Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রামকৃষ্ণ সেবায়তন ল্পতরু দিবসে সংহতির আহ্বান হলদিয়া এন্কারেজ

রামকৃষ্ণ সেবায়তন ল্পতরু  দিবসে সংহতির আহ্বান হলদিয়া এন্কারেজ
শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। তাঁর গলরোগ প্রবলাকার ধারণ করেছে। চিকিৎসকদের পরামর্শমতো মুক্ত বায়ুযুক্ত স্থান বেছে তাঁকে সেখানে আনা হয়েছে। তিনি এই বাগানবাড়িতে এস…

 



রামকৃষ্ণ সেবায়তন ল্পতরু  দিবসে সংহতির আহ্বান হলদিয়া এন্কারেজ


শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। তাঁর গলরোগ প্রবলাকার ধারণ করেছে। চিকিৎসকদের পরামর্শমতো মুক্ত বায়ুযুক্ত স্থান বেছে তাঁকে সেখানে আনা হয়েছে। তিনি এই বাগানবাড়িতে এসেছেন ১৮৮৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। এই বাগান বাড়ির মালিক গোপাল ঘোষ এবং বাড়িটির সংবাদ আনেন ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত। মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ার চুক্তি হয় এবং চুক্তির মেয়াদকাল ছিল ১৮৮৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ১৮৮৫ সালে জুন মাসে পানিহাটির চিঁড়েমহোৎসবে যোগ দেওয়ার পরই ঠাকুরের গলাব্যথা শুরু। পরে সে ব্যাধি আরও জেঁকে বসে। চিকিৎসা ও ওষুধে কোনও সুফল মেলেনি। তাই তাঁর গৃহী ও ত্যাগী সন্তানদের যৌথ উদ্যোগে তাঁকে কলকাতায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তাঁর চিকিৎসা হয় ভালোভাবে। অন্তরঙ্গদের অনুরোধেই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের লীলাভূমি ও তাঁর আরাধ্যা মা-ভবতারিণীকে ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দেন। কলকাতায় এসে প্রথম ৭ দিন বলরামবাবুর গৃহে এবং তারপর শ্যামপুকুরে গোকুল ভট্টাচার্যের ভাড়াবাড়িতে থাকেন ৭০ দিন। তারপরই কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। এখানে তিনি প্রায় আট মাস অবস্থান করেন।

১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। বছরের প্রথম দিনটি পৃথিবীর সমস্ত শ্রীরামকৃষ্ণ অনুরাগীদের কাছে ‘কল্পতরু দিবস’ হিসাবে পরিচিত। ১৮৮৬ সালের ওই দিনটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানবাটীতে সমবেত গৃহীভক্তদের অযাচিত কৃপা বিতরণ করেছিলেন। ওই দিনটি ছিল ছুটির দিন। বেলা তিনটের মধ্যে গৃহীভক্তগণ শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শনের জন্য বাগানে জমায়েত হয়েছেন। ঠাকুর ওইদিন একটু সুস্থ বোধ করেন এবং সেবক লাটুকে বলেন, পোশাক পরিয়ে বাগানে নিয়ে যেতে। পরনে লালপাড় ধুতি, গায়ে সবুজ রঙের জামা, মাথায় শীতের কান-ঢাকা টুপি, পায়ে মোজা ও বার্নিশ করা চটি। তাঁর মুখ জ্যোতির্ময় ও লাবণ্যপূর্ণ। ভক্তরা কেউ তখন গাছতলায়, কেউ বা পুকুর ধারে আর কেউ বাগানের চারপাশ ঘুরে দেখছেন। ঠাকুর ওপর থেকে নেমে বাগানের মধ্যে হাঁটতে লাগলেন। তাঁকে দেখে ভক্তরা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন তাঁকে প্রণাম জানাতে। সামনেই পেলেন গিরিশচন্দ্রকে তাঁকে দেখে বললেন, ‘তুমি আমাকে অবতার বলে প্রচার কর কেন?’ এ  কথা বলা মাত্রই গিরিশচন্দ্র হাঁটু গেড়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে বসে বলেন, ‘প্রভু! ব্যস, বাল্মীকি যাঁর বর্ণনা করতে অপারগ, আমি তাঁর কথা কি বলব?’ গিরিশের কথা শুনে ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। ততক্ষণে বাগানের সব ভক্তরা সেখানে হাজির হয়েছেন এবং তাঁকে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হয়ে বলেন, ‘আর বেশি তোমাদের কী আশীর্বাদ করব, তোমাদের সকলের চৈতন্য হোক! তোমাদের সকলের মনে আনন্দ জাগ্রত থাকুক।’ তখন বাগান থেকে ফুল নিয়ে ভক্তগণ তাঁর পায়ে অঞ্জলি দিতে লাগলেন আর তিনি সকলকে তাঁর দৈব-স্পর্শ দিয়ে তাঁদের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করে দিতে লাগলেন। এই কৃপা বিতরণে কোন বাছ-বিচার ছিল না। মাস্টার, গিরিশ, রাম, অক্ষয়, অতুল, নবগোপাল, উপেন্দ্র, বৈকুণ্ঠ, দেবেন্দ্র মনোমোহন, রামলাল প্রমুখ সকলেই সেই দৈবস্পর্শে মোহিত হয়েছিলেন। গিরিশ ঘোষ সকলকে ঠাকুরের কাছে ডেকে এনে তাঁদেরও কৃপালাভের সুযোগ করে দেন।  হারান নামে এক ব্যক্তি এবং গাঙ্গুলি পদবির এক পাচক— যাঁরা তাঁর চিহ্নিত ভক্ত নন, তাঁরাও সেদিনের কৃপালাভে কৃতার্থ। তাঁর পরিচিত দু’জন হাজরা ও হরমোহন সেদিন কৃপা লাভ করতে না পারলেও পরে তাঁরাও কৃপালাভে ধন্য হন।

