Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পুরানো কলকাতার পালকি’রানারানা

‘পুরানো কলকাতার পালকি’রানারানাকাঁচা মাটির এবড়ো খেবড়ো একটা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ছ’জন বেহারা মিলে একটা পালকিকে কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে। সেই পালকির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে। পালকির একমাত্র সাহেব যাত্রীর উদ…

 




‘পুরানো কলকাতার পালকি’রানারানা

                                               

কাঁচা মাটির এবড়ো খেবড়ো একটা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ছ’জন বেহারা মিলে একটা পালকিকে কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে। সেই পালকির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে। পালকির একমাত্র সাহেব যাত্রীর উদ্দেশ্যে তাঁরা কাতর গলায় বলছে - “মী, পুয়োর বয় স্যার”। আর পালকির পর্দা সরিয়ে হাসতে হাসতে হাত নেড়ে তাঁদের সেই আবেদনে সম্মতি জানাচ্ছেন এক ‘স্কটিশ’ সাহেব। সেই সাহেবের নাম ‘ডেভিড হেয়ার’। তখনকার দিনে হেয়ার সাহেবের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য ছেলেরা অমনভাবে তাঁর কাছে কাকুতি মিনতি করত। সেই সময়ের কলকাতার ইউরোপীয় সাহেবরা পালকিতে চড়ে যাতায়াত করতেন। কলকাতা শহরে ঘোড়ার গাড়ি আসার বহু আগে থেকেই পালকি ছিল স্থলপথের একমাত্র পরিবহন।

পালকি ছিল নানা ধরণের। সাধারণতঃ এক একটা পালকির দাম ছিল দেড়শো থেকে তিন-চারশো টাকা। প্রায় সব পালকিতেই একজন মাত্র লোক যেতে পারতেন। প্রথম আমলের পালকি অবশ্য ঘেরা ছিল না। সেগুলোর চারদিক খোলা থাকত। ওপরের চালের দিকের মাঝখানটা উঁচু থাকত। তবে সেই সময়ের বড়লোকেরা বেশ জমকালো ধরনের পালকি ব্যবহার করতেন। এর পরের যুগে চারদিক ঢাকা পালকি আর ‘চেয়ার পালকি’র প্রচলন হয়েছিল। ‘তঞ্জাম’ ছিল অনেকটা চেয়ার পালকিরই মত। সেই তঞ্জাম তৈরি হয়ে আসত বিলেত থেকে। রাজা রামমোহন রায়ের সাথে ভারতে ‘সতীদাহ প্রথা’ রদের মূল কারিগর, ‘গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক’ মূলতঃ তঞ্জামে চড়েই সর্বত্র যাতায়াত করতেন।

একটা পালকি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য সাধারণতঃ ছ’জন বেহারা লাগত। তবে চার, আট ও ষোল বেহারার পালকিও ছিল। ‘রানী রাসমণি’র পালকি ছিল আট বেহারার, আবার রানী রাসমণির খাজনা আদায়কারী ‘চৌধুরী’দের পালকি ছিল চার বেহারার। এছাড়া পালকির সঙ্গে থাকত একজন ‘ছাতা বরদার’। তাঁরা ছাতা ধরে যাত্রীর মাথা বাঁচাত।

