Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ঐতিহাসিক ও গৌরবময় আদিগঙ্গার সংক্ষিপ্ত কাহিনী

আদিগঙ্গা (অন্যান্য নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি বা সারম্যানের নালা বা টালির নালা) হল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নদীটিই ছিল হুগলি ন…

 





আদিগঙ্গা (অন্যান্য নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি বা সারম্যানের নালা বা টালির নালা) হল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নদীটিই ছিল হুগলি নদীর প্রধান ধারা। পরে এই ধারাটি ক্ষীণ হয়ে আসে। ভাগীরথী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। বহু প্রাচীনকালে গঙ্গা-ভাগীরথী আরও পশ্চিম দিকে রাজমহল, সাঁওতালভূমি, ছোটনাগপুর, মানভূম, ধলভূমের তলদেশ দিয়ে সোজা দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়ত এবং এই প্রবাহই ছিল অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণের সঙ্গম। এই নদী তিনটি তখন নাতিদীর্ঘ।

এই ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় অধুনা তমলুকে ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দর। এর পরবর্তীকালে গঙ্গার ক্রমশ পূর্বদিকে যাত্রা শুরু হলে তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ফরাক্কা থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত গঙ্গা-ভাগীরথী ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বজবজ, ফলতা, ডায়মন্ডহারবার হয়ে সমুদ্রে পতিত হত সরস্বতী নদী। তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হওয়ায় এই নদীর তীরে গড়ে ওঠে সপ্তগ্রাম বন্দর। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী (উল্লেখ্য, এই নদীটির সঙ্গে উত্তর ভারতের যমুনা নদী বা বাংলাদেশের যমুনা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই), মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি নদী বাঁক নিত (নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে হুগলি নদী বেতড়ের কাছে বাঁক নিত যেটি বর্তমানে গার্ডেনরিচের ঠিক উল্টোদিকে শিবপুর থেকে ব্যাতাইতলার মধ্যেকার অঞ্চল) এবং কালীঘাট, বারুইপুর, মগরা, গোচরণ, জয়নগর, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ, বড়াশী, খাড়ি, কাশীনগর ও কাকদ্বীপের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সাগরদ্বীপে (সম্ভবত এই সাগরদ্বীপে প্রাচীন বীর বাঙালি জাতি গঙ্গারিডিদের রাজধানী গঙ্গে বন্দরের অবস্থান ছিল) প্রবেশ করে ধবলাট ও মনসা দ্বীপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা।

