Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বাসন্তী দুর্গাপুজো-তমাল দাশগুপ্ত

বাসন্তী দুর্গাপুজো-তমাল দাশগুপ্ত
বাসন্তী দুর্গোৎসব সমাসন্ন। এই দুর্গাপুজো শারদীয়া দুর্গাপুজো থেকে কতটা আলাদা? এই বাসন্তী পুজোর উল্লেখযোগ্য দিকগুলিই বা কি? জানব এই লেখায়। আজ বাসন্তী দুর্গাপুজোর সপ্ত বৈশিষ্ট্য।
১. দুটি দুর্গাপুজোই যথ…

 



বাসন্তী দুর্গাপুজো-তমাল দাশগুপ্ত


বাসন্তী দুর্গোৎসব সমাসন্ন। এই দুর্গাপুজো শারদীয়া দুর্গাপুজো থেকে কতটা আলাদা? এই বাসন্তী পুজোর উল্লেখযোগ্য দিকগুলিই বা কি? জানব এই লেখায়। আজ বাসন্তী দুর্গাপুজোর সপ্ত বৈশিষ্ট্য।


১. দুটি দুর্গাপুজোই যথাক্রমে বসন্তে ও শরতের চৈত্র ও আশ্বিনের দেবীপক্ষে ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত ঘটে। কিন্তু প্রথম পার্থক্য, বাসন্তী দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীতে বোধন নেই। শারদীয়া দুর্গাপুজোয় আমরা জানি ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়। এই শারদীয়া বোধনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অকাল বোধন তত্ত্বের অবতারণা ঘটেছে।


২. কিন্তু যদিও শারদীয়া দুর্গাপুজো সম্পর্কে অকাল বোধন কথাটি প্ৰচলিত, আসলে শারদীয়া দুর্গাপুজোই বেশি প্রাচীন। এই অকাল বোধনের কাহিনীটি মধ্যযুগে প্ৰচলিত কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়ে সাধারণ বাঙালি জেনেছিল। মূল বাল্মীকি রামায়ণে এটা নেই। 


ষষ্ঠ শতকের গ্রন্থ শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী ঘোষণা করেছেন তাঁর শারদীয়া পুজোর কথা। 


তারও আগে প্রাচীন ভারতে শরৎকালে ঊষার বোধন হত। সুকুমার সেন ঊষার শারদীয়া বোধন থেকেই শারদীয়া দুর্গাপুজোর বোধন এসেছে, এমন সিদ্ধান্ত করেন।


ঊষা অত্যন্ত প্রাচীন। ডি ডি কোসাম্বি সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে ঊষা হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত হতেন। 


৩. বাসন্তী দুর্গাপুজো প্রকৃতপক্ষে জলদেবী বা নদীমাতৃকার উপাসনা বলে সুকুমার সেন সিদ্ধান্ত করেন। সেক্ষেত্রে প্রাচীনযুগে সিন্ধু, সরস্বতী, গঙ্গা প্রভৃতি নদীমাতৃকা ছাড়াও হ্রদ অথবা সমুদ্রে অবস্থিতা পদ্মাসনা কমলা/লক্ষ্মী বা পদ্মা/মনসা এই বাসন্তী পুজোর মাধ্যমে আরাধিত হন এরকম নির্যাস টানা যায়। বেদে এক স্থানে শক্তিদেবী বলেন যে সমুদ্রের তলদেশ থেকে তাঁর উৎপত্তি, অতএব বাসন্তী পুজোয় উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতা থেকে পূজিত শ্রী/লক্ষ্মীর সুপ্রাচীন স্মৃতিও আছে। 


৪. মনে রাখা দরকার, চৈত্র নবরাত্রির শেষে অন্নপূর্ণা উপাসনা হয়। অতএব হরপ্পা সভ্যতা থেকেই পূজিত যে শস্যমাতৃকা, বা শাকম্ভরী, ধান্যলক্ষ্মী বা শস্যলক্ষ্মী, যাঁর নানা মূর্তি হরপ্পা সভ্যতা থেকে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতা পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাঁর উপাসনাও এই বাসন্তী পুজোয় নিহিত। মনে রাখতে হবে শারদীয়া দুর্গাপুজো সমস্ত মাতৃকার উদ্দেশ্যেই ভক্তের নিবেদন, সেজন্য শারদীয়া পুজোয় সপ্তমী তিথিতে শস্যমাতৃকার প্রতীক রূপে নবপত্রিকা স্নান হয়।