পালকিতে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যেতে তখন দশ পনেরো ক্রোশ (২৫-৩০ কি.মি.) বা তারও বেশি পথ চলতে হতো। এতটা পথ চলায় যথেষ্ট কষ্ট ছিল। তাই পথের কষ্ট লাঘবের জন্য বেহারারা মুখে মুখে একরকম ছড়া কেটে আনন্দে পথ চলতো। সেটাকে ‘পালকির গান’ বলা হতো। সেগুলো ছিল ওই সময়ের একধরনের ‘শ্রম-সঙ্গীত’। বেহারাদের মধ্যে একজনই (প্রথমজন) গানের কথা ও সুর ধরতেন। তারপরে অন্যেরা কেবলমাত্র ‘ধুয়ো’ ধরে সেই গানের সুরকে ধরে রাখতেন। প্রথমে ওই গান শুরু হত ধীর তালে। ক্রমে গানের তাল বা লয় বাড়ত। একই সাথে বাড়ত বেহারাদের চলার গতি। এক সময় গানের লয় বাড়তে বাড়তে আবার ধীরগতিতে নেমে আসত। বেহারাদের চলার গতি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তাঁদের গানের গতিও কমে বা বেড়ে যেত। ওসব গান মুখে মুখে বা তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হত। বেহারাদের সেই গানের কথায় থাকত প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনা, পথের ধারে দেখা ক্ষণিক দৃশ্য, পথের প্রতিবন্ধকতা সুখ-দুঃখের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা আবার কখনো বা আদি রসাত্মক কথা। গানের কথায় ও শব্দের মধ্যে পারম্পার্য থাকবে, এমন কোন কথা ছিল না। কখনও গানের কথা অসংলগ্ন হত, কখনও বা কথার খেই ধরে রাখার জন্য মনে যা আসত সেটাই বলা হত।

১৭৯৪ সালে পাঁচজন ঠিকা বেহারার এক দিনের ভাড়া ছিল এক টাকা। আর অর্ধদিবসের জন্য আট আনা। কলকাতার বাইরে পাঁচ মাইল পর্যন্ত যেতে পালকি ভাড়া হতো চার আনা হিসেবে। এক ঘণ্টার কম সময়ের জন্য যাত্রীরা এক আনা হিসেবে ভাড়া দিতেন। সবার পক্ষে ওই ভাড়া সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে সেই সময়ে পালকিতে চড়ার অধিকার কেবলমাত্র বিত্তবানদেরই ছিল। পলাশীর যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বড় ধরনের কর্মচারী ছাড়া আর কেউই পালকিতে চড়তে পারতেন না।

তখনকার দিনে কলকাতা থেকে পালকি ভাড়ার হার ছিল এই রকমের -


‘চন্দননগর’ - সাড়ে বাইশ টাকা থেকে সাড়ে চব্বিশ টাকা।

‘হুগলি’, ‘চুঁচুড়া’, ‘বংশবাটি’ - সাড়ে বিয়াল্লিশ টাকা থেকে সাড়ে ছেচল্লিশ টাকা।

‘মুর্শিদাবাদ’ - একশো সাতচল্লিশ টাকা আট আনা থেকে একশো ঊনষাট টাকা আট আনা।

‘ভাগলপুর’ - তিনশো আটাশ টাকা বারো আনা থেকে তিনশো চুয়ান্ন টাকা বারো আনা।

‘মুঙ্গের’ - তিনশো ছিয়াত্তর টাকা চার আনা থেকে চারশো ছ’টাকা চার আনা।

‘পাটনা’ - পাঁচশো টাকা থেকে পাঁচশো চল্লিশ টাকা।

‘কাশী’ - সাতশো সাত টাকা আট আনা থেকে সাতশো চৌষট্টি টাকা।


সেই যুগে ওড়িশা বাসীদের জন্য পালকি বেহারার কাজটি এক চেটিয়া ছিল। ১৭৭৬ সালে সরকার থেকে ঠিকা বেহারাদের জন্য যে দর বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তা ছিল -


৫ জন ঠিকা বেহারা দৈনিক সিক্কা - ১ টাকা।

৫ জন ঠিকা বেহারা আধদিন - আট আনা।

(তখন প্রায় আট ঘণ্টায় আধ দিন ধরা হত)


