আজ সারদা মায়ের জন্মদিন।মা সারদা যেমন একাধারে ছিলেন পরমহংসের দেবের পত্নী ও সাধনসঙ্গিনী তেমনি ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী। ভক্তগণ তাঁকে শ্রীশ্রীমা নামে অভিহিত করে থাকে। গার্হস্থ ও সন্ন্যাস জীবনের আদর্শ স্থাপন করার জন্য পরম…
আজ সারদা মায়ের জন্মদিন।
মা সারদা যেমন একাধারে ছিলেন পরমহংসের দেবের পত্নী ও সাধনসঙ্গিনী তেমনি ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী। ভক্তগণ তাঁকে শ্রীশ্রীমা নামে অভিহিত করে থাকে। গার্হস্থ ও সন্ন্যাস জীবনের আদর্শ স্থাপন করার জন্য পরমহংসদেব ও মা অবিচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্যের অনুশীলন করে জীবনযাপন করতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর অবশিষ্ট জীবন সারদা দেবী অতিবাহিত করেন জয়রামবাটি ও কলকাতার উদ্বোধন ভবনে। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল স্বামী, ভ্রাতা ও ভ্রাতৃ-পরিবারবর্গ এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সন্তানদের প্রতি সেবা ও আত্মত্যাগে উৎসর্গিত। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ তাঁকে আপন জননীর আসনে বসাতেন। গুরুর প্রয়াণের পর উপদেশ ও উৎসাহলাভের আশায় ছুটে আসতেন তাঁর কাছে। তিনি তাঁর জীবৎকালে এবং পরবর্তীকালে ভক্তদের নিকট মহাশক্তির অবতার রূপে পূজিত হতেন।
১৮৫৯ সালের মে মাসে, সেকালে প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর ব্রহ্মচর্য অনুশীলন করছিলেন। বিবাহের পরেও সারদা দেবী তাঁর পিতামাতার তত্ত্বাবধানেই রইলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ফিরে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে। এরপর চোদ্দো বছর বয়সে প্রথম সারদা দেবী স্বামী সন্দর্শনে কামারপুকুরে আসেন। এই সময় তিনি যে তিন মাস শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করেছিলেন, তখনই ধ্যান ও অধ্যাত্ম জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি পান তাঁর স্বামীর থেকে।
এই সময় সারদা দেবী ও দিব্য মাতৃকাকে অভিন্ন জ্ঞান করে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। কালীর আসনে বসিয়ে পুষ্প ও উপাচার দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা করেন তাঁকে। অন্য সকল নারীর মতো সারদা দেবীকেও তিনি দেবীর অবতার বলে মনে করতেন। এই কারণে তাঁদের বৈবাহিক জীবনও ছিল এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সঙ্গত।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের দুই সপ্তাহ পর লক্ষ্মী দেবী, গোপাল মা প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সারদা দেবী উত্তর ভারতের তীর্থ পর্যটনে যাত্রা করেন। রামচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত অযোধ্যা ও কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করেন তাঁরা। পরে তিনি দর্শন করেন কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন। কথিত আছে, এই বৃন্দাবনেই সারদা দেবীর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয়েছিল। এবং এই বৃন্দাবন থেকেই গুরু রূপে তাঁর জীবনের সূত্রপাত হয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যোগেন মহারাজ প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের তিনি মন্ত্রদীক্ষা দান করেন। বৃন্দাবনেই শ্রীশ্রীমা রূপে তাঁর সত্তার সূচনা ঘটে।
তীর্থযাত্রার শেষে সারদা দেবী কয়েকমাস কামারপুকুরে বাস করেন। এই সময় একাকী অত্যন্ত দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ১৮৮৮ সালে এই খবর শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী শিষ্যদের কানে পৌঁছলে তাঁরা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এসে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। স্বামী সারদানন্দ কলকাতায় তাঁর জন্য স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করান। ‘মায়ের বাটী’ নামে পরিচিত বাগবাজারের এই বাড়িটিতেই জয়রামবাটীর পর সারদা দেবী জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত করেছিলেন। এই বাড়িটিতে স্থাপিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের বাংলা মাসিক মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকা তথা মিশনের বাংলা প্রকাশনা উদ্বোধন কার্যালয়ের প্রধান অফিস। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত এই বাড়িতে তাঁর দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাতেন। তাঁর মাতৃসমা মূর্তি ও মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলকে মানসিক শান্তি দিত। শ্রীমা রামকৃষ্ণ সংঘ ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনটি লাভ করেছিলেন।
উদ্বোধন ভবনে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যারা তাঁর সঙ্গ দিতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোপাল মা, যোগিন মা, গৌরী দিদি ও লক্ষ্মী মা।
১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীমা জয়রামবাটী যাত্রা করেন এবং সেখানেই এক বছর কাটান। জয়রামবাটীতে অবস্থানের শেষ তিন মাস তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অশক্ত অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় আনা হয়। পরের পাঁচ মাস তিনি রোগযন্ত্রণায় অত্যন্ত কষ্ট পান। মৃত্যুর পূর্বে এক শোকাতুরা শিষ্যাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন,যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার। মনে করা হয় এই উপদেশটিই বিশ্বের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ বার্তা। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে তাঁর প্রয়াণ ঘটে। বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই স্থানটিতেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে শ্রীমা সারদা দেবীর সমাধিমন্দির।
No comments