ভরা ভাদ্রের আধোআঁধার আচ্ছন্ন দুপুরবেলায় আকাশ ভরা মেঘের থেকে অবিশ্রান্ত বারিধারা মনকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন সূদূরে-- যেখানে মানস চোখে দেখছি তাল তমাল ছাতিম বট অশ্বত্থের পল্লবের ঘন আচ্ছাদনের নীচে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুচার…
ভরা ভাদ্রের আধোআঁধার আচ্ছন্ন দুপুরবেলায় আকাশ ভরা মেঘের থেকে অবিশ্রান্ত বারিধারা মনকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন সূদূরে-- যেখানে মানস চোখে দেখছি তাল তমাল ছাতিম বট অশ্বত্থের পল্লবের ঘন আচ্ছাদনের নীচে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুচারটে গাইগরু তাদের প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে , পাশেই বটের শিকড়ের কোলে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় শুয়ে আছে কয়েকটি ছাগশিশু তাদের মায়ের কোলের বুকের কাছে ! উপর থেকে আশ্রয়দাতা বৃক্ষের ঘন সন্নিবিষ্ট পত্রপুঞ্জের গা বেয়ে মাঝেমাঝে আচমকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলি এসে ওদের লোমশ দেহকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে মজা করছে ! -- আমার মনে হচ্ছে এখনই ছুটে গিয়ে আদুর গায়ে ওদের জড়িয়ে ধরি আদর করি আর কিছু আম জাম কলা পাতা সংগ্রহ করে ওদের খেতে দিয়ে আমার পায়ের নীচে মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির জলের ধারায় দাপাদাপি লাফালাফি করে সময় কাটাই শিশুর মতো; হ্যাঁ মা প্রকৃতির কোলে এক সরল দুরন্ত শিশুর মতো ! যা বাবা! বর্ষার পরিবেশে তমালের বিষয়ে কিছু কথা লিখতে গিয়ে পথ হারিয়ে মন কোথায় যেন চলে যেতে চায়! এমনি আমার বাংলা মায়ের ভালবাসা এমনধারাই যেন আমার বঙ্গজননীর স্নেহের টান বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন সময়ে !
ফিরে আসি আবার তমালের প্রসঙ্গে !
অনেকেই জানেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে তমাল একটি অতি পবিত্র বৃক্ষ কারণ এই তমালের ডালে বসেই শ্রীকৃষ্ণ বাঁশী বাজিয়ে রাধাকে আহ্বান করতেন তার সঙ্গী হতে ! তাই রাধার কাছেও তমাল প্রিয় গাছ তাই তিনি সখিদের বলতে পারেন --
"না পুড়াইও রাধার অঙ্গ না ডুবাইও জলে ,
মরিলে তুলিয়া রাইখো তমালেরই ডালে!"
বিশ্ব কবি তমাল বৃক্ষকে উল্লেখ করে লিখেছেন-
'কোন তমালের কাননতলে মধ্যদিনের তাপে,
বনচ্ছায়ার শিরায় শিরায় তোমার
সুর কাঁপে!"
আবার তাঁর পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের "বাঁশী" কবিতায় তমালের উল্লেখ দেখতে পাই ---
"এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধূলিলগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী ,
তীরে তমালের ঘন ছায়া,
আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে,
তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর !
রুপসী বাংলার প্রাণের কবি জীবনানন্দের দাশের "বাংলার মুখে" দেখি তমালের নীল ছায়া :---
"চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ!"
সাহিত্যের আঙিনায় তমালকে খুঁজতে গিয়ে আবার মনে পড়ে যায় পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নক্সীকাঁথার মাঠের কবিতার কথা ! যেখানে বাংলা মায়ের প্রাণপ্রিয় কৃষক সন্তান 'রুপাইয়ের' রুপ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তমাল বৃক্ষের উপমার সাহায্য নিয়েছেন , লিখেছেন ----
"কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি- মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু,
গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু। "
কবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনা মতো আজও হয়তো গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে খুঁজে পাবো কালো ভ্রমর, রঙিন ফুল, কাঁচা ধানের পাতা, কচি মুখের মায়া জড়ানো রোদে পোড়া কৃষক 'রূপাই'কে,
কিন্তু বৈষ্ণব কবি বা জসিমুদ্দীনের সেই তমালতরু বা তমাল বৃক্ষকে কোথায় পাব ?
