Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা -

রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা -
বিগত দেড় হাজার বছরে আমাদের ভারতের ইতিহাস মূলত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। প্রথম দিকে সেইসব বিদেশি হানাদারদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন। উদাহরণস্বরূপ আলেকজান্ডারের ভারত আ…



 রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা -


বিগত দেড় হাজার বছরে আমাদের ভারতের ইতিহাস মূলত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। প্রথম দিকে সেইসব বিদেশি হানাদারদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন। উদাহরণস্বরূপ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের উল্লেখ করা যায়। কিন্তু ইসলামের নামে হওয়া পশ্চিমের আক্রমণ এদেশের সমাজ-সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বিভেদ সৃষ্টি করার কাজ করেছে। দেশের সামাজিক মনোবল নষ্ট করার জন্য তাদের ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করা অনিবার্য ছিল। তাই বিধর্মী বিদেশি হানাদাররা ভারতের মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করে। এক-আধবার নয়, এইসব অপশক্তি বহুবার এই অপকর্ম করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সমাজকে হতোদ্যম করা, যাতে ভারতীয়রা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিদেশিরা তাদের উপর নির্বিঘ্নে শাসন করতে পারে ।

এই একই উদ্দেশ্যে অযোধ্যায় শ্রীরাম মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। বিদেশি হানাদারদের এই অপকৌশল শুধু অযোধ্যা বা একটি মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বিশ্বের সর্বত্র তারা এই কাজ করেছে।

ভারতীয় শাসকরা কখনও কাউকে আক্রমণ করেননি, বরং বিশ্বের শাসকরা তাঁদের রাজ্য বিস্তারের জন্য আগ্রাসী হয়ে এমন অপকর্ম করেছেন। কিন্তু তাঁরা যেমনটি আশা করেছিলেন ভারতের মাটিতে তেমন সফল হননি। এদেশের সমাজের প্রতি আস্থা, আনুগত্য ও মনোবল চিড় খায়নি, সমাজ বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত করেনি, সাহসের সঙ্গে তাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এই লক্ষ্যেই শ্রীরাম জন্মভূমি উদ্ধার করে সেখানে মন্দির পুনর্নির্মাণের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলেছে। এর জন্য অনেক যুদ্ধ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ হয়েছে; হিন্দুদের মনে শ্রীরাম জন্মভূমি উদ্ধারের সঙ্কল্প দৃঢ়তর হতে থাকল।

১৮৫৭ সালে, যখন বিদেশি অর্থাৎ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতির সময়, তখন হিন্দু-মুসলমান একত্রে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করার বিষয়ে পারস্পরিক মতবিনিময় করেছিল। সেই সময়েই গোহত্যা নিষিদ্ধ করা এবং শ্রীরাম জন্মভূমির মুক্তির বিষয়ে একটা সমঝোতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর হলফনামায় গোহত্যা নিষিদ্ধ করার কথা অন্তর্ভুক্ত করেন। এসব কারণেই সমগ্র সমাজ একসঙ্গে লড়াই করেছে। সেই যুদ্ধে ভারতীয়রা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করলেও দুর্ভাগ্যবশত সেই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি এবং ভারত স্বাধীনতা পায়নি। ব্রিটিশ শাসন কায়েম ছিল, কিন্তু শ্রীরাম মন্দির পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম থামেনি। ব্রিটিশ তাদের নীতি অনুসারে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চালু করেছিল। এদেশের তৎকালীন অবস্থা অনুসারে সেই অপকৌশল আরও বেশি করে প্রয়োগ করা হল। দেশের মানুষের ঐক্য ভাঙতে ব্রিটিশরা অযোধ্যায় সংগ্রামী বীরদের ফাঁসি দিয়েছিল। ফলে শ্রীরাম জন্মভূমির সমস্যার সমাধান হল না। কিন্তু শ্রীরাম মন্দিরের জন্য সংগ্রাম চলতেই থাকল।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, যখন সর্বসম্মতিক্রমে সোমনাথ মন্দিরের সংস্কার করা হল, তখন থেকেই শ্রীরাম মন্দির-সহ এই ধরনের অন্য মন্দিরগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শ্রীরাম জন্মভূমির মুক্তির বিষয়েও তখন ঐক্যমত তৈরি করে বিচার-বিবেচনা করা যেত। কিন্তু রাজনীতির গতিপথ বদলে গেল। বিভেদ, বৈষম্য এবং অরাজকতা সৃষ্টিকারী রাজনীতি ক্রমশ প্রকট হতে থাকল। শ্রীরাম মন্দিরের সমস্যাটি অমীমাংসিত থেকে গেল। দেশের পূর্ববর্তী নির্বাচিত সরকারগুলি এই বিষয়ে হিন্দু সমাজের ইচ্ছা ও অনুভূতিকে বিবেচনাই করেনি। উল্টে, সমাজের গৃহীত উদ্যোগকে বারবার দমন করার চেষ্টা হয়েছে। এই সংক্রান্ত আইনি লড়াই, যা স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই চলেছে। শ্রীরাম জন্মভূমির মুক্তির জন্য সামাজিক আন্দোলন আটের দশকে শুরু হয় এবং দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তা চলতে থাকে।

