বেগম আখতার : বেদনার সঙ্গীতময় সৌরভমেয়েটির নাম 'বিব্বি'। যমজ এক দিদি ছিল তাঁর, নাম জোহরা। মা মুস্তারিবাইকে সারাদিন পরিশ্রম করতে হয় বাইরে-বাইরে। নাহলে যে ছোটো মেয়েদুটিকে বাঁচাতে পারবেন না তিনি। এদিকে ঘরে-বাইরে শত্রু। ভালোবেস…
বেগম আখতার : বেদনার সঙ্গীতময় সৌরভ
মেয়েটির নাম 'বিব্বি'। যমজ এক দিদি ছিল তাঁর, নাম জোহরা। মা মুস্তারিবাইকে সারাদিন পরিশ্রম করতে হয় বাইরে-বাইরে। নাহলে যে ছোটো মেয়েদুটিকে বাঁচাতে পারবেন না তিনি। এদিকে ঘরে-বাইরে শত্রু। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন লক্ষ্মৌয়ের আইনজীবী সৈয়দ আসগর হুসেনকে। কিন্তু কোথায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সৈয়দ সাহেব আর কোথায় তিনি ফৈজাবাদের এক সাধারণ ব্যাপারীর মেয়ে! স্বামীর ঘরে যাওয়া হয়নি কোনোদিন। মেয়েরাও পায়নি পিতার পরিচয়। কিন্তু জীবন বড় আশ্চর্য এবং জটিল গল্পের দৃশ্যপট। দুই মেয়ের মাকে কখনও স্বীকারই করেননি তাঁর স্বামী। কারণ তিনি ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও, সৈয়দ বংশের সন্তান, আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মেয়েটির মা সামান্য এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। অতএব তাঁর জাত নেই। ফলে, যমজ কন্যার জন্ম দিয়ে একা থাকতে হত তাঁকে।
তাও সৈয়দ সাহেব আসতেন প্রথমদিকে, তারপর একদমই বন্ধ করে দিলেন সমস্ত দরজা। মুস্তারির নিজের আত্মীয়দের সঙ্গেও চলছে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। একদিন বাড়ি ফিরে দেখেন ঘরের মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে দুই মেয়ে। মুখে গ্যাঁজলা। ছোট্ট দুই যমজ বোনের হাতে আদর করে মেঠাই তুলে দিয়েছিল অচেনা দুটো লোক। সরল মনে সেই মিষ্টি মুখে তোলা মাত্র ছটফট করে ওঠে বোন। নরম শিশু শরীরটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে আসে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই সব শেষ। ঘাতকের এনে দেওয়া বিষ মেশানো মিষ্টি মুখে না তোলায় সেদিন কপালগুণে বেঁচে গেছিল চার বছরের ছোট্ট বিব্বি। বোন জোহরাকে শেষ দেখাটুকু দেখারও সুযোগ মেলেনি তার। কান্নামেশানো প্রশ্নের উত্তরে পাথরের মতো চোখ নিয়ে মা বলেছিল, 'বোন আল্লার কাছে বেড়াতে গেছে'… কপাল জোরে বেঁচে যাওয়া সেই ছোট্ট মেয়েটা জানতেও পারেনি তাদের মেরে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে সামিল ছিল তাদের নিজেদের বাবাও। বিব্বি সুস্থদেহে হাসপাতাল থেকে ফিরলেও বাঁচানো গেল না জোহরাকে। কিছু টাকা অবশ্য পাঠিয়েছিলেন সৈয়দ সাহেব, ফেরত দিলেন মুস্তারি। নিজের লড়াই লড়ে নেবেন তিনি। এক মেয়েকে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন জীবনসংগ্রামে। সাপের ছোবলের মতো নীলাভ যন্ত্রণা নিয়ে জীবন শুরু হয়েছিল বিব্বির। বনেদি সৈয়দ বংশের সেই পথের কাঁটা, গরিব মায়ের মেয়ে বিব্বি আর কেউ নয়, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের সাক্ষাৎ সরস্বতী, যাঁকে আজ সারা ভারত চেনে 'বেগম আখতার' নামে।
