Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

আলোর পথযাত্রী --- রদ্যাঁ: “শিল্পীর পরিচয় তো বিশেষণে হয় না, তার পরিচয় হয় বিশেষ্যে তার কাজে”-

: আলোর পথযাত্রী --- রদ্যাঁ:                “শিল্পীর পরিচয় তো বিশেষণে হয় না, তার পরিচয় হয় বিশেষ্যে তার কাজে”-জীবন খাতার প্রতিটি পাতায় যিনি লিখছিলেন এই কথাগুলি, তিনি হলেন শিল্পী ফ্রাসোঁয়া অগুস্ত রেনে রদ্যাঁ। পিতা পারিসিন জা ব…

 



: আলোর পথযাত্রী --- রদ্যাঁ:

                “শিল্পীর পরিচয় তো বিশেষণে হয় না, তার পরিচয় হয় বিশেষ্যে তার কাজে”-

জীবন খাতার প্রতিটি পাতায় যিনি লিখছিলেন এই কথাগুলি, তিনি হলেন শিল্পী ফ্রাসোঁয়া অগুস্ত রেনে রদ্যাঁ। পিতা পারিসিন জা ব্যপ্তিস্ট রদ্যাঁর ছত্রছায়ায় প্রস্ফুটিত করে তুলছিলেন তার স্বপ্ন কুসুমকে। কিন্তু যে আধারে তার আকৃতি প্রকৃতি বিকশিত হচ্ছিল ,সেই আধার ক্রমশ তার চারপাশে জড়িয়ে নিচ্ছিল অন্ধকারের সামিয়ানাকে। নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাসে মহাজনের চক্রান্তে পাপা রদ্যাঁ নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিলেন প্যারির বস্তিতে। এই দুর্বিসহ জীবনের শৃঙ্খলাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে নিয়ে জন্ম নিলেন রদ্যাঁ।


মাত্র চার বছর বয়সে প্রকাশিত হতে থাকে তার সুপ্ত প্রতিভা। একাডেমিক শিক্ষার হাঁসফাঁস করা গণ্ডি শেষ করে মাত্র চার বছর বয়সে ছোটদি মেরির প্রচেষ্টায় রদ্যা খুঁজে পেলেন তার নিজস্বতা। বোঁ আৎ ছিল সেই সময়ের প্যারীর সবচেয়ে বড়ো সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পয়সার অভাবে কপালে সেদিন জুটলো না ঘি। অগত্যা পেতি- এ কোলের গুরু লেকক হলেন তার শিক্ষাগুরু। নকলনবিশির বাইরে গিয়ে এক নতুন ধারা স্মৃতিনির্ভর শিল্পে জোর দিলেন এই ভিন্ন ধাঁচার মানুষটি। চলার পথে শেখালেন  শিল্পী চোখ দিয়ে দেখে না বা হাত দিয়ে আঁকে না, দেখে হৃদয় দিয়ে, আঁকে মস্তিষ্ক দিয়ে। যা রসোত্তীর্ণ তাই শিল্প। এইভাবে লেকক্ রঁদ্যার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে যাচ্ছিলেন বিন্দুতে সিন্ধুকে ধরার প্রয়াস।


