Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শহিদ অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-সন্দীপ চক্রবর্ত্তী

"আমি পারব না নিরীহ একটা জীবকে হত্যা করতে । কিন্তু স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, আর প্রাণ নিতেও মোটেই মায়া হবে না " এই কথা গুলি যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি হলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী মহিল…

 




 



 "আমি পারব না নিরীহ একটা জীবকে হত্যা করতে । কিন্তু স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, আর প্রাণ নিতেও মোটেই মায়া হবে না " 

এই কথা গুলি যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি হলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার । মহিলা শহিদ অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্বাধীনতা সংগ্রামের নারী সমাজের অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন ।  প্রীতিলতা কিন্তু অগ্নিাময়ী অগ্নি শিখার মতাে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের । শুধু এগিয়ে আসাই নয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরােভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি ।

মাস্টারদার বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে যে বীরাঙ্গনার নাম জড়িত ছিলেন তিনি হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার । প্রীতিলতা ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পূর্বে বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন ।

জন্ম :

৫ ই মে ১৯১১ সাল, চট্টোগ্রাম।

আত্মবলিদান :

২৪ শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সাল।

১৯১১ সালে ৫ ই মে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভা দেবী । প্রীতিলতার ডাকনাম রাণী, ছদ্মনাম হলো ফুলতারা ।

তার ছাত্রজীবন কাটে প্রথমে ঢাকায় ও পরে কোলকাতায় । ঢাকায় থাকার সময়েই সেখানকার বিপ্লবী সংগঠন দীপালী সঙেঘর সংস্পর্শে আসেন । কোলকাতায়ও ছাত্রী সংঘের উৎসাহী কর্মী ছিলেন । তিনি ঢাকা বাের্ডে আই , এ , পরীক্ষায় মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন । বি.এ. পরীক্ষায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন ।

চট্টগ্রামে ফিরে এসে নন্দনকানন স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার পদে যােগ দেন তিনি । 


প্রীতিলতা যে অতুলনীয় কর্মকুশলতার পরিচয় রেখে গেছেন সামাজিক ক্ষেত্রে কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা সহ ভারতীয়  নারীসমাজ সেজন্য অনন্তকাল গর্ব অনুভব করবে তার জন্যে । সে সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে উৎসাহী মহিলা কর্মীর সংখ্যা ছিল খুবই কম , ছিলনা বললেই চলে । বিপ্লবী দমনের নামে ব্রিটিশ পুলিশরা নিষ্ঠুর ভাবে অত্যাচার করত । নারীত্বের অবমাননা করত তাই সহজে কোন মহিলা বিপ্লবী দলে যােগ দিতে চাইতেন না ।


মাস্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রামে উমাতারা উচ্চ ইংরাজি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেন সেখানে প্রতিলতা মাষ্টারদার কাছে শিক্ষকতার বৃত্তি  নিয়েছিলেন । এই সময়ে তিনি সমাজ সেবার  সাথে সাথে তার ছাত্রদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবার কাজ শুরু করলেন  । এইভাবে তার  অনুগামীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তিনি ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম রিপাবলিকান আর্মি নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন । এই সংগঠনের প্রশিক্ষক যােদ্ধাবাহিনী মাষ্টারদার নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ ই এপ্রিল অল্পস্বল্প  অস্ত্রশস্ত্রকে সম্বল করে ব্রিটিশ শাসকের শক্তির উৎস দুর্ভেদ্য অস্ত্রাগার আক্রমণ করে । সাময়িকভাবে বিদ্রোহ সফল হয়েছিল । বিপ্লবীদের তৎপরতায় চট্টগ্রাম সারা ভারতের বিপ্লবতীর্থ বলে পরিচিত হয় উঠেছিল সেই সময় । সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদার নেতৃত্বে ৬৫ জন সাহসী যুবক নিয়ে দুটি অস্ত্রাগার ও পুলিস লাইন একযােগে আক্রমণ করে দখল করেন ।

চট্টগ্রামে মাষ্টারদার দলই  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে  সর্বপ্রথম ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ইউনিফর্ম পরে সম্মুখ সমরে  যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজও দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে ।

মাষ্টারদার বিপ্লবীদলেরই অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রীতিলতা । অস্ত্রাগার দখলের আগে মাষ্টারদার নির্দেশে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করে ছিলেন । অস্ত্রাগার দখলের পরে মাষ্টারদা তার ৬০ জন অনুগামী যােদ্ধাকে নিয়ে শহর ছেড়ে পাহাড়ী অঞ্চলে চলে যান । গোপন আশ্রয় নিলেন জালালাবাদ পাহাড়ি  অঞ্চল।