ফৈজাবাদের একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয় বিব্বিকে। সেই স্কুলে এক দিন অর্থ সাহায্য করতে এলেন গওহরজান। সেই গহরজান, যাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। স্কুলটি ঘুরে দেখছেন গওহরজান। হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে তাঁর বহু দামী ওড়নাটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গহর সস্নেহে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম তোমার?’ মেয়েটি যখন তার নাম বলছিল, তখনই তার কণ্ঠস্বর শুনে গহরজান বুঝতে পারেন, মেয়েটি গান গায়। গওহর মেয়েটিকে গান গাইতে বললে সে একটি কলি গেয়েছিল। ওই কলিটি তার জীবনে প্রথম গাওয়া গান। তার আগে সে কোনও দিন গান গায়নি। কিন্তু সেই এক কলি গান শুনেই গহর মনে মনে বলেছিলেন, এই মেয়ে এক দিন বিরাট বড় শিল্পী হবে।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার এক অখ্যাত শহরে জন্ম 'আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি'র। ছোট থেকেই লড়াই করে বেড়ে ওঠা তাঁর। আখতারির মা মুস্তারির প্রেমে পড়েছিলেন বাবা আসগর হুসেন৷ বিয়েও করেন। কিন্তু তারপরই শুরু হয় অসম্মান আর অস্বীকার। আসগর হুসেন ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও সৈয়দ বংশের সন্তান; আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মুস্তারি তো সামান্য ব্যবসায়ীর মেয়ে৷ এ বিয়ে মেনে নিলে পরিবারের মুখ ছোট হবে যে! তাই বিয়ের কিছু দিন পরই শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় মুস্তারিকে। সদ্যোজাত দুই মেয়েকে নিয়ে পেটের টানে পথে নামেন মা। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই মেলে না। বিষ মেশানো মিষ্টি খেয়ে কিছুদিন পরই মারা যায় ছোট মেয়ে জোহরা। আখতারি বরাতজোরে বেঁচে গেলেও মা-মেয়েকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয় তারপরেও। এবার ভয় পেয়ে যান মা মুস্তারি। ছোট্ট বিবির হাত ধরে ফৈজাবাদ থেকে পালিয়ে চলে আসেন গয়া।
উঠলেন গয়ায় তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে। শর্ত হল, মা-মেয়ের থাকা খাওয়ার বিনিময়ে গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করে দেবেন। আর, মেয়ের ভবিষ্যৎ? মায়ের ইচ্ছে, মেয়ে স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। মেয়ে কিছুতেই স্কুলে যাবে না। সে পড়বে না, গান শিখবে। সে ব্যবস্থাই হল। আর সেখানেই শুরু হয় বিব্বির সঙ্গীতশিক্ষা। বাড়িতে ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে থাকল মেয়েটি।