সেদিনের এই ঘটনায় ঠাকুরের কোনও ত্যাগী সন্তান সেখানে ছিলেন না। এই উদ্যোগ কেবল গৃহী অন্তরঙ্গদের মধ্যেই ঘটেছিল। তাঁদের ভক্তিভাব প্রবল, তাঁরাই বিশেষ উদ্যোগী হয়ে ঠাকুরের উত্তম চিকিৎসা ও দ্রুত আরোগ্য প্রত্যাশায় উদ্যানবাটী ভাড়া নিয়েছেন এবং নিজেদের সাংসারিক ব্যয় সংকোচন করে ঠাকুরের সেবাকাজে নিয়মিত অর্থসাহায্য করে চলেছেন। গৃহীভক্তগণের চেতনার অপূর্ণতার কথা ভেবেই হয়তো ঠাকুর সেদিন তাঁদের হৃদয়ে পূর্ণ চেতনা জাগ্রত করেছিলেন। অন্তর্যামী ঠাকুর জানতেন, অচিরেই এক বিসংবাদ সমাজে হাজির হবে এবং তাতে যেন তারা হতবুদ্ধি ও দিশেহারা না হন।

শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আসেন, তখন তাঁর গলরোগের সমস্যা আরও বেড়েছে। সেই কারণে তাঁর নিখুঁত সেবার কথা ভেবে ত্যাগী সন্তানগণ দিবারাত্র সেখানে থাকার সংকল্প নেন। ত্যাগী সন্তানগণ তখন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ফলে অর্থ সাহায্য তাঁদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন গৃহীভক্তগণ। এরমধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত সুরেন্দ্রনাথকে বাড়িভাড়ার দায়িত্ব গ্রহণের কথা বললে তিনি আনন্দিত মনে তা স্বীকার করেন। ভক্ত বলরামকে বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত পথ্যের ব্যয়ভার নিতে। কৃতার্থ হয়ে বলরাম সে দায়িত্ব মেনে নেন। বাকি থাকে অন্যান্যদের খাই-খরচ বাবদ ব্যয়। সে দায়িত্ব নেন প্রধান গৃহীভক্ত কয়জন, তাঁরা চাঁদা তুলে সে অর্থ তুলে দিতেন ত্যাগী সন্তানদের হাতে।

