ওমিক্রন কতটা দুশ্চিন্তার?
লিখেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ জ্যোতির্ময় পাল ও স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক ডাঃ শ্বাম্ব সম্রাট সমাজদার।
সার্স কোভ ভাইরাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মিউটেশন বা পরিবর্তন। আর …
ওমিক্রন কতটা দুশ্চিন্তার?
লিখেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ জ্যোতির্ময় পাল ও স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক ডাঃ শ্বাম্ব সম্রাট সমাজদার।
সার্স কোভ ভাইরাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মিউটেশন বা পরিবর্তন। আর এই কারণেই সারা বিশ্ব এখন প্রবল উদ্বেগে আছে এই মারণ ভাইরাসের নতুন মিউটেন্ট স্ট্রেন ‘ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট’কে নিয়ে।
৩২টি মিউটেশন
প্রত্যেক ভাইরাসের মতোই সার্স কোভ করোনা ভাইরাস, নিজেদের পরিবর্তন করে যাচ্ছে অনবরত। মিউটেশন হল ভাইরাসের জেনেটিক কোডের পরিবর্তন। এই মিউটেডেড ভাইরাসকেই ‘ভ্যারিয়েন্ট’ বলা হয়। কিছু করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট, অন্যদের তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে এবং সহজে ছড়ায়। এর জন্য সংক্রমণের হারও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সংক্রমণের এইরূপ বৃদ্ধিতে অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এমনকী মৃত্যুও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে কমপক্ষে ৫০টি পরিবর্তন হয়েছে, যার মধ্যে ৩২টি মিউটেশনই হয়েছে স্পাইক প্রোটিনে।
নম্বর ৬১৪
স্পাইক প্রোটিন হল ভাইরাসের সেই অংশ, যা মানুষের কোষে ভাইরাসটিকে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন ভাইরাসের মূল স্ট্রেনের তুলনায় অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টে দেখতে পাওয়া অনুরূপ মিউটেশনগুলি উচ্চতর সংক্রমণযুক্ত এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এই ভ্যারিয়েন্ট স্ট্রেনটির ক্ষতিকারক প্রভাব সম্বন্ধে এখনও আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। মিউটেশনগুলি অক্ষর এবং সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যেমন ডি৬১৪জি—যার অর্থ ভাইরাল স্পাইক প্রোটিনের ৬১৪ নম্বর অবস্থানে একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড ডি থেকে জি-এ পরিবর্তিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মধ্যে পাঁচটি ভ্যারিয়েন্টকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন’ বা ভিওসি এবং আটটি ভ্যারিয়েন্টকে ভ্যারিয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট বা ভিওআই হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই নামের কারণ
২০২১ সালের মে থেকে, আলফা দিয়ে শুরু হওয়া গ্রিক বর্ণমালার অক্ষর অনুসারে তাদের নামকরণ করা হয়েছে। এই অনুসারে পরবর্তী অক্ষর নেওয়া উচিত ছিল ‘Nu’ এবং তার পরবর্তী ‘Xi’ । কিন্তু হু’র মতে, ‘Nu’ খুব সহজেই ‘New’ (নিউ) এর সঙ্গে গুলিয়ে যায় এবং ‘Xi’ টি খুবই সাধারণ উপাধি। ঠিক এই কারণেই ১৫তম অক্ষর, ওমিক্রনকে (Omicron) ব্যবহার করা হয়েছে।
ধোঁয়াশা এখনও
হু’র মতে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিশ্বব্যাপী বিপদ অনেক বেশি। এই মুহূর্তে, ডেল্টা ভাইরাস, যা অক্টোবর ২০২০ সালে ভারতে প্রথম পাওয়া যায়, সব থেকে প্রভাবশালী স্ট্রেন। এই স্ট্রেনই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে করোনা আক্রান্ত করেছে। রবিবার হু বলেছে, এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন আরও সংক্রমণযোগ্য এবং ক্ষতিকারক কি না। এইক্ষেত্রে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে টিকাগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ এও ইঙ্গিত করছে যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট থেকে ফের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু এই মুহূর্তে তথ্য খুবই সীমিত। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মহামারী বিশেষজ্ঞ সেলিম আব্দুল করিমের কথায় কিছুটা ভরসা পাওয়া যায়। তিনি জানিয়েছেন, এই ভাইরাস সংক্রমণে ইতিমধ্যেই টিকাপ্রাপকদের ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কম থাকে। বিশ্বে ওমিক্রন কতটা প্রভাব ফেলবে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানীরা সে সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন। কিন্তু যদি প্রভাব বেশি হয়, টিকানির্মাতা সংস্থাগুলিকে ভ্যাকসিনের ফর্মুলা পরিবর্তনও করতে হতে পারে। সেই বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা শুরুও হয়ে গিয়েছে।
ডেল্টা এবং ওমিক্রন
