Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

টুথপেস্টের খালি বাক্স-আশিস কুমার পন্ডা

টুথপেস্টের খালি বাক্স-আশিস কুমার পন্ডা
এক জনপ্রিয় টুথপেস্ট কোম্পানি তাদের প্রক্রিয়ার এক বড় সমস্যা নিয়ে লড়াই করছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে, তারা মাঝে মাঝে তাদের ভোক্তাদের কাছে খালি বাক্স (অর্থাৎ ভিতরে কোন টুথপেস্ট টিউব ছাড়া) সরবরাহ কর…

 




টুথপেস্টের খালি বাক্স-আশিস কুমার পন্ডা


এক জনপ্রিয় টুথপেস্ট কোম্পানি তাদের প্রক্রিয়ার এক বড় সমস্যা নিয়ে লড়াই করছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে, তারা মাঝে মাঝে তাদের ভোক্তাদের কাছে খালি বাক্স (অর্থাৎ ভিতরে কোন টুথপেস্ট টিউব ছাড়া) সরবরাহ করছিল। ঝুঁকির অংক ছিল খুব বেশি; খালি বাক্স পরিবহনের খরচ, খুচরা বিক্রেতা, পরিবেশক এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে ঘন ঘন অভিযোগ, বদনাম এবং বাজারের শেয়ারের ক্ষতি।

‘একটি পিচবোর্ডের প্যাকেটের মধ্যে একটি টুথপেস্ট টিউব’- এক নজরে  তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি পণ্য এক জটিল এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দিনের চব্বিশ ঘন্টা ধরে উত্পাদন লাইন থেকে প্যাকিং হয়ে বেরিয়ে আসে। সংস্থার নতুন এবং উদ্যমী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দোষারোপ না করে এক কাঠামোগত পদ্ধতিতে সমস্যাটির মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সবার আগে, তিনি তার ম্যানেজারদের তদন্ত এবং সমস্যার সমাধানের জন্য নিযুক্ত করলেন। তারা চুরির সম্ভাবনা বাতিল করে দিলেন এবং নিশ্চিত করলেন যে প্যাকিংয়ের আগেই বাক্সগুলির ভিতরে টুথপেস্ট টিউব অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। স্বভাবতই স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন লাইনে কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে! যেহেতু উত্পাদন লাইনগুলি চব্বিশ ঘন্টাই চালু থাকতো, তাই যে কোনও তদন্তের জন্য কয়েক দিনের জন্য উত্পাদন লাইনগুলি বন্ধ রাখার প্রয়োজন ছিল এবং এই কাজ বাইরের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের সাহায্যে সম্পন্ন করতে হতো। এর ফলে কোম্পানির রাজস্বের বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। সমস্যার তীব্রতা বুঝতে পেরে, সিইও নিজেই পদক্ষেপ নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক নামীদামী পরামর্শদাতা সংস্থা নিয়োগ করা হল, কাজের পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা  করা হল, বাজেট নেওয়া হল এবং একটি নিষ্ঠাবান প্রজেক্ট গ্রুপ তৈরি করা হল।

প্রায় ছয় মাস এবং চার কোটি টাকা ব্যয় করে, এক তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে, বাজেটের মধ্যে এবং উচ্চ মানের সমস্যার সমাধান কিনে, উত্পাদন লাইনগুলিতে যোগ করে দেওয়া হলো। উচ্চ-প্রযুক্তির নির্ভুল এই ওজন মাপার স্কেলগুলি প্রতিটি টুথপেস্ট বাক্সকে উত্পাদন লাইন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওজন করতে থাকবে। কোন বাক্স, খুব হালকা-ওজন হিসাবে চিহ্নিত হলে, একটি অ্যালার্ম বেজে উঠবে ও একটি ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলতে নিভতে থাকবে এবং সেই সঙ্গে উত্পাদন লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। বিভাগীয় অপারেটর অ্যালার্ম স্বীকার করবেন, কনভেয়ার বেল্ট থেকে খালি বাক্সটি সরিয়ে দেবেন এবং উত্পাদন লাইন পুনরায় চালু করবেন। প্রকল্পটি সুন্দরভাবে বাস্তবায়িত হল, পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হল এবং ক্লায়েন্ট দ্বারা গৃহীত হল। খালি বাক্স পরিবহনের খরচ এবং খ্যাতির ক্ষতির  বিপরীতে এই প্রকল্পের জন্য উচ্চ বিনিয়োগ ন্যায্য বলে গণ্য করা হোল। সবাই ভাবলেন যে সমাধানটি চমৎকার এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

সিস্টেমটি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলার পরে, সিইও প্রকল্পের ROI (বিনিয়োগের রিটার্ন) দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল দেখতে পেলেন! স্বয়ংক্রিয় ওজন মাপার মেশিন লাগানোর পর থেকে কারখানার বাইরে একটিও খালি বাক্স পাঠানো হয়নি। খালি টিউব নিয়ে গ্রাহকদের কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি এবং কোম্পানী তার হারিয়ে যাওয়া বাজার ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিল। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন "একটু বেশি হলেও, চার কোটি টাকা ভাল কাজে ব্যয় হয়েছে।"

