Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

" রুপবান হিজল" --সমীর ব্যানার্জী

"--চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ   জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থেরা করে আছে চুপ;   ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;    --"(জীবনানন্দ দাশ , বাংলার মুখ)এখনও দেখেছি যেখানেই যাই আর এই দুটো চোখ মেলে আমার রু…

 





"--চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ   জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থেরা করে আছে চুপ;  

 ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;

    --"(জীবনানন্দ দাশ , বাংলার মুখ)

এখনও দেখেছি যেখানেই যাই আর এই দুটো চোখ মেলে আমার রুপসী বাংলার,  কি সোনার বাংলার  রুপের যেটুকু হদিস পাই, সেখানেই মনে পড়ে কখনও  জীবনানন্দ, কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও  নজরুল , কখনও  জসিম উদ্দিন, কখনও শরৎচন্দ্র, কখনও বিভূতিভূষণ কিম্বা তারাশঙ্করের মতো বাংলা মায়ের অতি প্রিয় স্বনামখ্যাত  সন্তানদের ! আমার দেশ , আমার ভারত, আমার বাংলা, নিয়ে  আমার অন্তরে আমার গর্ব ও অস্মিতা সদাজাগ্রত আছে ও থাকবে  তবে এটাও ঠিক  হৃদয়ের এই গর্ব অহংকারের জন্ম ও বিকাশ তো  আমার জন্মভূমি  নদিয়া জেলায় অবস্থিত  আমার  গ্রাম আর  আমাদের শৈশব বাল্য ও কৈশোরের বিচরণ ভূমি থেকেই !

আমার নদিয়ার গর্ব:-

মাঝে মাঝে আমি নদিয়া জেলার গ্রামের  মানুষ বলে বেশ গর্ব অনুভব  করি !  কারণ এই জেলার গঙ্গা জলঙ্গী এবং চূর্ণি  নদী বিধৌত অতি  ঊর্বর জমির  মতো এখানকার সাংস্কৃতিক মাটিও যথেষ্ট উন্নত! এই জেলার দৈনন্দিনের  কথ্য ভাষাও যুক্ত বঙ্গের সমস্ত জেলার ভাষার মধ্যে সুমিষ্ট ও শ্রুতিমধুর !  তেমনি এই জেলার আছে আছে স্বনামখ্যাত  মিষ্টান্ন  কৃষ্ণনগরের  সরপুরিয়া সরভাজা ! ঘূর্ণির পুতুলের কথা আমাকে কি আর আলাদা করে বলতে হবে ?  বোধ হয়, না !  অনেকেই জানেন কোলকাতা শহর স্থাপনের বহু আগেই বাংলার সাংস্কৃতিক পীঠস্থান ছিল নবদ্বীপ এবং  তার পরবর্তীকালে ছিল  কৃষ্ণনগর!  এই তিন প্রধান নদী ছাড়াও  অসংখ্য খাল বিল ও দহ এই জেলার নদীমাতৃক  সৌন্দর্য ও তার  বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিয়ত প্রকটিত করে !

ঘাটিশ্বরের বেলের দহ :-

আমার পাঠক বন্ধুরা   দেশে গ্রামে  খালবিল নদীনালা  অনেকে দেখেছেন তবে 'দহ' কি তা  হয়ত অনেকে জানেন আবার  অনেকেই জানেন  না !  'দহের' দেখা সব জায়গায়  পাওয়া  যায়  না !   দহ বলতে বোঝায়  প্রাকৃতিক কারণে মূলত ভূমিকম্প জনিত  ভূমি বিপর্যয়ের ফলে হঠাৎ  তৈরী হওয়া বিশাল জলাধার  !  

নদিয়া জেলার ঘাটিশ্বরে গ্রামে  এই রকম একটি  বিশাল দহের একেবারে  পাড়ে ঘন সবুজ  বৃক্ষ আচ্ছাদিত একটি পাড়ায়  ছিল আমার দাদুর বাড়ি ! দহটির নাম 'বেলের দহ' ! বিশাল চওড়া সেই দহ! তার গভীর ,পরিস্কার জল এবং পাড়ের কাছে  আংশিক কচুরিপানা  আচ্ছাদিত ঘাটগুলিতে এলাকার  কর্মক্লান্ত নরনারী ও বালক বালিকা সহ বহু  মানুষ সকাল দুপুর সন্ধ্যায় পরিপূর্ণ  অবগাহন করে তৃপ্ত হতো !

এই বিল বা দহটির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল অতিপ্লাবন না হলে এর  জলস্তর সাধারণ  বন্যা বা খরায় খুব একটা  বাড়ে কমে না  ! ওটার সৃষ্টি হবার পিছনে একটি গল্প আছে পরে বলা যাবে সেটা !

 ভাবি ইয়ুরোপের কোনো দেশে এমন একটি সুদৃশ্য  স্থান থাকলে  তারা  সহজেই এই  দহটিকে একটি ট্যুরিস্ট  স্পট করে ফেলতো  ! যাক সে কথা!


হিজলের সাথে প্রথম পরিচয়:--

 সুতরাং  এই দহের  একটি ঘাটের একেবারে  ধারে একটু উঁচু ঢিবির ওপর  সেই দাদুর বাড়িটা  নিয়ে  আমার গর্ব কম ছিল না !  আর এই বিল বা দহের গভীর জলের  একটা ঘাটের পাশেই ছিল আমার জীবনে প্রথম দেখা একটি অতিব সুন্দর বৃক্ষ যার নাম হয়তো অনেকেই জানেন সেটা হল জীবনানন্দের কবিতায় উল্লেখিত  ঐ হিজল গাছ !  বিশাল আকারের ঘন সবুজ পাতার হিজল গাছটির  ছায়ায় আশ্রিত ঐ  ঘাটেই আমি মায়ের সাথে স্নান করতে গিয়ে সাঁতার শিখি !  ঘন সবুজ পাতায়  ভরা আর অসাধারণ  সৌন্দর্যের  গোলাপী লাল ফুলের ভারে অবনত দীর্ঘ পুষ্পমঞ্জরীর সৌন্দর্য  না দেখলে কাউকে বোঝানো মুশকিল ! 

