গুরু মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের শিষ্য ও শিষ্যাগণ
আমরা সকলেই জানি, গুরুই পরমব্রহ্ম, গুরুই পরমগতি, গুরুই পরাবিদ্যা, গুরুই পরম আশ্রম, গুরুই পরম উৎকর্ষ, গুরুই পরমধন।গুরু শব্দের আক্ষরিক অর্থ—‘গ’ কার উচ্চারণ মাত্র ব্রহ্ম হত্যা পাপ দূর হয়…
গুরু মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের শিষ্য ও শিষ্যাগণ
আমরা সকলেই জানি, গুরুই পরমব্রহ্ম, গুরুই পরমগতি, গুরুই পরাবিদ্যা, গুরুই পরম আশ্রম, গুরুই পরম উৎকর্ষ, গুরুই পরমধন।
গুরু শব্দের আক্ষরিক অর্থ—
‘গ’ কার উচ্চারণ মাত্র ব্রহ্ম হত্যা পাপ দূর হয়, ‘উ’ কার উচ্চারণ মাত্র সারা জীবনের পাপ থেকে মুক্তি হয়, পুনরায় ‘উ’ কার উচ্চারণ মাত্র কোটি জন্মজাত পাপ মুক্ত হয় মানুষ।
আবার গুরু কথার অনুবাস করলে দাঁড়ায়— গ-কার সিদ্ধিদান করে, র-কার পাপের দহনকারী বা হরণকারী এবং উ-কারকে বিষ্ণু বা মহাদেব বলে জানি।
তারক উপনিষদে কথিত আছে, ‘ও’ শব্দ অন্ধকার, ‘রু’ শব্দ তার নিরোধক।
আমরা পৌরাণিক আমলে গুরুর একটা বিশেষ সম্মানের কথা জানি। সেই সময় গুরুকে সবাই পরম দেবতা জ্ঞান করতেন। তখন আশ্রমে গুরুর কাছে শিক্ষা নিতে হত এবং শিষ্যকে গুরুগৃহে গিয়ে বাস করতে হত। গুরুর কাজ ছিল পঠন, পাঠন এবং যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি সম্বন্ধে শিষ্যকে শিক্ষা দেওয়া। সেই সময় শিষ্যকে গুরুগৃহে কঠিন পরিশ্রম করতে হত। আবার গুরুর কাছ থেকে ফেরার সময় গুরুর বাসনা অনুযায়ী গুরুদক্ষিণা দিতে হত। বলা হয় গুরুর ঋণ শোধ করা যায় না। তবে শাস্ত্রে আছে, গুরু হবেন শান্ত, সদ্বংশীয়, বিনীত এবং শুদ্ধাচারী, শুদ্ধবেশী, সুবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তন্ত্রমন্ত্র বিশারদ। প্রচলিত মতে গুরু দেবতাস্বরূপ বা ইষ্টদেব। গুরু সামনে থাকলে নিত্যপূজা বা দেবতাপূজা না করে গুরুর পূজা করাই কর্তব্য। এখানে একটা কথা বলি, পিতা-মাতা জন্মের কারণ বলে প্রযত্নপূর্বক পূজনীয়। তবে গুরু ধর্ম-অধর্মের প্রদর্শক বলে তাদের অপেক্ষা অধিকতর পূজ্য। অর্থাৎ পিতা শরীর দান করেন, গুরু জ্ঞান দান করে থাকেন, এই জন্য দুঃখ-সাগর সংসারে গুরু থেকে গুরুতর কেউ নেই।
আমাদের ভারতবর্ষ গুরুর দেশ। শাস্ত্রে আছে গুরুর স্মরণ না করলে কোনও কাজ সিদ্ধ হয় না। মানুষের পঞ্চভৌতিক দেহে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সংস্কার শুদ্ধির জন্য গুরুর মন্ত্র গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। গুরুর সাহায্যে পরমজ্ঞান উৎপন্ন হয়। কাম, ক্রোধ, তৃষ্ণা, বিদ্বেষ প্রভৃতি থাকে না এবং মুক্তি হয়। এই মুক্তির জন্য জ্ঞানের অভ্যাস করতে হয়। আবার জ্ঞান ছাড়া ধ্যান হয় না। জ্ঞানী ব্যক্তি তৈজস, বিশ্ব, প্রাজ্ঞ ও তুরীয় এই চতুর্জ্ঞান করে ধ্যান অভ্যাস করতেন। অগ্নি যেমন শুষ্ক কাঠকে দগ্ধ করে, তেমনই জ্ঞান সমস্ত প্রকার পাপকে দগ্ধ করে। এই কারণেই ধ্যান অভ্যাস করা দরকার।
এখন প্রশ্ন গুরু কে?
