*হিন্দু শব্দের উৎপত্তি*সিন্ধু শব্দ থেকে হিন্দু হয়েছে, আবার তা থেকে India ও ইন্দাস... গ্রীক, পারস্য ও আরবীয় অবদান... এ কথা আমরা শুনে আসছি...
তাহলে সিন্ধু শব্দ কি থেকে এলো? ওপরের গল্প যারা শোনায়, তাদের কাছে এই উত্তর নেই কেন?
অবশ্যই…
*হিন্দু শব্দের উৎপত্তি*
সিন্ধু শব্দ থেকে হিন্দু হয়েছে, আবার তা থেকে India ও ইন্দাস... গ্রীক, পারস্য ও আরবীয় অবদান... এ কথা আমরা শুনে আসছি...
তাহলে সিন্ধু শব্দ কি থেকে এলো? ওপরের গল্প যারা শোনায়, তাদের কাছে এই উত্তর নেই কেন?
অবশ্যই ওপরের ন্যারেটিভের ভিত্তি আছে l আভেস্তায় hendu ও hindvo শব্দ আছে l তার অনেক পরে দারিয়ুসের শিলালিপিতে নিম্নলিখিত শব্দ আছে ( c. 550–486 BCE) -
H-i-du-u-š এবং H-n-d-wꜣ-y
আবার দারিয়ুসের পরে হেরোডোটাস (c. 484 – c. 425) বলেছেন indoikn
সবই ঠিক আছে... কিন্তু
অনেকের আবার চাপা বা উৎকট কষ্ট আছে, বিদেশীরা আমাদের নাম দিলো? আমাদের নিজেদের নাম কি ছিল?
আচ্ছা, আমি বা আপনি যখন জন্মেছিলাম, তখন কি নিজেই নিজের নাম ঘোষণা করেছিলাম, নাকি অন্যে... বাবা মা দাদু ঠাকমা দিদা... আমার নাম দিয়েছিলো l
তাহলে অন্যের দেয়া নামকে আমি আমার আইডেন্টিটি ভাবি কেন? তার বেলায় তো আপত্তি বা কষ্ট হয়না !
যারা অন্যের দেয়া হিন্দু নাম নিয়ে কষ্টে আছেন, তাঁরা তাহলে অন্যের দেয়া নামটাকে হেয় করে ফেলে দিয়ে নিজেই নিজের একটা নাম ঘোষণা করুন l
স্বনামধন্য হতে না পারলেও নিজেই নিজের একটা নাম দিয়ে অন্তত "স্বনাম ধন্য" হয়ে উঠুন l
আচ্ছা... এই অবধি হিন্দু শব্দের উৎপত্তির ন্যারেটিভ আমরা সবাই কম বেশী জানি l তা নিয়ে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই l
এবার বরং একটু অন্যভাবে ভাবা যাক l
প্রশ্নটা আগেই করেছি l সিন্ধু থেকে যদি হিন্দু হয়, তাহলে সিন্ধু কি থেকে হল?
মনে রাখতে হবে, ঋগ্বেদে সিন্ধু মানে শুধু সিন্ধু নদ নয়, সিন্ধু মানে অন্য নদী, যেকোনো নদী, এমনকি আকাশ, সমুদ্র ও ভূমি l এমনকি ভূমির সূত্রে মানুষও বোঝায় l
এই হল সংস্কৃত ভাষার মহিমা l একই শব্দ ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন অর্থ হতে পারে l
জীবনে যেমন "একটি প্রধান গল্প" (grand narrative) বলে কিছু নেই l সংস্কৃত ভাষাতেও তাই l সংস্কৃত ভাষা জীবনের প্রতিচ্ছবি l
পন্ডিতপ্রবর Monier Williams ও সিন্ধু শব্দের etymology নির্ধারণ করতে পারেননি l উনি tentatively বলেছেন, সিন্ধুর উৎপত্তি সিদ ধাতু থেকে, যার মানে গতি l
অর্থাৎ গতিময়তাই সিন্ধু l মন্দ নয় l হিন্দু শব্দের মধ্যে একটা dynamic ব্যাপার তাহলে আছে l
কিন্তু মন ভরে কি? সিদ থেকে সিন্ধু কেন? যেখানে আরো পরিষ্কার etymology আছে l
সুতরাং আসুন... সবার আগে সিন্ধু শব্দের উৎপত্তি খুজি l
ঋগ্বেদে যে কোনো "বল" (power) হল ইন্দ্র l তাই সিন্ধু নদেও ইন্দ্র শক্তি আবার সরস্বতী নদীতেও l ঋগ্বেদে আবার সরস্বতী আর ইন্দ্র কখনো কখনো এক l দুজনেই বৃত্র হন্তা l সুতরাং gender নিয়ে অনর্থক চিন্তিত হবেন না l ঋষিরা gender এর উর্দ্ধে l
হিন্দুধর্ম পুরুষ কেন্দ্রিক নয় l
এবার হিন্দু শব্দ নিয়ে আমার মত বলি l
না... সিন্ধু থেকে হিন্দু নয় l বিদেশীদের উচ্চারণে সেটা হয়ে থাকলে সেটা ভাষাগত এক্সিডেন্ট l
যেমন ধরুন বাংলায় গৃহীত দেওয়াল, আর ইংরাজিতে wall
এই মিল থেকে লাফিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে বাংলা ইংরেজিকে নকল করেছে বা উল্টো l
কোনো এক আদি উৎস থাকতে পারে (PIE নামক কাল্পনিক ভাষার মতো), যা থেকে লতায় পাতায় মিল হয়েছে l এইটুকুই বড়জোর কল্পনা করা যায় l তার ভিত্তি নাও থাকতে পারে l
বৃহদ আরণ্যক উপনিষদে, ইন্দ্রের আদি নাম ইন্ধ l যার তাৎপর্য হল চক্ষু l (মন্ত্র নং 4.2.2)
সুতরাং চক্ষু মানে আক্ষরিক অর্থেই শুধু ড্যাবড্যাবে চোখ ভাববেন না l চক্ষু হল দৃষ্টি বা দর্শন... যার তাৎপর্য ঋষি এবং আর্য শব্দের মধ্যে আছে l ঋষিকে ইংরাজিতে seer বলা হয় l
সুতরাং... সিন্ধু শব্দের উৎপত্তি...
