Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বিজ্ঞানীর আড়ালে এক আত্মভোলা খেয়ালি বাঙালি : সত্যেন্দ্রনাথ বসু

বিজ্ঞানীর আড়ালে এক আত্মভোলা খেয়ালি বাঙালি : সত্যেন্দ্রনাথ বসু
আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি 'সত্যেন্দ্রনাথ' শব্দটি দেখে প্রথমেই অধিকাংশের মনের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা চলে এসেছে। কিন্তু না, এখানে সত্যেন্দ্রনাথ এর পরে…

 




বিজ্ঞানীর আড়ালে এক আত্মভোলা খেয়ালি বাঙালি : সত্যেন্দ্রনাথ বসু


আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি 'সত্যেন্দ্রনাথ' শব্দটি দেখে প্রথমেই অধিকাংশের মনের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা চলে এসেছে। কিন্তু না, এখানে সত্যেন্দ্রনাথ এর পরের শব্দটি ‘দত্ত’ নয়, ‘বসু’; বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি 'বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান' আবিষ্কারের জন্য দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন, যার নামের কারণে শুরুর দিকে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। হ্যাঁ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু তিনি, যার কথা আজও বাঙালী গর্বভরে স্মরণ করে একজন বাঙালী বিজ্ঞানী হিসেবে।


বাংলা বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান প্রায় এভারেস্টের মতো। শুধু বাংলাতেই নয়, ভারতবর্ষের বুকে আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণায় তিনি আজও এক অবিস্মরণীয় নাম। পদার্থবিদ্যার অন্যতম জটিল শাখা, গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান ছিল তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র। পরমাণুর চেয়েও ছোট পূর্ণসংখ্যক স্পিনবিশিষ্ট মৌলিক কণিকার আরেক নাম ‘বোসন কণা’। এই ‘বোসন’ বা ‘ঈশ্বর’ কণার আবিষ্কারে বিশ্বখ্যাত আইনস্টাইনের সঙ্গে একযােগে উচ্চারিত হয় বাংলার সেই স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর নাম। তিনি, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু।


১৮৯৪ সাল, যখন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে, সেই ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কোলকাতায় তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে ১ জানুয়ারি এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তার বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি’র একজন হিসাবরক্ষক। তার গণিত এবং বিজ্ঞানের প্রতি ছিল অদম্য আকর্ষণ। এই আকর্ষণ থেকেই তিনি ১৯০৩ সালে তিনি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ও কেমিক্যাল কোম্পানি চালু করেন। সত্যেন্দ্রনাথের মা ছিলেন আমোদিনী দেবী। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার সাত সন্তানের জ্যেষ্ঠ সন্তান। তবে সাতজনের মধ্যে কেবল সত্যেন্দ্রনাথই ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান।


প্রাথমিকভাবে সত্যেন্দ্রনাথ স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হন। তবে পরবর্তীতে তার পরিবার কলকাতার গোয়াবাগান নামক স্থানে চলে গেলে তিনি ‘নিউ ইন্ডিয়ান স্কুল’ এর শিক্ষার্থী হন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার বাবাই মূলত তার গণিতে দক্ষতা বাড়াতে মূল ভূমিকা পালন করেন। সুরেন্দ্রনাথ প্রতিদিন কাজে যাবার সময় ঘরের মেঝেতে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা লিখে যেতেন যা সত্যেন্দ্রনাথ তার বাবা বাড়ি ফেরার পূর্বেই সমাধান করে রাখতেন।এভাবে ধীরে ধীরে তার গণিতের প্রতি ঝোঁক অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং দক্ষতাও বাড়ে। ১৯০৭ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ভারতের অন্যতম পুরাতন বিদ্যালয় ‘দ্য হিন্দু স্কুল’ এর ভর্তি পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন এবং সেখানে ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তির অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গণিতে অত্যন্ত ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার গণিত শিক্ষক বিশ্বাস করতেন যে সত্যেন্দ্রনাথ একদিন পিয়েরে লাপ্লাসের মতো বিখ্যাত গণিতবিদ হবেন।


মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে ১৯০৯ সালে তিনি তৎকালীন ক্যালকাটার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। তিনি ফলিত গণিতে তার স্নাতক পড়ালেখা শুরু করেন। এবং এখানেও তার মেধার বিচ্ছুরণ ঘটার কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক পড়ালেখা শেষ করেন ১৯১৩ সালে। গণিতে নিজের অসাধারণ দক্ষতার জন্যই হোক কিংবা ইচ্ছার জন্যই হোক, তিনি ততদিনে ঠিক করে ফেলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করবেন। তিনি তৎকালীন ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা শুরু করেন। ২১ বছর বয়সে, ১৯১৫ সালে তিনি সেখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। এবং এবারো তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার যে মেধা, তাতে তিনি প্রথম হবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে যা শুনলে আপনারা কিছুটা হলেও বিস্মিত হবেন তা হলো তিনি পরীক্ষায় রেকর্ড স্কোর করেন যা এখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষত আছে!


ছোটবেলায় স্কুলে অংক পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘অংকে ১০০-র মধ্যে ১১০ পাবে তো?’ কথাটির মানে তেমন বুঝতাম না। এখনও বিজ্ঞাপনে বলতে দেখি, ‘ ১০০-র মধ্যে ১০০ পেয়েছি আর কি করে বেশী নম্বর পবো’? তবে সত্যিই এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কথাটি সত্যি প্রমাণ করেছিলেন। অথবা বলা যায় তাঁর জন্যই কথাটি প্রচলিত হয়েছে। আর তিনি-ই সত্যেন্দ্রনাথ বসু। হিন্দু স্কুলে এন্ট্রান্সের টেষ্ট পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ অঙ্কের সব প্রশ্নগুলির উত্তর তো করেছিলেনই, উপরন্ত জ্যামেতির প্রশ্নগুলি একাধিক উপায়ে সমাধান করে দেন। অংকের শিক্ষক শ্রী উপেন্দ্রনাথ বক্সী খুশি হয়ে তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন। শোনা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তাঁর প্রাপ্ত নম্বর আজ এতবছর পরেও টপকাতে পারেনি কেউ। এ হেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞানের সেবায় নিরলস কাজ করে গেছেন সারা জীবন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পথিকৃৎও।


এরই মাঝে তিনি দুটি কাজ করে ফেলেন। একটি হলো তিনি জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় মোটামুটি রকমের দক্ষতা অর্জন করেন। আর অন্যটি হলো, উষাবতী দেবীকে বিয়ে করেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগদানের পর সত্যেন্দ্রনাথ বসু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন। এছাড়া তিনি শ্রেণিকক্ষে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পড়াতেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আজ সারা দুনিয়া সমীহ করে কেবল মাত্র একটি অঙ্ক ভুল করার কারণেই। সত্যিই কিন্তু তিনি যদি অঙ্কটি ভুল না করতেন তবে হয়তো আজ পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কণার নাম ‘বোসন’ হতো না। ব্যাপারটি কিন্তু বড্ড অদ্ভুতুড়ে!


একদিন ক্লাসে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও অতিবেগুনি রশ্মি বিপর্যয় পড়ানোর সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বর্তমান তত্ত্বের দুর্বলতা বোঝাতে এই তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের পার্থক্য তুলে ধরেন। ঠিক ঐ সময় তত্ত্বটিকে অঙ্কের মাধ্যমে বোঝাতে গিয়েই তিনি ভুলটা করে ফেলেন। পরে দেখা যায় তার ঐ ভুলের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অনুমান মিলে যাচ্ছে! তিনি তখন মনে মনে ভাবলেন, সে ভুল নিশ্চয় কোনো ভুল নয়। শুরু হলো তার উপর নিজের মতো করে গবেষণা। প্রথম প্রথম কেউ তার কথা মানতে চাননি। (বসু পরে তার ঐদিনের লেকচারটি একটি ছোট নিবন্ধ আকারে ‘Planck’s Law and the Hypothesis of Light Quanta’ নামে প্রকাশ করেন।)


