শুভেচ্ছা দ্রৌপদী দেবীকে -শেখর ভারতীয়
বেলপাহাড়ির যে গ্রামে আমার বাড়ি সেখান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ছিল উচ্চবিদ্যালয়৷ জঙ্গলের লাল মোরামের রাস্তায় বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে এসে বাস ধরে তারপর স্কুলে আসা। আমার সঙ্গে পাশের গ্রাম থেকে এ…
শুভেচ্ছা দ্রৌপদী দেবীকে -শেখর ভারতীয়
বেলপাহাড়ির যে গ্রামে আমার বাড়ি সেখান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ছিল উচ্চবিদ্যালয়৷ জঙ্গলের লাল মোরামের রাস্তায় বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে এসে বাস ধরে তারপর স্কুলে আসা। আমার সঙ্গে পাশের গ্রাম থেকে একই ক্লাসে পড়ত ফুলমণি টুডু। ভালো অঙ্ক করত মেয়েটা৷ হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। স্কুল থেকে ফিরেই গরু নিয়ে মাঠে যেত ফুলমণি। কখনও স্কুল ছুটির দিনে মাঠে ধান কাটত৷ আমরা একটু বড় হওয়ার পর দু'জনের বাড়ি থেকে সাইকেল কিনে দিয়েছিল৷ সাইকেলে জঙ্গলের রাস্তা ধরে স্কুল, টিউশানি যেতাম আমরা৷ যদিও ফুলমনির ছিল গার্লস আর আমার হাইস্কুল৷ আমি ছোটো বেলায় মনে প্রাণে 'শক্তিমান' হতে চাইতাম৷ প্রচন্ড ইচ্ছে ছিল কুন্ডলীনি চক্র জাগ্রত করে পঞ্চভূতের শক্তিতে 'শক্তিমান' হয়ে যাবো৷ ফুলমণি শিক্ষিকা হতে চাইত৷ এরপর আমরা তখন বোধহয় উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছি, অসুস্থ হয়ে ফুলমনির বাবা মারা যায়। ছোটো বোনের দায়িত্ব এসে পড়ে ওর উপর ৷ পড়াশুনো প্রায় বন্ধ হয়ে যায় যায়। কিন্তু এরপরও লড়াই চালিয়ে গিয়েছে ফুলমণি৷ উচ্চমাধ্যমিকের রুটিন দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ফুলমণিকে বেশ কয়েকদিন কোচিং কামাই করতে দেখলাম৷ একদিন সাইকেলে করে স্কুল থেকে ফিরছি, ওদের গ্রামেরই অন্য এক জুনিয়ারকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আরে ফুলমণি আসছে না কেন?
- তুই জানুস নাই? উয়ার তো বিহা হইছে।
-মানে! আকাশ থেকে পড়লাম! বড় জোর ১৫ দিন বাকি আছে আর! এর মধ্যে বিয়ে!
আরও পাঁচদিন পরে কোচিং এল ফুলমণি৷ ইংরাজি স্যারের কোচিং৷ প্রচন্ড ঝাড়লেন স্যার৷ কেন পরীক্ষার আগে এরকম দুম করে বিয়ে করে নিল! চুপচাপ মাথা নীচু করে শুনল মেয়েটা! কোচিং শেষ হল, আমি সাইকেল বের করছি, হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল,
- নোটসগুলা দিবি?
- না
- কেনো?
- তুই বিয়া করলি, জানাইছিলি?
কোনও উত্তর দেয়নি ফুলমণি৷ চোখগুলো কেমন যেন ছলছল করে উঠেছিলি৷
- আচ্ছা কুন সাবজেক্টগুলা লাগবে বল?
- সবগুলা দিবি?
- আচ্ছা কাল আনব জেরক্স করে লিয়ে লিস।
উচ্চমাধ্যমিকের ১৫ দিন আগে বিয়ে করেও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছিল ফুল।
আমার এমএ শেষ হওয়ার আগেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগও দিয়েছিল৷ বছর সাতেক আগের কথা, বিকেলে বাড়ি ফিরছি ওদের গ্রাম হয়ে। দেখছি সন্ধ্যে নামার মুখে বাড়ির অনেকের সঙ্গে রাস্তার ধারের জমিগুলোতে ধান কাটছে ফুলমণি। ভীষণ ভালো লাগল, শিক্ষিকা হয়েও মাটির গন্ধ ভুলে যায়নি মেয়েটা৷ বললাম,
- কিরে কি খবর? উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
- তুই এখন কুথায় আছু?
- কলকাতায়।
- পুতুল টুতুল কিনব নাকি রে?
আবারও উত্তর না দিয়ে
- কটা বই আনে দিবি?
- না, তুই আগে বল খাওয়াবি কবে?
- খাওয়াবো, বই গুলা আনি দিবি?
-দিবো৷
ফুলমণি অনেক লড়াই করে পেরেছিল আবার আমার নার্সারির বান্ধবী নীলাবতী মান্ডি পারেনি৷ অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না, তারপর একদিন শুনেছিলাম ও আর নেই...
বেলপাহাড়ি থেকে ময়ুরভঞ্জের দূরত্ব ১১১ কিলোমিটার। কিন্তু বেলপাহাড়িতে আমার গ্রাম আর ময়ুরভঞ্জের দ্রৌপদী মুর্মুর গ্রাম যেন এক সুতোয় বাঁধা৷ প্রথম জীবনে দ্রৌপদীও শিক্ষকতার পেশায় ছিলেন৷ লড়াইয়ের পথে দুই ছেলে, স্বামীকে হারিয়েছেন দ্রৌপদী। ভেঙে পড়েছেন হয়ত, তারপর আবার উঠে দাঁঠিয়েছেন৷ ময়ুরভঞ্জ হোক কিংবা বেলপাহাড়ি, এরকম প্রত্যন্ত জায়গা থেকে রাইসিনা হিলস উঠে আসার লড়াই যে কী অসম, কী ভীষণ তা আমরাই জানি৷ কিন্তু দ্রৌপদী মুর্মু পেরেছেন। আমাদের সবার হয়ে লড়াইটা লড়তে দ্রৌপদী মুর্মু পেরেছেন৷
এ লড়াই বাস্কেদাকা-র (পান্তাভাত) সঙ্গে ইতালিতে 'চিন্তন শিবিরে' যাওয়া লোকের লড়াই,
এ লড়াই জল-জঙ্গলের সঙ্গে ব্যরিস্তার দামি ধোঁয়া ওঠা কফির-কাপে চুমুক দিয়ে 'প্রলেতারিয়া' বুলি আওড়ানোদের বিরুদ্ধে লড়াই,
এ লড়াই মাটির সঙ্গে ঝকমকে টাইলসের লড়াই, যে মাটিতে ধান জন্মায়...
আসলে মহাভারত হোক কিংবা আজকের ভারত। শেষমেশ দ্রৌপদীরা জিতে যান৷ নিজের যোগ্যতায় জয় ছিনিয়ে আনেন।
শুভেচ্ছা দ্রৌপদী দেবীকে৷ শুভেচ্ছা তাঁর ময়ুরভঞ্জ থেকে রাইসিনার লড়াইয়ে জন্য৷ পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাইসিনার অলিন্দে পা রাখার জন্য৷ ধন্যবাদ বিজেপি, এনডিএ জোট ও অবশ্যই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে৷
No comments