Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

‘রাজরাণী থেকে তপস্বিনী’-রানা চক্রবর্তী

গ্রাম বাংলার এক অতি দরিদ্র পরিবার থেকে এসে, একেবারে অতি ধনশালী জমিদার বাড়ির গৃহিনীরূপে রাসমণি দেবী, সব কিছুই মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের গুণে। এক পরিচিত সামাজিক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত এক অপরিচিত সামাজিক পরিবেশে আত্মপ্রকাশের দ্…

 




                                            

গ্রাম বাংলার এক অতি দরিদ্র পরিবার থেকে এসে, একেবারে অতি ধনশালী জমিদার বাড়ির গৃহিনীরূপে রাসমণি দেবী, সব কিছুই মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের গুণে। এক পরিচিত সামাজিক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত এক অপরিচিত সামাজিক পরিবেশে আত্মপ্রকাশের দ্বারা রাসমণি দেবী বাস্তব জীবনের সত্য আদর্শকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং অনভ্যস্ত আচরণকে নিজের অভ্যাসের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসমণি দেবীর জীবনের ভাগবত-চেতনাগত শুদ্ধতার স্পর্শে তাঁর শ্বশুরালয় যেমন ঐশ্বর্যের সাথে মাধুর্যমণ্ডিত ও সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠেছিল, তেমনই তাঁর শ্বশুরালয়ও তাঁকে গৃহলক্ষ্মীরূপে বরণ ক’রে তাঁর দুর্বার প্রভাবকে স্বীকার করে নিয়েছিল। তাঁর শ্বশুরালয়ের সবাই - শ্বশুর, শাশুড়ী, স্বামী প্রভৃতি গুরুজন এবং অন্যান্য আত্মীয়জন - রাসমণি দেবীর চালচলনে ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দেব-দ্বিজে তাঁর অপরিসীম ভক্তি, পূজা-আহ্নিকে তাঁর গভীর নিষ্ঠা, অতিথিসেবা ও দীন-দুঃখীর অভাবমোচনে তাঁর সতত আগ্রহ, প্রভৃতি নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, রাসমণি দেবী সকলের শ্রদ্ধা ও স্নেহের পাত্রী হয়েছিলেন। ‘প্রীতিরাম মাড়’, তাঁর শেষজীবনে অমন গুণময়ী, সুলক্ষণা পুত্রবধূর স্বমহিমায় অধিষ্ঠানের দৃশ্য দর্শন ক’রে অতি মাত্রায় সুখী হয়েছিলেন। প্রীতিরাম তাঁর পুত্রবধূকে এতটাই স্নেহ করতেন যে, কন্যাসমা বৌমা রাসমণিকে না দেখলে, বা তাঁকে কাছে না পেলে তিনি অধীর হয়ে পড়তেন। শ্বশরের সেই পরম স্নেহ তাঁকে তাঁর নিজের পিতার অনুপস্থিতির কথা ভুলতে সাহায্য করত। আবার, প্রীতিরামের সংসারে পুত্রবধূরূপে রাসমণি দেবীর আগমনের পর থেকেই, প্রীতিরামের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জমিদারীর আয় ক্রমশঃ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সুলক্ষণা পুত্রবধূর আগমনের দরুনই সেই অর্থগিম - এই ধারণায় রাসমণি দেবীর প্রতি প্রীতিরামের একটি বিশেষ টানও ছিল। যেদিন থেকে রাসমণি দেবী শ্বশুরালয়ে পা রেখেছিলেন, সেদিন থেকেই তিনি প্রত্যহ শ্বশুর-শাশুড়ীর ‘পাদোদক’ পান ক’রে, তবেই অন্নগ্রহণ করতেন। আবার ‘পতি পরম গুরু’ জ্ঞানে রাসমণি দেবী সর্বদাই তাঁর স্বামী ‘রাজচন্দ্রের’ সেবা করতেন। পিত্রালয়ে থাকার সময় থেকেই রাসমণি দেবী সকল প্রকার গৃহকর্মে সুনিপূণা হয়ে উঠেছিলেন; তাই শ্বশুরালয়ে গিয়েও তিনি সেখানকার সব কাজের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। ফলে, সকাল থেকে গভীর রাত অবধি তাঁর কাজের বিরাম থাকত না। ঠাকুর-ঘর পরিষ্কার, ফুল তোলা থেকে শুরু করে রান্নাঘরে গিয়েও তিনি রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করতেন। বাড়িতে দাসদাসী থাকা সত্ত্বেও সব কাজেই রাসমণি দেবী ব্যস্ত থাকতেন বলে স্নেহময়ী শাশুড়ীও তাঁর কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে সে সব কাজ থেকে তাঁকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিতেন বটে, কিন্তু সংসারের কাজকে সেবার মনোভাব নিয়ে করবার দরুন, রাসমণি দেবী কারুর নিষেধই শুনতেন না। এই ভাবে সব কাজ তত্ত্বাবধানের মাঝেও রাসমণি দেবী প্রতিদিন নিয়মিতভাবেই পূজাহ্নিক ক’রে যেতেন। বাড়ির দাসদাসীদেরও রাসমণি দেবী খুব আদরযত্ন করতেন এবং তাঁরাও তাঁদের রাণীমাকে, ‘রাণী’র মতই সম্মান করতেন। তাঁদের যা কিছু, আব্দার, অভিযোগ - সমস্তই তাঁরা তাঁদের রাণীমার কাছে পেশ করতেন এবং তিনিও ধৈর্য্যের সঙ্গে তাঁদের সব কথা শুনে যথাসাধ্য তাঁদের আব্দার পূরণ করতেন। স্বামী রাজচন্দ্রও রাসমণি দেবীকে সকল বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। এইভাবেই শ্বশুরালয়ে রাসমণি দেবী তাঁর শ্বশুর শাশুড়ীর জীবদ্দশাতেই সকল কর্তৃত্বের অধিকারিণী হয়ে, নিজের কাজের দ্বারা অন্তরের পুষ্টির আনন্দে ধীরে ধীরে নিজেকে আরো শ্রীময়ী