তিনি 'প্ল্যাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য হাইপোথিসিস অফ লাইট কোয়ান্টা' নামে এক গবেষণায় তাঁর ফলাফলগুলি প্রকাশ করেছিলেন। এটি 'দ্য ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন' নামের বিশিষ্ট বিজ্ঞান জার্নালে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর গবেষণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ওই জার্নাল। পরবর্তীতে সত্যেন্দ্রনাথ হতাশ চিত্তে গবেষণাপত্রটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন পুরো ব্যাপারটি বুঝে ফেলেন এবং সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। বসুর সেই ভুল অঙ্কটিই এখন 'বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব' নামে পরিচিত। ‘বোস পরিসংখ্যান’-কে মেনে চলা কণার শ্রেণি, ‘বোসন’ নামে পরিচিত হয়। বিজ্ঞানী পল ডির‍্যাক এই নামকরণ করেছিলেন।


মানুষ হিসেবে এই অঙ্কের যাদুকরটি ছিলেন একেবারেই যাকে বলে ‘বাঙালি’। আবার স্বভাবে ছিলেন একজন আত্মভোলা কবি। কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। প্রায়শই পরনের ফতুয়া ভুল করে গায়ে না জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়ে রাখতেন। জুতোর অবস্থাও ছিল এমন যে প্রায় সময়ই দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে সবখানে ঘুরে চলে আসতেন। মাথায় তো চিরুনী বোলানোর কথা তার সজ্ঞানেও আসতো না হয়তোবা। কিন্তু এই খেয়ালি  মানুষটি যখন অঙ্ক কষতে বসতেন তখন আর সময়জ্ঞান হিসেবে থাকতো না তার। আবার কখনও কখনও জটিল ধারার অঙ্ক থেকে ছুটি নিয়ে ডুবে যেতেন সাহিত্য এবং সঙ্গীতের জগতে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত এবং সাহিত্যেও ছিল তার আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ প্রীতি। প্রায়ই তাকে দেখা যেত সদ্য প্রকাশিত ফরাসি বইয়ের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে থাকতে।


বসু একজন ভালো সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন বটে। উচ্চমানের সঙ্গীত শোনার জন্য তিনি রাতের পর রাত জেগেই কাটিয়ে দিতেন। তিনি খুব ভালো এস্রাজ বাজাতেন। মন খারাপের সময়গুলো কাটাতেন এস্রাজের সুর-সাধনার জগতেই। যখন তিনি কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন থাকতেন তখনই বেজে উঠতো তার এস্রাজের সুর। ঢাকা থাকার সময় তার এই অভ্যাস নিয়মিতই ছিল। অনেক সময় তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সঙ্গীতের সুর নিয়ে গবেষণা করতেন। নতুন করে তিনি সুর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতেন। ছোটবেলা থেকেই গানবাজনার প্রতি এক অদ্ভুত টান ছিল সত্যেন্দ্রনাথের। বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। এসব গান-বাজনা মোটেও পছন্দ ছিল না তাঁর। তবে তিনি ছেলের শখ-আহ্লাদে বিশেষ হস্তক্ষেপ করতেন না। নিখাদ বাঙালি পরিবারের বড় ছেলে সত্যেন স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুদের, আড্ডা-আসরে জড়িয়ে ধরলেন গানকেও। পদার্থবিদ্যা আর গণিতচর্চার পাশাপাশি শিখলেন এসরাজ বাজানো, শিখলেন বেহালাও। ছাত্রাবস্থায় হেদুয়ার ধারে বন্ধুদের আড্ডার মূল আকর্ষণ ছিলেন হরিৎকৃষ্ণ দেব। কলেজের দিনগুলোয় সত্যেন আর হরিৎ ছিলেন যেন হরিহর আত্মা। যদিও দু-জনের কলেজ আলাদা, সত্যেন্দ্রনাথের প্রেসিডেন্সি, আর হরিৎকৃষ্ণের স্কটিশ চার্চ। অংকের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে গাঢ় হল বন্ধুত্ব, আর তাতে অনুঘটকের ভূমিকায় জুড়ে গেল গান। সন্ধের আড্ডায় সেসময় বন্ধু সত্যেনের অনুরোধে একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনাতেন হরিৎকৃষ্ণ। কম যেতেন না সত্যেন্দ্রনাথ নিজেও। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনতার সহিত এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে শেখার চেষ্টা করতেন ঠিক যেমন একই স্বভাব ছিল তাঁর গবেষণা কর্মের ক্ষেত্রে।


