Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সুবক্তা, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবীর- ভীমরাও রামজি আম্বেদকর

নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সুবক্তা, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবীর- ভীমরাও রামজি আম্বেদকর
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (জন্ম : ১৪ এপ্রিল, ১৮৯১ – মৃত্যু : ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৬), যিনি বাবাসাহেব আম্বেদকর নামেও পরিচিত, ত…

 




নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সুবক্তা, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবীর- ভীমরাও রামজি আম্বেদকর

  


ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (জন্ম : ১৪ এপ্রিল, ১৮৯১ – মৃত্যু : ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৬), যিনি বাবাসাহেব আম্বেদকর নামেও পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় ব্যবহারশাস্ত্রজ্ঞ (জ্যুরিস্ট), রাজনৈতিক নেতা, নৃতত্ত্ববিদ, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, সুবক্তা, ঐতিহাসিক, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী। তিনি 'বাবাসাহেব' নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতের সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ইনি ভারতের সংবিধানের মুখ্য রচয়িতা। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টি. ভি. ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি "শ্রেষ্ঠ ভারতীয়"ও নির্বাচিত হন।

পরিচিতি :

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতের গরীব মাহার পরিবারে (তখন অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে গণ্য হত) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামজি সকপাল ও মাতার নাম ভীমাবাঈ। আম্বেদকর সারাজীবন সামাজিক বৈষম্যের, “চতুর্বর্ণ পদ্ধতি”-হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্যতা প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজারো অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে (Theravada Buddhism) স্ফুলিঙ্গের মতো রূপান্তরিত করে খ্যাত হয়েছিলেন। আম্বেদকরকে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর “ভারতরত্ন” - ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি'তে ভূষিত করা হয়। বহু সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে, ভারতে কলেজ শিক্ষা অর্জনে আম্বেদকর প্রথম “দলিত ব্যক্তি" হিসেবে স্বীকৃতি পান। অবশেষে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয় (লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স) থেকে আইনে ডিগ্রি (বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি) লাভ করার পর, আম্বেদকর বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন এবং কিছু বছর তিনি আইন চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। পরে তিনি ভারতের অস্পৃশ্যদের সামাজিক অধিকার ও সামাজিক স্বাধীনতার উপর ওকালতির সময় সমসাময়িক সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন। কিছু ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা তিনি “বোধিসত্ত্ব” (বুদ্ধত্ব লাভে যিনি প্রমাণ পূরণ করছেন) উপাধিতে সম্মানিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি নিজেকে “বোধিসত্ত্ব” হিসেবে কখনো দাবি করেননি।

প্রথম জীবন এবং শিক্ষা :

'মোহ' (Mhow) অঞ্চলের (বর্তমান মধ্য প্রদেশ) এবং কেন্দ্রীয় সামরিক সেনানিবাসে ব্রিটিশ কর্তৃক স্থাপিত শহরে আম্বেদকর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন রামজী মালোজী শাকপাল এবং ভীমাবাইের ১৪তম তথা সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। তাঁর পরিবার ছিলেন মারাঠী অধ্যুষিত বর্তমান কালের “মহারাষ্ট্র”-এর রত্নগিরি জেলার “আম্বোভাদ” শহরে। তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত ছিল (মাহার জাতি), যারা অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে এবং প্রচণ্ড আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার হত। আম্বেদকরের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা এবং তাঁর পিতা “রামজী শাকপাল” মোহ সেনানিবাসের ভারতীয় সেনা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সেকালের গৎবাঁধা শিক্ষাপদ্ধতিতে মারাঠী এবং ইংরেজিতে ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এবং সেইসাথে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভে কঠোর পরিশ্রমে সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করেন। কবির পান্থের মতে, রামজী শাকপাল তাঁর সন্তানদের হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। যদিও আম্বেদকর বিদ্যালয়ে যেতেন, তাঁকে অন্যান্য অস্পৃশ্য শিশুর ন্যায় আলাদা করে দেয়া হত। শিক্ষকগণ তাদের প্রতি অমনোযোগী ছিলেন এবং কোনোরূপ সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন না। তাদের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে বসার অনুমতি ছিলো না, এমনকি তাদের যদি তৃষ্ণা পেতো, উচ্চবর্ণের কোনো একজন এমন উচ্চতা হতে সেই জল ঢেলে পান করাতো, যাতে নিচুজাতের শিক্ষার্থীরা জল, বা জলের পাত্র স্পর্শ না করতে পারে। এই কাজটি সাধারণতঃ আম্বেদকরের জন্য করতো বিদ্যালয়ের চাপরাসী, এবং যদি পিওন না থাকত বা না আসত, তখন সারাদিন জল ছাড়াই কাটাতে হতো, আম্বেদকর এই অবস্থাকে এভাবে আখ্যায়িত করেছেন - “পিওন নাই, জল নাই”(নো পিওন, নো ওয়াটার)।

