বঙ্কিম এই মন্দিরে তাঁর অমর সঙ্গীত বন্দে মাতরম রচনা করেছিলেন শৃঙ্খলবদ্ধ নৃত্যকালীর অপরূপ প্রতিমার সামনে বসে: মা শিকলকালী মন্দির, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ-তমাল দাশগুপ্ত লালগোলার অধিষ্ঠাত্রী কালীপ্রতিমার জুড়ি সারা বিশ্বে মেলা ভার, এই কা…
বঙ্কিম এই মন্দিরে তাঁর অমর সঙ্গীত বন্দে মাতরম রচনা করেছিলেন শৃঙ্খলবদ্ধ নৃত্যকালীর অপরূপ প্রতিমার সামনে বসে: মা শিকলকালী মন্দির, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ-তমাল দাশগুপ্ত
লালগোলার অধিষ্ঠাত্রী কালীপ্রতিমার জুড়ি সারা বিশ্বে মেলা ভার, এই কালীমূর্তি সবার থেকে ভিন্ন। কাঠের প্রতিমা, মা কালী এখানে শিবের বুকের ওপরে নৃত্যরত। মায়ের দুপাশে লক্ষ্মী সরস্বতী, সম্মুখে দুই কিন্নরী। একটু সামনের দিকে মদন ও রতি। মায়ের ওপরের বাম হাতে রুপোর খড়্গ, ডান হাতে বরাভয়। নিচের হাতদুটি জোড়বদ্ধ, মা যেন দুই হাত এক করে হাততালি দেবেন। কথিত আছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় একশো আটটি ছাগবলি হয়, মা সেই সময় বলি গ্রহণ করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মা যাতে বেদীচ্যুত না হন, সেজন্য পুরোহিত শেকলে বেঁধে দেন প্রতিমাকে।
অর্থাৎ মায়ের এই প্রতিমা জাগ্রত, তা বোঝাতে শেকলের ব্যবহার।
মায়ের নিচের দুই হাত জোড়বদ্ধ কেন? শ্রী শ্রী চণ্ডীতে রক্তবীজ বধের পরে মা এই ভঙ্গিতে নৃত্যরত ছিলেন বলে কল্পনা করা হয়েছে। মা যেন বদ্ধাঞ্জলি ভঙ্গিতে আঁজলা করে রক্ত তুলে নিচ্ছেন।
◆◆■■◆◆
বঙ্কিম যখন আনন্দমঠ লেখেন, তখন বন্দে মাতরম গান উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে ছিল। ভবানন্দের কন্ঠে গানটি গীত হচ্ছে, ভবানন্দের উক্তি বলেই উদ্ধৃতি, এই ভেবে সেযুগের গবেষকরা সেভাবে বিষয়টি তলিয়ে দেখেন নি। আজকের গবেষক থেকে পাঠক প্রায় সবাই জানেন যে বন্দে মাতরম গানটি আনন্দমঠ রচনার অনেক আগেই লেখা। আনন্দমঠ রচনার অনেক আগেই বঙ্গদর্শনের একজন কর্মচারী এ গানটি একটি কাগজে লেখা অবস্থায় বঙ্কিমের দেরাজে দেখেছিলেন, বঙ্গদর্শন তখন প্রেসে যাচ্ছে ছাপতে। পত্রিকার পাতায় খানিকটা ফাঁকা স্থান পূর্ণ করতে ওই গানটি দেওয়ার কথা ভাবলেন সেই কর্মচারী।
এরকম হত বটে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা পত্রপত্রিকায়। পাতা পূরণের জন্য পদ্য ছেপে দেওয়া হত। একসময় একটা রসিকতাই চালু ছিল, গদ্যের পদতলে স্থান বলেই কবিতাকে পদ্য বলে। কিন্তু বঙ্কিম এভাবে পদ্যাকারে ছাপাতে রাজি হন নি তাঁর এই রচনা। গানটি পুনরায় দেরাজে ভরে দিয়ে বলেছিলেন, এ গান এভাবে ছাপানো যাবে না। দেখবে, একদিন পুরো দেশ এই গানে মেতে উঠবে।
এ গান আগে থেকেই রচিত ছিল, সেজন্যও সম্ভবত আনন্দমঠে এ গানটিতে উদ্ধৃতির ব্যবহার।
কিন্তু আমার বিনীত ধারণা, নিজের লেখায় উদ্ধৃতিচিহ্ন দিয়ে বঙ্কিম এক গূঢ় ও প্রগাঢ় সত্যের দিকে ইঙ্গিত করেন। বন্দে মাতরম নিছক বঙ্কিমের স্বরচনা মাত্র নয়। অরবিন্দ বলেছিলেন, বঙ্কিম মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, তিনি বন্দে মাতরম মন্ত্র দিয়েছিলেন আমাদের, সেজন্যই তিনি ঋষি। যথার্থ।