পরবর্তীকালে অধ্যাপনা, গবেষণা আর হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও গানের প্রতি অনুরাগ একটুও কমেনি সত্যেন্দ্রনাথের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করার সময় এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। ক্লাসের মাঝে সত্যেন্দ্রনাথ বসু একদিন হঠাৎ জানতে পারলেন তাঁর এক ছাত্র খুব ভালো সেতার বাজায়। ছাত্রটিকে ডেকে তিনি বললেন, ‘তোমার বাজনা শোনাও।’ উত্তরে ছাত্রটি বলল, ‘স্যার আমি তো যন্ত্রটা সঙ্গে আনিনি, না হয় পরে একদিন আপনার বাড়ি গিয়ে শুনিয়ে আসব।’ কিন্তু সেসব কথায় কর্ণপাত করার মানুষই নন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি ছাত্রটিকে প্রায় বগলদাবা করে নিজের ঘরে বসিয়ে রাখলেন। তারপর লোক দিয়ে তার বাড়ি থেকে নিয়ে এলেন সেতারটা, সেই সঙ্গে ডেকে আনলেন একজন ভালো তবলা বাদককেও। এরপর, দু’জনকেই বসিয়ে দিলেন নিজের টেবিলে। সেতার না শুনে তিনি এক পা-ও নড়বেন না। সুরের গুঁতো বোধহয় একেই বলে।


কিন্তু বিজ্ঞানসাধনায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে নিজেকে জীবনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেননি সত্যেন্দ্রনাথ। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন খাঁজকাটা হিরের মতো। নানা গুণের পাশাপাশি রসবোধও প্রবল ছিল তাঁর। বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এক অজানা সত্যেন্দ্রনাথ। কেমন ছিলেন সেই রসিক মানুষটা? ‘বোসন কণা’ আবিষ্কার হয়ে গেছে ততদিনে, পদার্থবিদ্যার তাবড় বিজ্ঞানীদের মুখে মুখে ফিরছে বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এরকম একটা সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত হয়ে ভারতে এলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডির‍্যাক। একটা গাড়ি ভাড়া করে কয়েকজন প্রিয় ছাত্রকে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ গেছেন দমদম বিমানবন্দরে, ডির‍্যাককে সসম্মানে নিয়ে আসার জন্য। ডির‍্যাকের সঙ্গে আছেন তাঁর স্ত্রী ম্যান্সি। ফেরার পথে সত্যেন্দ্রনাথ ছাত্রদের গাড়ির পিছনে বসার নির্দেশ দিয়ে ডির‍্যাক ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে উঠলেন গাড়ির সামনে। কিছুক্ষণ পরে কী মনে হওয়ায় খানিক অস্বস্তি নিয়েই ডির‍্যাক বলে উঠলেন, “মিস্টার বোস, আমার মনে হয় গাড়িটা আমাদের জন্য বড্ড ছোট হয়েছে। আপনার ছাত্ররা গাড়ির পিছনে ভালো করে বসতেও পারছে না।” উত্তরে সকৌতুকে সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমার ছাত্ররা সব বোসন তো, ওরা ওই অল্প জায়গাতেই দিব্যি নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে।’ প্রসঙ্গত বোসন কণা হল একাধিক কণা যাদের আলাদাভাবে চেনা অসম্ভব এবং যাদের মধ্যে কোন মিথস্ক্রিয়া (Interaction) নেই।


বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে কী যে ভালোবাসতেন সত্যেন্দ্রনাথ। সত্যিকারের বন্ধুঅন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাটিও ছিল বিশাল। নিজের বিয়েতে অদ্ভুত একটা দাবি পেশ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১৪ সালে যখন ঊষাবতী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়, সেই সময় তিনি ঊষাবতী দেবীর বাবা যোগীন্দ্রনাথ ঘোষকে বলেছিলেন, বিয়েতে তিনি কোনওভাবেই টাকা-পয়সা পণ হিসাবে নিতে পারবেন না। তবে তাঁর একশোজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন বরযাত্রী হিসাবে। বন্ধুদের খাতিরে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে।