শ্রীরামকৃষ্ণ এক কথায় বলেছেন ‘গুরু হল ঘটক’। যিনি ভগবানের সঙ্গে ভক্তের যোগ ঘটিয়ে দেন। গুরু শিষ্যের ভাব অনুযায়ী মন্ত্র ও ইষ্ট ঠিক করে দেন। যে দক্ষ ব্যক্তির কাছে দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ অন্ধকার থেকে আলোয় আসার ঠিকানা পায় বা পথ দেখতে পায় তিনিই গুরু। আরও বিশদে বলা যায়, গুরু হলেন আধ্যাত্মিক পথের দিশারী। মানুষকে জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উন্নীত করে পরম সত্যস্বরূপ ঈশ্বরের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।
শাস্ত্রে বলেছে—
যিনি অজ্ঞানরূপ তিমির অন্ধকারে জ্ঞানরূপী অঞ্জন দ্বারা চক্ষুর উন্মিলন ঘটান তিনিই হলেন গুরু।
একটা মজার কথা বলি, ‘ইঞ্জিন স্বরূপ গুরু’ ‘গাড়ি স্বরূপ শিষ্যকে’ বিভিন্ন টানাপড়েন, ওঠা-পড়া, শোক-তাপ, দুঃখ-কষ্ট অথবা আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে চলে উত্তরণের পথে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন, চুরিবিদ্যা জানতেও একজন গুরুর দরকার হয়। আর এত বড় ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে তো গুরুর দরকার হবেই।
এ বার আসি গুরুপূর্ণিমার কথায়। গুরুর দীক্ষা তিন প্রথায়- শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত। এঁদের প্রত্যেকের গুরুপরম্পরা থাকে। শৈবমতে সর্বপ্রথম শুরু শিব। বৈষ্ণব মতে শ্রীকৃষ্ণ এবং শাক্তমতে শ্রীচণ্ডী। এঁদেরই চিরাচরিত গুরু বলে মানা হয়। এঁদের মাধ্যমই গুরু পরম্পরা শুরু হয়েছে।
এ বার আসি পূর্ণিমার নিয়ম সম্পর্কে। এ বছর ২৭ জুলাই, শুক্রবার, ১০ শ্রাবণ গুরুপূর্ণিমা। এই উৎসব উপলক্ষ্যে সমস্ত জায়গাতেই অর্থাৎ সব মন্দিরে বা ভক্তদের বাড়িতে তাদের নিজ নিজ গুরুদেবের পূজাপাঠ হয়। যদি গুরুদেব জীবিত থাকেন, তবে তাঁর পাদুকা ধুয়ে কাপড় দিয়ে মুছে একটি জলচৌকির ওপর রেখে গুরুদেবকে নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে মালা, মুকুট এবং অলঙ্কারাদি দিয়ে সাজিয়ে পাদুকা পূজা শুরু হয়। যদি গুরুদেব সশরীরে না থাকেন তবে তাঁর পাদুকা বা চরণ বা খড়মে এই একই রূপে দুধ, গঙ্গাজল, ঘি, মধু, দই, অগরু ইত্যাদি দিয়ে মন্ত্র সহযোগে ধোয়াতে হয়। এরপর সেই চরণ পরিষ্কার করে তা কোনও থালায় বা রেকাবিতে রেখে চন্দন দিয়ে সাজিয়ে ফুলমালা দিয়ে পূজা করা হয়। এটা গুরুর প্রতিকৃতির সামনে রেখে করা হয়। এরপর শিষ্যরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া, নামকীর্তন, গান ও গুরুকে নানারকম উপহার দিয়ে দিনটি পালন করে। এই দিনটি প্রত্যেক ভক্তেরই আনন্দ উপভোগের দিন। অনেক সময় গুরুও এই দিন দীক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন, নামপ্রদান করেন। এই ভাবেই গুরুপূর্ণিমার দিনটি পালিত হয়।
গুরুধ্যান
ধ্যায়েচ্ছরসি শুক্লাব্জে
দ্বিনেত্রং দ্বিভুজং গুরুম্।
শ্বেতাম্বরপরিধানং
শ্বেতমাল্যা নুলেপনম্।।
বরাভয়করং শান্তং
করুণাময় বিগ্রহম্।
বামেনোৎপলধারিণ্যা
শক্ত্যা-লিঙ্গিত বিগ্রহম্।
স্মেরাননং সুপ্রসন্নং
সাধকাভীষ্টদায়কম্।।
গুরুস্তোত্রম
ওঁ অখন্ডমন্ডলকারং ব্যাপ্তং
যেন চরাচরম্।
তৎ পদং দর্শিতং
যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু
গুরুদেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরের পরং ব্রহ্মা
তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
একং নিত্যং বিমলচলং
সর্বৃধী সাক্ষীভূতম্।
ভাবাতীতং ত্রিগুণরহিতং
সদ্ গুরুং তং নমাম্যহম্।
গুরু মা রেখারানী অধিকারী গত ১১ তারিখ বুধবার সন্ধে ৬টা ৩০ মিনিটে পরলোকগমন করেছেন। যেহেতু আমার বাবা ধনঞ্জয় অধিকারী দীক্ষা দিয়েছেন অনেক শিষ্যদের তাই মা তাঁদের গুরুমা । আজ ১৪ ই জানুয়ারী চতুর্থ দিনে সবাই মিলে একসঙ্গে প্রায় ৭০-৮০জন শিষ্য ও শিষ্যা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছেন। গুরু মায়ের আত্মার শান্তি কামনার্থে শোকাহত পুত্র এবং পুত্রবধূ গণ এবং নাতি নাতনি নাতজামাই মেয়ে জামাই সবাই এক মিলিত হয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ২১ তারিখ শনিবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হবে। সবার আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা ও উপস্থিতি একান্ত ভাবে কামনা করি।মাতৃহারা পুত্রদয় প্রীতিভূষণঅধিকারী,স্মৃতিভূষণ অধিকারী ও পুত্রবধু কৃষ্ণপ্রিয়া অধিকারী, রূপালী অধিকারী।
No comments