ওই সময়ের ‘পালকি ডাক’ অনেকটা পালকির মতই দেখতে ছিল। সেটার সাথে একটা পালকির এটাই তফাৎ ছিল যে সেটাতে শুধুমাত্র চাকা লাগানো থাকত। ওই গাড়িটি কখনো মানুষে টানত আবার সেটার সঙ্গে কখনো কখনো ঘোড়াও জুতে দেওয়া হত। ১৮৫০ সালে কলকাতা থেকে ‘কানপুর’ পর্যন্ত ‘ডাক লাইন’ চালু করা হয়েছিল।

কলকাতার প্রথম সংগঠিত ধর্মঘটের জনক কিন্তু ছিলেন সেদিনের পালকির বেহারারা। বেহারাদের সেই সময় রমরমা অবস্থা ছিল। তাঁরা রীতিমতো যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম কষে লাভের হিসাব বুঝে নিয়ে তবেই পালকি বইতেন। ইংরেজদের সেই বিষয়টা মোটেও ভালো লাগেনি। তাই ব্রিটিশ সরকার পালকি বাহকদের ক্ষেত্রেও দর-দামটা বেঁধে দেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮২৭ সালের ১২ই মে তারিখে সরকার থেকে রীতিমতো আইন জারি করে জানানো হয়েছিল যে প্রত্যেক বেয়ারাকে পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে, আর ঘণ্টানুযায়ী মজুরি নিতে হবে। প্রত্যেক বেয়ারাকে নিজের হাতে জ্ঞাপক চাকতিও পরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নতুন নিয়মে দেখা গিয়েছিল যে বেহারাদের মজুরি আগের তুলনায় কমে গেছে। কারণ, সরকারি নির্দেশে বলা হয়েছিল - “সমস্ত দিন ফি - চারি আনা। ইঙ্গরেজি ১৪ ঘড়িতে একদিন গণা যাইবেক। অর্ধদিন অর্থাৎ ইঙ্গরেজি এক ঘড়ির অধিক পাঁচ ঘড়ির কম - দুই আনা।” একইসঙ্গে বেহারাদের ভাড়াও দিনে চার আনা করে দেওয়া হয়েছিল। চোদ্দ ঘড়ির দিনে অর্ধেক খাটলে মজুরিও ছিল অর্ধেক। এর আগে বেহারারা মজুরি পেতেন সময়ের হিসেবে নয়, দূরত্বের হিসেবে। আর খাটনির নিরিখে দরদামের স্বাধীন অধিকারও ছিল বেহারাদের।