ক’রে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন। রাসমণি দেবীর সঙ্গে বিবাহের পর থেকেই বাবু রাজচন্দ্র দাসেরও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল এবং অজস্র অর্থাগম শুরু হয়েছিল। একবার ‘এক্সচেঞ্জ’ অফিসের নীলামে, নিজের বুদ্ধিবলে তিনি একদিনেই ৫০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। ওভাবে প্রায়ই তাঁর প্রভূত অর্থ উপার্জন হোত। এছাড়াও, তাঁর জমিদারীর আয় ও ব্যবসায়ের আয়ও ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। রাসমণি দেবীর সঙ্গে বিবাহের পরে রাজচন্দ্র, বাণিজ্যিক-সম্ভারপূর্ণ জাহাজগুলি কিনে ব্যাবসা করার ফলে অতুল ধনৈশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। যেদিন ব্যবসা থেকে তাঁর ২০/২৫ হাজার টাকা লাভ না হত, সেদিন তাঁর আয় অতি অল্প হ’ল ব’লে তিনি মনে করতেন। কোন কোনদিন তিনি লক্ষাধিক টাকাও আয় করতেন। তাঁর যা কিছু ঐশ্বর্য, সবই তিনি তাঁর বুদ্ধিবলে উপার্জন করেছিলেন। অপরকে ঠকিয়ে কোনদিন কোন অর্থ রোজগারের চেষ্টা তিনি করেননি। রাজচন্দ্র, নিজের সেই প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তির মূলে তাঁর ভাগ্যলক্ষ্মী স্ত্রী রাসমণি দেবীর সুলক্ষণ সমূহকে স্বীকার করতেন এবং সেইমত তাঁর স্ত্রীর প্রতি তিনি বিশেষ অনুরাগ পোষণ করতেন। সেই সময় রাজচন্দ্র, কলকাতার মধ্যে যে সব জমি ও বাড়ি কিনেছিলেন বা প্রস্তুত করিয়েছিলেন, সেগুলো ছিল - (১) ১২-রাসেল স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (২) ২-পোলক স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (৩) ৭৪-ধর্মতলা স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (৪) ৭৫-ধর্মতলা স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (৫) ৭৫/১-ধর্মতলা স্ট্রিট: কুঠি, আস্তাবল সমেত জমি, (৬) ৭৬-ধর্মতলা স্ট্রিট: কুঠি ও জমি, (৮) ৭৭-ধর্মতলা স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (৯) ৩-ফ্রি স্কুল স্ট্রিট: জমি, (১০) ৪-ফ্রি স্কুল স্ট্রিট: দোকান সমেত জমি, (১১) ৫১-ফ্রি স্কুল স্ট্রিট: কুঠি ও দোকান সমেত জমি, (১২) ৭১-ফ্রি স্কুল স্ট্রিট: কুঠি সমেত জমি, (১৩) ৭২-ফ্রি স্কুল স্ট্রিট: দোকান সমেত জমি, (১৪) ১-ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (১৫) ১৬-মার্কেট স্ট্রিট: জমি, (১৬) ১৭-মার্কেট স্ট্রিট: দোতলা কুঠি সমেত জমি, (১৭) ৩৮-৩৯-৪০-মার্কেট স্ট্রিট: জমি, (১৮) ৮-ওয়েলেসলি স্ট্রিট: জমি, (১৯) ২৫-ওয়েলেসলি স্ট্রিট: দোকান সমেত জমি, (২০) ২৬-ওয়েলেসলি স্ট্রিট: জমি, (২১) ২৪-চৌরঙ্গী স্ট্রিট: দোতলা বাড়ি সমেত জমি, (২২) ১২-মার্কুইস স্ট্রিট: দোকান সমেত জমি, (২৩) ২-কিড স্ট্রিট: তিনতলা বাড়ি সমেত জমি, (২৪) ৩-কোবার্ন লেন: জমি, (২৫) ১৫-মটস লেন: জমি, (২৬) ৪৫-মটস লেন: কুঠিবাড়ি সমেত জমি, (২৭) ৪-গোয়ালটুলী: জমি, (২৮) ৫-গোয়ালটুলী: বস্তি, (২৯) ৪-উমাচরণ দাস লেন: জমি, (৩০) ৭-উমাচরণ দাস লেন: জমি, (৩১) ৩৬-নীলমণি হালদার লেন: গুদাম ও জমি, (৩২) ১২-কোড়া বরদার লেন: বস্তি, (৩৩) ৯-দত্ত লেন: বস্তি, (৩৪) ৬৪-ডাক্তার লেন: দোতলা বাড়ি সমেত জমি, (৩৫) ১-রামহরি মিস্ত্রি লেন: জমি, (৩৬) ১৬- মিশ্রী খানসামা লেন: জমি, (৩৭) ১২-শাঁখারীটোলা লেন: জমি, (৩৮) ১০-মির্জাপুর লেন: গুদাম সমেত জমি, (৩৮) ৪৭-মনোহর দাস স্ট্রিট: কুঠি সমেত জমি, (৩৯) ১-মুন্সী সদরদ্দী লেন: জমি, (৪০) ১-শরীফ দপ্তরি: বস্তি, (৪১) ২০১-২০৫-পুরাতন চীনা বাজার: দোতলা বাড়ি সমেত জমি, (৪২) ৯-তালতলা: বস্তি, (৪৩) ৮৭-তালতলা: বস্তি, (৪৪) ১৮-জানবাজার: দোকান সমেত জমি, (৪৫) ৩৭-৪৬-১১২-১১৫-জানবাজার: বস্তি, (৪৬) ৬৪, ১২৫ ও ১৩০-জানবাজার স্ট্রিট: জমি, (৪৭) ৯৯-জানবাজার স্ট্রিট: কুঠি সমেত জমি, (৪৮) বেলেঘাটা: বাজার, বাগান, কুঠি, জমি ও পুষ্করিণী, (৪৯) ভবানীপুর: যদুবাবুর বাজার, (৫০) কালীঘাট: বাগান, কুঠি, পুষ্করিণী ও গঙ্গার ঘাট, (৫১) সিঁথি: বাগান ও পুষ্করিণী। এখানে উল্লেখিত জমি ও কুঠিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আবার অত্যাধিক মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন - ‘রাসেল স্ট্রীটের’ জমি ও কুঠী সেই সময় প্রায় দু’লক্ষ টাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন  নিয়েছিল। এ ছাড়াও, মফঃস্বলের ‘ঘিপুকুর’, ‘জগন্নাথপুর’, ‘মকিমপুর’ ও ‘কলরা হোসেনপুর’ - এই চারটি মহলের আয়ও প্রচুর ছিল। সুতরাং নিজের শ্বশুরালয়ে রাসমণি দেবী সত্যিই রাণীর মর্যাদা নিয়েই ‘রাণী’ হয়ে বসেছিলেন।                                       

