Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জগদীশ চন্দ্র বসু - ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চ্চার জনক

জগদীশ চন্দ্র বসু - ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চ্চার জনক।
বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিদ্যায় অসামান্য অবদান রেখে নিজের নাম শুধু ব…

 




জগদীশ চন্দ্র বসু - ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চ্চার জনক।


বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিদ্যায় অসামান্য অবদান রেখে নিজের নাম শুধু বাঙালির ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও স্বর্ণাক্ষরে লিখে গিয়েছেন।


বিজ্ঞানের একজন অমর প্রতিভা জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির ওপর সফল গবেষণা করেন যার ফলশ্রুতিতে আবিষ্কৃত হয় রেডিও।


তাঁর উল্লেখযেযাগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ও ট্রান্সমিটারের উন্নয়ন, এবং ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র যা দিয়ে গাছের বৃদ্ধি নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায়। উদ্ভিদের জীবনচক্র তিনি প্রমাণ করেছিলেন।


গাছের প্রাণ আছে, একথা সারা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। আমাদের গ্রহের একমাত্র উপগ্রহ কোনটি? চাঁদ তো? সেই চাঁদের গায়ে একটি গর্তের নাম রাখা হয়েছে জগদীশ বোসের নামে। তাঁর স্মরণে সেই গর্তের নাম রাখা হয়েছে 'বোস'। একথা কি এতদিন জানতেন?


জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর শহরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল ঢাকা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে। তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু মাতা বামা সুন্দরী দেবী। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজের একজন বিশিষ্ট সদস্য। চাকরি করতেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের এবং একইসাথে ছিলেন ফরিদপুর, বর্ধমানসহ কয়েকটি এলাকার সহকারী কমিশনার। পিতার চাকরির সুবাদে জগদীশ চন্দ্র বসু ছেলেবেলার বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেন ফরিদপুরে।


পড়াশুনার হাতেখড়িও হয় ফরিদপুরের এক জেলা স্কুলে। স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সময় জগদীশ চন্দ্র বসু ছুটে আসতেন গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর শ্রীনগরের রাঢ়িখালে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্ব পদ্মার ঢেউ তার মনকে স্পর্শ করত। সময় সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন পদ্মার তীরে। জলরাশির ঢেউ, নদীর বিশালতা তার উপরে ভেসে থাকা নৌকা, জাহাজ তার সহজ সরল মনে প্রশ্ন তারিয়ে বেড়াত সবসময়।


এরপর ১১ বছর বয়সে তিনি কোলকাতা চলে যান। ১৮৬৯ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। ১৬ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন হন সর্বোচ্চ মেধা তালিকায় বৃত্তি নিয়ে। ১৮৭৭ সালে এফ.এ. পাশ করেন। সেখানে তখন বিজ্ঞান নিয়ে ভারতবাসীকে জাগানোর চেষ্টা করছেন ফাদার ইউজিন ল্যাকো। বিজ্ঞানেই মুক্তি, এই ছিল তাঁর যুক্তি। জগদীশ হয়ে উঠলেন তাঁর ভক্ত।


পিতা ভগবান চন্দ্র বসুর ইচ্ছে ছিল ছেলেকে চিকিত্‍সক বানাবেন। কিন্তু বাদ সাধলেন তাঁর মা। কারণ, তার কিছুদিন আগে মাত্র ১০ বছর বয়সে জগদীশের ছোট ভাই মারা যায়। মায়ের মন অবশিষ্ট সন্তান সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লন্ডন যাক, এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। অন্যদিকে, ভগবান চন্দ্র বসু অসুস্থ হয়ে পড়ায় বলতে গেলে ঘরবসা। আধা মাইনেতে সংসার চলে। যেসব উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন গ্রামের মানুষদের জন্য তার বেশির ভাগই ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অনেক ঋণে জর্জরিত। মন খারাপ করে জগদীশ দেশেই থাকবেন বলে যখন সিদ্ধান্ত নেন তখন আবার মায়ের মন পরিবর্তন হয়। বনসুন্দরী দেবী নিজের গয়না বিক্রি করে ও তাঁর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে, স্বপ্ন পূরন করার লক্ষে ১৮৮০ সালে ডাক্তারি পড়ার জন্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে বিদেশে পাঠান।  ছেলেকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জগদীশ আক্রান্ত হলেন জ্বরে, শরীর হয়ে গেল দুর্বল। বোঝা গেল ডাক্তারি পড়াটা কঠিন হয়ে যাবে।