এইকালে শ্রীরামকৃষ্ণের রোগ যেমন বেড়ে চলছিল, তেমনি তিনি তাঁর অন্তরঙ্গদের সংহত করার চেষ্টায় ব্যাকুল ছিলেন। তাঁর এই অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে গৃহী ও ত্যাগী সন্তানগণ। ত্যাগী সন্তানরা সেখানে দিবারাত্র অবস্থান করে তাঁর সেবার দায়িত্ব যেমন নিয়েছিলেন, তেমনই ঠাকুরের নির্দেশমতো ও নরেন্দ্রনাথের ব্যবস্থাপনায় নিজেদের জপ, ধ্যান ও শাস্ত্রপাঠে ব্যস্ত রাখতেন যাতে ঠাকুরের উপস্থিতিতে নিজেদের যথেষ্ট পরিমাণে আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটানো যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের যে ১৬ জন সন্ন্যাসী সন্তানদের নাম আমরা জানি সেকালে তাঁদের সকলেই উদ্যানবাটীতে অবস্থান করতেন না। তাঁদের মধ্যে ১১ জন (নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, বাবুরাম, নিরঞ্জন, যোগীন্দ্র, লাটু, তারক, গোপালদাদা, কালী, শরৎ ও শশী) থাকতেন, বাকিরা বাড়ি থেকে এসে ঠাকুরের সেবা কাজে অংশ নিতেন।

ঠাকুরের শারীরিক অবস্থার তাগিদে বহু গৃহীভক্তও ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গে উদ্যানবাটীতে রাত্রি বাস করে তাঁদের সঙ্গে ঠাকুরের সেবাকাজে অংশ নিতেন। ফলে বাগানের ব্যয়ভার বেড়েই চলছিল। শ্রীশ্রীমায়ের কথাতেও তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়: ‘তখন বাগানে  খুব খরচ হয়। তিনটে রান্না— ঠাকুরের একটা, নরেনদের (ত্যাগী সন্তানদের) একটা আর অপর সবার একটা। চাঁদা করলে টাকার জন্য। তাই চাঁদার ভয়ে একজন আবার ভেগে গেল।’ কার্যত গৃহী সন্তানদের অধিকাংশই ছিলেন চাকুরিজীবী।  সংসারের খরচ কমিয়ে তাঁরা চাঁদা দিতেন ঠাকুরের সেবার জন্য। এই ব্যয় ক্রমশ বেড়ে চলায় রামচন্দ্র দত্ত ক্ষুব্ধও হন। দেয় টাকার হিসাব রাখার কথা জানান ত্যাগী সন্তানদের। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, ত্যাগী সন্তানদের সকলের এখানে থাকার দরকার নেই। এখানে দু’জন থেকে বাকিরা বাড়ি থেকে এখানে যাতায়াত করলেই হবে এবং তাতে ব্যয়ভার ঠিক থাকবে। ত্যাগী গোষ্ঠীর নেতা নরেন্দ্রনাথ রামচন্দ্রের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি মেনে নিতে পারেননি। তিনি সে কথা ঠাকুরের কানে তোলেন। ঠাকুর তাতে দুঃখ পান। তিনি নরেন্দ্রকে জানান যে, সে যেখানে যাবে,  তিনি সেখানেই যাবেন এবং যেমন রাখবে তেমনই থাকবেন। নরেন্দ্র উত্তরে বলেন, ‘আপনাকে আমরা মাথায় করে রাখব, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে খাওয়াব।’ ত্যাগী সন্তানদের ভিক্ষা করার সাহস দেখে ঠাকুর মুগ্ধ হন এবং বলেন, ভিক্ষান্ন বড় পবিত্র। নরেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে কতিপয় সঙ্গীদের নিয়ে ভিক্ষায় বের হন। প্রথম ভিক্ষা নেন শ্রীশ্রীমার কাছ থেকে। ভিক্ষা সেরে ফিরলে ভিক্ষান্ন দিয়েই পাক করেন শ্রীশ্রীমা। ঠাকুর ও সকলে সেই অন্ন গ্রহণ করেন পরিতৃপ্তির সঙ্গে। ঠাকুরের অভিপ্রায় বুঝে নরেন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নেন যে, গৃহীভক্তদের কাছ থেকে আর কোনও অর্থ তাঁরা নেবেন না এবং তাঁদেরও ঠাকুরের কাছে যেতে দেওয়া হবে না। সিদ্ধান্ত মতো কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। নিরঞ্জন দ্বারীর ভূমিকা নেন। গৃহী ভক্তদের মধ্যে নিত্য যাঁদের যাতায়াত ছিল— মাস্টারমশাই, গিরিশ ঘোষ, রামচন্দ্র, অতুল প্রমুখ ব্যক্তিগণ বাগানে  আসেন কিন্তু ঠাকুরের দর্শন না পেয়ে মনোকষ্টে গৃহে ফিরে যান। ত্যাগী সন্তানরা নিয়মমতো ভিক্ষায় বের হয়ে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে নিজেদের খাবার জোগাড় করেন। এক কঠোর-কঠিন বিচ্ছেদের দেওয়াল গড়ে উঠেছিল ঠাকুরের অন্তরঙ্গ দুই গোষ্ঠীর মাঝে।