কাকার ইচ্ছেতেই গান শুরু। মাত্র সাত বছর বয়সে। ততোদিনে পেয়েছেন গওহরজানের আশীর্বাদ। গানের প্রতি বাড়ছে আকর্ষণ। যাযাবর থিয়েটার কোম্পানির চন্দাবাঈয়ের কাছে হাতেখড়ি। তাঁর যাতায়াত শুরু করেছিলেন ফৈজাবাদে থাকাকালীন। সঙ্গীতকে আঁকড়ে বাঁচবেন আজীবন, কৈশোরেই মনের মধ্যে যেন নিজের গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছেন তিনি। মুস্তারিও কড়া চোখে নজর রাখলেন মেয়ের রেওয়াজের উপর। জমির খান সাহেব ও আতা মোহম্মদ খানের কাছে চলল দীর্ঘ তালিম। প্রজাপতির মতো রঙিন ডানায় উড়ে বেড়াতে লাগল কণ্ঠের মূর্ছনা। এর পর পাটনার প্রখ্যাত সারেঙ্গি বাদক ইমদাদ খাঁ (যিনি সে সময় নিয়মিত মালকাজান ও গওহরজানের সঙ্গে বাজাতন), পাটিয়ালার আতা মহম্মদ খাঁ, লাহোর নিবাসী 'কিরানা' ঘরানার আবদুল ওয়াহিদ খাঁ, জুন্দা খাঁ, উস্তাদ বরকত আলি খাঁয়ের (উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ভাই) কাছেও তালিম নিয়েছেন।
ইস্কুলে যেতে ভালো লাগত না বিবির। তাঁকে টানত সুর, ভালো লাগত সারাদিন রেওয়াজ করতে। আর ভালো লাগত গান শুনতে। ঠুমরি, গজল, মার্গসংগীতের নন্দনকানন তখন কলকাতা। কিন্তু তখনও তিনি 'বিব্বি'। একটি অনুষ্ঠানে শিল্পীদের তালিকায় গওহর জান, মালকা জান, ছপ্পন ছুরি, খান সাহেবদের মধ্যে আগ্রা ঘরানার শ্রেষ্ঠ গায়ক আফতাব-এ-মৌসিকী ওস্তাদ ফৈয়জ খান, রজব আলি খান, কিরানার প্রাণপুরুষ আবদুল করিম খান, মাইহারের আলাউদ্দিন খান। চ্যারিটি শো, সবাই বিনা পারিশ্রমিকে গাইবেন। আসরের দিন অবশ্য দেখা গেল, উদ্বোধনী শিল্পী বেনারসের সানাইবাদক আমন আলি বক্স খান ছাড়া সবাই অনুপস্থিত। সেই আসরে প্রথম শ্রোতাদের সামনে সানাই বাজান আলি বক্সের ভাইপো প্রবাদপ্রতিম বিসমিল্লাহ খান। মেয়েটির ওস্তাদ ছিলেন চৌকশ লোক। আসরে ওস্তাদদের অনুপস্থিতিতে শ্রোতারা গরম হতে আরম্ভ করেছে দেখেই ছাত্রী আর তার মাকে বসিয়ে রেখে হাজির হলেন ব্যাক স্টেজে। এক উদ্যোক্তাকে ধরে বললেন, ‘বাঁচতে চান তো আমার ছাত্রীকে বসিয়ে দিন’ বিস্মিত উদ্যোক্তা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘পারবে এত বড় আসর সামলাতে?’ নিজের ছাত্রীর ওপর অগাদ আস্থা ওস্তাদের। নির্ভয়ে উত্তর জানালেন, ‘পারবে না মানে!’ ছাত্রীর মা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। গুরুজিও সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীকে নিয়ে স্টেজে হাজির হলেন।
আলফ্রেড থিয়েটারে সেদিন সত্যিকারের বাদুড় ঝোলা অবস্থা। অথচ প্রধান শিল্পীদের দেখা নেই। শেষে বিব্বিকেই তড়িঘড়ি বসিয়ে দেওয়া হল সেই অধৈর্য জনতার সামনে। অবশ্য 'বিব্বি' নাম তো আর চলতে পারে না, তাই ঘোষণা করা হল 'আখতারি বাঈ'-এর নাম! এত বড়ো আসরে আগে কখনও গান করেননি তিনি। প্রাথমিক বিহ্বলতা আর জড়তা কাটিয়ে ধরলেন, “তুনে বুঁত-এ-হরজাই কুছ অ্যাইসি আদা পায়ি”। মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেলেন সবাই। টানা একঘণ্টা চলল শুধু তাঁরই কণ্ঠের খেলা। শ্রোতার আসনে থাকা সরোজিনী নাইডু পরদিন পাঠিয়ে দিলেন একটা খাদি শাড়ি। কলকাতা থেকে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল নতুন গজল সম্রাজ্ঞীর আগমনবার্তা।
এগারো বছরের মেয়ে সেদিন কলকাতার ওই সঙ্গীত আসরের উদ্যোক্তাদের শুধু বাঁচিয়ে দেননি মাত করে দিয়েছিল গোটা অনুষ্ঠান। শ্রোতারা শিল্পী তালিকা ভুলে শুধু তার গানই শুনে গেলেন। তখন কলকাতার রইসদের তারিফ পাওয়া ছিল হিন্দুস্থানের গাইয়ে বাজিয়েদের চূড়ান্ত শিলমোহর। খবর কাগজওয়ালারা উচ্ছ্বসিত, ঘোষিত হল এক নতুন তারার জন্ম।
নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরে কলকাতায় আসা। নাটকের পাশাপাশি জলসাতেও গান করতেন। কলকাতার সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলে গান শেখা থামেনি। মার্গ সংগীতের দিকপালদের কাছে তালিম নিয়েছেন আখতারি। কলকাতায় বসে গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও।
১৯৩৬-এ ঘটে যায় এক মজার ঘটনা। কলকাতার রেডিও স্টেশনে তাঁকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন অভিনেত্রী নার্গিসের মা জড্ডনবাই। হঠাৎ তাঁকে একটা ঘরে বসিয়ে বললেন দাদরা গাইতে। তিনিও খোলা মনে গেয়ে দিলেন। গান শেষ হতেই জড্ডনবাই জানালেন এই মুহূর্তে সারা ভারতবাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর গান।
মেগাফোন সংস্থার বড়কর্তা জে. এন. ঘোষ চুক্তি করলেন মেয়ের মায়ের সঙ্গে। রিপন ষ্ট্রিটে ফ্ল্যাট হল, গাড়ি হল, ১৯৩৭ সালে নতুন রেকর্ড বেরোলো, কিন্তু গান আর তেমন হিট করল না। ঘোষবাবুর কপালে ভাঁজ। মেয়ের মাকে সোজা জানিয়ে দিলেন, আর একটা রেকর্ড, সেটা চললে ভাল, নচেৎ চুক্তি বাতিল। মাথায় বজ্রাঘাত; সারা জীবন বিপদ আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। এই প্রথম মেয়ের কল্যাণে সুখের মুখ দেখেছেন তিনি। কোনো ভাবেই সে সুখকে হাত ফসকে যেতে দেবেন না। ঘোষবাবুর কাছে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নিয়ে সোজা বেরিলি। এলেন তাঁর গুরু, পীর আজিজ মিয়াঁর কাছে। পীর সব শুনে বললেন, ‘কলকাতায় গিয়ে যে গানটা গাইবি, সেই পাতাটা আমার সামনে খুলে ধর তো বেটি’। মেয়েটি খাতা খুলল, গানের কথা লিখেছেন প্রখ্যাত বজাহদ লক্ষ্মৌভি। পাতায় হাত রাখলেন আজিজ মিয়াঁ। বললেন, ‘শোহরত তুমহারি কদম চুমেগি, দৌলত তুমহারি বান্দি হো কর ঘুমেগি’। মা মেয়ে আর দেরি করলেন না। ট্রেন ধরে সোজা কলকাতা, হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি ঘোষবাবুর অফিসে, বললেন রেকর্ডিং-এর আয়োজন করতে। আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি গাইলেন : ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে’। গানটি আক্ষরিক অর্থেই সারা ভারতকে তাঁর ‘দিওয়ানা’ বানিয়ে ফেলল। বাকিটা সাফল্যের ইতিহাস। কলকাতায় থাকাকালীন অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই প্রথম রেকর্ডিং করতে হয়। এইচ. এম. ভি.'র হয়ে আখতারি প্রথম কিছু গজল ও ঠুংরি রেকর্ড করেন। যার মধ্যে একটা গজল ছিল ‘ওহ আসীরে দাম-এ-বালা হুঁ ম্যায়’। এই গান খুবই জনপ্রিয় হয়। তার আগে কলকাতার একাধিক থিয়েটারে গান গেয়েছেন, সেই সূত্রেই ডাক মেলে মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগতে। ১৯৪২ পর্যন্ত টানা কাজ করার পর ফিরে আসেন মুম্বই থেকে। তিনের দশক। কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি তাঁকে ‘এক দিন কা বাদশা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়।