প্রীতিরামের জীবদ্দশাতেই রাসমণি দেবীর তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। রাসমণি-রাজচন্দ্র দাসের প্রথমা কন্যা ‘পদ্মমণি’র জন্ম হয়েছিল ১২১৩ বঙ্গাব্দে, তাঁদের দ্বিতীয়া কন্যা ‘কুমারী’র জন্ম হয়েছিল ১২১৮ বঙ্গাব্দে এবং তৃতীয়া কন্যা ‘করুণাময়ী’র জন্ম হয়েছিল ১২২৩ বঙ্গাব্দে। ১২২৪ বঙ্গাব্দে প্রীতিরামের দেহ ত্যাগের পরে, ১২২৬ বঙ্গাব্দে রাসমণি দেবীর একটি মৃত পুত্র হয়েছিল, রাসমণি দেবীর চতুর্থ, তথা কনিষ্ঠা কন্যা ‘জগদম্বা’র জন্ম হয়েছিল ১২৩০ বঙ্গাব্দে। প্রীতিরাম ১২২৪ বঙ্গাব্দে (১৮১৭ সালে) তাঁর মৃত্যুকালে, সাড়ে ছ’লক্ষ টাকার ধনসম্পত্তি ও জমিদারী রেখে গিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী ‘যোগমায়া দেবী’ জীবিতা ছিলেন। প্রীতিরামের মৃত্যু উপলক্ষ্যে তাঁর পুত্র রাজচন্দ্র, বহু আড়ম্বরে পিতৃশ্রাদ্ধ সমাধা করেছিলেন। নানাস্থান থেকে আগত ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, ভাটভিখারী, অনাথ, আতুর প্রভৃতিকে তিনি দান, পান, ভোজন ও সামাজিক বিদায়ে পরিতুষ্ট করেছিলেন। এর কিছুকাল পরে, রাজচন্দ্রের মাতা ‘যোগমায়া দেবী’রও মৃত্যু হয়েছিল এবং একই ভাবে মহাধুমধাম ও আড়ম্বরের মধ্যে তাঁরও শ্রাদ্ধাদি কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে, মাতা যোগমায়া দেবীর স্মৃতি রক্ষার্থে - রাজচন্দ্র কলকাতার ‘আহিরীটোলা’য় একটি স্নানেরঘাট নির্মাণ করিয়েছিলেন। পিতা প্রীতিরামের মৃত্যুর পরে, তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী পুত্ররূপে কৃতবিদ্য রাজচন্দ্রের ওপরে যেমন সমগ্র জমিদারী ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল, শাশুড়ী যোগমায়া দেবীর মৃত্যুর পরেও তেমনি সংসারের যাবতীয় কর্তব্য কর্মের ভার তাঁর সুযোগ্যা পুত্রবধূ, রাসমণি দেবীর ওপরে বর্তেছিল এবং তাঁদের উভয়েই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাসমণি দেবীর বিবাহের পর থেকেই জানবাজারের জমিদার বাড়িতে বিত্ত উপবিত্ত বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায়, নিজ বুদ্ধিমত্তা ও বদান্যতায় রাজচন্দ্র শীঘ্রই কলকাতার তৎকালীন অভিজাত সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে অন্যতমরূপে পরিগণিত হয়েছিলেন। সেই সময় ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ‘রাজা রামমোহন রায়’, ‘রাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর’, ‘রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর’, জোড়াসাঁকোর দেওয়ান ‘গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’, সুতানুটীর ‘রায় রাজ বল্লভ’, ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর’, ‘অক্রর দত্ত’, ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ প্রভৃতি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর গভীর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এমনকি, ‘লর্ড অকল্যাণ্ড’ সাহেবের সঙ্গেও তাঁর বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেই সময়, রাসমণি দেবীর অসীম প্রাণধারার অনুপ্রেরণার প্রভাবে রাজচন্দ্র বহুবিধ সৎকাজের অনুষ্ঠান করেছিলেন। ১২৩০ বঙ্গাব্দে রাসমণি দেবীর পিতা, ‘হরেকৃষ্ণ দাসের’ মৃত্যু উপলক্ষ্যে, পরলোকগত পিতার ‘চতুর্থী’ করার জন্য রাসমণি দেবী, তাঁর বাড়ির কাছের গঙ্গার তীরে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে, সেখানকার ঘাটটি অতিশয় পঙ্কিল, ভাঙা ইঁট ইত্যাদি সেখানে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে এবং ঘাটতি স্নান করার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক। তবুও সেখানেই তিনি তাঁর পরলোকগত পিতার চতুর্থীর কাজ কোন প্রকারে সম্পন্ন করে, বাড়িতে ফিরে গিয়ে, তিনি তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন যে, যাতে ঐ ঘাটটি স্নানার্থীদের জন্য উপযুক্তরূপে নির্মাণ করা হয়। পরদুঃখে কাতরা স্ত্রী রাসমণি দেবীর বিশেষ আগ্রহেই রাজচন্দ্র সেখানকার তৎকালীন কর্তৃপক্ষ, ‘গ্যারিসন অফিসারের’ (Garrison Officer) সঙ্গে সেই বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে, নিজের বহু অর্থ ব্যয়ে সেই গঙ্গার তীরের ‘বাবুঘাট’টি নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘাটর্নিমাণের দু’বছরের মধ্যেই তিনি আবার নিজের বাড়ি থেকে গঙ্গাতীর অবধি তৎকালীন কাঁচা রাস্তার বদলে নিজ ব্যয়ে প্রশস্ত পাকা রাস্তা - ‘বাবুরোড’ও নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজচন্দ্র দাস নির্মিত সেই বাবুরোডের কিছু অংশকে এখন ‘রাণী রাসমণি রোড’ বলা হয়। ছত্রিশটি থাম ও ‘চাঁদনী’ দ্বারা শোভিত সেই বাবুঘাটের দেওয়ালের ওপরে প্রোথিত একটি প্রস্তর ফলকে আজও লেখা আছে - “The Right Honorable Lord William Cavendish Bentinck, G.C.B. & G. C. H. Governor General, &C, &C, &C. with a view to encourage the direction of private munificence to works of public utility has been pleased to determine that this Ghaut constructed in the year 1830 at the expense of Baboo Raj Chandra Doss shall hereafter be called Baboo Raj Chandra Doss’s Ghuat.” বলা বাহুল্য, এমনি ভাবেই রাসমণি দেবীর বিশেষ প্রেরণায় রাজচন্দ্র আরো নানা মহৎ ও সৎকার্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১২৩০ বঙ্গাব্দে, প্রচণ্ড বন্যার সময় রাসমণি দেবীর অনুরোধে, রাজচন্দ্র তাঁর বাড়িতে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাঁদের আহারাদির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। এছাড়া, ‘নিমতলা’য় মুমুর্ষ গঙ্গাযাত্রীদের জন্য গৃহনির্মাণ করা, রাজচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি। গঙ্গাযাত্রীদের