অন্তর্যামী ঠাকুর সব বোঝেন। এ বুঝি তাঁর এক লীলা। তিনি ভাবেন ত্যাগী সন্তানদের কল্যাণের জন্য গৃহীদের রক্তার্জিত অর্থ ব্যয় ব্যাপারে মিতব্যয়ী হওয়া এবং আরও সংযম শিক্ষার প্রয়োজন। আবার গৃহী ভক্তগণ উদ্যোগী ও উৎসাহী হলেও তাঁদের আরও উদার হওয়া আবশ্যক এবং তাঁদের অবশ্যই জানা উচিত যে, ত্যাগী সন্তানরা সবকিছু ত্যাগ করে উদ্যানে রয়েছে কেবল সেবার জন্য, এ জাতীয় সেবা অর্থের বিনিময়ে পাওয়া যায় না।

লীলাময় ঠাকুর বুঝতে পারেন যে, দুই গোষ্ঠীর বিবাদের জন্য তাঁর গৃহী অন্তরঙ্গগণ ঘরে যন্ত্রণায় অধীর হয়ে প্রহর গুনছে আর ত্যাগী সন্তানগণও ভিক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত থাকায় তাদের মূল উদ্দেশ্যের বিঘ্ন ঘটছে। বৈরীভাবের তিনটি দিন কাটলে ঠাকুর অস্থির হয়ে পড়েন। লোক দিয়ে ডেকে পাঠান সুরেন্দ্র, রাম, গিরিশ প্রমুখ গৃহীভক্তদের। তারা ঠাকুরের কাছে এলে তিনি নরেন্দ্র, রাখাল, লাটু প্রভৃতি ত্যাগী সন্তানদেরও কাছে ডাকেন। তিনি উভয় গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের নানা উপাখ্যান শোনান যার মাধ্যমে উভয় গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা নিজের নিজের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা অনুভব করেন। তাঁরা উভয়েই ঠাকুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ঠাকুর স্বয়ং দুই অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর মাঝে যে বিভেদের অস্থায়ী প্রাচীর গড়ে উঠেছিল সেটি নস্যাৎ করে তাদের মেল বন্ধনকে দৃঢ় করে দিলেন। সেই দিন থেকে ঠাকুর গৃহী ও ত্যাগী ভক্তদের সমশ্রেণিতে উন্নীত করলেন। পরবর্তীকালে সেই আদর্শের ধারা পালন করে ত্যাগী ও গৃহী  ব্যক্তিদের নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের ১ মে তারিখে গঠন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাদর্শবাহী ‘রামকৃষ্ণ সংঘ’।

কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আসার তিন সপ্তাহ পরই তিনি কল্পতরুরূপে হাজির হয়েছিলেন ভক্তদের মাঝে। তিনি তাঁর গৃহী অন্তরঙ্গদের অন্তরে চেতনা জাগ্রত রাখার ক্ষমতা দান করে তাঁদের যেমন কৃতার্থ করেছেন, তেমনই ত্যাগী সন্তানদেরও নানা রূপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাঁদের যাত্রা ঘটিয়ে তাঁদেরও পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন। ঠাকুর বলতেন, ‘জটিলা-কুটিলা ছাড়া লীলা পোষ্টই হয় না’, ‘চাপান-উতোর না হলে, কেবল একতরফার কবি পাঁচালী জমে না।’ ভক্ত হৃদয় ভাবে, হয়তো লীলাময় ঠাকুর এই অস্থায়ী বিরোধ বাঁধিয়ে শেষে দুই অন্তরঙ্গগোষ্ঠীকে ভ্রাতৃপ্রেমের বন্ধনকে দৃঢ় ও মজবুত করে দিয়েছিলেন জীবনের প্রান্তবেলায় কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। তাই বারবার মনে হয় কল্পতরু দিবসের আড়ালেই রয়েছে বুঝি সংহতির আবাহন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন ত্যাগী ও গৃহী ভক্তদের সম্মিলিত প্রয়াস। এ উদ্যোগ ছিল স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণের। এটি তাঁর দক্ষিণেশ্বর জীবনেও যেমন দেখা গিয়েছে, কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রোগশয্যায় থেকেও সেই প্রচেষ্টার কোনও ঘাটতি ছিল না। একবার অসুস্থ ঠাকুরের জন্য আঙুর নিয়ে গিয়েছেন গৃহীভক্ত কালীপদ ঘোষ। আঙুর দেখে ঠাকুর খুশি হলেন। আঙুরের বাক্স নিজের পাশে রেখে ভক্তদের বিতরণ করলেন। প্রথমে দিলেন ত্যাগী সন্তানদের নেতা নরেন্দ্রকে, তারপর হরির লুটের মতো ছড়িয়ে দেন উপস্থিত ভক্তদের মাঝে। ঠাকুরের অনুরাগী বালক ক্ষীরোদ ঠাকুরের অনুমতি নিয়ে গঙ্গাসাগর যেতে চান। ঠাকুর সানন্দে অনুমতি দেন। শহরে শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। বালক ক্ষীরোদ শীতে কষ্ট পাবে বলে চিন্তা ঠাকুরের। মণিকে (মাস্টারকে) বললেন কম্বল কিনে দিতে। গৃহী ও ত্যাগী সকলেই ঠাকুরকে বেষ্টন করে নব উদ্দীপনায় নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উঠেপড়ে লড়ছেন। ঠাকুর মণিকে জিজ্ঞেস করেন— ‘আচ্ছা, ছোকরাদের একি হচ্ছে বলো দেখি? কেউ শ্রীক্ষেত্র পালাচ্ছে— কেউ গঙ্গাসাগরে।’ 

নরেন্দ্রনাথের পিতৃ বিয়োগ ঘটেছে কিছুকাল হল। সংসারে চরম দারিদ্র্য নেমে এসেছে। সে চিন্তাও তাঁকে পীড়িত করে তুলছে। নরেন্দ্রর মনঃকষ্ট দেখে মাস্টার সমব্যথী হন। তিনি নরেন্দ্রকে একশো টাকা দিতে চান গোপনে। নরেন্দ্রনাথ সে কথা ঠাকুরের কাছে ব্যক্ত করেন। বলেন, এখানকার একজন বন্ধু বলেছেন, আমায় একশো টাকা ধার দেবেন। সেই টাকাতে বাড়ির  তিনমাসের বন্দোবস্ত করে আসব। নরেন্দ্রর মুখে এই কথা শুনে ঠাকুর মাস্টারের দিকে তাকান। তিনি অন্য কথার অজুহাতে স্থান ত্যাগ করেন।

১৮৮৬ মার্চ মাস। ঠাকুরের ব্যাধি বৃদ্ধির মুখে। গভীর রাত। ঠাকুরের শারীরিক কষ্ট বাড়ছে। তাঁর ত্যাগী সন্তানরা চিন্তায় আকুল। রাতে ঠাকুরের কাছে রয়েছেন তাঁর ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গে মাস্টার ও গিরিশ ঘোষ। এপ্রিল মাস পড়ে গিয়েছে। গরমে ঠাকুরের কষ্ট বেড়েছে। তাই হাতপাখা দিয়ে তাঁকে বাতাস করতে হয়। গৃহী সন্তানদের কেউ হাজির হলে ত্যাগী সন্তানদের হাত থেকে তালপাখা নিয়ে নিজেই লেগে যান সেবার কাজে। ত্যাগী ভাইদের বিশ্রামের সুযোগ দেন। ঠাকুর বুঝি মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি দিতে চান। ডাক্তার রাজেন্দ্র  দত্ত ঠাকুরের চিকিৎসা করতে এসে ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। ঠাকুরের পায়ের মাপ নিয়ে নতুন জুতো কিনে আনেন।

