Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

মাতঙ্গী: দশমহাবিদ্যার অন্যতম মাতৃকা, যিনি তন্ত্রের সরস্বতী -তমাল দাশগুপ্ত

মাতঙ্গী: দশমহাবিদ্যার অন্যতম মাতৃকা, যিনি তন্ত্রের সরস্বতী -তমাল দাশগুপ্ত চারণকবি মুকুন্দ দাস লিখেছিলেন, ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ, সমর রঙ্গে...। মা মাতঙ্গী হলেন দশমহাবিদ্যার অন্যতম। সেনযুগে দশমহাবিদ্যা ধারণার…

 




মাতঙ্গী: দশমহাবিদ্যার অন্যতম মাতৃকা, যিনি তন্ত্রের সরস্বতী -তমাল দাশগুপ্ত 

চারণকবি মুকুন্দ দাস লিখেছিলেন, ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ, সমর রঙ্গে...। মা মাতঙ্গী হলেন দশমহাবিদ্যার অন্যতম। সেনযুগে দশমহাবিদ্যা ধারণার মাধ্যমে আবহমানকালের তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃধর্মের একাধিক সুপ্রাচীন মাতৃকার পুনরভ্যুদয় ঘটে। একাধিক মাতৃকার ধারণা উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই রয়েছে, সেখানে ঊষা ও নিশার উপাসনা হত, যা থেকে আজকের দুর্গা কালী এসেছেন। আবার হরপ্পা সভ্যতার একটি ফলকে বলিদানের সময় সপ্তমাতৃকার উপস্থিতি লক্ষণীয়। অতএব জগন্মাতার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন ভিন্ন মাতৃকার রূপকল্প আমাদের সভ্যতায় অনেকদিন ধরেই আছে।


বলা দরকার যে ষষ্ঠ শতকে গৌড়ের উত্থান থেকে ত্রয়োদশ শতকে সেনযুগের অবসান পর্যন্ত অনবরত মাতৃধর্মের নবরূপদান ঘটেছে। হারিয়ে যাওয়া হরপ্পা সভ্যতা থেকে বাঙালির সুপ্রাচীন গঙ্গারিডাই যুগের সভ্যতার একাধিক মাতৃকার নবনির্মাণ করা হয়েছে গৌড় ও বঙ্গে তন্ত্রধর্মের এই মহামন্থনকালে।


বৌদ্ধ জাতকে দেখা যায় মাতঙ্গী হলেন হস্তীদের অধিপতির কন্যা। মাতঙ্গী নামের ব্যুৎপত্তি এই। তিনি রণহস্তী শাসিত একটি সভ্যতার প্রাচীন শক্তিদেবী। অতএব তাঁর আদি উপাসনা উপমহাদেশে হরপ্পা থেকে গঙ্গারিডাই সভ্যতার মধ্যে হাতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্মারক। যদিও সেনযুগে মাতঙ্গী মাতৃকার নবরূপায়ণ সেই হস্তী স্মারক আর ধরে রাখে নি। যেমন বগলামুখী আদিতে বলাকামুখী বলাকামাতৃকা ছিলেন যিনি পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে চন্দ্রকেতুগড় পর্যন্ত অতীব জনপ্রিয়, তিনি যখন সেনযুগে দশমহাবিদ্যা ধারণায় নতুন ভাবে পুনরুত্থিত হলেন তখন সেই বলাকা রূপ আর থাকে নি।


তন্ত্রশাস্ত্রে মাতঙ্গী হলেন সরস্বতী। তাঁর উপাসনায় বাকসিদ্ধি হয়। এই মুহূর্তে পালিত হচ্ছে যে তান্ত্রিক নবরাত্রি, অর্থাৎ মাঘ মাসের গুপ্ত নবরাত্রি, তার সঙ্গে মা মাতঙ্গীর নাম অভিন্ন। এই মাঘী নবরাত্রির পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো হয়।