বাগান করা ছিল তার কাছে শখের ঘরানা ব্যাপার। সময় ও সুযোগ পেলেই তার শখের বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সাহিত্যজগতে আনাগোনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয় ঘটে সাহিত্য জগত দিকপাল বুদ্ধদেব বসুর সাথে। আর তার সে পরিচয় কালের আবর্তে পৌঁছে গিয়েছিল কোলকাতার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ‘কবিতা ভবন’ দ্বারপ্রান্তে। সেখানে প্রায় সময় সত্যেন্দ্রনাথ যেতেন, আড্ডা দিতেন, সময় কাটাতেন। আড্ডার আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। কথিত আছে, তিনি বুদ্ধদেব বসুর ‘মেঘদূত’ এবং বদলেয়ার অনুবাদ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন।


ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও অনেক সময় তার মতামত নিতেন। তিনি গান গাওয়া, এস্রাজে সুর তুলে গণিতজ্ঞদের নিয়ে অনেক মজার রসিকতায় কবিতা ভবন মাতিয়ে তুলতেন। তাছাড়া গায়িকা রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে অনর্গল জার্মান আর ইতালীয় ভাষায় মজার অনেক গল্পও করতেন।


বাংলা সাহিত্যের উপর তার ছিল অগাধ পড়াশুনা। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ছিল তার সবিশেষ ঝোঁক। এ নিয়ে একটা গল্প বেশ প্রচলিত আছে। একবার সত্যেন্দ্রনাথের ঢাকার বাড়িতে অন্নদাশঙ্কর রায় গিয়েছিলেন। দেখেন কী, মশারির ভেতরে শুয়ে শুয়ে ‘প্রোফেসর’ বই পড়ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তার পড়া বইগুলোর কোনোটি কিন্তু বিজ্ঞানের বই নয়। আরেকদিন তাকে দেখেছিলেন প্রাকৃত ভাষায় লেখা ব্যাকরণ বই পড়তে। সত্যেন্দ্রনাথের লেখালেখিতে পাওয়া যেত এক পুরোদস্তুর সাহিত্যিকের ছোঁয়া। তার বিভিন্ন লেখা পড়লে তা সহজেই বোঝা যায়।


গোড়াতেই বলেছি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে অসম্ভব উদযোগী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। শুধু বিজ্ঞানচর্চাই নয়, বাংলা সাহিত্যের উপরেও অগাধ পড়াশুনা ছিল তাঁর। জ্ঞানার্জনের ঝোঁক তো ছিলই, তার সঙ্গে জুড়েছিল সাহিত্যানুরাগও। এ নিয়ে একটা গল্প বেশ প্রচলিত আছে। একবার অন্নদাশঙ্কর রায় গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ঢাকার বাড়িতে। গিয়ে দেখেন মশারির ভেতরে শুয়ে শুয়ে ‘প্রোফেসর’ বই পড়ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাঁর পড়া বইগুলোর কোনোটিই কিন্তু বিজ্ঞানের বই নয়। আরেকদিন তাঁকে দেখেছিলেন খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছেন সত্যেন্দ্রনাথ। অমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে বই মুখে ঘুরতে দেখে আপাতভাবে মনে হতেই পারে সায়েন্সের কোনও থিওরি নোট পড়ছেন বিজ্ঞানী। কিন্তু মজার কথা, সেই বইটা ছিল প্রাকৃত ভাষায় লেখা একটা ব্যাকরণের বই। পড়াশোনার ব্যাপারে কোনওদিনই বাছবিচার করতেন না বসু। নানারকম বই পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালিখিও করতেন। তাঁর লেখালেখিতে যে একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিকের ছোঁয়া পাওয়া যায়, তার অনেকটাই এই পাঠাভ্যাসের ফল।