এর পর ‘আমিনা’, ‘রূপ কুমারী’- সহ করেকটি ছবিতে অভিনয়। পরে লখনৌ ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে পরিচালক মেহবুব খান তাঁকে ‘রোটি’ ছবিতে অভিনয় ও গান করার কথা বলেন। আখতারি রাজি হন। সেই ছবির সুরকার ছিলেন অনিল বিশ্বাস। বিয়ের পর থেকে অভিনয়েও নিষেধাজ্ঞা ছিল। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও তাঁর স্মরণীয় গান আছে। প্রখ্যাত সব সুরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
অনেক পরে, ১৯৫৮ সালে শেষবারের মতো সিনেমার পর্দায় দেখা মিলল তাঁর। সিনেমার নাম ‘জলসাঘর’, পরিচালক সত্যজিৎ রায়। প্রথমে অবশ্য রাজি ছিলেন না ফের সিনেমায় অভিনয়ে। শেষ পর্যন্ত স্বামী ‘নবাব’ ইস্তিফাক আহমেদ আব্বাসির অনুমোদনে রাজি হন। সত্যজিৎ রায় স্বয়ং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমরা লখনউ গেলাম। ওঁকে বললাম। শুরুর দিকে উনি রাজি হননি। আমার এক আত্মীয় তখন লখনউয়ের ব্যারিস্টার। উনি আখতারির স্বামীর ভাল বন্ধু। শেষে উনিই রাজি করান।’’
ফুরিয়ে আসছে অতীতের গরিমা, অথচ ভাঙা বাড়িকে আঁকড়ে বিলাসে মেতে উঠেছেন এক জমিদার। আর সেখানেই বেগম আখতারের গান। জমিদারের মেহেফিলে বিলায়েত খানের সুরে গেয়ে উঠলেন ‘ভর ভর আয়ি মোরি আঁখিয়া’। সাড়ে তিন মিনিটের বেশি গানটির প্রায় সবকটি ফ্রেম জুড়েই তিনি। ছবিতে দুর্গাবাঈ হিসেবে আখতারির গান এবং তার সঙ্গে রোশনকুমারীর নাচ এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
দেখতে সুন্দরী, পোশাকে-আশাকে শালীন, কানে বড় বড় পান্না-হীরে বসানো টব, গলায় সরু সোনার হার এবং তাতে একটা বড় হীরে বসানো, তার পাশে রকমারী পাথর। হাতেও দামি পান্না বসানো হীরের আংটি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেই বোঝা যেত আভিজাত্য। একই রকম দক্ষ ছিলেন তিনি গজল গায়কীতে। তাঁর গানের সুর শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতে পারতো। বেগম আখতারের গান মানুষ কেমন ভালোবাসতো সে সম্পর্কে একটা চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত আছে :- লখনৌর এক গান-পাগল ভদ্রলোক বেগম আখতারের গান শুনে তাঁকে ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু বেগম আখতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। উপায়ান্তর না দেখে সেই ভদ্রলোক বেগম আখতারের বাসার কাছে রাস্তায় খড়িমাটি দিয়ে নাম লিখে রাখতেন। বেগম আখতার যখন তাঁর নামের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে চলে যেতেন তাতেই তিনি তাঁর ভালোবাসার প্রতিদান পেয়েছেন বলে মনে করতেন। এই কাহিনী থেকেই বেগম আখতারের গানের আবেদন কত সুদূর প্রসারী, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজকেও প্রকৃত সঙ্গীতপ্রেমী আর সমঝদাররা অম্লান করে রেখেছেন বেগম আখতারকে।