নিদারুন কষ্ট অনুভব ক’রে, রাসমণি দেবী, রাজচন্দ্রের দ্বারা সেখানে, মুমূর্ষুদের সেবা-শুশ্রূষার কাজের জন্য, নিজ ব্যয়ে ১টি গৃহ নির্মাণ করিয়ে, তাতে একজন দারোয়ান, দু’জন ভৃত্য এবং একজন চিকিৎসককে নিযুক্ত করেছিলেন। বর্তমানে সেই গৃহটি, পোর্টট্রাষ্ট রেলের পাশে অবহেলিত অবস্থাসয় পড়ে আছে। ‘মেটকাফ হলে’ সরকারি গ্রন্থাগারের উন্নতিকল্পে, রাজচন্দ্র এককালীন ১০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। বেলেঘাটায় খালের ওপরে ‘পুল’ তৈরীর আগে, জনসাধারণ যাতে বিনা ব্যয়ে খাল পারাপার করতে পারেন, তার জন্য রাজচন্দ্র বেলেঘাটার নিজের জমি ব্রিটিশ প্রশাসনকে দান করে দিয়েছিলেন। জনগণের স্বার্থে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সে জন্য কোন মূল্য গ্রহণ করেননি। ‘ব্যারাকপুরের’ ‘চাণকের তালপুকুর’টি অন্যলোকের ছিল। সেখানকার অধিবাসীদের জলকষ্ট নিবারণের উদ্দেশ্যে রাজচন্দ্র, নিজ ব্যয়ে অপরের সেই তালপুকুরটি খনন করিয়ে সেখানকার জলাভাব দূর করেছিলেন। কলকাতায় ‘হিন্দু কলেজ’ স্থাপনের সময়েও রাজচন্দ্র বিশেষ আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। রাজচন্দ্রের জমিদারীর মধ্যে চাষবাসের সুবিধার জন্য চাষীদের স্বার্থে দীঘি ও পুকুর প্রতিষ্ঠাও তাঁর মহত্বের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়া, বহু দরিদ্র ছাত্রদের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের জন্যও রাজচন্দ্র নিয়মিত অর্থ ব্যয় করতেন। উপরোক্ত বহু জনহিতকর কাজের জন্য ১৮৩২ সালে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী রাজচন্দ্র দাসকে ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল৷ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বহু গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, রাজচন্দ্র নাকি ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছিলেন; কিন্তু এটি ভুল তথ্য৷ কারণ, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে কাউকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেওয়া হত না, ‘রায়’ উপাধি দেওয়া হত। অবশ্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর পরে, ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণের পরে, ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিটির প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং ‘রায়’ উপাধিটিও ‘রায় বাহাদুর’ উপাধির সমতুল্য হয়েছিল। ১৮৩৫ সালে, কোম্পানী সরকার কর্তৃক ‘রায় রাজচন্দ্র দাস’কে, সম্মানসূচক ‘অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট’ বা ‘অবৈতনিক বিচারক’ পদেও নিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজচন্দ্র এমনই সত্যনিষ্ঠ ও বাঙনিষ্ঠ পুরুষ ছিলেন যে, ‘হুক্ ডেভিডসন এণ্ড কোম্পানী’ (মতান্তরে ‘বার্নাড কোম্পানী’) নামক এক ইংরাজ সদাগর অফিসকে দেউলিয়া জানা সত্বেও, তাঁর পূর্বের অঙ্গীকার মত সত্যরক্ষার্থে - একলক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছিলেন এবং ঋণ পাওয়ার পরের দিনই ঋণ গ্রহীতা বণিক সাহেব রাজচন্দ্রের সঙ্গে প্রতারণা ক’রে বিলাত চলে গিয়েছিলেন। নিজের দেওয়া বাক্যের সততা রক্ষার জন্যই রাজচন্দ্র সেদিন প্রকৃতপক্ষে অনেক নামীলোকের সমতুল্য কাজই করেছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ করার মত একটি দৃষ্টান্ত। রাজচন্দ্র সরাসরি সেই সময়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, জনহিতকর সমাজ বিপ্লবের সমর্থক হওয়ায়, ‘লর্ড বেণ্টিকের’ শাসনকালে ‘সতীদাহ’ নিবারণের জন্য ‘রাজা রামমোহন রায়’কে সম্পপূর্ণ সমর্থন করেছিলেন এবং তাঁর সাধ্যমত সহযোগিতা করেছিলেন। সেই বিষয়ে রাজচন্দ্র, সকল প্রকার হিন্দু গোঁড়ামীর ঊর্ধে উঠে দেশবাসীর কল্যাণে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা এদেশে বাণিজ্য করতে এসে এখানেই রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন, সেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীরই একজন প্রধান অভিজাত অংশীদার এবং তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের অন্যতম ধনকুবের, ‘জন্‌ বেব’, একবার কলকাতায় এলে, রাজচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছিল। এটি অবশ্য অনেক আগেকার ঘটনা। সেই সময় রাজচন্দ্রের উদার ভাব, জনহিতকর কার্যাদি ও অগাধ সম্পত্তির পরিচয় জেনে, বেব সাহেব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আজীবন বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী হয়েছিলেন। বিলাতে ফিরে গিয়েও বেব সাহেব রাজচন্দ্রের কথা মনে রেখে, ১৮২৬ সালের জানুয়ারী মাসে, প্রীতির চিহ্নস্বরূপ একটি ‘স্বর্ণঘড়ি’, বিলাত থেকে রাজচন্দ্রকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘড়িটি এখনও রাজচন্দ্র এবং রাণী রাসমণির বাড়িতে রক্ষিত আছে। ঘড়িটিতে লেখা আছে - “A TOKEN OF ESTEEM Sent by JOHN BEBB ESQ. of London TO HIS FRIEND Babu RAJ CHANDRA DAS, January 1826.” কথিত আছে যে, ভারতবর্ষের তৎকালীন বড়লাট, বাঙালীদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজচন্দ্র দাসের উদ্যানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। কলকাতায় অবস্থানকারী বহু ইংরেজের সঙ্গে রাজচন্দ্রের হৃদ্যতা থাকায়, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর বাড়িতে মাঝে মাঝে পদার্পণ করতেন। এইভাবে একেবারে নীচুতলার দীন দরিদ্র থেকে উপর মহলের রাজা মহারাজাদের সঙ্গে নিরহংকারী রাজচন্দ্র সমভাবে মিলিত হতেন এবং তাঁর সেই উদার ভাবের জন্য তিনি সকলের প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।