১৯৪৯ সালে রাম জন্মভূমিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি প্রকট হয়। ১৯৮৬ সালে, আদালতের আদেশে মন্দিরের তালা খোলা হয়। পরবর্তী সময়ে বহু অভিযান ও করসেবার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের নিরন্তর সংগ্রাম চলতে থাকে। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে সমাজের সামনে এসে ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ৩০ বছরের আইনি লড়াইয়ের পরে, মহামান্য সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সত্য ও তথ্য যাচাই করে একটি সুষম সিদ্ধান্ত দেয়। এই সিদ্ধান্তে উভয় পক্ষের ভাবাবেগ ও পরিস্থিতির বাস্তবতাও বিবেচনা করা হয়েছে। আদালত সব পক্ষের যুক্তি তর্ক শোনার পরই ওই সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্দির নির্মাণের জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। শ্রীরাম মন্দিরের ভূমিপূজন ২০২০ সালের ৫ আগস্ট হয়েছিল এবং আগামী পৌষ শুক্লা দ্বাদশী, যুগাব্দ ৫১২৫-তে অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি ২০২৪-এ শ্রীরাম লালার প্রতিমার স্থাপনা ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার আয়োজন করা হয়েছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, শ্রীরাম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের পুজোর দেবতা এবং শ্রীরামচন্দ্রের জীবন এখনও সমগ্র সমাজের দ্বারা স্বীকৃত আচরণের আদর্শ। তাই এখন একটা ছোটখাটো বিরোধের জের ধরে যে বিরোধিতা দেখা দিয়েছে, তা সমাপ্ত হওয়া উচিত। এরই মধ্যে যে তিক্ততা দেখা দিয়েছে, অবসান হওয়া উচিত তারও। সমাজের জ্ঞানীগুণীজনদের দেখতে হবে যে, এই সমস্ত বিবাদের সম্পূর্ণ অবসান যাতে হয়ে যায়। অযোধ্যা মানে ‘যেখানে যুদ্ধ হয় না’, ‘সংঘাতমুক্ত স্থান’, সেই নগরটা এমনই ছিল। এই কারণে, অযোধ্যার পুনর্গঠন সমগ্র দেশের সাম্প্রতিকতম প্রয়োজন এবং এটি আমাদের সকলের কর্তব্যও বটে।