বিজ্ঞানের স্নাতক হন তিনি ১৮৭৯ সালে। ১৮৮১ সালে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই সময় জগদীশের স্ত্রীর ভাই বাংলার প্রথম রাংলার, আনন্দ মোহন বসু জগদীশকে কেমব্রিজে ভর্তি হতে সহায়তা করেন। আনন্দ মোহন বসু ১৮৭৪ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে গণিতে ট্রাইপস পান। কেমব্রিজে আর লন্ডনে জগদীশের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন লর্ড রেইলি, মাইকেল ফস্টার, সিডনি ভাইন, ফ্রান্সিস ডারউইনের মতো বিজ্ঞানীরা। ১৮৮৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞানে বি.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. ডিগ্রি অর্জন করে জগদীশ চন্দ্র বসু ভারত ফিরে আসেন।


জগদীশচন্দ্র যখন কেমব্রিজের ছাত্র, ঠিক সেই সময়ে বাংলার আরেক তরুণ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এডিনবার্গের ছাত্র। তিনি সেখানে তখন রসায়নবিদ্যার পাঠ নিচ্ছেন। লন্ডনে থাকাকালীন তাদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়।


কেম্ব্রিজ কলেজের অধ্যাপক লর্ড র‌্যালে ছাত্র জগদীশের ভিতর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সন্ধান পান। তার অনুপ্রেরনায় প্রকৃত বিজ্ঞানে অনুপ্রানিত হন। ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভৌত বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু নিযুক্ত হন। ১৮৮৭ সালে ২৭শে ফেব্রয়ারি জগদীশ চন্দ্র বসু অবলা বসুকে বিয়ে করেন। অবলা বসু ছিলেন সে সময়ের হিন্দু সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দূর্গা মোহন দাসের কন্যা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাইঝি।


‘ভারতীয়রা পড়াতে পারে না’ - এই অজুহাতে কলেজের সেই সময়কার অধ্যক্ষ চার্লস টাউনি এবং বাংলার পাবলিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফট প্রবল বিরোধিতা করলে জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিপনের শরণাপন্ন হন। শেষমেশ, ভাইসরয়ের হস্তক্ষেপে তিনি শিক্ষক হলেও চার্লস টাউনি এবং স্যার আলফ্রেড ক্রফট তাঁকে ‘অস্থায়ীভাবে’ নিয়োগ দেন। এমনকি তাঁর বেতন নির্ধারণ করা হয় একই পদে আসীন ব্রিটিশ অধ্যাপকদের অর্ধেক। এমনকি তাঁকে গবেষণাগারে একটা কাজ করারও সুযোগ দেওয়া হতো না। সাহসী জগদীশ অর্ধেক বেতনের নিয়োগপত্র অগ্রাহ্য করে কলেজে যোগ দেন এবং একনাগাড়ে তিন বছর বেতন নিতে অস্বীকার করেন। এই সময়কালে নিজের মেধা ও পাণ্ডিত্য দিয়ে তিনি প্রায় সবার মন জয় করেন। অন্যদিকে নিজের বাড়িতেও একটি গবেষণাগার গড়ে তোলেন। তিন বছর পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সসম্মানে, পূর্ণবেতনে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। আর এই নিয়োগ দেওয়া হয় ভূতাপেক্ষা, অর্থাৎ তিন বছর আগে থেকে। তাঁর তিন বছরের বকেয়া বেতনও পরিশোধ করা হয়। সেই টাকা দিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর বাবার ঋণ শোধ করেন। 


প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন সেভাবে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই। একদিন তিনি স্থানীয় একজন ঝালাই মিস্ত্রিকে ডেকে নিয়ে এলেন কলেজে আর তাকে দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্র তৈরি করিয়ে গড়ে তুললেন নিজের খরচে গবেষণাগার। আর ক্লাস শেষে সেখানেই নিভৃতে ‘বিজ্ঞানচর্চা’ করতে শুরু করলেন। জগদীশ একমনে নিজের মত করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিন হঠাৎ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশের সহকর্মী হিসেবে হাজির হলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের পর 'দ্বিতীয় ভারতীয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক' হিসেবে যোগ দিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।