এই বিষয়ে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল - “কলিকাতা হইতে কালীঘাটে কোনও বাবুকে লইয়া যাইতে হইলে মরে পিটে এক ঘন্টার মধ্যে যাওয়া যায় এবং সে এক ঘন্টার মজুরি তাঁহারা প্রত্যেকে কেবল এক ২ আনা করিয়া পাইবেক কিন্তু সেই এক ঘন্টায় তাঁহাদের তাবৎ দিবসের বল যাইবে।” ইংরেজি পত্রিকাতেও বেহারাদের পক্ষে মতামত আসা শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ ন্যায্য প্রশ্ন তুলেছিলেন। বেহারাদের কাছে ঘড়ি ছিল না। বড়োলোক বাবু বা সাহেবরা যদি সময় নিয়ে তাঁদের ঠকায়? সরকারি ব্যয়ে বেহারাদের ঘড়ি কিনে দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। নানা মুনির নানা মতে পুরানো কলকাতার পথ-ঘাট-চত্বর তখন সরগরম হয়ে উঠেছিল। শেষে পালকি বাহকদের ধর্মঘট আন্দোলন শুরু হয়েছিল। নিম্ন শ্রেণির নিম্ন আয়ের ওই শ্রমিকদের একটা বড় অংশ একত্রে জড়ো হয়ে সেই সময়ের ‘ক্যালকাটা প্লেনস’-এ (এখনকার ময়দান) সভা ডেকেছিল। সেই সভায় পালকি বাহক ‘পাঁচু সুর’ ছিলেন সভাপতি, আর প্রধান বক্তা ছিলেন ‘গঙ্গাহরি’। গঙ্গাহরির বক্তব্য ছিল, তাঁরা ইংরেজ সরকারের ওই আইন কিছুতেই মানবেন না। সেই সভায় ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান, নৌকার মাঝিদের মধ্য থেকেও দু’জন করে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে ইংরেজ সরকার তাঁদের ভাড়ায়ও হস্তক্ষেপ করতে পারে, তাই তাঁরা পালকি বেহারাদের সেই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বেহারারা ইংরেজ সরকারকে লিখিতভাবে নিজেদের আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। ইংরেজরা তাঁদের আবেদন উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। বেহারাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল যে রাস্তায় কোনো পালকি নামবে না। পালকি ছাড়া সেকেলে কলকাতা ছিল অচল। পথ-ঘাট শুনশান হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ব্যক্তিগত পালকির বেহারারাও সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে পালকি-চাপা কলকাতাবাসীর তখন নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল। রাজাদেশের বিরুদ্ধে এমন লড়াকু জোট কিন্তু সেযুগে বেশ ব্যতিক্রমী ব্যাপার ছিল। বেহারাদের সর্দাররা ঐক্য বজায় রাখতে হুকুম দিয়েছিলেন - দল ভাঙলেই একঘরে হতে হবে। দল ভাঙার প্রশ্নও ছিল না অবশ্য। কারণ ইংরেজ সরকারের সেই নতুন ফতোয়া সবারই পেটে টান মেরেছিল। এরপরে কলকাতার কয়েক হাজার পালকি বেহারা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁরা রীতিমতো মিছিল করে লালবাজারে পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের সামনেও তাঁরা বিক্ষোভ করেছিলেন। ওই ঘটনা তখন সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল। সেই সময়ের একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, “Yesterday all the Theeka Bearers of Calcatta had formed themselves into a body and unanimously swore that they would not bear palan keens untill the new Regulaiton Promulgaled for licensing then, be abolished and that those who would disregard this agreement should be excommunicalted from the community forfeiting their caste.” অত মানুষের উত্তেজিত ভিড় দেখে ইংরেজ প্রশাসনিক কর্তারা খানিকটা নরম হতে বাধ্য হয়েছিলেন। রফায় রেজিস্ট্রেশনের তাবিজ কেনার খরচ বাদ দেওয়া হয়েছিল। আরও খুচরো দু’-একটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বেহারাদের ঢল ফিরে গিয়েছিল। কর্তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

কিন্তু, ‘স্ট্রাইক’ প্রত্যাহার হয়নি। কারণ, আসল সুরাহাই নাকি মেলেনি। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায় যে, মিটিং-এর পরে বেহারারা সুপ্রিম কোর্টের সামনের জমিতে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে সরকারি প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের বিবেচনা-আলোচনা চলেছিল। এবং, সবাই একমত হয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা জাত খুইয়ে হাতে চাকতি বাঁধবেন না।

কলকাতার পালকি বাহকদের সেই ধর্মঘট প্রায় এক মাস ধরে স্থায়ী হয়েছিল। ওই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা একটি রম্য সংবাদ প্রকাশ করে লিখেছিল, “সে যে হউক বেহারারা ‘চলিয়া’ গিয়াছে, হইতে পারে যে তাহারা শ্রীক্ষেত্র দর্শনে গিয়াছে। সম্প্রতি রথযাত্রা উপস্থিত। ভরসা হয় যে একবার রথ টানিয়া পুনর্বার পালকি বহিবেন। ইতোমধ্যে কলিকাতা নগরের ঘোড়া সকল পালকি বেহারা হইয়াছে এবং বোধ হয় যে দুই তিন হপ্তার মধ্যে ঘোড়াদের সভা হইয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত হইবেক।” আর এভাবে নিম্ন শ্রেণির পালকি বাহকেরা কলকাতার ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা কোন ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে কাঠের তৈরি একটি পালকি মিউজিয়ামে ঠাঁই পেলেও পালকি বহনকারী মানুষগুলোর ইতিহাসে কোথাও ঠাঁই হয়নি - না ইতিহাসে, না সমাজে!