রাজচন্দ্র ইতিপূর্বে, ‘৭১ নং ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের’ পৈতৃক দোতলা বাড়িতে বাস করতেন। অতঃপর তিনি তাঁর সেই বাড়ির সংলগ্ন সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপরে একটি বিরাট দোতলা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। সেই প্রাসাদটি তৈরী হতে প্রায় ৮ বছর (১২২০-১২২৮ বঙ্গাব্দ) সময় লেগেছিল এবং প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। সেটাই বর্তমানে ‘রাণী রাসমণির বাড়ী’ নামে জনসাধারণের কাছে পরিচিত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অনেক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, সেই বিশাল প্রাসাদটির নাম - ‘রাসমণি কুঠি’ এবং রাজচন্দ্র দাস নিজেই সেটি তাঁর স্ত্রীর নাম নামকরণ করেছিলেন। এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। ওই প্রাসাদটির নাম কোনদিনই ‘রাসমণি কুঠি’ ছিল না এবং সেরকম কোন নামকরণও রাজচন্দ্র ক’রে যাননি। কলকাতার বুকে সেই বিশাল প্রাসাদটি দেখে এবং সেটিতে স্বনামধন্যা রাণী রাসমণি বাস করতেন বলেই, জনসাধারণ সম্ভবতঃ সেটিকে ‘রাসমণি-কুঠি’ নামে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটির নাম ‘রাসমণি-কুঠি’ নয়। তবে ওই বিশাল প্রাসাদের অপর প্রান্তে অবস্থিত, ‘রাণী রাসমণি ভবন’ নামাঙ্কিত যে বাড়িটি এখনো বিদ্যমান, সেটি রাসমণি দেবীর দেহত্যাগের বহু কাল পরে নির্মিত হয়েছিল এবং সেটি নির্মাণ করেছিলেন, রাসমণি দেবীর অন্যতম বংশধর - ‘নৃত্যগোপাল বিশ্বাস’। যাই হোক, তখনকার দিনে একজন বাঙালীর পক্ষে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সেই বিশাল সাত মহল প্রাসাদ (১টি পুষ্করিণী, ৬টি প্রাঙ্গণ এবং ৩০০টি ঘর সমেত) নির্মাণ করা যে কতটা কৃতিত্বের পরিচয় এবং বাঙালীর পক্ষে সেটি যে কত বড় গৌরবের বিষয়, সে কথা স্বীকার না ক’রে কোন উপায় নেই। রাসমণি দেবীর যেমন অমর কীর্তি - ‘দক্ষিণেশ্বর দেবালয়’, ‘রায় রাজচন্দ্র দাসের’ তেমন অমর কীর্তি সেই বিশাল প্রাসাদ৷ সেই প্রাসাদে কন্যাগণ, আত্মীয়স্বজন ও দাসদাসী নিয়ে রাসমণি-রাজচন্দ্রের বসবাস ছাড়াও - ঠাকুরদালান, নাটমন্দির, দেওয়ানখানা, কাছারী ঘর, অতিথিশালা, গোশালা, অশ্বশালা প্রভৃতিও ছিল। বর্তমানে সেই প্রাসাদের আভ্যন্তরীণ ভাগের অনেক পরিবর্তন হলেও, মূল প্রাসাদটি তৎকালীন সৌখিন আসবাবপত্রে সুসজ্জিতরূপে আজও বিদ্যমান। কলকাতার সেই ঐতিহ্যময় প্রাসাদ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে ‘শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’, তাঁর রচিত ও ১৩৫২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘রাণী রাসমণি’-গ্রন্থে যে বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন, সেটি উল্লেখ না করলে তৎকালীন সেই প্রাসাদ সম্পর্কে পাঠক-পাঠিকাদের কোন ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ‘প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’ লিখিত গ্রন্থ থেকে, সেই বিশদ ও সুন্দর বিবরণটি এখানে হুবহু উদ্ধত করাই যুক্তিসঙ্গত হবে - “এখন যে দেউড়িতে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের দিকে দ্বারবাগণ বসিয়া থাকে, উহাই আদি সিংহদ্বার ও প্রবেশদ্বার। বৃহদাকার প্রকারের বৃহদাকার তোরণ। বৃহৎ কপাটের বক্ষে লৌহগলি বসানো৷ ঐ বৃহৎ কপাটের অধোভাগে আবার একটি ক্ষুদ্রায়তন কপাট আছে। রাত্রি ১০ টার পর বৃহদ্বার বন্ধ হইবার নিয়ম। বৃহদ্বার বন্ধ হইয়া গেলে, ঐ ক্ষুদ্র দ্বার আগম নির্গমের জন্য ব্যবহৃত হইত। অবশ্য উৎসবে বৃহদ্বার সারা রাত্রি উন্মুক্ত থাকে। সিংহদ্বার উত্তীর্ণ হইলেই দুই ধারে দ্বারবানদিগের বিশ্রামাগার, শয়নাগার, প্রহরার স্থান। সেই সকল স্থানের ভিত্তি গাত্রে দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যাইত, উহাতে ঢাল, তরবারি, সড়কি, বন্দুক, রৌপ্যনির্মিত শঙ্কর মৎস্যের পুচ্ছ, বল্লম, বর্শা, ভোজালি, খেটক, খর্পুর, টাঙ্গী, পিতলের গুল বাঁধানো ভিতরে শিশা ঢালা মোটা মোটা পাকা বাঁশের লাঠি; আবার স্থানে স্থানে ঢোলক, ডুগডুগী, ডম্বরু, সারঙ্গী, সেতার, ঝাঁঝ, খঞ্জনী, করতাল, বাঁশের বাঁশী ইত্যাদি প্রমোদোপযোগী, দ্বৌবারিকদের হোলী ও বাসনের সম্বল, আবার তাহার পার্শ্বই মুদগর, লৌহ গোলক, লৌহ ধনুক, কাঠের বল পরীক্ষার পাপড়ী, গদসা কালসারের শৃঙ্গনির্মিত রৌপ্যমণ্ডিত আততায়ীর আক্রমণ-রোধী হাতিয়ার, বলবৃদ্ধির পরিচায়ক অস্ত্রগুলি সজ্জিত আছে। আবার তার পার্শ্বেই পাগড়ী, মুরাঠা, উষ্ণীষ, তাজ, কোমরবন্ধ, বুকবন্ধ, চাপরাশ ইত্যাদি শোভা পাইতেছে। তারপর একধারে কতকগুলি ভাং প্রস্তুতের কুণ্ডি ও নিম্বদণ্ডের বৃহৎ বৃহৎ ঘোটনদণ্ড সজ্জিত রহিয়াছে। দণ্ডগুলি