স + ইন্ধ
অর্থাৎ দৃষ্টি, দর্শন ও বলের সমন্বয় l
ঋগ্বেদে আবার ইন্দু হল সোম বা অমৃত l
ইন্ধ বা ইন্দ্র আবার ইন্দু l
সুতরাং...
সিন্ধু যদি... স + ইন্দু হয়... তাহলেও হেরফের হয় না l
একই ভাবে, হিন্দু হতে পারে
হ + ইন্দু l
তার মানে, পবিত্র সোম বা অমৃতর প্রবাহ l
হি + ইন্দু... হলে অর্থ হবে "গতিময় অমৃতের প্রবাহ"
ঋগ্বেদে, "হিণ" হচ্ছে সন্তানের প্রতি পৃথিবী মাতার আদরের শব্দ...
সুতরাং...
হিন্দু = হিণ + দু
এটাও হতে পারে l
দু শব্দের অর্থ উত্তাপ... যা থেকে তপ, তাপস প্রভৃতি
বৈদিক সভ্যতা হল সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার ক্রমবিকাশ (যদি না এক হয় l এ নিয়ে আলোচনা এই পোস্টে প্রাসঙ্গিক নয় l গবেষণা চলুক l প্রত্নতত্ত্ব নির্ধারণ করুক)
সরস্বতী সিন্ধু সভ্যতায় প্রাচীন রূপের শিব পূজা ছিল l ঋগ্বেদেও শিবলিঙ্গ পূজার উল্লেখ আছে l
এখন, শিবের এক নাম হিন্দুক l সুতরাং হিন্দু শব্দের তাও উৎপত্তি হতে পারে l
মনে রাখতে হবে, সে যুগে ভারতের উত্তর পশ্চিম অংশ অত্যন্ত উন্নত ছিল, এবং সেটাই ছিল "বিদেশের" সাথে আদানপ্রদানের দরজা l
যারা বলেন, গ্রিকরা সিন্ধু থেকে তারপর হিন্দু থেকে india করেছে, তাঁরা প্রমাণ দিতে পারবেন তার?
আমি যদি বলি, গ্রিকরা সরাসরি ইন্দু থেকেই india করেছে l
এর কিন্তু একটা প্রমাণ আছে l
প্রাচীন চৈনিকরা ভারতকে বলত ইন্টু l বা ইন্দু l অর্থ হল সোম বা চাঁদ l তাদের কিন্তু উত্তর পশ্চিমের ঘুরপথে সিন্ধু থেকে ইন্দু করে ইন্টু করার সম্ভাবনা নেই l
অর্থাৎ... ইন্দু থেকেই ইন্টু হয়ে india... এই সম্ভাবনা চৈনিক প্রমাণে জোরদার l
আভেস্তায় যে হিন্দু শব্দ তাকেও বিদেশী বলা যায় না l প্রাচীন পারস্য বৈদিক সভ্যতারই অন্য ভাগ l একই কয়েনের অন্য পিঠ l
সুতরাং হিন্দু নাম প্রাচীন পারস্য দিলে, সেটা বৈদিক নাম l তাকে মোটেই "বিদেশী" নাম বলা যায় না l
তাকে এখনকার বাউন্ডারি মাথায় রেখে বিদেশী বলা ভুল হবে l
আবার... ইন্ধ বা ইন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে (স + ইন্ধ, বা স + ইন্দু), আবার যদি "বিদেশে" স খসে গিয়ে হ হয়ে যায়, তাহলে সেটাও বৈদিক নিরুক্ত বা etymology র সাথে সঙ্গতি রেখেই হয়েছে...
