতি (ওড়া) ব্যবহার করার জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে বচসা করতে লাগলো। ঈগলের বাচ্চার এই ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হলো না, তাই তাকে কঠোরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হলো।


মাছের বাচ্চা স্কুল থেকে বাড়িতে এসে তার বাবা-মাকে বলল, “আমার  স্কুলে যেতে একেবারেই ভালো লাগে না। সাঁতার কাটতে দারুণ ভালো লাগে। জল থেকে লাফিয়ে উঠে কিছুক্ষন উড়তেও বেশ মজা লাগে। কিন্তু দৌড়ানো আর গাছে চড়া? একেবারেই অসম্ভব, কারণ আমার পা নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা জলের বাইরে থাকলে আমি শ্বাস নিতে পারি না।" মাছের বাচ্চাটির বাবা-মা স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি রিপোর্ট কার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “আপনাদের বাচ্চা সাঁতারে ক্লাসের মধ্যে সবথেকে এগিয়ে আছে, তাই তাকে সাঁতারের ক্লাসে যেতে হবে না। তাকে দৌড়ানো এবং গাছে চড়া অনুশীলন করানোর জন্যে প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করা হবে।"


বাচ্চা কাঠবিড়ালি তরতর করে গাছ বেয়ে অনায়াসে মগডালে পৌঁছে যেতে পারতো। কিন্তু ওড়ার ক্লাসে সে হতাশ হয়ে গেল, কারণ তার শিক্ষক তাকে গাছের চূড়া থেকে ওড়া শুরু করার বদলে মাটি থেকে শুরু করার জন্য জোর দিতে লাগলেন। মাটি থেকে ওড়ার চেষ্টা করতে করতে তার পায়ের পেশীতে খিল ধরে গেল এবং গাছে চড়ার ও দৌড়ানোর পারদর্শিতা সে হারিয়ে ফেললো। পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষায় তাকে গাছে চড়ায় C এবং দৌড়ে D গ্রেড দেওয়া হলো।


প্রেইরি কুকুর (prairie dog) এবং ইঁদুরের বাচ্চাদের এই স্কুলে ভর্তি করা গেল না কারণ বিদ্যালয়ের প্রশাসন, পাঠ্যক্রমে খনন এবং গর্ত খোঁড়া-বিষয়দুটি অন্তর্ভুক্ত করেন নি। তাদের অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের একটি ব্যাজারের (badger) কাছে  শিক্ষানবিশরূপে চুক্তিবদ্ধ করে এক প্রাইভেট স্কুল শুরু করার উদ্যোগ নিলেন।  


বছরের শেষে, এক উড়ুক্কু মাছ যে খুব ভাল সাঁতার কাটতে পারে, কিছুক্ষণ কাদামাটির  উপর দৌড়াতে পারে, ছোট গাছে চড়তে পারে এবং অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক ভালো উড়তে পারে, সর্বোচ্চ গড় নম্বর পেয়ে ক্লাসের সেরা ছাত্রের পুরস্কার পেল।


গল্পটি আমাদের এমন একটি পাঠ শেখায় যা আমাদের বারবার শিখতে হয়। প্রতিটি মানুষ কিছু সহজাত দক্ষতা এবং কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাই, সবাই সব বিষয়ে পারদর্শী হতে পারেন না। প্রত্যেকেই কোন না কোন বিষয়ে ভাল, এবং প্রত্যেকেরই এমন ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলিতে তারা দুর্বল। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু, অল্প বয়স থেকে বাড়ি এবং স্কুল থেকে আমাদের দুর্বলতাগুলিকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয় এবং পরবর্তীকালে, কর্মক্ষেত্রে এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়েও তা চলতে থাকে। আমাদের শূন্যতা এবং স্বল্পতাগুলিকে পূরণ করার চেষ্টা চলতে থাকে। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে এই দূর্বলতাগুলি শুধরে নিলেই আমরা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবো! এই মানসিকতার প্রধান সমস্যা হল যে এটি আমাদের মধ্যে এক মূল্যহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। "আমি যথেষ্ট নই" এই অনুভূতি অন্যান্য অনেক নেতিবাচক আবেগের জন্ম দেয়, যেমন হীনমন্যতা, রাগ, ভয়, এবং উদ্বেগ; যেগুলি আমাদের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট উত্সাহ যোগায় না। কখনো আবার, দুর্বলতাগুলিকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে আমরা অবাস্তব লক্ষ্য স্থির করে আমাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত মূল্যায়ন করে ফেলি। ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করলেও, শেষ পর্যন্ত নতুন দক্ষতা আয়ত্ব করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনও কখনও কেবল সামান্য পরিমান দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্যে অনেক কঠোর পরিশ্রম ও সময়ের প্রয়োজন হয়। একসময়, আমরা বুঝতে পারি, আরো বেশি পরিশ্রম ও সময়ের প্রয়োজন, তখন আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিই। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বেদনাদায়ক পরিণাম হল, যদি আমরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হই, সেই বিষয়ে আমাদের দক্ষতার সামান্য উন্নতির জন্য আমাদের শক্তি, সময় এবং সম্পদের একটি বিশাল পরিমাণ ব্যয় করেও, আমরা খুব বেশি হলে, এক মাঝারী যোগ্যতার স্তরে পৌঁছাতে পারবো, কখনোই শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, প্রতিটি ব্যক্তি এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী এবং সেই প্রতিভা খুব সহজে তার মূল শক্তিতে পরিণত হতে পারে। এই কাজে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রবৃত্ত এবং অনুপ্রাণিত হই এবং আমাদের শক্তির বিকাশের জন্যে বিভিন্ন সুযোগ খোঁজার প্রেরণা পাই।  এইভাবে, আমাদের শক্তির উপর ফোকাস করার ফলাফল নাটকীয়ভাবে ভাল হয়। একই সময়ে, আমাদের দুর্বলতাগুলিকে মেনে নিতে হবে, কারণ সেগুলি আমাদেরই অংশ। কিন্তু, কঠিন সত্য হলো, দুর্বলতাকে শক্তিতে পরিবর্তন করার কোন জাদুমন্ত্র নেই। তাই, সতর্ক থাকতে হবে, কোনও পরিস্থিতিতে যেন এই দুর্বলতাগুলি যেন আমাদের পরিচায়ক হয়ে না ওঠে। প্রাসঙ্গিক হলে, আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে দুর্বলতাগুলির প্রভাব কমানোর জন্যে অবশ্যই কিছু সময় ব্যয় করতে হবে। এটি দুর্বলতাগুলিকে ঠিক করার বা দূর করার প্রচেষ্টা নয়, এটি দুর্বলতাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ার একটি পথ খুঁজে নেওয়া, যাতে আমরা সহজে  আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারি।

তাই, হাঁসের বাচ্চাকে সাঁতার কাটতে দিন, খরগোশের বাচ্চাকে দৌড়াতে দিন, ঈগলের বাচ্চাকে উড়তে দিন, এবং কাঠবিড়ালির বাচ্চাকে গাছে চড়তে দিন। নিজের নিজের শক্তির উপর মনোনিবেশ করে পূর্ণতা এবং অগ্রগতির অনুভূতি নিয়ে তাদের বাঁচতে দিন। তাদের দুর্বলতা কখনই শক্তিতে বিকশিত হবে না। তারা যেমন আছে ঠিকই আছে। তবে, শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে সাফল্য তারা অর্জন করবে তা তাদের যে কোন দুর্বলতাকে পূরণ করে দেবে।

No comments