বাঙালির মধ্যে আর নবরাত্রি সেভাবে পালনীয় নয়, এখন নবরাত্রি বললে মূলত উত্তর ভারতীয় উৎসব বোঝায়, যেখানে পশুবলি নিষিদ্ধ, যা আমাদের তন্ত্রধর্মীয় সভ্যতার মূল আঙ্গিকের বিরোধী। আসলে কিন্তু প্রাচীনকালে এই নবরাত্রি ছিল তন্ত্রাশ্রয়ী ব্রাত্যধর্মের উৎসব। আর্যাবর্তর উৎসব নয়, কোনোমতে বৈদিক নয়। 


মোট চারটি নবরাত্রি হয় এক বছরে। শারদীয়া এবং বাসন্তী নবরাত্রি সর্বজনবিদিত। এছাড়া আষাঢ় মাসে একটি গুপ্ত নবরাত্রি হয়, তন্ত্রের দেবী বারাহী এই সময় পূজিত হন। আরেকটি গুপ্ত নবরাত্রি হয় মাঘ মাসে। এখন মাঘ মাসের গুপ্ত নবরাত্রি শুরু হয়েছে, এই উৎসব তান্ত্রিকদের পালনীয়, এই সময় মাতঙ্গীর উপাসনা হয়।


তন্ত্ররাজতন্ত্রে মাতঙ্গী হলেন বীণাবাদনরত। কালিকাপুরাণও বলে মাতঙ্গীই সরস্বতী, এছাড়া সেখানে তিনি উমার অষ্টযোগিনীর অন্যতম। তন্ত্রসার অনুযায়ী মাতঙ্গী হলেন শ্যামবর্ণা, চন্দ্রশেখরা, ত্রিনয়না। তিনি রত্নসিংহাসনে উপবিষ্ট, তাঁর হাতে অসি, খেটক, পাশ ও অঙ্কুশ।


ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে মাতঙ্গী এভাবে পূজিত:


রক্তপদ্মাসনা শ্যামা রক্তবস্ত্র পরি

চতুর্ভুজা খড়্গচর্মপাশাঙ্কুশ ধরি

ত্রিলোচনা অর্ধচন্দ্রকপালফলকে।


কালীবিলাসতন্ত্রে বলে, সিংহবাহিনী মা দুর্গা, শববাহিনী মা কালী, এবং রক্তপঙ্কজবাহিনী মা মাতঙ্গী একই মহাশক্তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ।


মাতঙ্গীর আরেকটি রূপ হল উচ্ছিষ্ট চণ্ডালিনী, মায়ের এই রূপের বিবরণ দেয় কুলার্ণবতন্ত্র। তিনি বাগদেবী, বাক অর্থাৎ উচ্চারিত শব্দ মনুষ্য ওষ্ঠে উচ্ছিষ্ট হয়, অথচ এই শব্দ অতি পবিত্র। শব্দে আছে ঐশ্বরিক ইন্দ্রজাল। কুলার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে মা উচ্ছিষ্ট চণ্ডালিনী এভাবে বর্ণিত: তিনি বীণাবাদ্যরতা ও বিনোদগীতরতা, নীলবস্ত্রে উদ্ভাসিতা, শুকপক্ষীর মত শ্যামলবর্ণা, তিনি সুস্মিতা।


দক্ষিণ ভারতে একাধিক মাতঙ্গী মন্দির আছে। পূর্ব ভারতে কামাখ্যা পীঠে মাতঙ্গী পূজিত হন। দক্ষিণ ভারতে রাজমাতঙ্গী সহ মায়ের নানা রূপভেদ দেখা যায়।  


পূর্ব ভারতে, উত্তর ভারতে এবং দক্ষিণ ভারতে পূজিত মা মাতঙ্গীর দশটি চিত্র রইল, বেশিরভাগই মধ্যযুগ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে অঙ্কিত বা মুদ্রিত এবং এখন বিদেশের নানা মিউজিয়ামে রয়েছে। প্রথম দুটি বাংলার, তৃতীয়টি উত্তর ভারতের এবং পরের সাতটি দক্ষিণ ভারতের।

জয় জয় মা মাতঙ্গী!

No comments