ফুরিয়েছে রাজার আমল। তাই নেই রাজা ও রাজত্বও। কিন্তু, বর্গভীমা মায়ের মন্দিরে আজও তলোয়ারকে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির প্রতীক হিসেবে মহাষষ্ঠীতে পুজো করা হয়। প্রজার মঙ্গল কামনায় রাজবাড়ির পক্ষ থেকে পুজোর সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। রাজবাড়ি…
ফুরিয়েছে রাজার আমল। তাই নেই রাজা ও রাজত্বও। কিন্তু, বর্গভীমা মায়ের মন্দিরে আজও তলোয়ারকে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির প্রতীক হিসেবে মহাষষ্ঠীতে পুজো করা হয়। প্রজার মঙ্গল কামনায় রাজবাড়ির পক্ষ থেকে পুজোর সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। রাজবাড়ির নামেই মন্দিরে শুরু হয় প্রথম পুজো। আনুমানিক ১৪০৩ বছর আগে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির কুমারীরা দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। রানিরা আরতি করতেন। রাজবাড়ির পুজোয় পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। রাজাই হতেন পুজোর প্রধান অতিথি। ন’দিন ধরে রাজবাড়ির পুজো চলত। মহাষ্টমীর দিন অস্ত্র পুজোর চল ছিল। রাজবাড়ির বর্তমান আটচালা আসলে একটা সময় দুর্গামণ্ডপ ছিল বলে মনে করা হয়। সময়ের সারণী বেয়ে এখন রাজবাড়ির পুজো সর্বজনীন চেহারা নিয়েছে। ওই পুজো তমলুক শহরে আদি তাম্রলিপ্ত সর্বজনীন দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। তমলুক থানার সামনে রাজবাড়ির ময়দানে এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য তথা তমলুক পুরবোর্ডের চেয়ারপার্সন দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় রাজ পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে রাজবাড়ির পুজো এখন তমলুক শহরে আকর্ষণীয় সর্বজনীন পুজো হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গতবছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে ওই পুজোর উদ্বোধন করেছিলেন।
তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। রাজবাড়ির পুজোয় নিষ্ঠা ও ভক্তির বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। একটা সময় মহিষ বলি দেওয়া হতো। এখন তা হয় না। সপ্তমী, সন্ধি ও নবমীতে রাজবাড়ির পক্ষ থেকে তিনটি পাঁঠা বলি দেওয়া হয় বর্গভীমা মায়ের মন্দিরে। সন্ধিপুজোর সময় ১০১টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। ঘড়ির কাঁটা ধরে সময় মেনে অঞ্জলি দেওয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাম্রলিপ্ত রাজ পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রাজবাড়ির ময়দানে এসেছিলেন। সেইসময় ক্ষুব্ধ ব্রিটিশরা রাজবাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সামনে কামান বসিয়ে দিয়েছিল। আতঙ্কে রাজবাড়ির সদস্যরা গোপনে হুগলিতে কাছারি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেজন্য পুজোয় কয়েক বছর ছেদ পড়ে যায়।
সকলের মঙ্গল কামনায় রাজবাড়ির পক্ষ থেকে পুজো দেওয়া হয়। প্রতীক হিসেবে তলোয়ার ও পুজোর সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয়। সেই তলোয়ারকে রাজশক্তির প্রতীক মেনে পুজো করা হয়। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এই পুজোকে ঘিরে মেলা বসে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। কিন্তু, করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে গতবছর থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ। বিরাট মাঠজুড়ে মেলা বসবে। তার প্রস্তুতি চলছে। রাজ্যের সেচ ও জলপথ দপ্তরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র এবার পুজোর উদ্বোধন করবেন। এছাড়াও প্রশাসনিক আধিকারিক, বিধায়ক ও অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের থাকার কথা। মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে।
রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য দীপেন্দ্রনারায়ণবাবু বলেন, এখন আর রাজস্ব নেই। কোষাগারে টান ধরেছে। তবুও সাধ্য অনুযায়ী রাজ পরিবারের পুজো হয়ে আসছে। টানা ১২ বছর রাজবাড়ির পুজো আদি তাম্রলিপ্ত সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা সর্বজনীন চেহারা নিয়েছে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি ময়দান। এই ময়দানেই মায়ের আরাধনা করা হয়। আগমনি মেলা বসে। সকলের মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে পুজো নিবেদন করা হয়। এক সময় পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এখন পুজোর ব্যাটন পুরুষদেরই হাতে থাকে।
No comments