Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

মা মনসা সম্পর্কে একটি আশ্চর্য তথ্য -তমাল দাশগুপ্ত

মা মনসা সম্পর্কে একটি আশ্চর্য তথ্য -তমাল দাশগুপ্ত
পালযুগে প্রাপ্ত সমস্ত মাতৃমূর্তির মধ্যে সবথেকে বেশি দেখা গেছে সর্পমাতৃকা মনসা অথবা জাঙ্গুলি। মনসাবিস্তার শিরোনামে আমার একটা লেখা এই পেজে পাবেন। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় প্রো…

 




মা মনসা সম্পর্কে একটি আশ্চর্য তথ্য -তমাল দাশগুপ্ত


পালযুগে প্রাপ্ত সমস্ত মাতৃমূর্তির মধ্যে সবথেকে বেশি দেখা গেছে সর্পমাতৃকা মনসা অথবা জাঙ্গুলি। মনসাবিস্তার শিরোনামে আমার একটা লেখা এই পেজে পাবেন। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় প্রোটো মনসা মূর্তি পাওয়া গেছে, সে ছবি দিয়েছি আগে। 


আজ যে বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। মা মনসা যে চাঁদ বণিক কর্তৃক "চেঙ্গমুড়ী" বলে আখ্যায়িত, সেটা স্কুলে বাংলা পড়ার সময় আমরা অনেকেই শুনেছি। স্মৃতিতে এখনও অমলিন হয়ে আছে, যে বাংলার শিক্ষকের মুখে শোনা চাঁদ বণিকের দম্ভোক্তি: যেই হাতে পূজি আমি শিব শূলপাণি, সেই হাতে নাহি পূজি চ্যাং মুড়ি কানি। যেমন শুনেছি তেমন লিখলাম। 


কেতকা দাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে পাওয়া যায় বারবার চাঁদ কর্তৃক বা শত্রু কর্তৃক মা মনসাকে অভিহিত করা হচ্ছে "চেঙ্গমুড়ী কাণী"। 


মা মনসা অবৈদিক এবং ব্রাত্যধর্মীয় তাতে সন্দেহ নেই। মা মনসার ক্ষেত্রে অন্তত "সবই ব্যাদে আছে" বলা যাবে না। না, মা মনসার স্পষ্টতই কোনও বৈদিকত্ব নেই। 


ভারতে মাতৃকা উপাসনা এবং সর্প উপাসনার ঐতিহ্য হরপ্পা সভ্যতা থেকে প্রবহমান। মা মনসা সেই অনাদি তন্ত্রধর্মীয় ঐতিহ্যের স্মারক। অতএব তিনি যে পুরুষতন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হবেন, সেটা খুব একটা আশ্চর্যের নয়। কিন্তু ওই অদ্ভুত শব্দের অর্থ কি? চেঙ্গ বা চ্যাং মাছের মুড়ি বা মাথার মত অবয়ব তো মা মনসার একেবারেই নয়। সমস্ত মূর্তিতে মা মনসার অপরূপ গরিমা ঐশ্বর্য বিভূতি স্পষ্ট। তবে এরকম নাম কেন? 


আসলে, এই চেঙ্গমুড়ী শব্দের সঙ্গে চ্যাং মাছের কোনও যোগ নেই। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন একটি বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ ভাবপ্রকাশ থেকে উদ্ধৃত করে দেখান যে (দাক্ষিণাত্যের ভাষায়) সিজবৃক্ষের আরেক নাম চেংমুড়। এখনও তেলুগু ভাষায় এই সিজবৃক্ষকে বলে চেমুড়। আর এই সিজবৃক্ষকেই চলতি বাংলায় মনসা গাছ বলি আমরা।


অর্থাৎ বৃক্ষবাসিনী মাতৃকার দ্যোতনা হিসেবে এই চেঙ্গমুড়ী শব্দের আদি ব্যবহার।


মা মনসার সঙ্গে এই গাছের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক  বলেই ওই নাম। 


কাণী কেন? সম্ভবত ঐ গাছের কাঁটায় খোঁচা লেগে কিংবদন্তি বা ব্রতকথার কোনও চরিত্রের চক্ষু আহত হওয়ার কোনও একটি প্রাচীন কাহিনী প্ৰচলিত হয়ে থাকবে যেটা মা মনসার ওপরে আরোপিত হয়েছিল। 


মা মনসা, বলা বাহুল্য, বহু প্রাচীন। পালযুগে তাঁর অতীব জনপ্ৰিয়তা, পালযুগেই কানা হরিদত্ত প্রথম পদ্মাপুরাণ লেখেন। কিন্তু সেনযুগের গৌড়বঙ্গ বাঙালির নিজস্ব তন্ত্রধর্মের সহজ সংস্কারের মাধ্যমে মাতৃকা উপাসনায় তন্নিষ্ঠ ছিল, তার প্রমাণ আছে। প্রথম সেন সম্রাট বিজয়সেনের নামাঙ্কিত মনসামূর্তি পাওয়া গেছে বলে জানতে পারছি হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের বই থেকে, যদিও সে মূর্তির বর্তমান অবস্থান বলা নেই।