কণ্ঠে তাঁর অমৃতের স্পর্শ, স্বয়ং দেবতারা যেন সাধুবাদ পাঠান অমরাবতী থেকে। সঙ্গীত তাঁর কাছে ঈশ্বরসাধনার আরেক নাম। গজল-ঠুংরি-দাদরার জাদুতে ‘দিওয়ানা’ করেছেন বহু অনুরাগীকে আর ‘জোছনা করেছে আড়ি’ বলেও রাতের আঁধারে জ্বালিয়ে দেন নক্ষত্রের আলো। ঠিক ততটাই ‘বিষ’ ছড়িয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। গান শুধু দেয়নি, নিয়েছেও অনেক। চেনা লোকের হাতেই যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন, একাধিকবার। তওয়াইফের মেয়ে, এই পরিচয় মুছে শিল্পীর পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন, চেয়েছেন ঘর-বর, স্বাভাবিক দাম্পত্য।
একদিন হঠাৎই আখতারির ডাক পড়ল উত্তরপ্রদেশেরই রামপুরের নবাবের দরবারে। নিমন্ত্রণ রাখলেন আখতারি। কিছু দিন সেখানে থাকার পর, নবাব আখতারিকে নিকাহ্ করার প্রস্তাব দেন। রামপুরের সেই রাজা কুদর্শন, কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তাঁর প্রচুর খ্যাতি। তাঁর দরবারে গান হল আখতারির। গানের শেষে নিজের তাঁবুতে ফিরে এসেছে আখতারি, এমন সময় রাজবাড়ি থেকে ফের ডাক পড়ল তার। সারা রাত ফিরতে পারল না সে। ভোররাতে দারোয়ান এসে পৌঁছে দিয়ে গেল আখতারির সংজ্ঞাহীন, রক্তাক্ত দেহ। সঙ্গীতপ্রিয় রাজা ধর্ষণ করেছেন তাঁকে। ছ’দিন জ্ঞান ফিরল না আখতারির। তত দিনে মুশতারি তাকে নিয়ে লখনউ চলে এসেছেন। সেখানেই ন’মাস পরে মেয়ের জন্ম দিল আখতারি। তখন তার ১৪ বছর বয়স। মেয়ের নাম রাখা হল শামিমা। লোকলজ্জার হাত থেকে ছোট্ট আখতারিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন মা মুস্তারি। চাউর করে দেন, নবজাতিকা তাঁরই আত্মজা। আমৃত্যু সেই মেয়েকে বোন বলে এসেছেন আখতারিবাঈ। বয়স তখন মাত্র ১৩!
পরে লখনউয়ের প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার ও কাকলির নবাব ইশতিয়াক আহম্মদ আব্বাসি বিয়ে করলে, অযোধ্যার ‘উচ্চবিত্ত’ সম্প্রদায়ের মধ্যে আখতারি অন্য ভাবে সমাদৃত হন। 'বাঈজি' থেকে 'বেগম' হন আখতারি। নবাবের সঙ্গে অবশ্য আলাপ হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। ১৯৩৪ সালে লখনউয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন আখতারি। আব্বাসি তখন তরুণ আইনজীবী। আখতারির গাড়ি তাঁকে আর একটু হলেই চাপা দিচ্ছিল। কোনও রকমে সে যাত্রা রক্ষা পান নবাবজাদা। এর পর দীর্ঘ আলাপে প্রেম। ক্রমে আখতারির গানে মজে যান তিনি। শেষে বিয়ে।
একের পর এক মৃত সন্তান ধরেছেন গর্ভে। জীবন? সে তো সুরের মতো ঘুরতে থাকে খাদের ধার ঘেঁষে। শত যন্ত্রণার ওপার থেকে আসা সঙ্গীত ঈশ্বরের আহ্বান একমাত্র জ্বলতে থাকে আলো হয়ে। সেই নিশানকে অনুসরণ করেই 'বিব্বি' হয়ে ওঠেন 'আখতারি বাঈ'। সমুদ্রমন্থনের হলাহলের ওপার হতে উঠে আসা অমৃতের স্পর্শে হয়ে ওঠেন সঙ্গীতের ‘বেগম’। প্রেমের বিয়ে, তাও শর্ত ছিল প্রকাশ্যে গান গাওয়া যাবে না। মেনেও নিয়েছিলেন আখতারি। কিন্তু সুর যার শিরাধমনীতে বইছে, তাকে গানের থেকে আলাদা করা কি সম্ভব? তাই বিয়ের কবছর পরেই প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন আখতারি। ডাক্তার নিদান দিলেন, ওষুধ নয়, গানে ফিরুন। নিমরাজি হল শ্বশুরবাড়িও। আবার নতুন করে তানপুরো তুলে নিলেন বেগম আখতার। তারপর বাকিটা ইতিহাস…।