নববর্ষের দিন বহু মহিলা ভক্ত (বলরামের পরিবার, মণির পরিবার, বাগবাজারের ব্রাহ্মণী ও আরও অনেকে) তাঁদের শিশুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ঠাকুরকে দেখতে। তাঁরা প্রথমে শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে দেখা করেন, তারপর আসেন ঠাকুরের কাছে। দেহে প্রচণ্ড জ্বালা— তবু তাঁদের দেখে শিশুর মতো হাসেন ঠাকুর। অফিসের বড় দায়িত্ব সামলাতে হয় ভক্তপ্রবর সুরেন্দ্র মিত্রকে। অফিসের কাজ সামলে সেখান থেকে সোজা কাশীপুর হাজির হয়েছেন রাত আটটায়। ফুল, মালা, ফল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘আজ পয়লা বৈশাখ, আবার মঙ্গলবার, কালীঘাটে যাওয়া হল না। ভাবলাম, যিনি কালীকে ঠিক চিনেছেন, তাঁকে দর্শন করলেই হবে।’ সুরেন্দ্রর কথায় ঠাকুর হাসেন। সুরেন্দ্র আবার বলেন, ‘গতকাল আসতে পারিনি, সংক্রান্তি ছিল। আপনার ছবিতে ফুল দিয়ে সাজালুম।’ ঠাকুর সঙ্কেতে মণিকে জানান— ‘আহা কী ভক্তি!’

গিরিশ ঘোষ এসেছেন সকালবেলায় ঠাকুরকে দেখতে। ঠাকুর সন্তানদের বলেন, আলমবাজার মোড়ের ফাগুর দোকানের কচুরি আনতে। কচুরি এলে তা ঠাকুরের সামনে রাখা হয়। তিনি প্রসাদ  করে দেন। হঠাৎ দেখা যায় থালা থেকে একটা কচুরি তুলে নিয়ে গিরিশচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খাও, বেশ কচুরি!’

এই সময়ই মাস্টারের পুত্রবিয়োগ ঘটে। তারজন্য স্ত্রী নিকুঞ্জদেবীর উন্মাদিনী। মাস্টার বললেন, ‘ও আপনার কাছে এলে ঠিক থাকে, বাড়িতে ভীষণ ব্যারাম!’ ঠাকুর তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিন এখানে (কাশীপুরে শ্রীশ্রীমার কাছে) রাখার জন্য বলেন। মাস্টার অম্লানবদনে সে নির্দেশ মেনে নেন।

ঠাকুরের অসুখ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন গৃহী সন্তানরা ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গে রাত জেগে সেবার দায়িত্বে অংশ নিতে চান। এই দলে ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গে ছিলেন— মাস্টার, গিরিশ, অতুল আরও অনেকে। এই সময়ই গৃহী সন্তান সিন্ধুদেশবাসী হীরানন্দ কাশীপুরে ঠাকুরকে দেখতে হাজির হন। লাহোর থেকে ছুটে আসেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। ঠাকুরের রোগ নিরাময়ের জন্য রামচন্দ্রের চিন্তার শেষ নেই। শেষমেশ ঠাকুরকে দেখার জন্য আনা হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ডাক্তার কোটসকে। ঠাকুরের সমাধি দর্শন করে তিনি ধন্য হন। ডাক্তারকে পারিশ্রমিক দিতে গেলে তিনি তা গ্রহণ না করে ঠাকুরের সেবার জন্য ব্যয় করতে বলেন।

বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কাশীপুর জীবন পর্বে রোগশয্যায় শায়িত থেকেও এক বৃহৎ কর্মকাণ্ডকে সুচারু রূপে সংগঠন করে গেলেন। ত্যাগী সন্তানদের যেমন জ্বলন্ত সন্ন্যাস আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর অন্তরঙ্গ গৃহী সন্তানদের মনেও নানা সৎ অভিপ্রায়ের বীজ বপন করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর পৃথিবীর মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে। ত্যাগী সন্তানদের মতোই তাঁর গৃহী অন্তরঙ্গ— কেদার, মহেন্দ্র (শ্রীম) বলরাম, গিরিশ, বিজয়কৃষ্ণ, রামচন্দ্র, দুর্গাচরণ নাগ, নবগোপাল ঘোষ প্রমুখের মনে উদার মহত্বের বিকাশ ঘটিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে দুই গোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস ও প্রার্থনা তাকে সার্থকতার তীর্থে পৌঁছে দিয়েছে।

No comments