সেনরা দাক্ষিণাত্য থেকেও সম্ভবত কোনও একজন সর্পমাতৃকার পূজার স্মৃতি বহন করে আনবেন এবং চেংমুড় বা মনসা গাছের অধিষ্ঠাত্রী মাতৃকা হিসেবে মনসার জয়ধ্বনি সম্ভবত সেনযুগে দেওয়া হত, যেটার মূল অর্থ বখতিয়ার পরবর্তী মধ্যযুগে হারিয়ে গেছিল, কিন্তু শব্দটি রয়ে গেছিল। এই প্রসঙ্গে, নীহাররঞ্জনের ভ্রান্ত (কিন্তু সর্বৈব ভুল নয়) মঞ্চাম্মা হাইপোথিসিস স্মরণ করা কর্তব্য: সেনরা দক্ষিণের সর্পদেবী মঞ্চাম্মাকে বাংলায় নিয়ে এসেছেন এবং নাম হয়েছে মনসা এবং সেনযুগে মনসা পূজা শুরু - এই হচ্ছে মঞ্চাম্মা তত্ত্ব। নীহাররঞ্জনের তত্ত্বের সবথেকে বড় গলদ হল সুপ্রাচীন কাল থেকেই সর্পমাতৃকা বাংলায় আছেন, সেটা অস্বীকার, নীহার বলছেন সেনযুগে মনসা পূজা শুরু। যেখানে পালযুগে কানা হরিদত্ত মনসাকে নিয়ে কাব্য লিখছেন সে প্রমাণ স্বয়ং দীনেশ সেন দিয়েছেন। এবং পালযুগে যত মাতৃমূর্তি পাওয়া যায়, তার মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নিঃসন্দেহে মনসামূর্তি। তবে বাঙালির ধর্মের ইতিহাসের বিষয়ে নীহাররঞ্জন খুব একটা দক্ষ নন, তাঁর রাজবৃত্ত ইতিহাসও দায়সারা। তিনি বাঙালির ধর্ম ও বাঙালির রাজারাজড়া - এ দুটোই সম্ভবত কিছুটা অগভীর পাঠ করেছেন।


অতএব আমাদের সিদ্ধান্ত নিম্নপ্রকার:


১. হরপ্পা সভ্যতায় এবং হরপ্পা পরবর্তী ভারতেও মাতৃকা উপাসনা, নাগমাতৃকা উপাসনা এবং বৃক্ষমাতৃকা উপাসনার ধর্ম (শেষেরটি অতি ব্যাপক। হরপ্পা সিলে বৃক্ষবাসিনী যে মাতৃকার কাছে ছাগবলি দেওয়া হচ্ছে তিনি সাধারণত দুর্গা বা কালীর আদিরূপ বলেই চিহ্নিত। কিন্তু ওই গাছটি দেখে মনে হয় মনসা গাছও হতে পারে। উপরন্তু মনসা পূজায় ছাগবলির সার্বজনীন প্রথা বিদ্যমান আমরা জানি) প্রবলভাবে প্ৰচলিত ছিল সাধারণ জনতার মধ্যে, এবং মনসা এই সম্মিলিত ঐতিহ্য থেকে এসেছেন। 


২. মা মনসার সঙ্গে সংযুক্ত গাছটি সংস্কৃত ভাষায় সিজবৃক্ষ, বাংলায় মনসা গাছ, দক্ষিণদেশে চেংমুড়। সেখান থেকে চেঙ্গমুড়ী।


৩. মা মনসার আদিরূপ চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় প্রচলিত ছিল, সেই প্রত্নপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপর গঙ্গারিডাই সভ্যতার পতন ঘটলে বাঙালির আবহমানকালের মাতৃধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে ষষ্ঠ সপ্তম শতকে গৌড়ের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিপুলভাবে মাথা তোলে তন্ত্রধর্ম এবং মাতৃকা উপাসনা। তন্ত্রকে এইজন্য গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা বলা হয়।


তারপর দেখি পালযুগে মনসা উপাসনা অতীব জনপ্রিয়। সম্ভবত বাউড়ি সহ একাধিক যোদ্ধা জাতি এই সময় পালরাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ ছিলেন এবং তাঁরা আজকের মত সেযুগেও মনসা পুজো করতেন। এই পালযুগে দাক্ষিণাত্যের একাধিক উপাদান বাঙালির জাতীয় জীবনে মিশেছিল। পালরা রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে প্রায়ই বিবাহাদি করতেন। সেনরা বাংলায় আগমন করেন পালসৈন্য হিসেবে, পরে পালদের সামন্ত হিসেবে কর্মরত। এই দক্ষিণের চেংমুড় নামের প্রভাবে বাংলায় সর্পমাতৃকার সঙ্গে যুক্ত মনসাগাছটির দক্ষিণী নামে মা মনসার ওই নাম, চেঙ্গমুড়ী, যেটা সেনপতনের পরে মধ্যযুগে একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ হয়ে যায়, মূল অর্থও বিস্মৃত হয়।


বিস্মৃত সেই অতীতের পুনরুদ্ধার আমাদের কর্তব্য।


জয় মা।


© 


পালযুগে গৌড়বঙ্গে উৎকীর্ণ দশম-একাদশ শতকের মা মনসার এই মূর্তিটি যথারীতি বিদেশে চলে গেছে আমাদের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগগুলোর দুর্নীতি এবং বিশ্বমানবিক জুয়াচুরির ফলে। বাঙালি তার মাতৃধর্মের শেকড় সম্পর্কে জানুক, সেটা ওরা চায় না, সেজন্য আমাদের অতীতের অমূল্য প্রত্ন নথি ওরা এভাবে চোরা পাচার করে, এবং আমাদের স্কুল ও কলেজের ইতিহাসের সিলেবাসে বাঙালির আবহমানকালের মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মের কথা জানতে দেয় না। 


ছবি একটি ফরাসি নিলামসংস্থার সাইট থেকে।

No comments