রামজী শাকপাল ১৮৯৪ সালে অবসর নেন ও দুই বছর পরে তাঁর পরিবার “সাতারা”-য় চলে আসে। জায়গা বদলের অল্পদিনের পরে, শিশু আম্বেদকরের মাতা মারা যান। তারা (সন্তানরা) মাসির সান্নিধ্যে কষ্টের পরিবেশে লালিত হন। তিন ছেলে বালারাম, আনান্দ্রা ও ভীমরাও এবং দুই মেয়ে মঞ্জুলা ও তুলাসাদের মধ্যে একমাত্র আম্বেদকরই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হন এবং কলেজের স্নাতক ডিগ্রি লাভে সক্ষম হন। 

আম্বেদকর প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশ থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী, এবং দুবার তিনি এই  ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকানুযায়ী, পৃথিবীর সেরা ১০০ পণ্ডিতের মধ্যে তিনি একজন। আম্বেদকর সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি, যিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে সমস্ত বিজ্ঞান বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

উচ্চতর শিক্ষালাভ :

আম্বেদকর ১৯০৩ সালে (মাত্র ১২ বছর বয়সে) বিয়ে করেন, অবশ্য আম্বেদকরের বিয়ে যথারীতি হিন্দু রীতিতেই ৯ বৎসরের দাপোলির মেয়ে “রামাবাই”এর সাথে হয়। এবং পরিবারসহ তিনি মুম্বাইয়ে (তারপর বোম্বে) চলে আসেন, যেখানে আম্বেদকরই হয়ে উঠেন এলফিন্‌স্টোন সরকারি বিদ্যালয়ের প্রথম অস্পৃশ্য ছাত্র। যদিও আম্বেদকর শিক্ষাদীক্ষায় সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, তথাপি তিনি যে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাতে তিনি ক্রমশঃ বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম অস্পৃশ্য হিসেবে ভারতের বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই সাফল্য তাঁর সম্প্রদায়কে উদ্দীপ্ত করে তুলে আশা যোগায়। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর শিক্ষক কৃষ্ণজী অর্জুন বেলুস্কর (অন্য নাম দাদা কেলুষ্কর), যিনি ছিলেন মারাঠী জাতির একজন বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র, তাঁর পরামর্শে “গৌতম বুদ্ধের জীবনী”র জীবনচরিত উপহার পান। ১৯০৮ সালে তিনি এলিফিন্‌স্টোন কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে থাকাকালীন তিনি বরোদা'র রাজা “গাইকোয়াড় সায়াজী রাও ৩য়” কর্তৃক মাসিক ২৫ রুপির বৃত্তি অর্জন করেন। ১৯১২ সালে, তিনি বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেন এবং বরোদা রাজ্যে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। সেই বছরেই তাঁর প্রথম সন্তান, ইশান্ত জন্মগ্রহণ করেন। আম্বেদকর তাঁর নতুন পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে আসেন, পরে অবশ্য তাঁর অসুস্থ পিতাকে দেখভাল করতে মুম্বাই চলে আসেন। তাঁর বাবা ১৯১৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর ছাত্র হিসেবে তিন বছর মেয়াদী মাসিক সাড়ে এগারো ব্রিটিশ পাউন্ডের বৃত্তি গ্রহণ করেন।

নিউইয়র্কে তিনি তাঁর পারসী বন্ধু “নাভাল ভাতেনা”র সাথে লিভিংস্টোন হলে বসবাস করেন। তিনি প্রত্যহ “লো” লাইব্রেরিতে চার ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। জুন ১৯১৩ সালে তিনি অর্থনীতিতে এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, এছাড়াও তিনি অন্য বিষয়গুলোতে- যেমন সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনশাস্ত্র এবং নৃতত্ত্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি গবেষণা লব্ধ প্রবন্ধ “প্রাচীন ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য” (Ancient Indian Commerce) প্রকাশ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি অন্য আরেকটি এম. এ. গবেষণা প্রবন্ধ “ভারতের জাতীয় কারাগারের লভ্যাংশ – একটি ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষণিক গবেষণা” 