হ + ইন্ধ, বা
হ + ইন্দু, বা
হি + ইন্ধ, বা
হি + ইন্দু
= হিন্দু
অর্থ একই থাকছে l
ঋগ্বেদের ঋষি ভারত সন্তানদের বলেছেন অমৃতস্য পুত্রা l সেই অমৃতই ইন্দু l সেই অমৃত দর্শনই ইন্ধ l
তা থেকেই ইন্দ্র l
হিন্দু তাই কোনো বিদেশী নাম নয় l বৈদিক অর্থবহ l
এই কারণেই হিন্দু বা হিন্দুধর্ম এই শব্দ গ্রহণ করেছে ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতীয় আইন l কারণ তা স্বাভাবিক l
যারা তর্ক করে যে হিন্দু বা হিন্দুধর্ম শব্দ বা নাম নিয়ে, তারা তাহলে ভারতের ঐতিহ্য শুধু নয়, ভারতের সংবিধান ও আইনের বিরোধিতা করছে l
ভারতের নাগরিক না হলে, মনের সুখে ওসব তর্ক করুন l কিন্তু ভারতীয় নাগরিক হয়ে হিন্দু শব্দ নিয়ে এলার্জি থাকলে চিকিৎসা করান l
না হলে আপনার জবাব দেবার দায় থাকছে
1. আপনি কেন অন্যের দেয়া নাম নিজের ব্যক্তিগত নাম বলে চালাচ্ছেন? কেন অন্যের দেয়া বলে নিজের নাম অস্বীকার করছেন না?
(মানে আইডেন্টিটি কার্ডে আপনার নিজের নাম, এবং হিন্দু ধর্মের হলে ফর্ম ফিলাপের সময় হিন্দু শব্দ বেমালুম লিখছেন l হিন্দু ম্যারেজ এক্টে অনেকে বিয়েও করছেন l অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নেবার সময়, রাষ্ট্রের মাটিতে খাওয়া দাওয়া বংশবৃদ্ধি ও মলত্যাগের সময় আপনাদের অনেকের মহান প্রাণে কষ্ট হচ্ছে না হিন্দু শব্দ নিয়ে )
2. কেন সংবিধান ও আইন অস্বীকার করছেন
তাহলে তৎকালীন ভারতবাসী নিজেদের কি বলতো?
মানুষকে বলত ভরত সন্তান l ঋগ্বেদ তার প্রমাণ l
রাষ্ট্র তো ছিলই l রাষ্ট্রের এক আদি অর্থ মানুষ l
হিন্দু ধর্মের আদি নাম ধর্ম, শুধুই ধর্ম l তার বৈদিক বিশেষণ হল সনাতন, ধ্রুব ও সত্য... অর্থাৎ সনাতন ধর্ম, সত্য ধর্ম, ধ্রুব ধর্ম... এরকমও বলা যায়...
আর এই ভূমির আদি নাম ভূ বা পৃথিবী মাতা l ঋগ্বেদে ভূমি বাচক "ভারত" সম্বোধন আছে l ক্রমে পঞ্চম বেদ বা মহাভারতে ভারতবর্ষ l পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতেও তার প্রমাণ l পাণিনির সময়কাল 900 bce থেকে 500 bce যে কোনো সময় l Goldstucker এর মতে 900 bce
যে কোনো হিসাবেই গ্রিকদের আসার অনেক আগে l
আবার পানিনিতে যবন শব্দ আছে l সেই হিসাবে গ্রিকদের সাথে আলেক্সান্ডার আসার অনেক আগেই আদানপ্রদান ছিল ধরে নিলে, এই মতই সিদ্ধ হচ্ছে যে গ্রিকরা ইন্দু থেকে বা ইন্ধ থেকেই india করেছে l
সিদ্ধান্ত l
হিন্দু বা India... উভয় শব্দের উৎপত্তি ইন্দ্র বা ইন্ধ থেকে l যার আবার উৎপত্তি ইন্দু থেকে l
তা থেকে আবার সিন্ধু হয়েছে l
তা থেকে আবার পুরানো হিন্দু ফিরেছে l
হিন্দু তাই বৈদিক শব্দ এবং বৈদিক ধর্মের অর্থবাহী l
হিন্দু মানে যার ইন্দু বা অমৃত আছে l অমৃতস্য পুত্রা l
বৈদিক ইন্দ্র হলেন বল, বিদ্যা, গতিময়তা বা dynamism, স্বরাট এবং সম্রাট, রাষ্ট্র প্রভৃতির প্রতীক l
হিন্দু শব্দ এই সমস্ত তাৎপর্য বহন করে l
আবারো স্মরণ করিয়ে দিই, হিন্দু স্বাভাবিক বৈদিক শব্দ বলেই, ভারতীয় সংবিধান ও আইন সেই শব্দ সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছে l
ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
No comments