গ্রীক যুগ থেকে রেনেসাঁ অতিক্রম করে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত যে ভাস্কর্য চিন্তা ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলছিল, তার পরিণতি হলো রদ্যাঁ । পুরোনো ফর্মকে ভেঙ্গে অর্থাৎ অনুকরণীয় প্রাচীনপন্থী ধারণাকে ভেঙ্গে নতুন ভাবনার জোয়ার আনলো যে নতুন কল্লোল গোষ্ঠী তার শরিক হলেন রদ্যাঁ । যদিওএর আদি সুরী মানে। ক্লদ মনেট ,পল সেজান, এদগাদ দেগা ,এদের পথ ধরেই এলেন রদ্যাঁ । শিক্ষক লেকক রদ্যাঁর সামনে যে বার্তা রেখেছিলেন তাকেই পাথেয় করে পথে চলেছিলেন রদ্যাঁ । ওল্ড মাস্টাররা হচ্ছেন সিড়ির ধাপ। থাপন জুড়ে বসে পড়ার জন্য নয় বরং তারা ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কালজয়ী উপাদানাগুলিকে খুঁজে বের করে রূপ দেওয়াই ছিল তাঁর শিল্পের লক্ষ্য। রদ্যাঁ ছিলেন সত্যের পূজারী। সুন্দর তাই ডানা মেলে ধরা দিয়েছিল তার মনের খাঁচায়। যা তিনি তৈরি করেছিলেন তার জন্য উজাড় করে ঢেলেছিলেন কর্মনিষ্টা। আকাঙ্খারা রূপ পেয়েছিল জ্ঞান আর মনোসংযোগে মাধুর্যে। আজীবন তিনি বিশ্বাস করে এসেছিলেন শিল্পের সুনির্দিষ্ট তাকে। রদ্যাঁ তার শিল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছিলেন ক্লাসিকাল যুগ থেকে, গ্রীক উপকথা থেকে। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁকে নতুন যুগচেতনায় রূপায়িত করতে। পৌরাণিক কাহিনী থেকে বিষয় নিয়ে মানুষ ও মানুষের মনের অনুভূতিকে ভিত্তি করে রস রূপ সৃষ্টি করাই ছিল তাঁর শিল্পের মূল লক্ষ্য। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় সমস্ত ভাস্কর্য হয়ে উঠত ব্যথা ;বেদনা; হাসি; কান্নার এক জীবন্ত আলেখ্য। 


রদ্যাঁ আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো হয়ে উঠত তাঁর সৃষ্টির উৎস। সমস্ত সৃষ্টির পশ্চাতে তিনি রেখে যেতেন একটা সূত্র, যে সূত্র ধরে মালা গাঁথার অবকাশ থাকতো দর্শকের। ছেনি হাতুড়ি চালিয়ে ভাস্কর্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হতো দর্শককেই। এমনই একটি ভাস্কর্যের নিদর্শন হলো অর্ফিয়াস।পত্নিবিরহা অর্ফিয়াস।  পৌরাণিক কাহিনীর ফর্ম ভেঙ্গে ব্যাথাতুর বীণাবাদক অর্ফিয়সের বীনাকে তিনি রাখলেন অসমাপ্ত। সর্পদংশনে মৃত পত্নীর দুর্ভাগ্যকে সঙ্গীতের জাদুতে পরিণত করলেও দুর্ঘটনাজনিত ব্যথায় তার আঙ্গুলগুলোকে রদ্যাঁ তৈরি করলেন ক্ষয়িতভাবে। অনুশোচনার আগুনে গলে পড়ছে তাঁর আত্মদহন মোমবাতির মতন।

মাইকেল অ্যাঞ্জেলার পথ ধরে এগিয়ে রদ্যাঁ উপলব্ধি করলেন মানবদেহ সুন্দর, তাকে রেখেঢেকে শিল্পের দোহাই দিয়ে বিচিত্র ঢংয়ে বিকৃত করা অপ্রয়োজন। দর্শকমাত্রই এখানে খুঁজে নেবে শিল্পীর শিল্পবস্তু। নগ্নতায় আছে সৌন্দর্য নেই যৌনতা। ওটা তো দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক। অর্থাৎ যদি কেউ নগ্ন দেহের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে না পারে তবে তা তার সংরক্ষণশীল মানসিকতাকেই পরিচয় করায়। রদ্যাঁ ব্রাসেলসে নিস্ট নামে এক সৈনিকের আদলে গড়লেন তারুণ্যের অবক্ষয়, ভ্যানকুইস্ট, এক দন্ডায়মান তরুণ। যার ডান হাত দুঃখ; কষ্ট; ক্ষোভ ;অপমানে ;মাথার চুল ছিঁড়ছে, অন্য হাতে যষ্ঠি প্রমাণ করে তবুতো ভেঙ্গে পড়া চলবে না।