প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়কার ঘটনা। সে সময় তিনি একটি রোমান্টিক গল্প এবং একটি প্রবন্ধ লিখে ভীষণ বাহবা পেয়েছিলেন। তার আরেকটি খেয়াল ছিল টেনশান কাটাতে ইনডোর খেলা। আই. এস. সি.- তে থাকাকালীন তিনি নতুন নতুন ক্যারম খেলা শিখেছিলেন। পরে সে খেলায় দিনরাত এক করে খেলতে শুরু করেন, তাতে অবশ্য মায়ের বকুনি কোনো অংশেই কম শুনতেন না, অথচ ক্যারমের নেশা যেন তাকে ছাড়েই না! এত বুঁদ হয়ে খেলার পরেও কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো হেরফের হতো না। বরঞ্চ প্রথম শ্রেণীতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। বসুর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদাম কুরি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিজের ‘বিশ্বপরিচয়’ বিজ্ঞানগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘জাপানে’ ভ্রমণরচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তার আবিষ্কৃত তত্ত্বের উপরে কাজ করে অনেকেই নোবেল পেলেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কিন্তু 'নোবেল' দেওয়ার কথা কেউ তোলেননি।


একেবারে আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। প্রায়শই পরনের ফতুয়া ভুল করে গায়ে না জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়ে রাখতেন। জুতোর ব্যাপারেও অন্যমনস্ক ছিলেন, প্রায় সময়ই দু’পায়ে দু’রকম জুতো গলিয়ে সব জায়গায় ঘুরে চলে আসতেন। অথচ এই খেয়ালি মানুষটি যখন অঙ্ক কষতে বসতেন তখন আর সময়জ্ঞানের হিসেবে থাকত না তাঁর। এই অংক কষা নিয়েও একটা মজার ঘটনা রয়েছে। তখনও দেশভাগ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন সত্যেন্দ্রনাথ। একদিন বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার বায়না ধরল বসুর মেয়ে। বসু তখন গণিতের একটা জটিল সমস্যা সমাধানে চিন্তামগ্ন। মেয়ের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন বাবা। মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন সিনেমা হলে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ বাসায় ফেলে এসেছেন। চিন্তিত মুখে মেয়েকে সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষা করতে বলে একই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বাসায় ফিরে এলেন। টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল কিছুক্ষণ আগে শেষ করতে না পারা বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির ওপর। খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে নিমেষেই বিস্মৃত হলেন সিনেমা দেখার কথা। মেয়েকে যে সিনেমা হলের সামনে একা ফেলে এসেছেন সেকথাও বেমালুম ভুলে গেলেন। অঙ্কের খাতাতেই আবার ডুব দিলেন আত্মহারা হয়ে।


এদিকে গাড়োয়ান বেচারা তো পড়েছে মহা বিপদে। সত্যেন্দ্রনাথ সেই যে ঘরে ঢুকেছেন, বেরোনোর নাম নেই। মানিব্যাগ খুঁজতে একজন মানুষের কত সময় লাগে রে বাবা! এত বড় বিজ্ঞানীর বাড়িতে হাঁকডাক করারও জো নেই। কাউকে যে সে বলবে তাকে গাড়িভাড়া দিয়ে বিদায় করতে, তেমন কোনও মানুষের দেখাও মিলছে না। এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পরে সাহস সঞ্চয় করে গাড়োয়ান নিজেই সটান ঢুকে পড়ে বসুর ঘরে। সত্যেন বসু তখনও চেয়ারে বসে অংক কষে চলেছেন। গাড়োয়ানের হাঁকডাকে ভারী বিরক্ত হয়ে তাকেই বকা লাগাতে যান আর কি! শেষমেশ অবশ্য সম্বিৎ ফেরে বিজ্ঞানীর। সিনেমায় যাওয়ার কথা আর মেয়েকে পথে একা দাঁড় করিয়ে রাখার কথা মনে পড়তেই উঠে বসেন তাড়াতাড়ি। তারপর সেদিন অপেক্ষারত মেয়ের কাছে ভুলোমনা বাবা কতখানি বকা খেয়েছিল সেটা অবশ্য জানা যায়নি।


শিক্ষকজীবনে খুবই ছাত্রদরদী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। যেকোনও প্রয়োজনে প্রায় বন্ধুর মতো ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়াতেন তিনি। ছাত্র আর অতিথিদের জন্য সবসময় খোলা থাকত তাঁর ঘরের দরজা। মজার ছলেই একবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারীকে তিনি বলেছিলেন “আমার ঘর তো শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়, যখন খুশি চলে আসা যায়।” শুধু ঘরে নয়, বিশ্ববন্দিত এই বিজ্ঞানীর হৃদয়েও অবাধ জায়গা ছিল প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের।