সেই সময়ে জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণার আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ, যা 'মাইক্রোওয়েভ' নামে পরিচিত। সে সময় তিনি ‘কোহেরার’ নামে একটি ধারণাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে দেখেন সেটিকে মাইক্রোতরঙ্গের গ্রাহক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।


প্রফুল্লচন্দ্র জগদীশচন্দ্রের কাজে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন। একদিন জগদীশচন্দ্র কলেজের ল্যাবরেটরিতে তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে ডেকে একটি আবিষ্কার দেখালেন। অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্রের ঘরে রাখা হল একটি ‘প্রেরক যন্ত্র’। আর ‘আলেকজান্ডার পেডলার’ নামে কলেজের আর একজন অধ্যাপকের ঘরে রাখা হল ‘গ্রাহক যন্ত্র’। দুটি ঘরের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৭০ ফুট আর তার মাঝখানে মোটা দেওয়াল বিদ্যমান। 'প্রেরক যন্ত্র’ থেকে অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ গিয়ে  অন্য ঘরের 'গ্রাহক যন্ত্রে'র মাধ্যমে একটি পিস্তলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। আর তা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।প্রফুল্লচন্দ্র জড়িয়ে ধরলেন জগদীশকে।


বৈদ্যুতিক তরঙ্গের ওপর তাঁর গবেষণার কাজ তিনি শুরু করেন ১৮৯৪ সালে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৯৬ সালে লণ্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে 'ডক্টর অফ সায়েন্স' উপাধি পান।


১৮৯৪ সালে তিনি কলকাতায় প্রথম বিনা তারে বার্তা প্রেরণ এবং তা গ্রহণ করার একটি কৌশল দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বড়লাটের হস্তক্ষেপে তাঁর এই আবিষ্কার ইংল্যান্ডে দেখানোর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সহায়তা করলে তিনি লন্ডনে গিয়ে সেটি প্রদর্শন করেন। ১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই লন্ডনে রয়্যাল সায়েন্স সোসাইটিতে তিনি তাঁর আবিষ্কার সব বিজ্ঞানীর সামনে তুলে ধরেন। এমনকি তিনি তাঁর পরীক্ষার খুঁটিনাটি এত বিশদভাবে তুলে ধরেন যে তা থেকে যে কেউ পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন।


মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলকাতার সেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের ঘটনাটিই প্রথম। পরে লন্ডনেও তিনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর উদ্ভাবনের কোনো ‘পেটেন্ট’ বা ‘স্বত্ব’ করেননি। কারণ, কর্ণ ছিল তাঁর আদর্শ। তাঁর সব কাজকর্ম হবে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। বলা যায়, জগদীশ চন্দ্র বসু হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মুক্ত দর্শনের অধিকারী বিজ্ঞানী।


উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করতে পারে সেই কথা জগদীশ চন্দ্র বসুই প্রমাণ করে দেখালেন। আর এই প্রমাণের জন্য নিজেই তৈরি করলেন 'ক্রিস্কোগ্রাফ' নামক একটি যন্ত্র। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বক্তৃতা দিয়ে সস্ত্রীক জগদীশ দেশে ফিরলেন, স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় ফেরার ঠিক দু’মাস পরে। আশ্চর্যের বিষয়  বসু দম্পতিকে অভ্যর্থনা জানাতে কয়েকজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউ রেল ষ্টেশনে উপস্থিত ছিল না। তবে হ্যাঁ পরিবারের লোকজনবাদে একজন এসেছিলেন, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ষ্টেশনেই মহেন্দ্রলাল জড়িয়ে ধরলেন জগদীশকে। তাঁর দুচোখে জল। এগিয়ে গিয়ে অবলাকে বললেন, "তুই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলি বলে তোকে আমি একদিন বকুনি দিয়েছিলুম, মনে আছে?’’ অবলা’ বললেন, "হ্যাঁ মনে আছে।" মহেন্দ্রলাল বলেলেন, "তুই ঠিক করেছিলি সেদিন মা, ডাক্তারনী হলে কি আর এমন স্বামী পেতিস! তুই ওকে থামতে দিস না। এই তো সবে শুরু, জগদীশ আমাদের নিউটন, গ্যালিলিও হবে।" 


জগদীশ চন্দ্র বসুকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চ্চার জনক। বাংলাদেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা মনে করেন বেতার যন্ত্রের প্রথম উদ্ভাবক হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যদিও বেতারের আবিষ্কারক হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন মার্কনি, কারণ জগদীশ বসু এটার আবিষ্কারকে নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। এ কারণেই এই আবিষ্কারের জন্য তাঁর দাবি স্বীকৃত হয়নি।


