Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

আত্মপূজা ... ও কিছু বিধান

নিজের পূজা করাই ভাল | তবে আত্মপূজারও কিছু বিধিবিধান থাকা কাম্য, কর্তব্যও বটে, নইলে তা অহংসাধনায় পর্যবসিত হবে |
বেদান্তবুদ্ধিতে স্থিত হলে, অর্থাৎ, আত্মদর্শন হলে আত্মপূজা করায় দোষ নেই | নির্বিকল্প সমাধিতে সাধকের ব্রহ্মানুভূতি হয় যখন…

 







নিজের পূজা করাই ভাল | তবে আত্মপূজারও কিছু বিধিবিধান থাকা কাম্য, কর্তব্যও বটে, নইলে তা অহংসাধনায় পর্যবসিত হবে |


বেদান্তবুদ্ধিতে স্থিত হলে, অর্থাৎ, আত্মদর্শন হলে আত্মপূজা করায় দোষ নেই | নির্বিকল্প সমাধিতে সাধকের ব্রহ্মানুভূতি হয় যখন, তিনি স্বীয়স্বরূপ পরিলক্ষণে নিজের পার্থিব দেহগত, মনোগত সত্তাকে ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়ারূপে দর্শন করেন ও বাকি জীবন আত্মচৈতন্যে আনন্দে বিহার করেন | তখন আত্মপূজা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার থাকে না কারণ তিনি ভূতে ভূতে আত্মসাক্ষাৎকার করতে থাকেন | সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তখন নিজেরই প্রসারিত সত্তারূপে প্রতীত হয় | তখন আত্মপূজা ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না | কিন্তু তার আগে তা করা বিপদসংকুল | সংসারসাগরে ডুবে যেতে হবে সাধককে অহংরূপ মায়ার তুফানঝড়ে |


ধর্মসাধনার প্রাথমিক কাল হতে অদ্বৈতানুভূতির শেষ স্তরে উন্নীত হওয়া পর্যন্ত আমরা শাস্ত্রনির্ধারিত পদ্ধতিতে আত্মসাধনাই করে থাকি | আরাধ্যদেবকে নাম দি মহাপ্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বরাদি | বাস্তবিক নিজের (আত্মার) কল্পনারই এগুলি নানা রূপ | নিজের দেহমনবিশিষ্ট মানবসত্তা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্রহ্মাণ্ডও এই আত্মার অথবা ব্রহ্মের রূপকল্পনা | আব্রহ্মস্তম্ভ আপেক্ষিকতা, সবই ব্রহ্মের মায়িক প্রকাশ | আমরা, তথাকথিত মানুষরাও, সেই মায়িক প্রকাশেরই অন্তর্গত, অর্থাৎ, বস্তুতঃ মিথ্যাসত্তা | আমাদের সত্য হল মায়াতীত ব্রহ্মসত্তা | এই সত্যটির উপলব্ধি ও তাতে অবস্থান হল ব্রহ্মজ্ঞানলাভ ও ব্রাহ্মীস্থিতি | এই ব্রহ্মই আমাদের স্বরূপ, আমাদের অন্তরতম সত্তা ও একেই যথার্থ 'আমি' বলা যেতে পারে সূক্ষ্ম মায়িক সহায়তায় কারণ ব্রহ্ম বাক্যমনের অতীত নিঃশব্দসত্তা | ভাষা তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না | অতএব, যে মুহূর্তে 'আমি' শব্দটি ব্যবহার করছি, সেই মুহূর্তে মায়ার কারাগারে আবদ্ধ হচ্ছি | তাই ব্রহ্মজ্ঞানী নিশ্চুপ হয়ে যান, নিজের শরীরমন থেকে আন্তর্সত্তার স্বাতন্ত্র উপলব্ধি করে দেহটাকে 'এই শরীরটা' ইত্যাদি নানা শব্দের দ্বারা অভিহিত করেন কিন্তু 'আমি' শব্দটি বড় একটা বলেন না |


অতএব, দুটি 'আমি' | একটি হল আত্মা, অপরটি অহং, একটি বস্তু, অপরটি মায়িক প্রকাশ, অবস্তু | অহংকে উপলক্ষ্য করে আত্মারূপ লক্ষ্যে পৌঁছানো, এইটিই বিবর্তনের গতি, এইটিই মানবদেহে শিক্ষা, সংস্কৃতি,স্বাধ্যায় ও সাধনার দ্বারা প্রাপ্তব্য বস্তু |


প্রশ্ন হল তাহলে রচনাটির আদি বক্তব্যটি কি তাহলে অবান্তর ? তা নয় | দৃষ্টির তারতম্যহেতু কারুর কাছে গ্রাহ্য, এমনকি অপরিহার্য, আবার কারুর কাছে ধর্তব্যের বিষয়ই নয় | এ তো গেল বৈচিত্রময় জগতের বিচিত্র বিচার | কিন্তু সত্যবোধটি কি ?