(National Dividend of India-A Historic and Analytical Study) প্রকাশ করেন।  ঐবছর ৯ই মে, নৃতত্ত্ববিদ প্রফেসর আলেকজান্ডার গোল্ডেনউইজার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারের আগে তিনি “ভারতীয় জাতি : তাদের পদ্ধতি, উৎপত্তি এবং উন্নয়ন” বিষয়ক অভিসন্দর্ভ পাঠ করেন। ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ভর্তি হন “গ্রেস ইন্‌ন ফর ল” (Gray's Inn for Law) এবং লন্ডনের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিজ্ঞান স্কুলে, যেখানে তিনি ডক্টরাল থিসিসের কাজ শুরু করেন। ১৯১৭ সালে জুন মাসে বরোদা বৃত্তির শেষান্তে তিনি ভারতে যেতে বাধ্য হন, অপরদিকে তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ জমা দেওয়ার জন্য ৪ বছরের মধ্যে জমা দেওয়া ও ফিরে আসার অনুমতি পান। তিনি তাঁর অতি মূল্যবান এবং অধিক পছন্দের গ্রন্থগুলো জাহাজযোগে (স্টিমার) পাঠানোর সময় একটি জার্মান ডুবোজাহাজ দ্বারা নিমজ্জিত হয়ে যায়।

ভারতের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে আম্বেদকরকে সাউথ বোরো কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো, ১৯১৯ সালে যেটি ছিলো ভারতের সরকারি আইন, ১৯১৯ এর প্রস্তুতিমূলক (কমিটি)। এটি শুনতেই, আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং অন্ত্যজদের জন্য কোটা সংরক্ষণ (তাঁর অনেকদিনের অন্তর্নিহিত বাসনা ) এবং অন্য সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ১৯২০ সালে, তিনি মুম্বাইয়ের একটি সাপ্তাহিক “মুকনায়ক – মৌনদের নেতা" প্রকাশ করেন, কোলহাপুরের মহারাজা, শাহু ১ম (১৮৮৪-১৯২২ সাল) আম্বেদকর এই পত্রিকাটিতে হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা করেন এবং ভারতের রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের বিতৃষ্ণা উপলব্ধিকরতঃ জাতিবৈষম্যের  প্রতি যুদ্ধ করেছিলেন। কোলহাপুরে তাঁর বক্তব্য অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের বৈঠকে আঞ্চলিক রাজ্যের রাজা শাহু ৪র্থ'কে মোহিত করে, যিনি আম্বেদকরকে “ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা” বলে গণ্য করেন এবং পরবর্তীতে গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আম্বেদকরের সাথে নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন। নিজের জমানো কিছু অর্থের সাথে কোলহাপুরের মহারাজা ও তাঁর বন্ধু নাভাল বাহেনার কাছ থেকে লোনকৃত কিছু অর্থ দিয়ে জুলাই মাসে তিনি শিক্ষক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি “লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স” ও “গ্রে ইন্‌ন” -এ পড়ার জন্য ফিরে এসে দরিদ্র জীবনযাপন শুরু করেন ও ব্রিটিশ জাদুঘরে নিয়মিত অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ সালে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আরো একবার আম্বেদকর সকলের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হন। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সে তিনি এম এসসি (অর্থনীতি)-র জন্য গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ সম্পূর্ণ করেন ও তাঁকে আইনজীবী সম্প্রদায়ে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়। আম্বেদকর তাঁর পিএইচডি প্রবন্ধটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। আম্বেদকর সফল আইনি চর্চা শুরু করেন। আইনি চর্চার শুরুর দিকে, আম্বেদকর কিছু ব্রাহ্মণ কর্তৃক তিন অ-ব্রাহ্মণ নেতা কে বি বাগদে, কেশাভরাও জেদহে এবং দিনকোরাও জাভালকরের বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমায় বিবাদীপক্ষে লড়েন। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাঁরা মানহানির মামলায় জড়িয়ে পড়েন। বাদীপক্ষে ছিলেন পুনার বিখ্যাত উকিল এল বি বোপাটকর। আম্বেদকর তাঁর মামলা যুক্তিপূর্ণ তথ্য ও দক্ষতার সাথে উপস্থাপনা করে বাকপটুতার দ্বারা ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে বিজয়ী হন। এই বিজয়ের সুনাম চারদিকে অনেক বিস্তার লাভ করেন।

লক্ষ্যসমূহ :