কল্পনায় কবিতায় গল্পে বইয়ের পাতার ছবিতে তাকে দেখলেও এখন আমার বাংলার গ্রামেগঞ্জে তার আর দেখা মেলা ভার ! ওপার বাংলায় শুনেছি তমাল গাছ রয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়! তবে কি তমালও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় পারুল গাছের মতোই !
হ্যাঁ অনেকটা তাই ! তমাল যা একসময় ছিল গ্রামে গঞ্জে বনে জঙ্গলে মাঝারি আকারের আরণ্যক বৃক্ষ, এখন তা একটি মহাবিপন্ন শ্রেনীর বৃক্ষ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে ! সুতরাং গাছটির সংরক্ষণ প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন !
নামধাম :-'
তমাল আদতে কোন দেশের তা জানা না গেলেও চীন ভারত সহ দক্ষা এশিয়ার প্রায় সব দেশেই এর দেখা মেলে বা মিলতো ! এই মুহূর্তের খবর অবশ্য সঠিক জানা নেই!
তমালের উদ্ভিদ জাগতিক নাম "ডাইওস স্পাইরাস মন্টানা " বা "ডাইওস স্পাইরাস কর্ডিফোলিয়া" !
কৃষ্ণ কালো তমাল শাখার ফাঁকে আকাশকে অপরুপ নীল দেখায় বলে বাংলাতে এর আরেক নাম নীলধ্বজ!
তা ছাড়াও আর ও অনেক নাম আছে তমালের ! ইংরেজিতে "মটল্ড এবনি"
মালয়ালমে "মনজাকারা" ,তামিলে "ভাকানাই" হিন্দিতে "বিস্তেন্দু" ইত্যাদি!
হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণব সম্প্রদায় তমালকে পবিত্র বৃক্ষের সম্মান দিয়ে থাকেন ৷ তবে সম্মান দিলেও আমরা এর সংরক্ষণ করার চেষ্টা করি নি ! এক সময় অবিভক্ত বঙ্গের মাঠ-ঘাটে, বন-জঙ্গলে সারি সারি তমাল গাছ দেখা যেতো৷ এখন তমাল বিরল এবং বিলীয়মান প্রজাতির বৃক্ষ৷
তমালের রুপ ও গুন :--
তমাল মধ্যমাকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ। কাঠ শক্ত, ঘরের আসবাব খুঁটি তৈরী সহ নানান কাজে লাগে ! তমাল গাছের ছাল ধূসর বর্ণের । পাতা গাঢ় সবুজ, উজ্জ্বল, দশ পনের ইঞ্চি লম্বা ও তিন চার ইঞ্চি চওড়া। ফুলগুলি সাদা, পুরু ও খসখসে। বসন্তে ফুল ফোটে ! ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে হলদে রঙের হয় !মসৃণ, গোলাকার ফলগুলি দেখতে অনেকটা ছোটো ছোটো আপেলের মতো ! ফলের সাধারণত একটি বীজ থাকে, কখনও কখনও দুটি তিনটি বীজ ও দেখা যায় ! বীজ লম্বাকৃতি দেখতে কাঁঠালের বীজের মতো।
বসন্তকালে তমালের ফুল ফোটে তারপর ফল ধরে ও গ্রীষ্মে ফল পাকে। পাকা ফল টকমিষ্টি সুস্বাদু। অনেকে জ্যাম তৈরির জন্যও ফল সংরক্ষণ করে রাখে। দক্ষিণ ভারতে এর ফল তেঁতুলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। শুকনো ফলের শরবত খেতে সুস্বাদু ! দক্ষিণ ভারতের তাপ্তি নদীর তীরে এই গাছটি প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় !
তমালের প্রচুর ভেষজ গুণ রয়েছে বলে জানা যায়! পাকা ফল পিত্ত নাশক, রুচিকারক, ক্ষুধাবর্ধক !
এর বীজ থেকে তৈরী মাখন থেকে প্রস্তুত ঔষধ ফাটা পায়ে লাগালে পা ফাটা সেরে যায় ! তমালের ফল,বীজ পাতা এবং নরম ডাল থেকেও মূল্যবান ভেষজ তৈরী করা হয়৷ তমালের ছালের রস শরীরের অতিরিক্ত পিত্তনাশে কার্যকরী !
সে যাই হোক পারুল গাছের মতো না হলেও তমাল গাছের অস্তিত্বও বিপন্ন তাই যারা গাছকে ভালবাসেন তারা এই বৃক্ষটির সংরক্ষণের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন এবং করবেন আশা করি !
(ছবি সংগৃহীত)
No comments