নতুন সিস্টেমটি এক সপ্তাহে কতগুলি খালি বাক্স সনাক্ত করেছে তা জানার জন্যে, সিইও বিস্তারিত প্রতিবেদনটি দেখতে লাগলেন, কিন্তু একটু পরে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে সিস্টেমটি লাগানোর পরে প্রথম কয়েক দিনে প্রতিদিন কয়েক ডজন খালি বাক্স সনাক্ত করেছে, কিন্তু পরবর্তী দিনগুলিতে একটিও করেনি। এই ঘটনা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো, কারণ নতুন ওজন মাপার স্কেলটি কেবলমাত্র খালি টুথপেস্টের বাক্স সনাক্ত করার জন্যে লাগানো হয়েছিল, টুথপেস্ট ফিলিং/প্যাকিং বিভাগে কোনও সংশোধন করার জন্য নয়। তিনি নিশ্চিত হলেন যে রিপোর্টিং সঠিক নয়। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের ডাকা হোল। তারা ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে জানালেন, “রিপোর্ট সঠিক। কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে সমস্ত বাক্স টুথপেস্ট টিউবসহ নিখুঁতভাবে বেরিয়ে আসছে। তাই, নতুন ওজন মাপার মেশিন কোন খালি বাক্স সনাক্ত করছে না।“ সিইও আরো বিভ্রান্ত হলেন, কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উত্তর পাবার আশায় কারখানার দিকে রওনা দিলেন। প্রোডাকশন লাইনের কাছে পৌঁছে গিয়ে, তিনি সেখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন যাদের উপর নতুন ওজন মাপার স্কেলের যন্ত্রপাতির পরিচালনা ও রক্ষণবেক্ষনের দায়িত্ব ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল এবং প্রতিটি বাক্স সঠিকভাবে নতুন মেশিন দিয়ে ওজন করা হচ্ছিল। একটি টুথপেস্ট টিউব ভর্তি বাক্স হাতে নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য তিনি লাইনের দিকে এগিয়ে যেতেই, তার পা একটি খালি বাক্সকে পিষে ফেলল। চারপাশে নজর ঘুরিয়ে, মেঝে জুড়ে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু বাক্স আবিষ্কার করলেন; হাতে নিয়ে দেখলেন, সবগুলিই খালি। এবার ম্যানুফ্যাকচারিং লাইনের দিকে চোখ ঘোরাতেই তিনি তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। নতুন নির্ভুল ওজন মাপার মেশিনের ঠিক আগে কেউ একটি পুরানো প্যাডেস্টাল ফ্যান (মূল্য ২০০০ টাকার বেশি নয়) বসিয়ে দিয়েছে যা উত্পাদন লাইনের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে বাতাস করে যাচ্ছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেল; নতুন সিস্টেম লাগানোর পর থেকে খালি টিউব সনাক্ত হলেই, প্রোডাকশন লাইন বন্ধ হয়ে যেত এবং একটি বিরক্তিকর অ্যালার্ম এবং ফ্ল্যাশ লাইট শুরু হয়ে যেত। প্রথম দু-তিন দিনের মধ্যে, সেকশনের অপারেটররা, এই অ্যালার্ম, ফ্লাশ লাইট ও বারবার প্রোডাক্শন লাইন চালু করতে করতে  ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং এদেরই একজন এই ফ্যানটি তার টেবিল থেকে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দেয়, যাতে করে খালি টুথপেস্টের প্যাকেট প্রোডাকশন লাইনে এলেই নতুন ওজন মাপার মেশিনে পৌঁছানোর আগেই ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যায়। তার পর থেকে, সেকশনের অপারেটরদের প্রতিটি খালি বাক্সের জন্যে বিরক্তিকর অ্যালার্ম শুনতে হচ্ছে না, ফ্লাশ লাইট দেখতে হচ্ছে না এবং প্রোডাকশন লাইনও বারবার চালু করতে হচ্ছে না। এই কারণেই নতুন মেশিনে কোন ত্রুটিপূর্ণ বাক্স রেকর্ড হচ্ছে না।

কোম্পানীর প্রধান হতভম্ভ হয়ে গেলেন; ‘দু’হাজার টাকার টেবিল ফ্যানের   বদলে চার কোটি টাকার স্বয়ংক্রিয় ওজন মাপার মেশিন!’