আদিগঙ্গা তীরস্থ ছত্রভোগ প্রাচীনকালে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য বন্দর ছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউ-এন্ সাঙ্ এসেছিলেন এই ছত্রভোগে (৪র্থ শতক)। বড়াশীর কাছে প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান চক্রতীর্থ - আজও এখানে বহু প্রাচীন 'নন্দার মেলা' হয়। ছত্রভোগের পর গঙ্গা শতমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। তাই এখানে এসে ভগীরথ শতমুখী গঙ্গার আসল ধারাকে চিনতে পারেননি। তখন গঙ্গা হস্তস্থিত চক্র দেখিয়ে তাঁর স্থান নির্দেশ করেন। তবে সে সব কাব্য ও কিংবদন্তির কথা। তবে মজিলপুরের ঐতিহাসিক কালিদাস দত্ত আদিগঙ্গার প্রাচীন ধারাটি আবিষ্কার করেন। কাকদ্বীপের কাছে ঘিবাটী গাঙ আদিগঙ্গার শেষাংশ। তাই আজও লোক ওর পাশে শবদাহ করে এবং ঐ নদীতে গঙ্গাস্নান করে। ষোড়শ শতাব্দীর আগে গঙ্গার মূল স্রোতটি সরস্বতী নদীর খাতে বইত। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এটি হুগলি নদীর খাতে বইতে শুরু করে। সরস্বতী নদীর উচ্চ প্রবাহটি এখন শুকিয়ে গেছে। সেটি কেবল নিকাশি নালা রূপে হুগলির সাঁকরাইলের কাছে হুগলি নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। হুগলি নদী আদিগঙ্গাকে ত্যাগ করে এখন সরস্বতী নদীর নিম্ন প্রবাহটি ধরে সমুদ্রে মিশছে। আর যমুনা নদীটি বর্তমানে মজে যেতে থাকায় নদিয়া জেলার হরিণঘাটা থেকে এটি উৎপত্তি লাভ করেছে বলে মনে হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে এর প্রাচীন স্রোতধারাটি ভাগীরথী নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। নদীটি উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় প্রবেশ করার পর গাইঘাটা ও গোবরডাঙার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চারঘাটের কাছে ইছামতি নদীতে মিলিত হয়েছে। বসিরহাটের নিকট বাদুড়িয়া গ্রামের অধিবাসী বিপ্রদাস পিপলাই তাঁর মনসাবিজয় (মনসামঙ্গল) কাব্যে (১৪৯৫ খ্রীঃ) চাঁদ সদাগরের যাত্রাপথের বর্ণনায় চিৎপুর, বেতড়, কালীঘাট, চূড়াঘাট, বারুইপুর, ছত্রভোগ, বদ্রিকুণ্ড, হাতিয়াগড়, চৌমুখি, সাতামুখি ও সাগরসঙ্গমের (সাগর দ্বীপ) নাম উল্লেখ করেছেন। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের বর্ণনার সঙ্গে ভ্যান ডেন ব্রুকের ১৬৬০ খ্রীঃ আঁকা আদিগঙ্গার মানচিত্রটি হুবহু মিলে যায়। কোনো কোনো মতে, অতীতে আদিগঙ্গার ধারাটি শুকিয়ে যাওয়ায় কৃত্রিম খালের সাহায্যে সরস্বতী নদীর নিম্ন প্রবাহের সঙ্গে সেটিকে যুক্ত করে রাখা হয়েছিল, যাতে সমুদ্রগামী জাহাজগুলি আদিগঙ্গা ধরে সমুদ্রে উপনীত হতে পারে। বাংলার নবাব আলিবর্দি খান এই ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলে জানা যায়। অন্য মতে, আদিগঙ্গা যেখানে গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেখানে গঙ্গা ও সরস্বতীর মোহনার কাছে একটি জোয়ারের জলে পুষ্ট খাঁড়ি ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ওলন্দাজ বণিকরা জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য এই খাঁড়িটি বিভক্ত করেছিল।