যেন এক একটি বংশদণ্ডের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। মধ্যে মধ্যে উপরে একটি আলোকাধার। ... একজন দ্বারবানের কি বিশাল বক্ষ, পেশী সমন্বিত ভুজযুগ, গলদেশে স্বর্ণমণ্ডিত কামরাঙ্গা ফলের হাসুলী, হাতে রূপার বলয়, কর্ণে - বীরবৌলী, অঙ্গুলে অঙ্গুরীয়। অন্য একটি দ্বারবান ভয়ানক মূৰ্ত্তি - গজস্কন্ধ, গজচক্ষু, দেহ স্থূল ও মাংসল, পেশী দৃঢ় ও সরল, উচ্চতায় সকল দ্বারবারিক অপেক্ষা কনিষ্ঠ, বলে সর্বশ্রেষ্ঠ, কেশ-বিরল মস্তক, ঐটা কুস্তিগীর, সহসা দেখিলে মনে হয় যেন কুম্ভকর্ণের প্রদৌহিত্র, কি বৃকোদরের দূর সম্পর্কীয় জ্ঞাতি ভাতা। এইরূপ ২৫৩০ জন দ্বৌবারিক তোরণ-রক্ষক। অল্প অগ্রসর হইলেই দুই ধারেই চলন পথ। চলন পথ পার হইলেই দুইধারে উপরে যাইবার দুইটী সোপান শ্রেণী। বামদিকের সোপান শ্রেণী দিয়া উপরে অন্তঃপরে যাইতে পারা যায় ও দক্ষিণদিকের সোপান শ্রেণী দিয়া উপরে বৈঠকখানায় যাইতে পারা যায়। অগ্রে নিম্নতলার কথাই বলা যাইতেছে৷ এই চলন পথ তিন দিক ব্যাপিয়া। উত্তরভাগে দেবতার স্থান, ঠাকুর দালান। মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, প্রাঙ্গণে বাঁধা কাঠগড়া। তিন দিককার চলন পথের পার্শ্বেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ। কোনটি দেওয়ানখানা, কোনটি গোলামস্তার, কোনটি সরকারের, কোনটি পাচক ব্রাহ্মণের, কোনটি পূজক ব্রাহ্মণের, কোনটি গৃহ শিক্ষকের, কোনটি ভাণ্ডারির, কোনটি ফরাসের, কোনটি বাতিঘর, কোনটি ভৃত্যের আবাস, কোনটি ঢাকী ও ঢুলির জন্য, কোনটি প্রতিমা-নির্মাতা কুম্ভকারের জন্য, কটি ঘড়িঘর, উহাতে একটি কাঁসার বড় পেটা ঘড়ি থাকিত ও ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাদিত হইয়া সময় ঘোষণা করিত। উহা এখনও আছে। পূর্বদিকের গৃহগুলিতে উৎসবে, পার্বণে, আহারীয় দ্রব্যাদি স্তরে স্তরে রাখা হইত। কোনটিতে রথ, রথের আসবাব সরঞ্জাম, ঘোড়া, সারথি, পতাকা, রজ্জু ও আশাসোটা ইত্যাদি থাকিত। কোনটি উদ্বোধনে ব্রাহ্মণদিগের বাসের জন্য ব্যবহৃত হইত। কোনটি দাশু রায়, গোবিন্দ অধিকারী ও আর আর সম্প্রদায়ের বাসস্থান নির্দিষ্ট হইত৷ কোনটি পূজার সময় পজোপকরণ সজ্জিত হইত। কোনটিতে দোলের সময়কার আবির, কুমকুম্, ফাগ, রং, পিচকারী, মঠ, ফুলের মালা ইত্যাদি রাখা হইত। কোনটিতে আড়ালি, স্বর্ণছত্র, রৌপ্যছত্র রাখা হইত। ... উত্তরদিকে তিন মহল ঠাকুর দালান, শেষ মহলে ঠাকুরের স্থান। উপরে ৩২ ডালের ঝাড়, দুই পার্শ্বে ২৫ ডালের করিয়া দুইটি ঝাড়, নীচে ঠাকুরের কাছে সেজ জ্বলিত হইত। উহাই দুর্গা প্রদীপ। ঠাকুর দালানটি সমস্তই পঙ্কের কাজ করা। থামে দেওয়ালগিরী ও চিত্রপট শোভা পাইত। উপরে বহুমমূল্যের চাঁদোয়া। মধ্যমহলে ষোড়শোপচারে পুজোপকরণ রাখিবার ও ব্রাহ্মণদিগের বসিবার স্থান। শেষ মহলে দর্শকদিগের স্থান। শেষ মহলের পরেই কতিপয় সোপান শ্রেণী, পরে প্রাঙ্গণ বলিদানের স্থান, দক্ষিণ দিকের গৃহগুলি পার হইলেই ফুলবাগান, তাহা এখন স্থানাভাবে পাকশালা, অশ্বশালা, গোশালা এবং যানবাহন রক্ষার স্থান হইয়াছে। উপরে, বৈঠকখানা, উপরে ঝাড়লণ্ঠন, সেজ, দেওয়ালগিরির বেল লণ্ঠনে গৃহ আলোকিত হইত। বড় বড় মুকুরে গৃহ প্রাচীর শোভিত ছিল। মহিষের বৃহৎ বৃহৎ শঙ্গ, মৃগশৃঙ্গ ও চর্ম, কালসারের শৃঙ্গ ও চর্ম, ব্যাঘ্রচর্ম ও মৃজাপুরী কারুকার্য খচিত গালিচায় শোভা পাইত। ... পূর্বদিকে দরদালান ও রঘুনাথ জীউর স্থান। এটি প্রথম মহল৷ প্রথম মহল পার হইলেই দ্বিতীয় মহল। নীচে উপরে দুইটি চলনপথ প্রথম মহল হইতে দ্বিতীয় মহলে লইয়া গিয়াছে। ইহার নীচে ও উপরে অনেকগুলি গৃহ সজ্জিত। তাহা এখন যদুনাথ চৌধুরী মহাশয়ের পুত্রগণের অংশে পড়িয়াছে৷ সদর ও মফঃস্বলে বিভক্ত করিয়া পঞ্চভ্রাতা পঞ্চপাণ্ডবের মত প্রিয় পরিজন, পুত্রকন্যা লইয়া বাস করিতেছেন। অধুনা ইহারাই যেন রাণীর গৌরব কতকাংশে অক্ষুণ্ন রাখিয়াছেন। ইহাই দ্বিতীয় মহল। দ্বিতীয় মহলে ছাদে যাইবার একটি গোল সিড়ি আছে। ইহার পরেই তৃতীয় মহল। ইহাতে ১টি প্রাঙ্গণ ও নীচে উপরে অনেকগুলি গৃহ আছে। ইহা গণেশবাবুর অংশে পড়িয়াছে। তারপরেই ৪র্থ ও ৫ম মহল। ইহা বলাইবাবুর অংশে ছিল, তিনি স্বেচ্ছায় উহা সীতানাথবাবুকে বিক্রয় করিয়া ইটালীতে যাইয়া পৃথক বাটি নির্মাণ করাইয়া বাস করিতেছেন। ... ষষ্ঠ মহলে একটি পুষ্করিণী ছিল। তাহা মৃত্তিকায় পূর্ণ করিয়া এখন উহাতে গৃহাদি নির্মিত হইয়াছে। সপ্তম মহলের অংশবিশেষ গৃহ ও অশ্বশালা হইয়াছে। ইহাতে নুন্যাধিক ৩ শত গৃহ, ৬টি প্রাঙ্গণ আছে। ১২২০ সালে ইহার নির্মাণকার্য আরদ্ধ হইয়া ১২২৮ সালে শেষ হয়। ইহাই রাসমণি-কুঠি নামে অভিহিত। ... এতদ্ব্যতীত উমাচরণ দাসের লেনে রাণী যদুনাথবাবুর জন্য স্বতন্ত্র একটি বাটি নির্মাণ করান। দুঃখের বিষয়, জীবদ্দশায় যদুনাথবাবুকে