এই গল্পে, খালি বক্সের সমস্যাটি কেবল সংস্থার প্রধান এবং অন্যান্য উর্দ্ধতন ব্যক্তিদের মধ্যে সীমিত ছিল; সেকশনের অপারেটররা এই সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাই তাদের মাথাব্যথাও ছিল না। অ্যালার্ম শোনা, ফ্লাশ লাইট দেখা, প্রোডাকশন লাইন বারবার চালু করার আগে পর্যন্ত, সেকশনের অপারেটররা তাঁদের রুটিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নতুন মেশিন লাগানোর পরে যখন খালি বাক্সগুলি অ্যালার্ম বাজাতে শুরু করে এবং ঘন ঘন প্রোডাকশন লাইন বন্ধ করে দেয়, তা সেকশন অপারেটরদের কাছে সমস্যা হয়ে ওঠে এবং এদেরই একজন সমস্যাটি দূর করার জন্য একটি সহজ সমাধান আবিষ্কার করেন এবং অবশেষে কোম্পানির দীর্ঘদিনের মুলতুবি সমস্যাটিও সমাধান করে ফেলেন।

এই গল্পের টুথপেস্ট কারখানার মতোই, প্রত্যেক সংস্থা সমস্যার সমাধান বা যে কোন রকম উন্নতির জন্য প্রায়ই বিভিন্ন পরিবর্তন বাস্তবায়ন করে এবং তার জন্যে অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ এবং সময় ব্যয় করে থাকে। পরে সেগুলি অপ্রয়োজনীয় এবং সম্পদের অপচয় হিসাবে প্রমাণিত হয়, যে মূহুর্তে একটি সহজ, নির্ভুল, এবং কম ব্যয়বহুল আভ্যন্তরীণ সমাধান উপলব্ধ এবং বাস্তবায়িত হয়। এর কারণ হল, সংস্থার প্রতিটি সামনের সারীর কর্মী প্রতিদিনের সমস্যাগুলি বোঝেন এবং সম্ভবত কোনও বহিরাগতের চেয়ে সমস্যাগুলি সমাধান করার অনেক বেশি ক্ষমতা রাখেন। অনেক সংস্থায়, বিভাগগুলি এক আবদ্ধ সংস্কৃতিতে নিজেদের কাজ করে চলে, যার ফলে তারা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায় এবং একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে কেবল প্রতিযোগিতা করে। তারা শক্তির উৎস হিসেবে তাদের তথ্য ও জ্ঞান সঞ্চয় করে। এই আবদ্ধ সংস্কৃতি বৃহত্‍ সংস্থার স্বার্থের পরিবর্তে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দিকে বেশি নজর দিতে উত্সাহিত করে। যদি সংস্থার বিভাগগুলি বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কাজ করে যায় এবং কেবল তাদের নিজেদের অংশ সম্পর্কে চিন্তা করে, তবে একসঙ্গে কাজ করার ফলে যে বড় লাভ পাওয়ার সম্ভবনা থাকে তা তাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। সুতরাং, সংস্থার সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংস্থার সমস্ত সদস্যদের মধ্যে তাদের সমস্যা, ধারণা এবং দক্ষতা ভাগ করে নিয়ে দলবদ্ধভাবে কাজ এবং সহযোগিতা করার একটি সংস্কৃতি অতি অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে।

'এক সহযোগিতামূলক সংস্কৃতি!' - এটা বলা যত সহজ, গড়ে তোলা সবসময় তত সহজ হয়ে ওঠে না। যখন বিভিন্ন পটভূমি, প্রত্যাশা এবং ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন ব্যক্তি একসঙ্গে কাজ করেন, তখন দলগতভাবে কাজ করার সংস্কৃতি সবসময় স্বাভাবিকভাবে  পালিত হয় না। সদস্যরা হঠাৎ করে মিল খান না, এর জন্যে চাই সময়, ধৈর্য এবং প্রচেষ্টা। এটি ঘটতে সাহায্য করে সংস্থার প্রচলিত সংস্কৃতি। সহযোগিতার সংস্কৃতি সংস্থার শীর্ষ স্তর থেকে শুরু হয়, উর্দ্ধতন কার্যনির্বাহকদের অবশ্যই উদাহরণ তৈরি করার মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে। এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ম্যানেজার, সুপারভাইজার এবং কর্মচারীদের মধ্যে বিশ্বাস এবং বোঝাপড়া তৈরি হবে। যোগাযোগ উন্মুক্ত, স্পষ্ট এবং সম্মানজনক হবে, সকলের মধ্যে  শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং বিচারের ভয় ছাড়াই খোলাখুলিভাবে তারা নিজেদের ধারনা ব্যক্ত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। এটি তাদের সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিগত বৃদ্ধিকেও উৎসাহিত করবে।

অবশেষে, সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার এক আশ্চর্যজনক সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য এক বিনিয়োগের প্রয়োজন, কিন্তু এর প্রতিদান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। একবার এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে, নিশ্চিতভাবে সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) ‘দু’ হাজার টাকার ফ্যানের বদলে চার কোটি টাকার ওজন মাপার মেশিন কখনই কিনতে হবে না।‘

No comments