যদিও বেলের দহ এখনও  প্রায় সেই  একই রুপেই বিদ্যমান তবে যতদূর জানি  নেই সেই আমার ছেলেবেলার মধুর স্মৃতির সাক্ষী  হিজল গাছটি!  ভাবলে দুঃখ  হয়  কি আর করা যাবে, তবে বেলের দহ তো আছে  এটাই সান্ত্বনা ! 

 মনে পড়ে গ্রাম বাংলার এই  শ্যামল সুন্দর ধুলিকাদা মাখা  পথে বাল্যকালেই  মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতে ঘুরতে জীবনে চিনেছিলাম দুটি বিখ্যাত গাছ একটা হল "বাঁদর লাঠি" যার ভাল নামটা পরে জেনেছিলাম  'অমলতাস' আর একটা হল আজকের এই  প্রতিপাদ্য বিষয়  হিজল গাছ ! অমলতাস এখন বহু জায়গায় সৌন্দর্যায়নের গাছ হিসাবে রোপন করা হয় বটে তবে হিজল গাছ আমি আমার দাদুর বাড়ির গ্রাম ছাড়া আর কোথাও দেখিনি ! তবে অবশ্যই এপার না হলে ওপাড় বাংলার বহু জায়গায় জলাশয় বা খাল বিলের ধারে  এই গাছটি আছে বলেই আমার বিশ্বাস! 

গাছের  বৈশিষ্ট্য ও বর্ণনা:- হিজলগাছের বৈজ্ঞানিক  নামটি খুব সুন্দর  "ব্যারিংটোনিয়া একিয়ুট এঙ্গুলা "  "Barringtonia Acutangula "

হিজলগাছ হল  মাঝারি থেকে বৃহৎ  ধরণের বৃক্ষ ! ডালপালার বিস্তার চারদিকে। সাধারণত জলজ পরিবেশে অর্থাৎ  কাদা জলের পরিবেশে  এই গাছ জন্মায়! এর বীজ থেকেই নতুন  গাছ হয়। উচ্চতায়  প্রায়  চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত  হয় এই গাছ ! ঘন  সবুজ পত্র সজ্জিত এর ডালপালা শাখাপ্রশাখার  বিপৌল বিস্তার দেখলে দূর থেকে বটগাছ বলে মনে হবে !

হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে। ফুলগুলি দেখতে খুবই সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের  আট দশ ইঞ্চি লম্বা পুষ্পদণ্ডের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফুটে থাকে।  ফুলগুলির বৈশিষ্ট্য  হল গভীর রাতে ফুল ফোটে, আর বেলা বাড়লে সূর্যের আলোতে  ঝরে পড়ে। হিজলের ফুলের একধরনের মাদকতা মাখানো মিষ্টি  গন্ধ আছে ! 

এর আর দু-একটি বৈশিষ্ট্য আছে  তার একটি হল এর প্রবল প্রাণশক্তি ! বন্যার জলে বা তীব্র খরাতেও  এ বেশ  ভালভাবেই টিঁকে থাকে দ্বিতীয়ত  জলের  নীচে কয়েক মাস ডুবে  থাকলেও এই  হিজলগাছ বেঁচে থাকতে পারে !!  শুনেছি বেলের দহে এক অনুসন্ধানকারী দল  গভীর জলের নীচে  এমন কয়েকটি হিজলের সন্ধান পেয়েছিলেন তবে প্রয়োজনীয়  যন্ত্রপাতির  অভাবে তাদের উদ্ধার করা বা জলের উপরে কেটে আনা সম্ভব  হয়নি ! 

হিজলের কাঠ নরম, শ্বেতবর্ণের  বর্ণের! বেশ  উজ্জ্বল মসৃণ টেকসই তাই  কাঠের আসবাব বানাতে কাজে লাগে !   আর জলে  নষ্ট হয় না বলে নৌকা বা জলযান  তৈরীতে ব্যবহৃত হয় !  এর ছাল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায় এছাড়াও উদ্ভিদটির মেডিসিনাল গুরুত্ব ও রয়েছে। 

জলাশয়ের  উপরিভাগে যখন এর ফুল ঝরে পড়ে তখন দেখতে অপূর্ব লাগে। হিজল ফুল শেষ হলে গাছে ফল আসে। ফলগুলি তেতো ও বিষাক্ত প্রকৃতির !  দেখতে অনেকটা ত্রিফলার  হরীতকীর মতো। 

যাই হোক আমার কাছে  সেই অনিন্দ্যসুন্দর হিজল গাছ মানেই জীবনানন্দ, হিজলগাছ মানেই  আমার দাদুর বাড়ির স্মৃতি ,হিজল গাছ মানেই আমার শৈশব , সর্বোপরি  হিজল গাছ মানেই কঠোর এবং অক্লান্ত অসাধারণ পরিশ্রমী  ও হাজার দুঃখ কষ্টে সদা হাস্যময়ী আমার মা , আমার মায়ের মুখের মধুর হাসি! 

( হিজলের গাছ পাতা ও ফুলের ছবি সংগৃহীত)

No comments