অন্যান্য সম্ভাবনার মধ্যে ওমিক্রন; আলফা, বিটা, ল্যাম্বডা, গামা, মিউ এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের পথেই যেতে পারে। ভ্যারিয়েন্টগুলির উদ্বেগজনক মিউটেশনের ফলে ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আরও সংক্রমণযোগ্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাবের পর সেগুলি বিলুপ্তির দিকে চালিত হয়েছিল। সংক্রমণের দিক থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বেশ বিপজ্জনক ভাইরাস। সময়ই বলবে ওমিক্রন কতটা বিপজ্জনক হবে। এখনও অবধি বিশেষজ্ঞদের মতামতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে ওমিক্রন অতটা বিপজ্জনক হবে না। অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট; যেমন মিউ-এর মিউটেশনের ক্ষমতা সার্স কোভ ২-এর অ্যান্টিবডির ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। কিন্তু ইমিউনিটি কমানোর ক্ষমতা কখনওই যথেষ্ট ছিল না। এই কারণেই দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে যখন প্রথম মিউ ভ্যারিয়েন্ট এল, তখন তা প্রথম দু’এক সপ্তাহ চর্চার বিষয় ছিল। তারপরই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে তা হারিয়ে গিয়েছিল।
উৎস
এখনও অবধি ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উৎস কাররই জানা নেই। এর উৎস ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে না হলেও, এর মধ্যে কিছু ডেল্টার মিউটেশনের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ল্যাবরেটরি টেস্ট এবং জেনেটিক অনুসন্ধানের পরও বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি যে ওমিক্রন কতটা বিস্তার করতে পারবে। হয়তো এটা সম্ভব যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ধীরে ধীরে জনসংখ্যায় বিকশিত হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নজর এড়িয়ে গেছে। আরও একটি সম্ভাবনা হল, ইমিউনো কম্প্রমাইজড রোগীর শরীরে দীর্ঘদিন ধরে থাকার জন্য এভাবে বিবর্তিত হয়েছে করোনা ভাইরাস।
নানা মুনির নানা মত
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বা কনভালেসেন্ট প্লাজমার মধ্যে দিয়ে চিকিত্সা করাকালীন একটি ভাইরাস স্ট্রেন নিজেকে মিউটেশন করার জন্য সচেষ্ট থাকে। এই ক্ষেত্রে বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা করা দরকার। আবার অনেকের মতে পশুদের থেকে এই ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি হয়েছে। একদল বিজ্ঞানী পরামর্শ দিয়েছিলেন যে এখানে পাওয়া মিউটেশনের একটি ভ্যারিয়েন্ট আগে মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি।
কিছু বিজ্ঞানীর মতে, করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে প্রাণীর মধ্যে যেতে পারে এবং সম্ভবত আবার ফিরেও আসতে পারে। এই ধাঁধাটি বোঝার জন্য মানব এবং পশু স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।কিছু করোনা ভাইরাসের মিউটেশন তাদের জেনেটিক কোডকে পরিবর্তন করে তাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই মিউটেশনগুলি তাকে আরও দুর্বলও করে তুলতে পারে। তাই সময়ই বলবে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আসল প্রভাব কী হতে চলেছে।
মেনে চলুন করোনা বিধি
এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হল ভ্যাকসিনেশন, সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব, হাত ধোওয়া এবং হাঁচি কাশির সময় শিষ্টাচার পালন করা। মানুষের মনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, সকাল সন্ধ্যা আরটিপিসিআর টেস্ট করছি, তাতে রোগটি ধরা পড়বে কি না। হু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, কোভিড আরটিপিসিআর-এর মধ্যে দিয়েই আমরা মিউটেশন ধরতে পারব। দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শরীরে এই নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গ খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে ভ্যারয়েন্টটি বেশি মাত্রায় সংক্রামক।
পূর্বাভাস
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আরও ভালোভাবে এই ভ্যারিয়েন্টটির প্রভাব বোঝা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই এখনই খুব ভয় পাওয়ার দরকার নেই। যে কোনও ভাইরাস মিউটেশনের পরে দুই রকমের আশঙ্কা থাকে। সে অতিমাত্রায় সংক্রামক হয়ে ওঠে কিন্তু মানব শরীরে তার ক্ষতিকারক প্রভাব কম হয়। অথবা তার মানবশরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব বেড়ে যায়। ফলত, সংক্রামক ক্ষুধা কমে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম থাকে। সংক্রামক ক্ষমতা এবং শরীরে ক্ষতি করার প্রভাব দুটোই বৃদ্ধি পায়। যেমনটি হয়েছিল ডেল্টার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে আমরা আশা করব ওমিক্রন হয়তো খুব বেশি পরিমাণে সংক্রামক ক্ষমতা সম্পন্ন হবে, কিন্তু মানবশরীরে ক্ষতি করার ক্ষমতা তার কমই থাকবে। এভাবেই হয়তো আমরা হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়ে যাব।
No comments