বেতার কাজ করে বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গের ভিত্তিতে, যে তরঙ্গ নিয়ে জগদীশ বসু গবেষণা করেছিলেন। যদিও তাঁর আগে এবং তাঁর সময়ে এই তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার কাজ করছিলেন মার্কনি সহ বিভিন্ন দেশে একাধিক বিজ্ঞানী। কিন্তু কলকাতার বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গবেষক ড. দিবাকর সেনের মতে, জগদীশ বসুই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ।


"মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কারের ব্যাপারটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আজকের দিনে মহাকাশ বিজ্ঞানে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, টেলিভিশন সম্প্রচারে এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে মাইক্রোওয়েভ কাজে লাগে। কম্যুনিকেশনের (যোগাযোগ) ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে এই তরঙ্গ কাজে লাগে।"


"দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যখন সাবমেরিন এলো, রাডার এলো, তখন মানুষ বুঝতে পারল এই মাইক্রোওয়েভের গুরুত্ব কতখানি। তিনি যখন এই আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তার কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল না। মার্কনি এবং তদানীন্তন বিজ্ঞানীরা যোগাযোগের জন্য যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ব্যবহার করেছিলেন তা তারা করেছিলেন লঙ্গার ওয়েভ (দীর্ঘ তরঙ্গ) ব্যবহার করে - মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে নয়।"


অর্থাৎ জগদীশ বসুর আবিষ্কার ছিল অতি ক্ষুদ্র বেতার তরঙ্গ, যার থেকে তৈরি হয়েছে আজকের মাইক্রোওয়েভ, যা পরবর্তীতে 'সলিড স্টেট ফিজিক্স'-এর বিকাশে সাহায্য করেছিল। পরে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের আরও গুরুত্বপূর্ণ নানা আবিষ্কার করেন যেমন 'ডিটেক্টর', 'রিসিভার' ইত্যাদি।


"চৌকো মুখ ফানেল আকৃতির একটি হর্ন অ্যান্টেনা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আজ বিশ্বে যুদ্ধকালীন যোগাযোগ, বা রাডার যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও অনেক ধরনের রিসিভার উনি তৈরি করেছিলেন যা আজও বহুল ব্যবহৃত," বলেছেন ড. দিবাকর সেন।


আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার নিয়ে ইংল্যাণ্ডে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ব-খ্যাত বহু বিজ্ঞানীকে চমকে দিয়েছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। লণ্ডনের একটি দৈনিক পত্রিকা 'ডেইলি এক্সপ্রেস' তাঁকে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি দিয়েছিল।


লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এর অন্যতম কারণ হলো, তিনি তখন ‘ধাতব বস্তুর’ প্রাণ আছে কি না তা ভাবতে থাকেন। তবে তাঁর এই ভাবনাটা ক্রমেই উদ্ভিদের দিকেই চলে যায়।


ফলে মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জগদীশের সাফল্য অনেকে ভুলে যান। অন্যদিকে উদ্ভিদের জীবনের বহিঃপ্রকাশের কারণে তিনি সেই দিকে বেশি কার্যকরী হন।


বর্তমানে, বিশ্বের তাবত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে জগদীশ চন্দ্র বসু কাজ করেছেন মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে এবং রেডিও যন্ত্রের উদ্ভাবক মার্কনি কাজ করেছেন বেতারতরঙ্গ নিয়ে।


অনেকেরই ধারণা, জগদীশ চন্দ্র যদি মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে তাঁর কোহেরারকে আরও এগিয়ে নিতেন, তাহলে ১৯০১ সালের প্রথম নোবেল পুরস্কারটি একজন বাঙালি পেলেও পেতে পারতেন। যে কলেজ তাঁকে নিয়োগ দিতে চায়নি, সে কলেজই তাঁকে অবসরের পরও অতিরিক্ত দুই বছর জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে বেতন দিয়েছে। ১৯১৫ সালে অবসরের পর তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৩ সালে তাঁকে 'কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার' উপাধি দেয়। ১৯২৮ সালে তিনি 'রয়্যাল সোসাইটি'র ফেলো নির্বাচিত হন।


কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানে এমন অসাধারণ অবদান সত্ত্বেও জগদীশ চন্দ্র বসু সারা বিশ্বে খ্যাতিলাভ করেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে।


ড. দিবাকর সেন বলেন, জগদীশ বসু আদৌ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু ওয়্যারলেস রিসিভিং ইন্সট্রুমেন্ট (তার-বিহীন গ্রাহক যন্ত্র) নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলেন।


"তিনি দেখলেন একটা টিনের তারকে মোচড় দিলে তার ভেতরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রায় যেমন বিদ্যুত তরঙ্গ তৈরি হয়, তেমনই আঘাত করলে গাছের ভেতরেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, একই ঘটনা ঘটে প্রাণী দেহেও। উনি তখন প্রশ্ন তুললেন তাহলে জীবনের সংজ্ঞা কী হবে? এবং এখান থেকেই জন্ম নিল আধুনিক জৈব-পদার্থ বিজ্ঞান।"


জনপ্রিয় ধারণা হল তিনি সবার আগে আবিষ্কার করেছিলেন গাছপালার প্রাণ আছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা বলেছেন অতি প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের মানুষ বিশ্বাস করতো গাছ একটা জীবন্ত স্বত্ত্বা। একই বিশ্বাস ছিল অ্যারিস্টটলেরও। তাহলে জগদীশ বসুর আবিষ্কারে নতুনত্ব কোথায় ছিল?


"গাছের যে প্রাণ আছে তার কিছু স্থূল লক্ষ্মণ সম্পর্কে মানুষ জানত, যেমন গাছ জন্ম নেয়, বড় হয়, একদিন মরেও যায়। কিন্তু বাইরের কোন উদ্দীপক বস্তু ব্যবহার করলে বা গাছকে আঘাত করলে গাছ কীভাবে সাড়া দেয়, সেটা জগদীশ বসু যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করে দেখান, যা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার," বলেন ড. শর্মা।


মে ১০, ১৯০১। লন্ডনের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। দীর্ঘদিন এখানে এত লোকের ভিড়ে কোনো বিজ্ঞানী বক্তব্য দেননি। এই বিজ্ঞানী আবার এসেছেন সাত সাগরের ওপার অর্থাৎ ভারত থেকে। দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন লর্ড রেইলির মতো বিজ্ঞানকুল শিরোমণি। দর্শকেরা অবশ্য খুব বেশি চমৎকৃত হলেন না পরীক্ষার বন্দোবস্ত দেখে। একটি গাছের মূল একটি বোতলের জলের মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা, গাছ থেকে কী সব তারটার টেনে এটা কিম্ভূতদর্শন যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো।


দর্শকদের জ্ঞাতার্থে বিজ্ঞানী জানালেন, বোতলের ভেতরের তরল পদার্থটি জল নয়, এটি ব্রোমাইড সলিউশন। উপস্থিত বিজ্ঞানের লোকেরা বুঝলেন অচিরেই গাছটি মরবে। কারণ, হাইড্রোব্রোমিক অ্যাসিডের এই লবণের দ্রবণ সহ্য করার ক্ষমতা গাছের নেই। তাতে অবশ্য তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের লক্ষ্য কিম্ভূত যন্ত্রটি।


বিজ্ঞানী গাছের মূলকে সলিউশনে দিয়ে দিলেন আর চালু করে দিলেন তাঁর যন্ত্র। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি কাগজের ওপর মানুষের হৃদযন্ত্রের ওঠা-নামার মতো গ্রাফ আঁকতে শুরু করল। তবে সেটিতে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। পেন্ডুলামের মতো একই নিয়মের ওঠা-নামা। কিন্তু একটু পরই যন্ত্রের গ্রাফে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিল। গ্রাফ বেশ দ্রুত ওঠা-নামা শুরু করল। মনে হচ্ছে কার সঙ্গে যেন লড়ছে গাছটি। তবে একসময় সব চাঞ্চল্য থেমে গেল।


উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দেখলেন, গাছটি মরে গেছে!