১৯৩০ সালে ২১ শে এপ্রিল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ করে । দুই পক্ষে মধ্যে প্রায় সারাদিন ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় । বিপ্লবীদের কয়েকজন প্রাণ হারান । শেষ পর্যন্ত মাষ্টারদা অনুগামীদের নির্দেশ দেন, যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যান আর যাঁরা চিহ্নিত হয়েছেন  তারা যেন জেলা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগােপন করেন । মাষ্টারদা নিজেও সেই সময় আত্মগোপন করেন ।জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈনাদের সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরে প্রায় তিন বছর ধরে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন ।  বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাষ্টারদাকে আড়াল করে রাখা । অস্ত্রাগার আক্রমণের পরে প্রীতিলতা দলের বৈপ্লবিক কাজের ভার পান । তিনি জেলে বন্দি ও জেলের বাইরের আত্মগােপন করে থাকা বিপ্লবীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যােগাযােগ রাখতেন । মাষ্টারদা যখন ধলঘাটে আত্মগোপন করে ছিলেন সেই সময় প্রীতিলতা তার সঙ্গে মেশাযােগ রক্ষার দায়িত্বভার পালন করেছিলেন  ।১৯৩২ সালের জুন মাসে ধলঘাটে বিপ্লবী দলের সঙ্গে  ব্রিটিশদের সংঘর্ষ হয়, এই সংঘর্ষে ব্রিটিশ পক্ষের ক্যাপ্টেন  ক্যামেরুন মৃত্যু হয় এবং বিপ্লবীদলের সদস্য নির্মল সেন ও অপূর্ব সেনে শহীদ হয়েছিলেন । সেই সময় বেগতিক বুঝতে পেরে মাষ্টারদা ও প্রীতিলতা ঘটনাস্থল ছেড়ে পালিয়ে যান। পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে এবং পুলিশের হাত থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয় । এরপরই সরকার থেকে প্রীতিলতাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয় । চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে পাহাড়তলির স্টেশনের কাছে ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিলো ব্রিটিশদের প্রমোদ কেন্দ্র । আর বিপ্লবীদলের লক্ষ্য ছিল পাহাড়তলীর ইউরােপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা  কিন্তু প্রস্তুতি শুরু করেও এই কাজ সম্পূর্ণ করা যায় নি । মাষ্টারদা এই আরাধ্য কাজটি সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব দেন প্রীতিলতাকে । চট্টগ্রামের সাহেব মেমনের ক্লাব সম্পর্কে প্রীতিলতাই প্রথম মাষ্টারদার কাছে অভিযােগ জানিয়েছিলেন । দেশের মানুষদের সঙ্গে সাহেবরা যে দুর্ব্যবহার করে , তার উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য তিনি মুখিয়ে ছিলেন ।

এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিলো......

"কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ"।

 যা দেখে প্রীতিলতা সহ বিপ্লবীদের শরীরের রক্ত আগুন হয়ে ফুটতে থাকে।

সেই ক্লাব ১৯৩২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর, শনিবার, আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা সূর্য সেন । নেত্রী হিসাবে বেছে নেন প্রীতিলতা কে । পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন ।  সন্ধ্যার পর ক্লাবে জমে উঠল ফুর্তি আর নাচ - গানের আসর । ক্লাবের বাইরে প্রহরীরা যার যার নির্দিষ্ট স্থানে প্রহরারত । তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে প্রীতিলতা তার সহযােদ্ধাদের চারদিকে ছড়িয়ে দিলেন । বিপ্লবীর লক্ষ্য একটাই কর্তব্যসাধন নয়তো আত্মবলিদান । মাষ্টারদার এই শিক্ষা রক্তের সঙ্গে ধমনীতে প্রবাহিত । নানা দিকে ছড়িয়ে আছেন অপর সহযােদ্ধারা ।

ক্লাবের ভেতরে উন্মত্ত উল্লাসে মেতে উঠেছে সাহেব মেমের দল । জানালার আড়াল থেকে সবই দেখতে পাচ্ছেন প্রীতিলতা । প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটির চারপাশ ঘিরে ফেলে আক্রমণ শুরু করেন প্রীতিলতা হুইসেল শোনামাত্র বিপ্লবীরা গুলিবর্ষণ শুরু করেন । ব্রিটিশদের সাথে প্রবল গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষ শুরু হয়। গুলির লড়াইয়ে এক ইংরেজ নিহত হয় আর দু পক্ষের আহত হয় অনেকে প্রীতিলতার শরীরে একটা গুলি লাগে। বেগতিক দেখে অন্য বিপ্লবীদের নেত্রী নির্দেশ দেন নিরাপদ স্থানে চলে যেতে । এরপর প্রীতিলতা কে ব্রিটিশ পুলিশ দেখতে পেয়েগেলে

প্রীতিলতা স্থানত্যাগ করবার আগেই ইতিমধ্যে খবর পেয়ে পুলিসবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ক্লাব চত্বর । নির্ভীক নেত্রী কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না । দেখতে পেলেন তাকে দেখে পুলিস ছুটে আসছে গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল । তাই পুলিসকে বাধা দেওয়া গেল না । কিন্তু তার জীবিত দেহ স্পর্শ করার কোনো সুযােগও তাদের দিলেন না তিনি । মৃত্যুকে তাে নিজের সঙ্গেই বেঁধে রেখেছিলেন প্রীতিলতা । তাই পটাসিয়াম সায়ানাইড সঙ্গেই রেখেছিলেন তিনি । পুলিস তার কাছে এগিয়ে আসার আগেই প্রীতিলতা  পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দিলেন এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন । প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল । ব্রিটিশ শাসকের পুলিসবাহিনী বীরাঙ্গনা প্রীতিলতার প্রাণহীন দেহটাই নিয়ে গেল । ১৯৩২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর, শনিবার মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশের সেবায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বধীনতা আন্দোলন কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বা তরান্বিত করেছিলেন ।প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রথম মহিলা বিপ্লবী শহীদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন । আজ তাঁর আত্মবলিদান দিবসে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

No comments