১৫১০ খ্রীঃ শ্রীচৈতন্য শান্তিপুর থেকে নীলাচলে যাত্রাকালে আদিগঙ্গার তীর ধরে পদব্রজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে নৌকায় মেদিনীপুর হয়ে উড়িষ্যায় পৌঁছেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের ১৫ বৎসরের মধ্যে বৃন্দাবন দাস রচিত প্রথম চৈতন্য-জীবনী 'চৈতন্য-ভাগবত' (১৫৪৮ খ্রীঃ)-এ আছে – “এই মত প্রভু জাহ্নবীর কূলে কূলে। আইলেন ছত্রভোগ মহা কুতুহলে॥ সেই ছত্রভোগ গঙ্গা হই শতমুখী। বহিতে আছেন সর্বলোক করি সুখী॥ ছত্রভোগে গেলা প্রভু অম্বুলিঙ্গ ঘাটে। শতমুখী গঙ্গা প্রভু দেখিলা নিকটে॥” কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে (১৫৯০ খ্রীঃ) আদিগঙ্গার উভয় তীরস্থ বহু স্থানের উল্লেখ আছে। এই কাব্যে শ্রীমন্ত সদাগরের সিংহল যাত্রা প্রসঙ্গে বর্ণনা রয়েছে – “বালিঘাট এড়াইল বেনের নন্দন। কালীঘাটে ডিঙা দিল দরশন॥ তীরের প্রয়াণ যেন ঢলে তরিবর। তাহার মেলানি রহে মাইনগর॥ নাচনগাছা, বৈষ্ণবঘাটা বামদিকে থুয়া। দক্ষিণেতে পারাশাত গ্রাম এড়াইয়া॥ ডাহিনে অনেক গ্রাম রাখে সাধুবালা। ছত্রভোগে উত্তরিলা অবসান বেলা॥” এই সমস্ত রচনাবলী আদিগঙ্গার অস্তিত্বের স্বপক্ষে মুখ্য প্রমাণ বহন করে। প্রাচীন ছত্রভোগ এখন জলঘাটা, ছত্রভোগ, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, বড়াশী, কাশীনগর প্রভৃতি অনেকগুলি ছোট ছোট গ্রামে বিভক্ত। সুতরাং এই সমস্ত রচনাবলীর উপর নির্ভর করে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে অতীতে একসময় কাশীনগর অঞ্চলের উপর দিয়েই প্রবাহিত হত আদিগঙ্গা। 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদিগঙ্গা আদি কলকাতার অন্যতম বসতি গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমা নির্দেশ করত। এই জন্য সেই সময় এই নদীর নামকরণ হয় "গোবিন্দপুর খাঁড়ি"। ১৭১৭ খ্রীঃ দিল্লিতে কোম্পানি দৌত্যের সময় দূতদলের নেতা এডওয়ার্ড সারম্যান খননকাজ চালিয়ে এটির সংস্কার করেন বলে কিছুকালের জন্য এর নাম হয় "সারম্যানের নালা"। শেষ পর্যন্ত ১৭৫০ খ্রীঃ নাগাদ আদিগঙ্গা মজে যায় এবং গঙ্গা তার প্রাচীনতম ভাগীরথী (সরস্বতী) প্রবাহপথেই ফিরে যায়। ১৭৭৩ খ্রীঃ কর্নেল উইলিয়াম টালি এই মজা নদীটিকে (আদিগঙ্গা) খননকার্যের মাধ্যমে গভীর করে সার্কুলার খালের সঙ্গে যুক্ত করেন। তারপর এর নাম হয় "টালির নালা"। ১৭৭৫ খ্রীঃ কর্নেল টালি আদিগঙ্গার সঙ্গে বিদ্যাধরী নদীর যোগ স্থাপন করেন। তবে ১৯৩০ খ্রীঃ ধাপা থেকে পোর্ট ক্যানিং পর্যন্ত বিদ্যাধরী নদীর দীর্ঘ ৩৫ মাইল অংশও মজে যায়।

কর্নেল টালির সংস্কারের পর আদিগঙ্গা আবার নৌপরিবহণ-যোগ্য হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে জলপথ ব্যবহারের প্রবণতা কমে যায়। দ্রুত নগরায়ণের ফলে আদিগঙ্গার গভীরতা কমে যায়। সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর পর থেকেই আদিগঙ্গা মজে যেতে শুরু করে। তবে তখনও বেতড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আদিগঙ্গার নদীখাতে কিছু জল প্রবাহিত হত। কারণ ১১৭৫ খ্রীঃ লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসনে প্রদত্ত গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে জাহ্নবী প্রবাহিত হত - এ প্রমাণ রয়েছে। তবে যাইহোক, ১৭৫০ খ্রীঃ আদিগঙ্গা মজে যায় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর পরেই এই অর্বাচীন নদীর (আদিগঙ্গা) প্রবাহপথ সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এটি দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার একটি নিকাশি নালায় পরিণত হয়। নগরায়ণের ফলে আদিগঙ্গার অধিকাংশ অংশ শুকিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এই নদী খণ্ডিত অবস্থায় স্থানে স্থানে 'ঘোষের গঙ্গা', 'বোসের গঙ্গা' প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত হয়ে বৃহৎ পুষ্করিণী আকারে পূর্ণ গঙ্গা মর্যাদায় অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। এর তীরে তীরে এখনও বহু শশ্মানঘাট বিদ্যমান।

★★চিত্র টি নরোত্তম বাবু নিজে হাতেই এঁকেছেন। ম্যাপে নদীর গতিপথ দেওয়া হয়েছে কালো কালি তে। আদিগঙ্গার দুই পার্শ্ববর্তী কোথায় কোথায় প্রত্নক্ষেত্র আছে সেগুলো ও চিহ্নিত করা আছে।

No comments