বীজ মন্ত্র কিন্তু কেউ বানিয়ে নেন না। মন্ত্রের আবির্ভাব হয়, যিনি ঋষি তিনি মন্ত্র দেখতে পান। একে অলৌকিক বা আজগুবি ভাবার প্রয়োজন নেই, এমনকি আধুনিক যুগের অনেক কবিতাই এভাবে লেখা, কবিগণ অনেক সময়েই একটি পংক্তি আচমকা শুনতে পান, দেখতে পান। বিংশ শতকের শেষার্ধে বিখ্যাত এক বাঙালি কবি একবার বলেছিলেন, "ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে", এই পংক্তিটি বিদ্যুৎচমকের মত আচমকা তাঁর মনের দৃষ্টিপথে এসেছিল।
কথায় বলে নাদ ব্রহ্ম। একজন ঋষি একটি মন্ত্র দেখতে পান, মন্ত্রের শব্দ শুনতে পান। বন্দে মাতরম নিছক রচনা নয়, এ হল দর্শন। বঙ্কিম উনিশ শতকে যাবনিক নিয়মে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেছেন বোঝাতে যে বন্দে মাতরম গান পশ্চিমী ধরণে লেখকের স্বরচিত স্বকপোলকল্পিত রচনা মাত্র নয়, এটি তিনি মন্ত্রের মত দর্শন করেছিলেন।
এই বন্দে মাতরম গানটি কি মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় মা নৃত্যকালীর মন্দিরে রচিত? হ্যাঁ, সেরকমই মনে করা হয়।
◆◆■■◆◆
লালগোলার স্থানেশ্বরী রক্ষাকর্ত্রী অধিষ্ঠাত্রী মা হলেন এই নৃত্যরতা কালী, এঁকে মা শেকলকালীও বলা হয়। মন্দির সংলগ্ন দীঘির নাম কলকলি যা একসময় পদ্মা নদীর সঙ্গে যুক্ত একটি নদী ছিল। কথিত আছে এই নদীতেই মায়ের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নদী থেকে মায়ের সেই মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন লালগোলার তৎকালীন রাজা। মায়ের মূর্তি এই মন্দিরে দক্ষিণমুখী।
বঙ্কিম ১৮৬৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বঙ্কিম মুর্শিদাবাদ জেলায় চলে আসেন (বহরমপুর জেলা সদরে) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হয়ে। দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন এখানে, গভীরভাবে এই সময়েই বাঙালির আবহমানকালের ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা নিয়ে চর্চা করেন, এই সময়ের একাধিক ইংরেজি ও বাংলা রচনা যার সাক্ষ্য দেয়, যার সম্পূর্ণ আলোচনা এই পোস্টে করা সম্ভব নয় স্থানাভাবে। এটুকু বলার যে নেহাত আলগা ভাবের ঘোরে আচমকা লেখা কবিতা নয় বন্দে মাতরম। দীর্ঘ চর্যা ও চর্চার ফল। এই গানটি বঙ্কিমের দর্শন, সমগ্র অর্থেই। প্রসঙ্গত এই মুর্শিদাবাদ জেলায় আসার ঠিক আগেই ১৮৬৯ সালে বঙ্কিম কাশী থেকে দিল্লি অবধি ভারত ভ্রমণ করে আসেন, এবং এইসময়েই ত্রয়োদশ শতকে গৌড়ে ইসলামিক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে 'মৃণালিনী' উপন্যাস রচনা করেন। শব্দের ভাস্কর তিনি, মায়ের মূর্তিই নির্মাণ করেছেন বন্দে মাতরম গানে বঙ্কিম। মায়ের মূর্তিকল্পে বঙ্কিম অনেক শত বছর, অনেক শত যোজন মিলিয়ে দেবেন।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ডেপুটির কাজ করার সময়েই বঙ্কিম আসেন রাজ অতিথি হয়ে লালগোলায়, আসেন এই মন্দিরে। এখানেই তিনি মন্ত্রাবিষ্ট হয়ে বন্দে মাতরম রচনা করেন, এরকম একটি তত্ত্ব আছে।
অনেক পরে নজরুল এই মন্দিরেই এসে কালী সাধনা করেছিলেন বরদাচরণ মজুমদারের উপদেশে। নজরুলের কয়েকটি শ্যামা সঙ্গীত এই লালগোলার কালীমন্দিরে রচিত।
◆◆■■◆◆
লালগোলার অধিষ্ঠাত্রী মা নৃত্যরত। প্রসঙ্গত সেনযুগের সমসাময়িক কর্ণাটকে হয়সালা হালেবিডু মন্দিরে প্রলয়নিত্যরত মহাকালীর একটি অপরূপ মূর্তি আছে। মা নাচলে বুঝি পৃথিবী সেই আন্দোলন, সেই কম্পন সহ্য করতে পারবে না, সেজন্য কি শেকলে বেঁধে রাখা?