এ প্রসঙ্গে একটা গল্পের কথা না বললেই নয়। ১৯২১ থেকে ১৯৪৫, প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। পদার্থবিদ্যার ক্লাসঘর থেকে কলেজ সোশ্যাল অনুষ্ঠান সবেতেই অধ্যাপক সত্যেন বসুর সঙ্গে হৃদতা গড়ে ওঠে ভানুর। ঢাকায় একবার সরস্বতী পুজোতে পঙ্গু ভিখারিকে খেতে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে এক গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন ভানু বন্দোপাধ্যায়। ছাত্র ভানুর বিপদে সেসময় তাঁর পাশে অভিভাবকের মতো এসে দাঁড়িয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ স্বয়ং। ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্কে টান পড়েনি কখনও। অভিনয়-জীবনে খ্যাতির মধ্যগগনে তখন ভানু। ঢাকার পাট চুকিয়ে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে ফিরেছেন সত্যেন্দ্রনাথও। এসময় স্যারের কলকাতার বাড়িতে প্রায়ই ডাক পড়ত ভানু বন্দোপাধ্যায়ের। বসু মাঝেমধ্যেই মজার ছলে ছাত্রকে ডেকে বলতেন, ‘মাথাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, একটু রস ঢেলে দিয়ে যা তো বাবা’


বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু আলোচনা হলেও শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে তেমন তথ্য মেলে না। যা মেলে তা হল, ছাত্রদের টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণ, বা কিছু ঐতিহাসিক দলিলের ভিত্তিতে অনুমান। যেমন, তাঁর ছাত্র জ্যোতির্ময় ঘোষের কথায়, কোনও নোটস ছাড়াই সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে সদ্য প্রকাশিত যে কোনও গবেষণাপত্রের ব্যাখ্যা সমীকরণ-সহ বিদ্যুৎগতিতে বোর্ডে লিখে ফেলতেন তিনি।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর 'জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি' পড়ানোর খ্যাতি শুনেই ১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়োগ করেন প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপস হার্টগ। 'এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্স' থেকে প্রকাশিত 'এস এন বোস, দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ় ওয়ার্কস'-এ উল্লেখ রয়েছে, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সায়েন্স কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়ানোর দায়িত্ব দেন। জার্মান বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ ও সাম্প্রতিকতম গবেষণার কথা ছাত্রদের জানাতে সত্যেন্দ্রনাথ নিজে জার্মান শিখতে শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের অনুমতিও আনিয়েছিলেন জার্মানি থেকে। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার এই আগ্রহ, শিক্ষকের এমন কর্তব্যপরায়ণতা আজ বিরল।

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু শুধুমাত্র বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, সারা জীবন ধরে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ডও হাতে নেন। এইসময় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের লক্ষ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, "যারা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।”

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন অত্যন্ত সহজ সাধারণ একজন মানুষ। তিনি তার আবিষ্কারগুলো নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। পুরস্কারের জন্য তার কখনোই আক্ষেপ ছিল না। উইলার্ড গিবস, ফ্রেড হোয়েলের মতো বিজ্ঞানীদের পাশে নাম লেখান বসু, যাঁরা বিজ্ঞানের জন্য অসাধারণ সব কাজ করেও নোবেল পুরস্কার জেতেননি। ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আশি বছর বয়সে ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়ায় ভুগে এই মহান পদার্থবিদ মৃত্যুবরণ করেন। তাকে স্মরণ করে আজও গর্বিত এবং বিজ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত হয় বাংলার লক্ষ-কোটি ছাত্র।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু' ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি', 'ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স', 'ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস' এবং 'ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট'-সহ বহু নামজাদা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলে'র উপদেষ্টা ছিলেন। পরে 'রয়্যাল সোসাইটি'র 'ফেলো' নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আজ বছরের প্রথম দিন। সেই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যেন ভুলে না যাই আজ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিন। ১৮৯৪ সালে এই দিনেই জন্মেছিলেন প্রতিভাবান পদার্থবিদ, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের উদ্ভাবক, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য ও প্রণতি।


No comments