তবে পালকি নিয়ে বেহারাদের ধর্মঘট এবং ইংরেজদের বাড়াবাড়ি যেমন হয়েছিল, তেমনি পালকি ব্যবহারের আধিক্যের কারণে ইংরেজ বণিকদের অবৈধ আয় ঠেকাতেও ইংরেজ সরকারকে বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছিল। সতেরো ও আঠারো শতকে বাংলার ইউরোপীয় বণিকেরা হাটবাজারে যাতায়াত এবং তাঁদের মালপত্র বহনের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন। তাঁরা পালকি ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে কোম্পানির একজন স্বল্প বেতনের সাধারণ কর্মচারীও এ দেশে যাতায়াতের জন্য একটি নিজস্ব পালকি রাখতেন এবং সেটার ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু সেই পালকির ব্যয় বহন করতে গিয়ে ইউরোপীয় কর্মচারীরা অবৈধ আয়ের নানা খারাপ পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেছিলেন। ফলে ১৭৫৮ সালে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টরস’, কোম্পানির সাধারণ কর্মচারীদের পালকি ক্রয় ও ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে একসময় পালকি ও বাহকদের এ দেশে প্রচুর প্রভাব ছিল। যদিও বেয়ারাদের সেই প্রভাব স্থায়ী হয়নি।

বেহারাদের ওই ধর্মঘট আন্দোলন চলতে থাকলে ইংরেজ সরকার তাঁদের সব দাবি মেনে নিতে বাধ্য হতেন কিনা জানা নেই, কিন্তু সেই বেনজির আন্দোলনের পেটে লাথি মেরেছিলেন ‘স্বদেশি’রাই। উড়িয়া বাহকরা কাঁধ থেকে পালকি নামিয়ে রেখেছে শুনে ‘হিন্দুস্থানি রাউনি বেহারা’রা গঙ্গা পেরিয়ে দলে দলে কলকাতায় ঢুকতে শুরু করেছিল। উড়িয়া বাহকদের জাত নষ্ট হওয়া, অধিকারের দাবি, ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবিগুলো সেই গরিব গুর্ব জোটের কাছে পাত্তা পায়নি। দেখতে দেখতে কলকাতার পথ-ঘাট হিন্দুস্থানি বেহারায় ছেয়ে গিয়েছিল। ওড়িয়া বেহারাদের বিদ্রোহকে ইংরেজ সরকারকে কড়া হাতে দমন করতে হয়নি। এমনকি মাথা নুইয়ে তাঁদের সব দাবিও মেনে নিতে হয়নি।

এরপরে কিছুদিনের মধ্যেই মহানগরীর চাকা গজিয়েছিল। পালকি-গাড়ি থেকে প্রথমে এক্কা ঘাড়ি, তারপরে ট্রাম। উড়িয়া বাহকদের মতো অন্যান্য পালকি-বাহকরাও একে একে উবে গিয়েছিলেন বা পেটের দায়ে নিজের পেশা বদলে নিয়েছিলেন। তবে উড়িয়া বাহকদের সেই প্রতিবাদটা কিন্তু মোটেও ‘ছোটো’ ছিল না। প্রায় এগারো হাজারেরও বেশি মানুষ ওই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। সেটাই ছিল কলকাতা মহানগরীর মেহনতি মানুষদের প্রথম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।


(ছবিটা ১৯৭৫ সালের কলকাতা শহরের)

                                              

(তথ্যসূত্র:

১- কলিকাতার কালকথা, রানা চক্রবর্তী।

২- Interesting History of Kolkata Aka Calcutta, Emily Stehr.

৩- Birth of a Colonial City: Calcutta, Ranjit Sen.)

                                        

No comments