রদ্যাঁর এই ন্যুড ভাস্কর্য সেদিন সমাজে তুলেছিল ঝড়। যে ঝড় তাঁকে ব্রাসেলস থেকে প্যারি পর্যন্ত তাড়িয়ে বেরিয়েছিল। 

দ্বিতীয় ন্যুড বাইবেলের ইভ। যাকে রদ্যাঁ প্রতিষ্ঠা করলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবনায়। তার ভাস্কর্যে ইভ পলায়নরতা নয়। বরং ঊনবিংশ শতকের নতুন শিল্পদৃষ্টি দৃপ্ত লোকে হাসিকান্না ব্যথা বেদনায় ভরা নতুন স্বর্গে প্রবেশে ইচ্ছুক এক নারী। রদ্যাঁর তাঁর মনের কথাগুলিকে রূপ দিয়েছিলেন ভাস্কর্যে। স্বর্গ আছে কল্পনায়। নরক চোখের সামনে।

রদ্যাঁ তার ভাস্কর্যে আরেকটি বিশেষত্ব নিয়ে এসেছিলেন। তা হলো গতিময়তা। গতির ঝড় যেন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তাঁর শিল্পে। জন দি ব্যাপটিস্ট এই গতিময়তার নিদর্শন। জনের দুই পা ভূমি স্পর্শ করে থাকলেও দেহের গতিময়তা লক্ষ্য করার মতো। এই গতিময়তা মানুষের মনের মধ্যেও সৃষ্টি করে গতির ঝড়।

                 যে বিষয় না রাখলে রদ্যাঁর ভাস্কর্যের পরিধি পরিপূর্ণতা পায় না তা হলো নরকের দ্বার। ফ্লোরেন্সের ঘিবার্টির ব্রোঞ্জ তোরণের স্বর্গদ্বার অনুকরণে নির্মিত নরকের দ্বার। কারণ রদ্যাঁ মনে করতেন নরক আছে চোখের সামনে। অনাহার অত্যাচার সব কিছুর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই নরক দ্বার এর তোরন। ভাস্কর্যের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য মনুমেন্ট কোয়ালিটি যাকে রদ্যাঁ আনলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে। বলজ্যাক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আকৃতিতে বড় নয় অথচ বলিষ্ঠ গঠন, বসার ভঙ্গি ,মুখের ভাব ভঙ্গি মার মধ্যে লুকিয়ে আছে তার ব্যক্তিত্ব। এগুলি ছিল ততটাই সহজ যতটা বাস্তবধর্মী।                                                          ,অবশেষে বলা যায় রদ্যাঁ কে বুঝতে হলে ধরতে হবে সময়কে। ঊনবিংশ শতক ছিল অবক্ষয়ের যুগ। শিল্পীরা রিয়ালিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে জন্ম দিলো এক নতুন দর্শন আর্ট ফর আর্ট শেখ। কিন্তু যারা জীবনবিমুখ হতে পারল না তারাই ছিল সে যুগের শিল্পীর দের মধ্যে প্রগতির বাহক। রদ্যাঁ রিয়ালিজম কে নতুন রূপ দিলেন। শুরু হলো শিল্পে নতুন সময়ের যাত্রা। ৭৭ বছরের জীবনে রদ্যাঁ নির্মাণ করেছিলেনছোট-বড় বহু ভাস্কর্য। যেমন আমরা জানি মহান মানুষের মৃত্যু হয় না ঠিক তেমনি রদ্যাঁ ও বেঁচে আছেন আমাদের অন্তরে। চির অপরাজেয় রদ্যাঁ শেষ যুদ্ধ বিজয়ী হয়ে রইলেন।

No comments