Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

নাগাসাকির দাঁড়ানো বালক (‘The Standing Boy of Nagasaki’)

নাগাসাকির দাঁড়ানো বালক (‘The Standing Boy of Nagasaki’)- আশিস কুমার পন্ডা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯ - ১৯৪৫) শেষের দিকে, মিত্র বাহিনী দ্বারা সমর্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য প্রথম বারের মত পার…

 




নাগাসাকির দাঁড়ানো বালক (‘The Standing Boy of Nagasaki’)- আশিস কুমার পন্ডা


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯ - ১৯৪৫) শেষের দিকে, মিত্র বাহিনী দ্বারা সমর্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য প্রথম বারের মত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৫ সালের ৬ এব‌ং ৯ আগস্ট দুই জাপানি শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে দু’টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। এই দুটি বিস্ফোরণের ফলে তাত্ক্ষনিকভাবে ২০০,০০০ এরও বেশি জাপানি নিহত হয়েছিলেন এবং ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছিল ছবির মতো সুন্দর দুটি শহর।

তার পরেই, ১৫ আগস্ট, আমেরিকার কাছে নিঃশর্ত সমর্পণ করার কথা ঘোষণা করে জাপান। বোমার তেজস্ক্রিয়তায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় শিশুদের মাথার চুল৷ শিশুরা খাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তারা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে ও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখী হন। ১৯৫০ সাল নাগাদ মৃতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষে পৌঁছে যায়৷

হিরোশিমা এবং নাগাসাকির উপর পারমাণবিক বোমা হামলার পর, পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতায় জাপানের দুটি শহরে যে ক্ষতি হয়েছিল তা নথিভুক্ত করার জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে এক সমীক্ষা দলকে জাপানে পাঠানো হয়েছিল। সেই দলে সঙ্গী হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী সার্জেন্ট জো ও'ডোনেল নামে একজন চিত্রগ্রাহক।  ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে পরবর্তী সাত মাসে, দলটি পশ্চিম জাপান জুড়ে বিধ্বংসী, বোমার প্রভাবে মৃত, আহত, গৃহহীন এবং অনাথ জাপানীদের দুর্ভোগ নথীভুক্ত করেছিল। এক অনুভবী চিত্রগ্রাহকের চোখ দিয়ে অগুনতি মানুষের কষ্টের ছবি জো তার হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছিলেন, তার এক সামান্য অংশ বন্দী করে নিয়েছিলেন তার নিজের ক্যামেরায়। চিত্রগুলি এতটাই নিষ্ঠুর ছিল, তিনি সেই নেগেটিভগুলিকে আর ডেভেলপ করেন নি।

নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার পরপরই, ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ের একদিন জো ও'ডোনেল নাগাসাকির পোড়া ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত মৃত মানুষদের শেষকৃত্যের ছবি তার ক্যামেরায় ধরে রাখছিলেন। হঠাৎ তার ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারের মাধ্যমে তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রায় দশ বছর বয়সী একটি বালক খালি পায়ে হেঁটে চলেছে। তার মাথা ছিল সুন্দরভাবে কামানো, পরনে ছিল ছেঁড়া পোষাক, পাথরের মতো শক্ত চোখ-মুখ। বালকের কাঁধে ও পিঠে বেল্ট দিয়ে বাঁধা ছিল একটি ছোট্ট শিশু, দেখলে মন হবে যেন ঘুমিয়ে আছে। জাপানের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তাদের ভাই বা বোনদের পিঠে নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই বালকটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা৷ জো দেখতে পেলেন যে বালকটি এই জায়গায় এসেছে কোন এক গুরুতর কারণে। বালকটি সেখানে পাঁচ-দশ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। শ্মশানের কর্মরত একজন সৈনিক তাকে লক্ষ্য করেন এবং তাকে তার কাঁধের শিশুটিকে নিচে রেখে  দিতে বলেন যাতে সে ক্লান্ত না হয়।

বালকটি উত্তর দেয়, "এ ভারী নয়, এ আমার ভাই!"

সৈনিকটি বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন। একটু পরে সাদা মুখোশ পরা কয়েকজন সৈনিক তার কাছে চলে গেলেন এবং চুপচাপ শিশুটিকে ধরে রাখা দড়িটি খুলে ফেলতে শুরু করলেন। তখনই জো ও'ডোনেল বুঝতে পারলেন যে শিশুটি ইতিমধ্যেই মারা গেছে। শ্মশানের লোকজন মৃত শিশুটির হাত ও পা ধরে তাকে আগুনের উপরে ফেলে দিলেন। বালকটি নড়াচড়া না করে সোজা হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আগুনের শিখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। সে সাহসী হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, সে তার নীচের ঠোঁটকে এত জোরে কামড়াচ্ছিল যে সেখান থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। সূর্য অস্ত যাওয়ার মতো চিতার শিখা একসময় স্তিমিত হয়ে গেল। বালকটি পিছনে ঘুরে চুপচাপ চলে গেল। একবারও ফিরে তাকায়নি আর। তার মুখে কান্না বা কষ্টের কোনও অনুভূতি ছিল না। সম্ভবত পরমাণু বিস্ফোরণে পরিবারের সব সদস্যকে সে হারিয়েছিল, তাই মৃত শিশুটির সৎকারের জন্য তার দেহ এইভাবে পিঠে বেঁধে তাকেই আসতে হয়েছিল। অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার, জো ও'ডোনেল, এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে এতটাই দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি বালকের পিঠে বাঁধা শিশুটির বেশ কয়েকটি ছবি তার সব ক্য়মেরাগুলিতে তুলে রাখেন।

হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসলীলার সরকারী ফটোগ্রাফগুলি তার ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি কখনও প্রকাশ্যে আসে নি। কিন্তু, ও'ডোনেল তার ছবিগুলির ৩০০টিরও বেশি ব্যক্তিগত কপি তৈরি করেছিলেন এবং সেগুলিকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত একটি ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রথমবারের মতো, ১৯৯৫ সালে, একটি ভ্রমণ প্রদর্শনী এবং জো’র ব্যক্তিগত ক্যামেরায় তোলা কিছু নির্বাচিত ছবি নিয়ে 'জাপান ১৯৪৫' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘The Boy Standing by the Crematory’ (বিকল্পভাবে ‘The Standing Boy of Nagasaki’ বা নাগাসাকির দাঁড়ানো বালক) নামে এই ছবি এক ঐতিহাসিক ছবি হয়ে ওঠে এবং বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেয়। তাঁর দেওয়া তথ্য নিয়ে অনেকেই সেই বালকটির খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সন্ধান মেলেনি সেই দায়িত্বশীল বালকের, তবে পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ আর হিংসার ভয়ঙ্করতম চেহারা দেখে শিহরিত হয়েছিলেন গোটা বিশ্বের সমস্ত সংবেদনশীল মানুষ।

"এ ভারী নয়, এ আমার ভাই"-এই গল্পে সৈনিকের সঙ্গে বালকটির সংলাপের এই কয়েকটিমাত্র শব্দের মধ্যে এক উপযোগী শিক্ষা নিহিত রয়েছে। এক ১০ বছরের বালকর পক্ষে তার ভাইয়ের মৃতদেহের ওজন বয়ে নিয়ে যাওয়া অবশ্যই কষ্টকর ছিল, তবুও সে তার ভাইয়ের বোঝা (শারীরিক ওজন নয়) নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল কারণ সে তার ভাইয়ের সঙ্গে ভালবাসা এবং দায়িত্ববোধের দৃঢ় বন্ধন অনুভব করেছিল।

আমাদের জীবনের কোন না কোন সময়ে, কেউ আমাদের বহন করেছেন এবং কোন কোন সময়ে, আমরা সম্ভবত অন্যকে বহন করেছি বা করে চলেছি। আমরা যা বহন করি তা হল দায়িত্ব এবং এর মধ্যে নিহিত থাকে আমাদের সেই ভার বহন করে চলার ক্ষমতা। দায়িত্ববান ব্যক্তিরা দায়িত্ব কখনও এড়িয়ে যান না, সক্রিয়ভাবে নিজের কাঁধে  তুলে নেন; যেমন কারো প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগী হন, কম ভাগ্যবানদের দুর্দশা দেখে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাদের নিকটাত্মীয়দের প্রতি সংবেদনশীল হন, মানুষের উপকারের জন্য গঠনমূলক কিছু করেন, ইত্যাদি। একনজরে দায়িত্বগুলিকে বোঝার মতো মনে হয়, তবে, দায়িত্ব কখনই ভারী হয় না, এটি বাস্তবের ওজনের মতো আচরণ করে না। কাঁধের উপর কোন ওজন নিয়ে চলতে গেলে আমাদের গতি ধীর হয়ে যায়, মাধ্যাকর্ষণ আমাদের নিচের  দিকে টেনে ধরে। কিন্তু দায়িত্বের ভার সবসময় এমন মনে হয় না। মহান দায়িত্ব সঙ্গে নিয়ে আসে মহান শক্তি; আমরা আমাদের জীবনে যত বেশি দায়িত্ব নিতে থাকি, ততই আমাদের মধ্যে শক্তি এবং অনুপ্রেরণার সঞ্চার হয়। প্রকৃতপক্ষে, দায়িত্ব কাঁধে নিলেই তা আমাদের হালকা, শক্তিশালী, দ্রুত এবং ক্ষমতায়িত বোধ করায়।

আমরা সকলেই আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পেয়ে ধন্য হই; দায়িত্ব এক মহান বিশেষ অধিকার। তাই, আরো দায়িত্বশীল হও, বড় হও এবং তোমার দায়িত্বগুলিকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ কর! "এ ভারী নয়। এ আমার ভাই, এ আমার বোন, ইনি একজন মানুষ" - এই শব্দগুলি আমাদের আদর্শ হয়ে উঠুক; সে যদি পড়ে যায়, তাকে ওঠাও। তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তাকে সাহায্য কর। যদি সে ভুল করে তবুও তাকে ক্ষমা কর। পৃথিবী যদি তাকে পরিত্যাগ করে তবে তাকে তোমার পিঠে তুলে নাও। স্বেচ্ছায় তোমার সময়, অর্থ বা শক্তি ব্যয় করে অন্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারলে, বিশ্ব আরও উন্নত হবে, তুমি আরও উন্নত হবে এবং তোমার সুখ, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার বোধকেও বাড়িয়ে তুলবে।



*আরো নিত্য নতুন আপডেট খবর দেখতে

আমাদের whatsapp চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন*

WhatsApp channel link - https://whatsapp.com/channel/0029VaCqqNUGk1FyEgWxaZ2r


No comments