অথবা মা ক্ষুধার্ত, জগৎসংসার বুঝি মা এখুনি খেয়ে ফেলবেন, সেজন্য কি মাকে নিরস্ত করার আকুতি আছে এই শেকলে?
অথবা ওই শেকল আমাদেরই প্রপঞ্চ, নিজে অজস্র আবিলতার বেড়ি পরে আছি বলে মাকেও তার মধ্যেই আটকে রাখতে চাই?
মায়ের মূর্তিটি যাতে নৃত্যরত অবস্থায় টলে না যায়, মা যাতে পূজার বেদীতে অটল থাকেন, সেজন্য শেকলে বেঁধে রাখা অবশ্য ভক্তের পুরোনো ছল। মা লক্ষ্মীকে অনেক সময় শেকলে বেঁধে রাখার কথা বলা হত, মা চঞ্চলা বলে।
মায়ের মূর্তিটি ঈষৎ সামনের দিকে ঝুঁকে। যাতে মূর্তি আরও হেলে না পড়ে সেজন্যই শেকল, এমন লৌকিক ব্যাখ্যাও অবশ্য আছে।
মাকে আমরা আমাদের মন্দিরে শেকল বেঁধে রাখতে গেছি, অথচ তিনি তো সমগ্র বিশ্বচরাচরের অধিষ্ঠাত্রী, তিনি বিশ্বজগৎ জুড়ে নৃত্য করছেন, ভক্ত তাও তাঁকে পুঁথির আর শাস্ত্রের আর শ্লোকের শেকলে বেঁধে রাখতে চাইছে। তিনি অব্যক্ত, তবুও মানববুদ্ধির শেকলে তাঁকে বাঁধতে বৃথা প্রয়াস আমাদের, এই অদ্ভুত প্যারাডক্স আমাদের শক্তিসাধনার এক অমূল্য ধাঁধা, আর সেজন্যই লালগোলার মা কালীর কাছে বারবার যেতে হবে আমাদের।
পরিকর পরিবেষ্টিত এই মায়ের মূর্তি আমাদের আবহমানকালের সম্পদ। পাঁচ হাজার বছর আগেকার হরপ্পা সভ্যতায় নৃত্যরত সপ্তমাতৃকা পরিবেষ্টিত আদিমাতা (মহাকালী?)র মূর্তির সামনে ছাগবলির ফলক পাওয়া গেছে। চব্বিশ শো বছর থেকে দুহাজার বছর আগেকার গঙ্গারিডাই সভ্যতায় মায়ের জনপ্রিয় মূর্তিকল্পনায় মা সর্বদাই চার অনুচর দ্বারা পরিবেষ্টিত, সে আবহ আজকের দুর্গা মূর্তির মধ্যেও পরিস্ফুট।
◆◆■■◆◆
লালগোলার কালীমন্দিরে ফলকে বাংলা ১৩১২ সালের উল্লেখ আছে, এই সময় রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ভাবা হয়, কিন্তু এখানে মায়ের অধিষ্ঠান আরও অনেক পুরোনো, এবং ইংরেজি ১৭৯০ সালেই এখানে মায়ের মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল এমন নথি আছে।
অনন্যসাধারণ এই লালগোলার নৃত্যকালী মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকলে রোমাঞ্চ হয়।
জয় জয় মা নৃত্যকালী। জয় জয় মা শেকলকালী। লালগোলার স্থানেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী মা কালীর জয়জয়কার হোক। জয় মা, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে। বন্দে মাতরম!
মায়ের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
No comments