মানুষের বিবর্তনের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় মানুষের বিস্ময়বোধ নিশ্চয় ছিল কিন্তু অতিপ্রাকৃতিক দ্বৈত ঈশ্বরবোধ, অনুস্যুত দ্বৈত ঈশ্বরবোধ ও একত্ববোধস্বরূপ অদ্বৈতব্রহ্মবোধ তার যুগ যুগান্ত পরে এসেছে | প্রাথমিক অবস্থার কিছু যুগ পরে হয়ত বা বিবর্তনের দ্বারা, অভিজ্ঞতার দ্বারা আদি, নিরালম্ব, বর্বর মানুষেরও কোনও অস্ফুট ঈশ্বরবোধ থেকে থাকতে পারে |


হঠাৎ কোনও বোধের উদয় হয় না | বোধেরও বিবর্তন আছে | জৈবরাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার দ্বারা ক্রমবিকশিত মানবদেহের, স্নায়ুতন্ত্রের ও মস্তিষ্কের গ্রহীতাশক্তি ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হয়েছে ও ধীরে ধীরে ক্ষীণ পরিবেশজিজ্ঞাসা, জীবনজিজ্ঞাসা ও পরিশেষে আদিম আত্মজিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়েছে মানবমনে | এরই ফলশ্রুতি ভাবিকালের মত, পথ, পন্থা, ধর্ম ইত্যাদি |


বন্য মানুষের ধর্ম বাধ্যতামূলকভাবে কিছু বন্য নয় আর তথাকথিত সভ্য মানুষের ধর্মও কিছু সংজ্ঞাগত কারণে সভ্য নয় | কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যেই আছে আত্মজিজ্ঞাসা, ক্ষীণাকারে অথবা স্পষ্টতরভাবে | অবশ্য, মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ স্বর্গান্বেষী, রাজনৈতিক, স্বৈরাচারী মতের কথা স্বতন্ত্র | সেখানে বর্বর রাজনীতি আছে কিন্তু ধর্ম -- যেরূপ আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পালন করে থাকি -- ও ধর্মতত্ত্ব বা দর্শন, তার চিহ্নমাত্র নেই | তার থেকে প্রাচীনতর ধর্মগুলি সর্বদিক দিয়ে উৎকৃষ্টতর | এমনকি বন্যদের ধর্মও অনেকাংশেই কম হিংস্র ও অধিক দরদী, গূঢ় অধ্যাত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞনতা সত্ত্বেও কারণ বন্যরা বর্বর হলেও সরল, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনুন্নত ও বিরাট বিশ্ব সম্বন্ধে অচেতন | তাঁরা তাঁদের নিজগণ্ডিতে যেমন ভৌগলিকভাবে সীমাবদ্ধ, তেমনি তাঁদের হিংসাও উপজাতিয় দ্বন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ | প্রযুক্তিগত বিবর্তনের অভাবে তাঁরা পৃথিবীর মানসিক ও বৌদ্ধিক আবহাওয়াকে বিষাক্ত করতে পারেননি | তাছাড়া, আগেই বলেছি, বন্যরা পরিবেশগতভাবে কতকটা হিংস্র হলেও, তাঁরা সরল ও প্রায়শঃই দরদী | তাঁদের ধর্ম আদিম হলেও আবশ্যিকভাবে বর্বর নয়, রাজনৈতিক কারণে বানানো নয় | তাঁদের আরাধ্য দেবদেবীও তাঁদেরই বন্য পরিবেশ থেকে উদ্ভূত যা তাঁদের সরল কল্পনাশক্তির প্রকাশ কিন্তু তা তথাকথিত সভ্য বন্যের কল্পিত বিষাক্ত বিধাতা নন যাঁর বিধান সর্বমানবের ওপর বলপূর্বক প্রযোজ্য | ফলে বন্যদের ধর্মবিশ্বাস সভ্য সমাজের তথাকথিত অভ্রান্ত ধর্মের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক মানবিক ও সত্যনিষ্ঠ |


No comments