৫. বসন্তকালে নানা রোগব্যাধির প্রকোপ ঘটে। বৈদিকরা রুদ্র ও তাঁর ভগ্নী অম্বিকা (রুদ্র ও অম্বিকা ভ্রাতা ভগ্নী রূপে কল্পিত হয়েছিলেন বেদ-উপনিষদ রচনার কালে। বাজসনেয়ী সংহিতা দ্রষ্টব্য। শিব শক্তি স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক প্রাচীনযুগে ছিল না)-র কাছে প্রার্থনা করতেন রোগমুক্তির জন্য। কাজেই আমরা বসন্তকালে যে ব্যাধিনাশিনী মাতৃকার পুজো করি, যিনি মূলত আজকে শীতলা স্বরূপা, এই বাসন্তী দুর্গাপুজো তাঁরও উপাসনা বটে।


৬. উপমহাদেশের নদীমাতৃক সভ্যতা, সে তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতা হোক অথবা গাঙ্গেয় গঙ্গাল সভ্যতা, শরৎকালে বিজয়যাত্রা করত। হরপ্পা সভ্যতার দাসজাতি বিজয়যাত্রা করতেন, হরপ্পা সভ্যতার পণি বিজয়যাত্রা করতেন। ব্রাত্য আর্য ও দ্রাবিড় মিশ্রিত এই শেকড় - এঁরাই আধুনিক বাঙালির পূর্বসূরী। শারদীয়া পুজোর বিজয়া দশমী এই বিজয়যাত্রার স্মৃতিবাহী।


এই দীর্ঘ বাণিজ্য বা যুদ্ধযাত্রা শেষে গৃহে ফিরে আসতেন সবাই বসন্তে, প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরুর আগেই। বাসন্তী দুর্গাপুজোর মাধ্যমে বসন্ত সমাপনী উৎসব হত। এই উৎসবের নানা অঙ্গ ছিল, তার মধ্যে কয়েকটি চান্দ্র তিথির পরিবর্তে সৌর তিথি মেনে চলত, যেমন  চরক। চরকও এই বসন্ত সমাপনী উৎসবের স্মৃতি বহন করে। চরক যে মাতৃধর্মের অঙ্গ ছিল, তা নিয়ে আগে লিখেছি। বাঙালির বৈশাখী নববর্ষও এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই সৃষ্টি, যখন সম্রাট শশাঙ্ক শিব ও নীলাবতীর বিবাহ উৎসবের সূচনা করেন, নীলের ব্রত পালন করে আমাদের সুমহান তন্ত্রাশ্রয়ী পূর্বজরা এই উৎসব পালন করতেন। 


বস্তুত বাসন্তী দুর্গাপুজো যে নববর্ষের উৎসব, তা তো আমাদের বৈশাখী নববর্ষের প্রাক্কালে এই পুজোর সময়কাল থেকেই প্রতিপন্ন। কিন্তু শারদীয়া দুর্গাপুজোও নববর্ষের উৎসব ছিল, কারণ একসময় শরৎকালে নতুন বছর শুরু হত, এবং শারদীয়া দুর্গাপুজোয় শারদ নববর্ষের স্মৃতি নিহিত আছে, এই বিষয়ে হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন।


৭. উত্তর ভারতে বাসন্তী ও শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় যথাক্রমে বাসন্তী ও শারদীয়া নবরাত্রি উদযাপিত হয়, এই সময় আমিষভোজন নিষেধ। কিন্তু বাঙালির মাতৃকা উপাসনা বলি ছাড়া হয় না। নয়দিন নয়জন মাতৃকার উপাসনার প্রথা আছে নবরাত্রিতে। বাঙালির মধ্যে কোনও প্রাচীনকালে এমন নবরাত্রি প্ৰচলিত থাকলেও বর্তমানে তা নেই বললেই চলে। বাঙালির মধ্যে বাসন্তী দুর্গাপুজোয় বারোয়ারি উদ্যোগ দেখা যায় না, শারদীয়া পুজোর মত। পারিবারিক পুজোর মাধ্যমেই মূলত বাসন্তী দুর্গাপুজো উদযাপিত। 



No comments