উপস্থিত বিজ্ঞানী ও দর্শকেরা সবাই চমৎকৃত হলেন ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানীর এই যন্ত্রে। লর্ড রেইলি উঠে গিয়ে দর্শক সারিতে বসা বিজ্ঞানীর স্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এলেন।


উদ্ভিদেরও প্রাণীদের মতো প্রাণ আছে, এই ধারণা কিন্তু নতুন নয়। কারণ, সবাই দেখেছে বীজ থেকে চারা হয়, সেটি মহিরুহ হয় এবং একসময় মরে যায়। কিন্তু উদ্দীপনায় উদ্ভিদও প্রাণীর মতো প্রতিক্রিয়া করে, জোর করে মেরে ফেলা হলে আর্তচিৎকার করে - এমনটা কেউ এর আগে ভাবেননি। ভেবেছেন ওই বাঙালি বিজ্ঞানী।


গাছ যে বাইরের আঘাতে বা তাকে উত্তেজিত করলে তাতে সাড়া দেয় সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার জন্য জগদীশ বসু সূক্ষ্ম সব যন্ত্র্র সাধারণ কারিগর দিয়ে তৈরি করেছিলেন যেগুলি কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সংরক্ষিত রয়েছে।


এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন তিনি যা দিয়ে দেখিয়েছিলেন একটা গাছ এক সেকেণ্ডে কতটা বাড়ে। তাঁর আবিষ্কৃত 'ক্রেসকোগ্রাফ' যন্ত্র উদ্ভিদদেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখত।


তাঁর গবেষণা জড় ও জীব জগত সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছিল।


"তিনি বলেছিলেন জড় এবং জীব জগতের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য। এতই সামান্য যেখানে জড় পদার্থ জীবের মত আবার জীব জড় পদার্থের মত ব্যবহার করে," বলেছেন ড. দ্বিজেন শর্মা।


জগদীশ বসু ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত জীব ও জড় বস্তুর প্রতিক্রিয়ার ওপর গবেষণার কাজ করেছিলেন।


জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতে বিজ্ঞান চর্চ্চা ও গবেষণার প্রসার ঘটাতে কলকাতায় ১৯১৭ সালে যে 'বসু বিজ্ঞান মন্দির' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি সম্ভবত ভারতের অন্যতম সবচেয়ে প্রাচীন বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এটিকে তিনি একটি ‘মন্দির’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই কেন্দ্র ভারতের বহু নামকরা বিজ্ঞানীকে গবেষণার কাজে অনুপ্রাণিত করেছিল যেমন সি. ভি. রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ।


ড. দ্বিজেন শর্মা বলেন, জগদীশ চন্দ্র বসু সবার আগে বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় লিখেছিলেন, যা এখনও বাংলা ভাষায় লেখা আদর্শ বিজ্ঞান বিষয়ক বই হিসাবে বিবেচিত। তাঁর 'অব্যক্ত' গ্রন্থের লেখাগুলো "বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের একটি অপূর্ব সংশ্লেষ। আমার ধারণায় বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় গ্রন্থ তাঁর এই বই।"


আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ চন্দ্র বসুর বন্ধুত্ব ছিল আমৃত্যু। একজনের হাতে বিকশিত হয়েছে বাংলায় সাহিত্য আর একজন করেছেন বাংলায় বিজ্ঞান রেনেসাঁর সূচনা।


স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একটি চমৎকার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, সে-ই প্রকৃত বিজ্ঞানী যে তার ল্যাবরেটরির সঙ্গে ঝগড়া করে না। অর্থাৎ, প্রকৃতিবিজ্ঞানী সব সময় নিজের ল্যাবরেটরি তৈরি করে নেন, অন্যকে দোষারোপ করেন না।


বিজ্ঞানও যে একটা সংস্কৃতি সেটা প্রমাণ করে গেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, বলেছেন ড. দ্বিজেন শর্মা, "তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সেই অর্থে একটা বিরাট মূল্যবান সাংস্কৃতিক অবদান।"


জগদীশ চন্দ্র বসু প্রয়াত হন কলকাতায়, ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর।


অন্ধকার কুসংস্কারে আবৃত পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ধারায় এক অতুলনীয় আলোকবর্তিকা জ্বেলে গেছেন আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম মহামানব স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তার আবিস্কৃত ডায়োড, ট্রায়োড, ট্রানজিষ্টর থেকে যে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ কম্পিউটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আজ থেকে প্রায় সোয়া-শো বছর আগে একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু মানবসভ্যতাকে একটি বড় ঝাঁকুনি দিয়েছেন। সেই মাত্রায় না হলেও যদি আমরা তাঁর মতো বিজ্ঞানকে ভালোবেসে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলেই কেবল এই বিজ্ঞানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারব।

No comments