অযোধ্যায় শ্রীরাম মন্দির নির্মাণের উপলক্ষটি রাষ্ট্রীয় গৌরবের প্রতীক, যা একপ্রকার নবজাগরণেরই প্রতীক। এটি, একদিকে আধুনিক ভারতীয় সমাজ জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির আরও এক স্বীকৃতি, যা শ্রীরামের চরিত্রের রূপকে নিহিত। ‘পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্’ পদ্ধতিতে মন্দিরে ভগবান শ্রীরামের পুজো করতে হবে। এবং মনোমন্দিরে শ্রীরামের আদর্শ স্থাপন ও তার আলোকে আদর্শ আচরণ অবলম্বন করে ভগবান শ্রীরামের পুজো করতে হবে। কারণ ‘শিবো ভূত্বা শিবং যজেৎ, রামো ভূত্বা রামং যজেৎ’—একেই বলা হয় যথার্থ পুজো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হলে, ভারতীয় সংস্কৃতির সামাজিক প্রকৃতি অনুসারে, ‘মাতৃবৎ পরদারেষু, পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ। আত্মবৎ সর্বভূতেষু, যঃ পশ্যতি সঃ পণ্ডিতঃ।’ 

এভাবে আমাদেরও শ্রীরামের পথে চলতে হবে। জীবনে সততা, শক্তি ও পরাক্রমের (সাহসিকতার) সঙ্গে ক্ষমা, সদিচ্ছা ও নম্রতা, সকলের সঙ্গে আচরণে ভদ্রতা, হৃদয়ের কোমলতা এবং দৃঢ় মনোবল হয়ে নিজের কর্তব্য পালন ইত্যাদি করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে শ্রীরামের গুণাবলি অনুকরণ করা। সবার জীবনে আনতে হলে সততা, নিষ্ঠা। কঠোর পরিশ্রমও করতে হবে।

আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের কথা বিবেচনা করে সমাজ জীবনেও শৃঙ্খলা সৃষ্টি করা উচিত। আমরা জানি যে, একই শৃঙ্খলার শক্তিতে শ্রীরাম-লক্ষ্মণ তাঁদের ১৪ বছরের বনবাস এবং শক্তিশালী রাবণের সঙ্গে সফল লড়াই পূর্ণ করেছিলেন। শ্রীরামের চরিত্রে প্রতিফলিত ন্যায় ও সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, পক্ষপাতহীনতা, সামাজিক গুণাবলি আবারও সমাজে পরিব্যাপ্ত করতে হবে। শোষণহীন সমাজ, ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে শক্তির পাশাপাশি করুণার অধিকারী চতুর্বর্গ পুরুষার্থযুক্ত এক সমাজ গড়ে তোলা— এভাবেই শ্রীরামের প্রকৃত পূজা হবে।

অহঙ্কার, স্বার্থপরতা ও বৈষম্যের কারণে এই জগৎ ধ্বংসের উন্মত্ততায় ডুবে আছে, যা নিজেদের উপর সীমাহীন বিপর্যয় ডেকে আনছে। সম্প্রীতি, ঐক্য, অগ্রগতি এবং শান্তির পথ দেখাচ্ছে জগদভিরাম (সর্বাঙ্গসুন্দর) ভারতবর্ষ। আমাদের ভারতবর্ষের পুনর্গঠনের সর্বজনীন এবং ‘সর্বেষাম্ অবিরোধী’ অভিযানের আরম্ভ, শ্রীরাম জন্মভূমিতে শ্রীরাম লালার প্রবেশ এবং তাঁর প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যা শুরু হতে চলেছে। আমরা সেই অভিযানের এবং বাস্তবায়নকারী সক্রিয় কার্যকর্তা। আগামী কাল, ২২ জানয়ুারি ভক্তিপূর্ণ উৎসবে আমরা সকলেই মন্দিরের পুনর্গঠনের পাশাপাশি ভারতের পুনর্গঠন এবং সেইসঙ্গে সমগ্র বিশ্বকে নব নির্মাণের পরিপূর্ণতা দেওয়ার সঙ্কল্প করেছি। আসুন, এই সচেতনতাকে মাথায় রেখে এগিয়ে যাই — জয় সিয়ারাম।

No comments