ঐ বাটিতে বাস করিতে হয় নাই। ইহার বহু বৎসর পরে, রাণীর ৪র্থ কন্যা জগদম্বা দাসী ১৫নং মার্কেট স্ট্রীটে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি বাটি প্রস্তুত করান৷ তাহাতে এখন দ্বারিকাবাবুর সন্তানেরা বাস করিতেছেন।” ‘শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’ লিখিত গ্রন্থটি ১৩৫২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরে ওই প্রাসাদটি ৪টি ভাগে বিভক্ত হয়ে বর্তমানে ৪টি পৃথক নম্বরে চিহ্নিত হয়েছে। ‘১৯ নং এস. এন. ব্যানার্জী রোডের’ অংশে, রাসমণি দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা, শ্রীমতী ‘পদ্মমণি’র পুত্র ‘গণেশচন্দ্র দাসের’ বংশধরগণ থাকেন এবং ‘২০, ২০এ ও ২০বি নং এস. এন. ব্যানার্জী রোডের’ অংশে শ্রীমতী ‘পদ্মমণি’র অপর পুত্র ‘সীতানাথ দাসের’ বংশধরগণ থাকেন। ‘১৮/৩এ, এস. এন. ব্যানার্জী রোডের’ অংশে রাসমণি দেবীর দ্বিতীয়া কন্যা, শ্রীমতী ‘কুমারী’র পুত্র ‘যদুনাথ চৌধুরী’র বংশধরগণ থাকেন। ‘১৩নং রাণী রাসমণি রোডের’ অংশে, রাসমণি দেবীর চতুর্থ কন্যা, শ্রীমতী ‘জগদম্বা’র পুত্র, ‘ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাসের’ উত্তরাধিকারীগণ থাকেন। অবশ্য রাসমণি দেবীর কয়েকজন বংশধর ঐ বাড়িতে বাস না ক’রে, বর্তমানে ‘ব্যারাকপুর’, ‘আগড়পাড়া’, ‘সিঁথি’ প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলে এবং ঐ প্রাসাদের কাছাকাছি ও কলকাতার নানা জায়গায়, নিজের নিজের বাড়িতে বাস করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ‘১৩নং রাণী রাসমণি রোডের অংশে’ (অতীতের ‘৭১নং ফ্রি স্কুল স্ট্রীট’) যখন রাসমণি দেবীর অন্যতম জামাতা ‘মথুরমোহন বিশ্বাস’ বাস করতেন, তখন তাঁর একান্ত আগ্রহে, রাসমণি দেবীর অবর্তমানে, সেই বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকবার আগমন বা অবস্থান ঘটেছিল। রাসমণি দেবী অপুত্রক থাকায় এবং তাঁর অপর দুই জামাতা অধিকাংশ সময় নিজের নিজের বাড়িতে বাস করায়, একমাত্র মথুরমোহনই তখন সেই বাড়িতে স্থায়ীভাবে বাস করতেন ও রাসমণি দেবীর সম্পত্তির তদারকি করতেন। ওই প্রাসাদটি ঠাকুর রামকৃষ্ণের অন্যতম লীলাস্থল এবং তাঁর সাথে জড়িত বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী। ওই প্রাসাদটি দোতলা এবং হলদে রঙের। পুরাতন ঐতিহ্যবাহী সেই বাড়ির যে অংশে প্রধানতঃ ঠাকুরের আগমন ঘটত, সেটি পশ্চিম-দুয়ারী এবং উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। বর্তমানে ওই বাড়ির বাইরের অংশে বহু দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। বাড়ির ভেতরে রয়েছে টিনের শেড দেওয়া বিরাট উঠান, যেখানে বর্তমানে বাড়ির গাড়ীগুলি থাকে। উঠানের বামদিকে মস্তবড় চণ্ডীমণ্ডপ, আগে সেখানে ওই বাড়ির যাবতীয় পূজাদি হত - বর্তমানেও সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা প্রভৃতি হয়। সেই চণ্ডীমণ্ডপেই এক শারদীয়া দুর্গাপূজার সময়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চামর দিয়ে প্রতিমাকে ব্যজন করেছিলেন। ওই অংশটি আগে বাড়ির ‘বাহির মহল’ নামে পরিচিত ছিল, সেটারই সংলগ্ন লাল রঙের পূর্ব-পশ্চিমে প্রশস্ত একই ধরণের বাড়িটি ‘অন্দরমহল’ নামে পরিচিত ছিল এবং সেই অংশেই রাসমণি দেবী বাস করতেন ও সেখানেই তাঁর পূজার ঘর ছিল। ওই ‘১৩ নং বাড়ি’র দোতলায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যবহৃত খাট, যাতে মথুরমোহনও সস্ত্রীক শয়ন করতেন, এবং ঠাকুরের ব্যবহৃত অন্যান্য কিছু জিনিস রক্ষিত আছে। বাড়ির সেই অংশে ঢুকে ডানদিকের রোয়াক বরাবর দোতলায় যাওয়ার কাঠের সিঁড়িটি আজও আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাস্থল বলতে মূলতঃ ওই বাড়িটি চিহ্নিত, যদিও বাড়িতীর অন্যান্য অংশেও তাঁর পদার্পণ ঘটেছিল। আগে সেই বাড়ির ঠিকানা ছিল - ‘৭১ নং ফ্রী স্কুল স্ট্রীট, কলকাতা-১৩’। বর্তমানে সেটির ঠিকানা – ‘১৩নং রাণী রাসমণি রোড, কলকাতা-৮৭’৷ মধ্য কলকাতার ধর্মতলার ট্রাম রাস্তার পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণমুখী রাস্তা - ‘রাণী রাসমণি রোড’ ধরে কিছুটা গেলেই পড়ে - পশ্চিমমথী ‘সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড’; সেই রাস্তাটি অতিক্রম করলেই, বামদিকে রাস্তার ওপরেই ‘রাণী রাসমণি রোড’ ও ‘সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের’ সংযোগস্থলে হলুদ রঙের বিরাট সেই দোতলা বাড়িটি অবস্থিত। ‘এস্প্ল্যানেডের’ দিক থেকে ‘জওহরলাল নেহেরু রোড’ দিয়ে ‘সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডে’ প্রবেশ করে পূর্বদিকে এগিয়ে গেলে, রাণী রাসমণি রোডের ওপরে ডানদিকে সেই ‘১৩ নং বাড়ি’টি পড়ে

