Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শ্রদ্ধায় স্মরণে হৃদয়ে থাকবে পি কে ব্যানার্জি

শ্রদ্ধায় স্মরণে হৃদয়ে থাকবে পি কে ব্যানার্জি
যতদিন বাঙালি থাকবে ততোদিন থাকবে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের লড়াই। আর যতদিন এই লড়াই থাকবে, ততোদিন হৃদয়ে থাকবে পি কে ব্যানার্জি অমল দত্তের নাম।পি কে বলতে সিনেমার চরিত্র বা রাজনৈতিক উপদেষ্…

 


শ্রদ্ধায় স্মরণে হৃদয়ে থাকবে পি কে ব্যানার্জি


যতদিন বাঙালি থাকবে ততোদিন থাকবে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের লড়াই। আর যতদিন এই লড়াই থাকবে, ততোদিন হৃদয়ে থাকবে পি কে ব্যানার্জি অমল দত্তের নাম।পি কে বলতে সিনেমার চরিত্র বা রাজনৈতিক উপদেষ্টা না, বাঙালি আজো বোঝে পরম বর্ণময় এক চরিত্র। যিনি ইস্টার্ন রেলের মতো ছোটো দলের হয়ে মাঠে নেমে কাঁপিয়ে দিয়েছেন তিন প্রধানকে। একার কাঁধে টেনেছেন দলকে। দীর্ঘদিন খেলেছেন ভারতীয় দলের হয়ে।ফুটবলার পি কে যতো বিখ্যাত ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত তিনি হন কোচ হিসাবে। বাংলার ক্লাব ফুটবল তখনও বিকিয়ে যায় নি বিদেশিদের কাছে। কোচ হিসেবে চিনতো বাঘা সোম, নগেন্দ্র সর্বাধিকারী বা রহিম সাহেবকে। সেই সময় কোচিং করাতে এলেন পি কে ব্যানার্জি।একদম এক নতুন ধারার সূচনা হলো ভারতীয় ফুটবলে। বুঝিয়ে দিলেন তাঁর দলে কোনো প্লেয়ার না তিনিই হচ্ছেন আসল স্টার। অসাধারণ জ্ঞান, অদ্ভুত উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর অনবদ্য বাগ্মিতা। প্রচার মাধ্যমের সব আলো তার পিছনে। কী বলছেন পিকে? 

পি কে বলছেন, বলছেন তাঁর ছাত্রদের। এই ক্লাব তোদের মা, এই ক্লাবের ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব তোদের, ক্লাব আছে তাই তোদের টাকা আছে, গাড়ি আছে, এতো খ্যাতি আছে। বাপের বেটা হোস তো ছিঁড়ে খা ওদের। জিতে আসিস। হারলে আর আসিস না। বাড়ি গিয়ে চুড়ি পরে থাক।

চালু হয়ে গেল বিখ্যাত ভোকাল টনিক।খেলা শুরুর আগে দরজা বন্ধ করে উত্তপ্ত লাভা উদগীরণ।রক্ত টগবগ করে ফুটছে প্লেয়ারদের। অ্যাড্রিনালিন হরমোনের প্রভাবে রক্তে দোলা। কখনও প্লেয়ার দের মায়ের ছবি ছুঁইয়ে শপথ করাচ্ছেন। কখনও ক্লাবের প্রাক্তন অশক্ত কর্মকর্তাদের এনে তাঁদের দিয়ে বলাচ্ছেন,আর বেশিদিন নেই। মরার আগে এই ম্যাচটা ভিক্ষে চাইছি বাবা।অজান্তেই প্লেয়াররা শপথ নিয়ে নিতেন মরি মরবো, কিন্তু হেরে ফিরব না। প্লেয়াররা বলতেন তাঁর আগুনে ভোকাল টনিকের এমন জোর যে, মরা মানুষও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে।

এখন টিমের সাথে মনোবিদ এসেছে। মোটিভেশনাল স্পিচ দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু সেই যুগে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝেছিলেন বড়ো টিমের খেলোয়াড়দের খেলা শেখাতে হবে না। আসল কাজ মোটিভেট করা। সেরাটা বার করে আনা। এখানেই তিনি পিকে।আট এর দশকে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের লড়াই হয়ে গিয়েছিল পিকে অমল দত্তের লড়াই। একজনের স্ট্র্যাটেজি আর এক জনের ভোকাল টনিক। কতো স্মৃতি, কতো শিরোনাম,কতো উন্মাদনা।


