"কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ"এই সমস্যা নিয়ে রচিত হল "বিসর্জন"
রবীন্দ্রনাথের একটি বিস্ময়কর ভাবনা, যা আজও মানুষের সভ্যতাকে ভাবায়...এই নাটকের অন্যতম চরিত্র জয়সিংহ যখন বুঝতে পারল," শুধু ধরা দেও তুমি মানবের মাঝ…
"কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ"এই সমস্যা নিয়ে রচিত হল "বিসর্জন"
রবীন্দ্রনাথের একটি বিস্ময়কর ভাবনা, যা আজও মানুষের সভ্যতাকে ভাবায়...
এই নাটকের অন্যতম চরিত্র জয়সিংহ যখন বুঝতে পারল,
" শুধু ধরা দেও তুমি মানবের মাঝে
মন্দিরের মাঝে নও "
কিন্তু তা মানুষ বুঝবে কী করে?
তখন রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন,
" তোমার হৃদয়ব্যথা আমার হৃদয়ে
এসে পেয়েছে চিরজীবন। "
এই ভাবনার ওপর ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটক লিখব বলে লেখা শুরু করেননি! ১৮৮৭ সালে একটি উপন্যাস রচনা করেন, রাজর্ষি। এটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। এটি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাবে লিখিত।প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের দ্বন্দ্বের মধ্যে মনুষ্যত্বের জয়গান,এই উপন্যাসের মূল বিষয়।
এর সঙ্গে একটি স্বপ্নের যোগাযোগ আছে।
মন্দিরের সিঁড়ির পথ দিয়ে বলির গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে ব্যথিত হয়ে ছোট্ট মেয়েটি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে ভয়ে,বাবা এতো রক্ত কেন?
এই স্বপ্নের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা রাজ পরিবারেরর কাহিনি যুক্ত করে উপন্যাস রচনা করেন।এখানে গোবিন্দমাণিক্য, রঘুপতি, নক্ষত্র রায় জয়সিংহের মতো চরিত্র অঙ্কিত।
সেই উপন্যাসের প্রথমাংশ নিয়ে রচিত বিসর্জন নাটক।
রাজর্ষি র নায়ক ছিলেন গোবিন্দমাণিক্য,অন্যদিকে বিসর্জন নাটকের নায়ক জয়সিংহ।
প্রথম সংস্করণে রাজর্ষি উপন্যাসের সঙ্গে নাটকের যোগ স্পষ্ট।
দ্বিতীয় সংস্করণে হাসির ও কেদার চরিত্র বাদ যায়।
এবং ধ্রুব ও অপর্ণার চরিত্র সংকুচিত হয়।
এই নাটকে অপর্ণা চরিত্রটি নতুন সৃষ্টি। এটি রাজর্ষি উপন্যাসে দেখা যায় না।
এবং রাজমহিষী গুণবতী চরিত্রটি জটিল হয়েছে। তাঁর সঙ্গে অধিকারবোধ নিয়ে রঘুপতির মিল আছে,সমস্যায়।
এই পঞ্চাঙ্ক নাটকটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন," আসল গল্পটা ছিল প্রেমের অহিংস পূজার সঙ্গে হিংস্র শক্তি পূজার বিরোধ।"
মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য অহিংস পূজার প্রতিনিধি, আর রঘুপতি হলেন হিংস্র পূজার প্রতিনিধি। এইভাবে দ্বন্দ্বের অধ্যায় সূচিত হয়।
এই প্রেম ও প্রতাপের টানাপোড়েনে নাটকটি চিরকালীন সত্য ও সুন্দরের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাঠক অপেক্ষা করে থাকে,কে শেষ পর্যন্ত জিতে যাবে?
প্রেম নাকি প্রতাপ?
কিন্তু শেষে যখন জয়সিংহ মারা গেল,তখন মৃত জয়সিংহের উদ্দেশ্য রঘুপতি বিলাপ করে যা বললেন,তাই তো মানুষের একমাত্র প্রার্থনা,
" জয়সিংহ, বৎস মোর গুরুবৎসল!
ফিরে আয়, ফিরে আয়, তোরে ছাড়া আর
কিছু নাহি চাহি,অহংকার অভিমান
দেবতা ব্রাহ্মণ সব যাক।তুই আয় "
এইভাবে মানবতার জয়গান রবীন্দ্রনাথ নাটকে তুলে ধরেছেন,যা এই সময়ের ধর্মের নামে যুদ্ধ রক্তপাত এবং ভেদাভেদকে সুচারুভাবে চিহ্নিত করে এবং উত্তরণের পথ দেখায়।
বিসর্জন নাটকটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরিচালনা করেছেন এবং নিজেই অসংখ্যবার অভিনয় করেছেন। তিনি রঘুপতির চরিত্রে অভিনয় করতেন।
শান্তিনিকেতনে বিসর্জন যখন মঞ্চথ হল,তখন রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরিচালক, প্রয়োজক এবং অভিনেতা ছিলেন।
কলকাতার এম্পায়ার মঞ্চে ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন অভিনয় করছেন,তখন তাঁর বয়স বাষট্টি।
অভিনয়ের সুবিধার্থে তিনি নাটকটি বারংবার পরিবর্তন করেন। তাই এই নাটকটির ২৯ টি দৃশ্য কমতে কমতে ১৯ টিতে পৌঁছে যায়।
রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদী কবি।
তাই মানুষের জীবনের ধর্মের ব্যাখ্যা তিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে করেছেন।তাই তো লিখতে পেরেছেন,
" যেথা দয়া সেথা ধর্ম,যেথা প্রেম স্নেহ
যেথায় মানব,সেথা মানবের গেহ।
বুঝিলাম ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,
পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন, দাতারূপে
করে দান,দীনরূপে করে তা গ্রহণ ---
শিষ্যরূপে করে ভক্তি,গুরুরূপে করে
আশীর্বাদ, প্রিয়া হয়ে পাষাণ অন্তরে
প্রেম-উৎস লয় টানি,অনুরক্ত হয়ে
করে সর্বত্যাগ"
এই সময়ের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটক শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, এই নাটকের প্রদর্শিত পথ মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার শক্তি ও সন্ধান।
হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের শুধু ধুলো,ধোঁয়া অথবা টাকা ওড়ে না,এখানে মানুষের মনের মধ্যে একটা মানবিক আকাশও উঁকি মারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উত্তরণ সাহিত্যপত্রের উদ্যোগ।
অভিনব এবং আলোকময়।
ডাঃ সমীররঞ্জন খাঁড়া সামগ্রিক ভাবে মন ও মননে সজীব ও সবুজ থেকে উত্তরণ দল নিয়ে এগিয়ে চলেছেন মানবতাবোধের পথে...
তিনি সাহিত্যের এই দিকটি নিয়ে আসছেন,হৃদয় থেকে হৃদয়ের সরোবরে সত্যি সত্যি মনুষ্যত্ববোধের সরোজ উন্মোচনে।
তাই এটি শুধু কোনো একটি নাটক পরিবেশন নয়, শ্রম ও হৃদয়বত্তার পরিচ্ছন্ন মার্জিত মিলনে এক নতুন দিনের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া।
আসুন, জীবনের মেকি ব্যস্ততার ও অন্ধত্বের প্লাস্টিক সরিয়ে নতুন করে দেখতে শিখি।
No comments