বৈষয়িক, সামাজিক প্রভৃতি কাজকর্ম ছাড়াও ধর্মপ্রাণ রাজচন্দ্র নিজের বাড়িতে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতিরও অননুষ্ঠান করতেন এবং সেগুলোর জন্য তিনি যথেষ্ট অর্থ ব্যয়ও করতেন। একদিন বৈশাখ মাসের দুপুরে রাজচন্দ্র নিদ্রা যাওয়ার সময়, জনৈক সন্ন্যাসী অযাচিত ভাবে তাঁর বাড়িতে গলদঘর্ম অবস্থায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সন্ন্যাসীর দেহটি কৃশ হলেও বেশ উন্নত ও বলিষ্ঠ ছিল; তাঁর পরিধানে ছিল গৈরিকবস্ত্র ও ধূলিমাখা নগ্নপদ৷ সন্ন্যাসী দেউড়ীতে এসে দ্বারবানদের জানিয়েছিলেন যে, তিনি জমিদার রাজচন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু দ্বারবানেরা সেই অসময়ে রাজচন্দ্রের সঙ্গে তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি না দেওয়ায়, সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁদের প্রথমাবস্থায় খুব বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। অবশেষে সন্ন্যাসীর বিশেষ পীড়াপীড়িতে, বাড়ির দাসীর দ্বারা অন্দরমহলে রাজচন্দ্রের কাছে সেই সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর রাজচন্দ্র, দোতলার বৈঠকখানায় এসে সন্ন্যাসীকে সেখানে আনার নির্দেশ করায়, সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং রাজচন্দ্রকে বলেছিলেন যে, “আমার কাছে রঘুনাথজীউ শিলা আছেন, আপনাকে দেবো, আপনি তাঁর সেবা করবেন, আপনার মঙ্গল হবে। আমি বহুদূর তীর্থ দর্শনে যাব; ফিরব কিনা সন্দেহ।” এরপরেও আরও কিছু কথাবার্তার পরে; সেই অপরিচিত সন্ন্যাসীটি, রাজচন্দ্রকে রঘুনাথ-শিলাটি অর্পণ করেছিলেন; কিন্তু বিনিময়ে রাজচন্দ্র তাঁকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সন্ন্যাসী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান ক’রে সঙ্গে সঙ্গে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। সেই ‘রঘুনাথজীউ’কে রাজচন্দ্র, তাঁর বাড়ির অন্দরমহলের ঠাকুর ঘরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং রামচন্দ্রকে স্মরণে রেখে রাজচন্দ্র ঐ শিলাটির পাশে একটি রৌপ্যনির্মিত হনমান মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ‘রঘুনাথজীউ’, জানবাজারের ‘মাহিষ্য’ জমিদার পরিবারের ‘কুলদেবতা’, যাঁকে রাসমণি দেবী একদা নিজের জীবন বিপন্ন করেও গোরাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ বলা প্রয়োজন যে, কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, জনৈক সন্ন্যাসী একটি অর্ধহস্তপরিমাণ ‘বিষ্ণুমূর্তি’ রাজচন্দ্রকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি কোন মূর্তি ছিলনা; সেটি ছিল একটি ‘রামশিলা’, যা ‘রঘুনাথজীউ’ নামে অভিহিত। অতএব ‘বিষ্ণুমূর্তি’ উপহারের তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। অতীতে সেটি পালাক্রমে শরিকদের বাড়িতে পূজা করা হত; ১৯৮৯ সালের জুন মাস থেকে সেটি ‘দক্ষিণেশ্বরে’ ‘৺রাধাকান্তের মন্দিরে রেখে’ পূজা করা হচ্ছে। রাজচন্দ্রের জীবদ্দশাতেই তাঁর কন্যাদের বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। ‘উত্তর চব্বিশ পরগণা’ জেলার ‘সিঁথিগ্রাম’ নিবাসী ‘রামচন্দ্র দাসের’ সঙ্গে তাঁর জ্যোষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী ‘পদ্মমণি’র বিবাহ হয়েছিল; ‘খুলনা’ জেলার ‘সোনাবেড়িয়া’ গ্রাম নিবাসী ‘প্যারীমোহন চৌধুরী’র সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা শ্রীমতী ‘কুমারী’র বিবাহ হয়েছিল এবং ‘উত্তর চব্বিশ পরগণা’ জেলার ‘বসিরহাট’ মহকুমার ‘বিথারী’ গ্রাম নিবাসী ‘মথুরমোহন’ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর তৃতীয়া কন্যা শ্রীমতী ‘করুণাময়ী’র বিবাহ হয়েছিল; কিন্তু বিবাহের কয়েক বছর বাদেই একটি সন্তান রেখে করুণাময়ীর মৃত্যু হলে, তাঁর চতুর্থ কন্যা শ্রীমতী ‘জগদম্বা’র সঙ্গে মথুরমোহনের পুনরায় বিবাহ হয়েছিল। রাসমণি দেবী যখন তাঁর দাম্পত্যজীবনে সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে অবস্থিতা, ঠিক সেই সময়েই অকস্মাৎ তাঁর জীবনে বিনামেঘে বজ্রাঘাত ঘটেছিল। একদিন রাজচন্দ্র গাড়ী করে ভ্রমণের সময়, গাড়ীর ভেতরেই অকস্মাৎ ‘পক্ষাঘাতে’ (Stroke) আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কোনক্রমে ইঙ্গিতে গাড়ীর চালককে বাড়িতে ফিরে যাবার নির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় অনতিবিলম্বে রাজচন্দ্রের সংজ্ঞাহীন দেহ নিয়ে বাড়িতে গাড়িটি এসে পৌঁছালে; দ্বারবান, কর্মচারী প্রভৃতি শশব্যস্তে এসে রাজচন্দ্রের সংজ্ঞাহীন দেহ বহন করে ওপরের ঘরের পালঙ্কে শুইয়ে দিয়েছিলেন এবং সকলকে সেই বিপদের সংবাদ দিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায়, কলকাতা শহরের মান্য, গণ্য, সম্ভ্রান্ত, ধনী ও পরিচিত ব্যক্তিরা সকলেই এসে রাজচন্দ্রের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাসমণি দেবী তাঁর কোষাগার উন্মুক্ত করে, তৎকালীন কলকাতা শহরের বড় বড় ডাক্তারকে রাজচন্দ্রের জীবন রক্ষার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। অনেকেই অনেক উপায় বা নানা ঔষধ নির্বাচন করেছিলেন। জানবাজারের রাস্তায়, বাড়ির সামনে, সিঁড়ির নীচে-ওপরে - ঘাস, বিচালী, শতরঞ্চি, গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে গাড়ীর ঘর্ঘর শব্দে বা পায়ের শব্দে রোগীর রোগ না বাড়তে পারে। কিন্তু সকল চেষ্টা, সকল চিকিৎসা ব্যর্থ করে রাজচন্দ্র, ১২৪৩ বঙ্গাব্দে (১৮৩৬ সালের ৯ই জুন), মাত্র ৫৩ বছর বয়সে অজ্ঞান অবস্থাতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। রাসমণি দেবীর বয়স তখন ৪৪ বছর। মৃত্যুকালে রাজচন্দ্র - ৩ কন্যা, ৩ জামাতা, ৪-৫ টি দৌহিত্র দৌহিত্রী ও পত্নী রাসমণিকে রেখে গিয়েছিলেন; আর রেখে গিয়েছিলেন স্ব-উপার্জিত নগদ ৬৮ লক্ষ টাকা, ৮ লক্ষ টাকা ‘বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শেয়ার’, ২ লক্ষ টাকা ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’কে দেওয়া ঋণ এবং ১ লক্ষ টাকা ‘হুক ডেভিডসন এণ্ড কোম্পানীকে’ দেওয়া ঋণ। এ ছাড়া আরো নানা জায়গায় তাঁর অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর বিষয়-সম্পত্তি, প্রাসাদ প্রভৃতিতো ছিলই। রাজচন্দ্রের কোন পুত্র না থাকায় তৎকালীন আইনানুযায়ী সেই বিশাল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী হয়েছিলেন তাঁর পত্নী রাসমণি দেবী৷ স্বামীর সেই আকস্মিক মৃত্যুতে রাসমণি দেবী মাটিতে আছড়ে পড়েছিলেন এবং যুগ্মজীবনের বিচ্ছেদ ব্যথায় প্রথমাবস্থায় একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন। স্বামী সোহাগিনী স্ত্রীর সেই সময়কার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। স্বামীর অকাল মৃত্যুর তীব্র বেদনায় রাসমণি দেবী, তিন দিন তিন রাত্রি অনশনে কাটিয়েছিলেন এবং মাটিতেই শয়ন করেছিলেন। সেটা শুধু রাসমণি দেবীর ব্যক্তিগত শোক ছিল না, জানবাজার প্রাসাদের সকলেরই সমান ও সমবেত শোক ছিল। তবু সেই শোকের বিরহাতুর অন্তরে অপরদের চাইতে রাসমণি দেবী যে ব্যতিক্রমী ছিলেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। রাজচন্দ্ররূপে সমদ্রকে আশ্রয় করেই রাসমণি-তরঙ্গের লীলা শুরু হয়েছিল, আবার সেই রাসমণি-তরঙ্গকে আশ্রয় করেই রাজচন্দ্র-সমদ্রের বিভূতি ঘটেছিল। আত্মিক বন্ধনে দু’জনেই ছিলেন পরস্পর যুক্ত। সেই বন্ধনটি সেদিন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল - মিলনানন্দের অবসান ঘটেছিল। রাসমণি জানতেন যে আর লৌকিক জগতে তাঁর পরমপ্রিয় স্বামী রাজচন্দ্রের সাক্ষাৎ মিলবে না - তখন থেকে শুরু হয়েছিল তাঁদের মানস সাক্ষাৎকার। মিলনে যা সংক্ষিপ্ত, বিরহে তা পরিব্যপ্ত। মিলনে বিচ্ছেদের আশঙ্কা, আবার বিরহে মিলনের আকাঙ্ক্ষা; মিলনে শুধু সঙ্গলাভ - বিরহে সর্বাত্মক স্মৃতি, নিবিড় ধ্যান৷ রাণীর সেই অবস্থা এই লেখনীর দ্বারা প্রকাশ করা অসম্ভব; কারণ, সেটি গভীর অনুভূতির বিষয়। তবুও ঈশ্বরে একান্ত নির্ভরশীলা সেই পুণ্যবতী, সতীসাধ্বী মহিলা - জগতের জন্ম-মৃত্যুকে স্বীকার করেই এবং সেটিও ঈশ্বরের ইচ্ছা - এই কথা স্মরণ করে নিজের শোক প্রশমিত করেছিলেন এবং পরলোকগত স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়ার প্রস্তুতির জন্য রাজচন্দ্র-স্মৃতির অনন্ত সমুদ্রে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে অমৃতময়ী হয়ে উঠেছিলেন৷ সৃষ্টি ও ধ্বংসের অনাদি, অব্যক্ত চিৎশক্তি রাসমণি দেবীকে পুরাতন জীবনের ধ্বংসাবশেষের ওপরে আবার নতুন জীবনের সৃষ্টি করিয়েছিল - সেখানেই রাজরাণী রাসমণি’র অবলুপ্তি ঘটেছিল এবং ‘তপস্বিনী রাসমণি’র আবির্ভাব হয়েছিল। রাসমণি দেবীর দাম্পত্য জীবনের সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল এবং সেখান থেকেই তাঁর বৈধব্য জীবনের শুরু হয়েছিল।

                                            ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- রাণী রাসমণি, প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা।

২- রাণী রাসমণির অন্তহীন জীবনবৃত্তে, ডঃ শিশুতোষ সামন্ত, সৌরজ্যোতি সামন্ত (২০০৯)।

৩- রাণী রাসমণির প্রথম জীবনী - হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যয় প্রণীত, গৌতম বাগচি, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।

৪- রাণী রাসমণি, গোপালচন্দ্র রায়।

৫- লোকমাতা রাণী রাসমণি, বঙ্কিমচন্দ্র সেন।

৬- রাণী রাসমণি: বংশধর পরিচিতি ও বংশতালিকা, লেখক অজ্ঞাত, প্রাপ্তিস্থান - National Digital library archive of United States, New York.)

                                        

No comments