এই তো সেদিন। ১৩ ই জুলাই ১৯৯৭। সেই রেকর্ড দর্শকের যুবভারতী, ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল। একদিকে চিমা বিজয়ন দীপেন্দুদের মোহনবাগান। অন্য দিকে বাইচুং সোসো ওমেলোদের ইস্টবেঙ্গল। মোহন কোচ সেই অমল দত্ত। সে বছর খেলাচ্ছেন ডায়মন্ড সিস্টেমে। হীরের মতোই দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেই সিস্টেম। গোলের মালা পরাচ্ছে বিপক্ষকে। সেমিফাইনালের আগে টগবগ করে ফুটছে বাংলা। পেপারে শিরোনাম,টিকিটের হাহাকার, প্রবল উন্মাদনা। অমল দত্ত ব্যঙ্গ করে বললেন ওই তো সব প্লেয়ার, চুমচুম শসা ওমলেট। চারদিকে এই নিয়ে তোলপাড়। সুযোগ নিলেন পিকে।শুরু করলেন মেন্টাল গেম। টিম মিটিংএ প্লেয়ারদের মাঝে ফেলে দিলেন পেপার কাটিং গুলো। যদি মানুষের রক্ত থাকে তবে প্রমাণ কর তোরা মানুষ। শসা ওমলেট চুমচুম না। অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়েছিল বাইচুং এর। পাহাড়ি বিছের হুলে ক্ষতবিক্ষত হলো বাগান। ৪-১ গোলে হেরে ডায়মন্ড তখন কাচের মতোই চুরমার। বাইচুং বলেছিল, পিকে স্যার যে আগুনটা লাগিয়েছিলেন, তাতেই ছাই হলো বাগান। মোটিভেশনের আগুন জ্বালানো এই লোকটার নাম ই পিকে ব্যানার্জি।


তারপর টিম আধুনিক হলো। পিকে অমলদের দর কমলো। বিদেশ থেকে এলো কোচ।বাঙালি প্লেয়ার হাতে গোনা। বিদেশি প্লেয়ারের প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ,ভিনরাজ্যের প্লেয়ারদের সাথে নেই ক্লাবের নাড়ির যোগ। এরা বোঝে টাকা। বোঝেনা জাতীয় ক্লাবের ঐতিহ্য, বোঝেনা লাল হলুদের আবেগ। ভোকাল টনিকের আওয়াজ আগুন জ্বালায় না তাদের রক্তে। আবেগহীন ফুটবলে পি কে আর মোটিভেট করার আগ্রহ পেলেন না। মাঠ থেকে সরে গেলেন। অশক্ত দেহ, স্ত্রী চলে গেলেন। নানান কথায় বক্তৃতায় জ্ঞানে বাগ্মিতায় মাতিয়ে রাখা মানুষটি আবদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে, একা, কিছুটা নিঃসঙ্গ। বাঙালি হীন বাংলার ফুটবল আর তেমন টানতো না তাঁকে। তারপর তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অমল দত্তও চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। পিকে অমলের একটা ডানা ভেঙে গেলো।


তারপর এই সময় যখন সারা দুনিয়া লড়ছে করোনার সাথে, তখন বহু লড়াইয়ের যোদ্ধা শুয়ে ভেন্টিলেশনে। শেষ লড়াইটা লড়ছিলেন মৃত্যুর সাথে। অচেতন ভাবে ঘোরের মধ্যে দৌড়চ্ছিলেন রাইট উইং ধরে। বিখ্যাত সেই দৌড়। অথবা চিৎকার করে বলছিলেন নিজেকে, কাম অন , কাম অন, হেরে আসিস না। যদি হেরে যাস, আর ফিরিস না। হয়তো দেখছিলেন মাঠের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়েছেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী অমল দত্ত। ডাকছেন আয় প্রদীপ আয়। আবার নতুন খেলা শুরু করি। সেই উন্মাদনা,সেই আগুন,সেই আবেগ। শুনতে পাচ্ছিস, সেই চিৎকার?তোদের এখানে কিছু নেই। আজ অমল পিকে কে কেউ চেনে না।ক্লাবকে কেউ মা ভাবে না। এরা আইএসএল জানে, চিয়ার লিডার জানে, রক্ত গরম করা বড়ো ম্যাচ জানে না, আর জানবে না। ক্লাব গুলো বিক্রি হচ্ছে, আবেগ বিক্রি হচ্ছে, নাড়ির যোগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ওটা আর আমাদের ময়দান নেই। চলে আয়।

চোখ বুজলেন পিকে। শেষ হলো বাংলা ফুটবলের একটা বর্ণময় অধ্যায়। প্রদীপ নিভলো ফুটবলের।

গতকাল ছিল তাঁর প্রয়াণ দিবস | আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য ।


No comments