বোম্বে হাইকোর্টে চর্চারত অবস্থায় আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের শিক্ষিত করে তুলতে অবিবেচকের মত দৌড়েছিলেন। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা ছিলো “বহিষ্কৃত  হিতকারিণী সভা”। এই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং গৃহহীন ও অন্ত্যজ জাতির উন্নতির জন্য কাজ করে। ১৯২৭ সালে আম্বেদকর অস্পৃশ্যতা'র বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গণ আন্দোলন শুরু করেন এবং সুপেয় জলের উৎস দানে সংগ্রাম চালিয়ে যান (উল্লেখ্য, সেসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে নিম্নবর্ণের প্রবেশের অধিকার ছিলো না)। মহদে সত্যগ্রহ নামের অস্পৃশ্যদের (অন্ত্যজ জাতির) জন্য সংগ্রাম করে সুপেয় জল পানের অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁকে ১৯২৫ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সি কমিটিতে নিয়োগ করা হয়েছিল যাতে করে তিনি সকল ইউরোপীয় সাইমন কমিশনের সাথে কাজ করতে পারেন। সমগ্র ভারতজুড়ে স্ফুলিঙ্গের আকারে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন এই তালিকাটি অধিকাংশ ভারতীয় কর্তৃক উপেক্ষিত হয়। আম্বেদকর নিজে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য একটি পৃথক সুপারিশনামা প্রণয়ন করেন। 

রাজনৈতিক অবদান :

আম্বেদকর ১৯৩৫ সালে মুম্বাইয়ের সরকারি আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। উক্ত পদে তিনি দু'বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুম্বাইয়ে বসবাসের বাসনায় তিনি একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেখানে তিনি ৫০,০০০ হাজারেরও বেশি বই সমৃদ্ধ একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী রামাবাই দীর্ঘ অসুস্থতার পরে একই বছর মৃত্যুবরণ করেন। অসুস্থ অবস্থায় তাঁর স্ত্রী রামাবাইয়ের পান্দরপুর তীর্থে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন, কিন্তু আম্বেদকর তাঁকে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, তিনি তাঁকে বরং একটি নতুন পান্দরপুর বানিয়ে দেবেন, হিন্দু পান্দরপুরের পরিবর্তে - যেটা কিনা তাদের অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে। ১৩ই অক্টোবর নাসিকের কাছে ঈওলার বৈঠকে বক্তব্যে আম্বেদকর তাঁর ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুগতদেরও হিন্দু ধর্ম ত্যাগে প্রণোদিত করেন। সমগ্র ভারতের অনেকগুলো জনসভায় তিনি তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৯৩৬ সালে আম্বেদকর স্বনির্ভর শ্রমিক দল (ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি) প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১৯৩৭ সালের কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন পরিষদ বা বিধানসভার (Central Legislative Assembly) নির্বাচনে ১৫টি আসন লাভ করে। নিউইওর্কে লিখিত গবেষণালব্ধ উপাত্তের ভিত্তিতে একই বছর তিনি তাঁর বই দ্য "এন্‌নিহিলেশন অব কাস্ট" প্রকাশ করেন। আম্বেদকর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা সমিতির এবং রাজপ্রতিনিধির নির্বাহী সভায় শ্রমমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। কংগ্রেস ও গান্ধীর অস্পৃশ্যদের প্রতি আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আম্বেদকর তীব্রভাবে গান্ধী ও কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন। “কারা শূদ্র ছিল?”তে বর্ণনা করতে চেষ্টা করেন শূদ্র বর্ণ কীভাবে গঠিত হয়, অর্থাৎ হিন্দু বর্ণপ্রথার নিম্নবর্ণ সৃষ্টির ইতিহাসের উপর আলোকপাত করেন। তিনি এও উল্লেখ করেন, শূদ্র কীভাবে অস্পৃশ্য হতে আলাদা। তিনি রাজনৈতিক দল সারা ভারতের "সিডিউল কাস্টস ফেডারেশন"-এ রূপান্তরিত করেন, যদিও তা ১৯৪৬-এ ভারতের সংবিধান পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফল করেনি। 

১৯৪৯ সালের ২৬ই নভেম্বর গণ-পরিষদ কর্তৃক সংবিধানটি গৃহীত হয়। আম্বেদকর ১৯৫১ সাল পর্যন্ত হিন্দু কোড বিল খসড়াটি সংসদে পড়ে থাকার কারণে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। হিন্দু কোড পৈতৃক সম্পত্তি, বিবাহ ও অর্থনীতি আইনের আওতায় লিঙ্গসমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করে। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, মন্ত্রিসভা ও অনেক কংগ্রেস নেতারা একে সমর্থন জানালেও বেশির ভাগ সাংসদ এর সমালোচনা করেন। আম্বেদকর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৫২'র নির্বাচনে লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু হেরে যান। তাঁকে পরে রাজ্যসভার সাংসদ পদে সমাসীন করা হয়। ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই সদস্যপদে বহাল ছিলেন।

বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ :

নৃতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে আম্বেদকর আবিষ্কার করেন মহরেরা আসলে প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ। বৌদ্ধধর্ম ত্যাগে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাদেরকে গ্রামের বাইরে সমাজচ্যুতদের ন্যায় থাকতে বাধ্য করা হলো, অবশেষে তারাই অস্পৃশ্যতে পরিণত হয়েছিলো। তিনি এই ব্যাপারে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই "কারা শূদ্র ছিল?"-তে বর্ণনা দেন।

আম্বেদকর সারাজীবন ধরেই বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়ন করেন, ১৯৫০ এর সময়ে তিনি এই ধর্মে তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন এবং শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন। তারপর শিলং যান বৌদ্ধ পণ্ডিতদের ও ভিক্ষুদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে। যখন তিনি পুনের কাছাকাছি একটি নতুন বৌদ্ধ মন্দির অর্পণ করেন, তখন আম্বেদকর ঘোষণা দেন যে, তিনি বৌদ্ধধর্মের উপর একটি বই লিখেছেন, যত শীঘ্রই তিনি বইটি শেষ করবেন, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ধর্ম গ্রহণ করবেন।

মৃত্যু :

১৯৪৮ সাল থেকে আম্বেদকর ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। শারীরিক অবনতির জন্য ১৯৫৪ সালে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন ও একপর্যায়ে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি ক্রমশঃ অনেক তিক্তবিরক্ত হয়ে ওঠেন, যা তাঁর স্বাস্থ্যের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ সালের পুরোটা জুড়ে তিনি প্রচুর কাজ করার ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থার অধিকতর অবনতি হয়। টানা তিন দিন “বুদ্ধ ও তাঁর ধর্ম” বইটির সর্বশেষ পাণ্ডুলিপি তৈরির পর তিনি ৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে তাঁর দিল্লীর নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

৭ই ডিসেম্বর তাঁর জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় আদলে দাদারচৌপাট্টি সমুদ্র সৈকতে একটি শবদাহ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো অনুসারী, কর্মীবৃন্দ ও শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হন। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে একটি ধর্মান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাঁরা শবদাহ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা একই স্থানে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

আম্বেদকরের দ্বিতীয় স্ত্রী সভিতা আম্বেদকর (বিবাহ পূর্ব নাম সার্দা কবির) স্বামীর সাথে তিনিও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং ২০০২ সালে বৌদ্ধ হিসেবেই মারা যান। ওনার পুত্র ইশান্ত (অন্য নাম ভাইয়াসাহেব আম্বেদকর) ও তাঁর পুত্রবধূ মীরা তাই আম্বেদকর। আম্বেদকরের নাতি প্রকাশ যিনি ইন্ডিয়ান বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশান এর জাতীয় সভাপতি। ভারতীয় "বহুযান মহাসঙ্ঘ"এর নেতৃত্ব দানকারী এবং ভারতীয় লোকসভার উভয় কক্ষে দায়িত্ব পালনকারী। 

আম্বেদকরের জন্য তাঁর দিল্লির ২৬ আলীপুর রােডের বাসভবনে একটি স্মারক স্থাপিত হয়। তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে আম্বেদকর জয়ন্তী বা ভীম জয়ন্তী হিসেবে পালিত হয়। তাঁকে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর পুরস্কার হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ উপাধি “ভারতরত্ন” দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সম্মানে বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়, যেমন হায়দ্রাবাদের ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর ওপেন ইউনিভার্সিটি, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম ডঃ বি আর আম্বেদকর ইউনিভার্সিটি, মুজাফ্‌ফরপুরের বি আর আম্বেদকর বিহার ইউনিভার্সিটি এবং জলন্ধরের বি আর আম্বেদকর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ও নাগপুরের ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শোনগাঁও বিমানবন্দর। ভারতের সংসদ ভবনে আম্বেদকরের একটি বিশাল প্রতিকৃতি প্রদর্শিত আছে।


নাগপুরে তাঁর জন্ম (১৪ই এপ্রিল) ও মৃত্যুবার্ষিকীতে (৬ই ডিসেম্বর) ও ধর্মচক্র প্রবর্তন দিন (১৪ই অক্টোবর), মুম্বাইয়ে কমপক্ষে ৫ লাখ অনুসারীরা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হন। হাজারো বইয়ের দোকান বসে, বিক্রি হয় এই দিন। তাঁর অনুসারীদের প্রতি বার্তা ছিল :  “শিক্ষিত হও!!! আন্দোলন কর!!! সংগঠিত হও!!!”

No comments