১৯৪৯ সালে লখনৌ রেডিয়োয় তিনটে গজল আর একটা দাদরা রেকর্ড করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর রেকর্ডে দেখা যায়, সেই গান ব্রডকাস্টের সময় তাঁকে 'বেগম আখতার' বলে সম্বোধন করা হয়। রেকর্ডিং করে এত আনন্দ পান, যে বাড়ি ফিরে অঝোরে কেঁদে ফেলেন। পরবর্তীকালে কোনও বড় অনুষ্ঠানের পরও যে ছবি ঘনিষ্ঠরা দেখেছেন। যে মা জীবনভর তাঁকে আগলে রেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যু এর কয়েক বছর পর। শোনা যায়, মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে যখন সমাধিস্থ করা হচ্ছে, তখন সেই সমাধিতে নেমে পড়েন আখতারি। সেখান থেকে কিছুতেই উঠে আসতে চাইছিলেন না। শেষে গানের কথা বলে তাঁকে ফেরানো হয়। জীবনভর এমন ছোট-বড় নানা দুঃখ থেকেই উৎসারিত তাঁর সব গান।
এত বছর পার করে এসেও কেন এত জনপ্রিয় আখতারি বাঈয়ের গান? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভূত তালিম ওঁর ঠুংরি-দাদরা-গজলে অদ্ভুত ভাবে মিশে যেত। রাগের মধ্যে যে অনুরাগ থাকে, সেটা বড় মিষ্টি করে উনি ব্যবহার করতেন। কখনও খেয়ালের সঙ্গে ফোক মিশিয়েছেন, কখনও গজলের সঙ্গে দাদরা। পাশাপাশি, উপস্থাপনের সময় তাঁর স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারতেন। গজল গাওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চারণ, আবেদন এবং গায়ন শৈলী বদলে আধুনিকতার ছোঁয়া আনেন আখতারি। যা ছিল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ভাবনা-চিন্তার ফসল।
আখতারির আগে গহরজান, মলকাজান বা জোহরাবাইয়ের আমলে একভাবে গজল গাওয়া হত। সেই ছক ভেঙে তিনি বেরোতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল সে সময়ের বিশ্রুত ঊর্দু কবি মির তাকি মির, শাকিল বাদাউনি বা কাইফি আজমির মতো একাধিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। এই জন্যই তো তিনি ‘মল্লিকা-এ-গজল’।
জীবনভর স্বীকৃতিও কম পাননি। পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা রাশিয়া গিয়েছেন ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে। পদ্ম সম্মান ও সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত। কিন্তু বিভিন্ন সময় একের পর এক ধাক্কা এবং একাকিত্ব ক্রমশই তাঁকে ঠেলে দেয় বিভিন্ন নেশার মধ্যে দিয়ে নিজের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখার দিকে।
বেগমের এক ঘনিষ্ঠ ছাত্রীর লেখা থেকে যা জানা যায়, মানসিক যন্ত্রণা এড়াতে বেশ কয়েক বার গর্ভপাত করতে হয়েছে। বয়সের সঙ্গে শরীরও খারাপ হয়ছে। সেটা ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪। আমেদাবাদে সেই অনুষ্ঠান নিয়ে মারাত্মক উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। প্রচার করা হয়, বেগম সাহেবার ৬০ বছরের জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠান। বেগমও নিজে সেই অনুষ্ঠান নিয়ে উত্তেজিত। শরীর ঠিক ছিল না। ইতিমধ্যেই দু’বার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীর দুর্বল। তার ওপর জ্বর। তবু, উৎসাহে ঘাটতি পড়েনি। কাইফি আজমি একটা গজল লিখেছিলেন, বেগম আখতারের ৬০ বছরের জন্মদিন মনে রেখে। সে গানও তো গাইতে হবে! ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়াম। পর্দা ওঠামাত্র হাততালিতে অভিবাদন। সামান্য মাথা নামিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করে বেগম গলা ফেললেন। কিন্তু শান্তি পেলেন না। স্কেল চড়িয়ে নিলেন। ফের বাঁধলেন তানপুরা। একের পর এক অনুরোধে জনপ্রিয় সব গান তাঁকে করেই যেতে হল উঁচু স্কেলে।
শেষ অনুরোধ। আরও একটা গান। ফের হারমোনিয়ামে সুর তুলতে হল। ‘অ্যায় মোহাব্বত, তেরি আনজাম পে রোনা আয়া’ - না শুনে তাঁকে ছাড়বেন না কেউ। গানের মাঝখানে মঞ্চেই তৃতীয় বার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলেন। তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে যেতে হল। তিন দিন বাদে মৃত্যু।
পুরনো লখনউ শহরের হজরতগঞ্জ এলাকার কেন্দ্রে বেগম হজরত মহল পার্ক। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের স্ত্রী হজরত মহল সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রায় এক বছর লখনৌয়ের দখল রাখেন নিজের হাতে। তাঁর স্মৃতিজড়িত সেই পার্ক পেরিয়ে গেলে গোমতী নদীর পাড় বরাবর কিছু দূর এগোলে ঠাকুরগঞ্জ এলাকা। সেখানেই অমরগঞ্জে গ্রিনল্যান্ড পার্কের কাছে রয়েছে বেগম আখতারের সমাধি। বেগম আখতারের সমাধিতে গেলে চোখে পড়বে লাল ইঁটের দেওয়াল ঘেরা ছোট্ট চালা। পাশাপাশি শ্বেতপাথরে বাঁধানো দু’টি সমাধি। একটি মা মুশতারি বাঈয়ের। পাশেরটি আখতারির।
তীব্র আঘাতের শত ঘাত সয়ে সয়ে তাঁর মানবজন্ম সার্থক হল শিল্পীসত্তার পূর্ণ বিকাশের যবনিকায়। যতই তিনি নিজে গান, "কোয়েলিয়া গান থামা এবার / তোর ঐ কুহুতান ভালো লাগেনা আর"; ততই মানুষ হৃদয়ের কান পেতে থাকে তাঁর গীতে, কথায়, গায়কীর বেদনা ও বিষাদে। তাঁর কণ্ঠ থেকে গান হয়ে যেন ঝরে পড়ে স্বরচিত জীবন বেদনার সঙ্গী শত নদীর বিরহী স্রোত। বেগম আখতারের মৃত্যুর ৪৯ বছর পরেও উত্তর লখনৌয়ের ঊষর পসন্দাবাগে তাঁর নিঃসঙ্গ সমাধির উপর জ্বলতে থাকা বাতিগুলি ধীরে ধীরে নিভে এলেও, ফুরাচ্ছে না ‘মালিকা-ই-গজল’ বেগম আখতারের ‘রুহি-গুলাব’ সৌরভমাখা অনিঃশেষ-ধ্বনিপুঞ্জ, অলৌকিক-সুর লহরী এবং বেদনার্ত-সঙ্গীত।
প্রায় প্রতিটি সঙ্গীতবোদ্ধা শ্রোতাই বেগম আখতারের গানের মধ্যে সঞ্চারিত বেদনা-বিধূর সুর ও সিম্ফনিতে অনুভব করেন তাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ বাস্তব-জীবনের করুণ ছায়াপাত। হেমন্তের বিষণ্নতায় প্রতিটি শীতের শুরু ও উপান্তে তিনি বিশেষভাবে আসেন মায়াবী কুয়াশার রহস্যময়তাকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর জন্ম ও মৃত্যুর যৌথস্মৃতিবন্ধনের অশ্রুমালায় ভেসে চলেন ভারতের প্রাচীন, ঘটনাবহুল, আলো-আঁধারীতে-ভরা ধ্রুপদী সাংস্কৃতিক আকাশের এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে।
No comments