Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

অম্বুবাচী তিথি কিছু কথা -তিলক পুরকায়স্থ

বর্তমান প্রজন্মের বোধহয় আদৌ জানা নেই , এটি আদতে একটি ধরিত্রী দেবীর আরাধনা উৎসব । আজ যখন নিজেকে আধুনিক প্রমান করার  অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে , ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কে অস্বী কার করা, তখন অনুরোধ করি, নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে এগুল…

 



 

 বর্তমান প্রজন্মের বোধহয় আদৌ জানা নেই , এটি আদতে একটি ধরিত্রী দেবীর আরাধনা উৎসব । আজ যখন নিজেকে আধুনিক প্রমান করার  অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে , ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কে অস্বী কার করা, তখন অনুরোধ করি, নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে এগুলিকে কুসংস্কার না ভেবে, এদের অন্তর্নিহিত বার্তা বোঝার চেষ্টা করুন।

 "কিসের বার কিসের তিথি,  আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বাবতী"।- আমাদের ছোটবেলায় মা- ঠাকুমার মুখে শোনা  এই কথাটি হয়ত এখনও  অনেকেরই মনে আছে।

  সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত অনেক পুজো, আর্চা, অনুষ্ঠান সম্মন্ধে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় কিছুই জানেনা।  এই তো সেদিন , ১৯৭০ সাল থেকে,জাতিসংঘের নির্দেশনায় , প্রতি বছর ২২ শে এপ্রিল দিনটিকে সারা পৃথিবীতে ধরিত্রী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে ।প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্মন্ধে আমরা এমন উদাসীন যে আমরা আদৌ জানি না যে, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয়রাও কিন্তু  নিজেদের মতন করে ধরিত্রী দিবস পালন করে আসত, অম্বুবাচী বা অম্বাবতী বা অমাবতী নাম দিয়ে । কিম্বা আমরা বিশ্বাস করি না, আমাদের পূর্বপুরুষরা এমন ধারা ভাবতে পারতেন বলে !

 বেদ-পুরান সর্বত্রই বসুন্ধরার উল্লেখ করা হয়েছে, ধরিত্রী মাতা বলে।শুধু তাই নয়, আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই অস্ট্রিক সভ্যতার মানুষেরা বিভিন্ন নামে ধরিত্রী মাতার পুজো করে এসেছে, এবং এখনও করছে। 

যেমন  ধরুন ওড়িশার কন্ধমাল জেলার কন্ধ আদিবাসীদের বিশ্বাস তাঁদের আদিমাতা হচ্ছেন ধরিত্রী দেবী বা 'দারনি'/টানা' পেনু এবং পিতা হচ্ছেন পর্বত দেবতা 'সারু পেনু'।

এঁদের সমাজের বিভিন্ন উৎসবের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে 'লাকা' শব্দটি।যেমন ফসল কাটার উৎসব 'সিসা লাকা', মহুয়া ফুলের উৎসব 'মারাঙ্গা লাকা'', আম খাবার উৎসব 'কেঁদু লাকা' ইত্যাদি। এই উৎসব কিন্তু আদতে পৃথিবী পুজো। ধরিত্রী মাতাকে  উৎসর্গ না করে এরা আম খায় না, মহুয়া ফুল কুড়োয় না এমন কি ফসল ও কাটেনা। 

প্রাচীন ভারতে এই ধরিত্রী দেবীর আরাধনা করা হত, অম্বুবাচী বা অমাবতী নাম দিয়ে। কিন্তু কিভাবে ?

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, কুমারী কন্যা নারীত্বে উন্নতি হয়ে যখন ঋতুমতী হন, তখনই সন্তান ধারণের সক্ষম হন এবং মাতৃ জাতিতে উন্নত হন।

সেভাবেই কৃষি নির্ভর ভারতীয় সভ্যতার ধারক ও বাহকেরা বিশ্বাস করতেন যে , আষাঢ় মাসের সাত তারিখ থেকে দশ তারিখ অবধি মাতা বসুন্ধরা ঋতুমতী হন। অবশ্যই এই বিশ্বাসের ভিত যুক্ত আছে প্রাচীন ভারতের কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে। অর্থাৎ অম্বুবাচী আদতে একটি কৃষিভিত্তিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মনে করা হত, নারী যেমন ঋতুচক্রের ফলে সন্তান ধারণের অধিকারী হতে পারেন, তেমনি আষাঢ় মাসে ঋতুমতী বসুন্ধরা , ভবিষ্যতে শস্যপূর্ন বসুন্ধরা রূপ ধারণ করে তাঁর অগুনতি সন্তানের মুখে খাদ্য তুলে দেবেন।

এই কারণেই এই চারদিন কৃষকেরা জমিতে হাল দেননা, মাটিই স্পর্শ করেন না। সন্ন্যাসী ও যোগীরা  মাটিকে আঘাত করেন না, অতি সন্তর্পণে হাঁটেন। পৃথিবীর বুকে আগুন না জ্বালিয়ে,কেবলমাত্র ফলমূল এবং কাঁচা দুধ পান করেন।  কিন্তু এই একই পদ্ধতি বর্তমানে কেবলমাত্র বিধবা  নারীরাই কেন পালন করেন, সেটা আমার মাথায় আসে না।

অম্বুবাচী পালনকে ধর্মীয় রূপ দিতে হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে যে, কামরূপের কামাখ্যা দেবীও এই কদিন ঋতুমতী থাকেন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জানতেন যে, সামাজিক অনুষ্ঠানকেও যদি ধর্মীয় মোড়কে পেশ করা যায়, তবে তার গ্রহনযোগ্যতা বেশি হয়। অম্বুবাচীর চারদিন কামাখ্যা মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে, কিন্তু এই কদিন সারা ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ ভক্ত মন্দির চত্বরে বসে কীর্তন গান করেন। হাজার হাজার নারী ভক্তরা কলস যাত্রা করেন।ছোট ছোট লাল কাপড়ের টুকরো মাথায় ও হাতে বেঁধে ভক্তরা ঘুরে বেড়ান।

সামাজিক ও ধর্মীয় শুচিবাই গ্রস্ত বর্তমানের পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণবাদি সমাজ যখন বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির দিনেও ,  সুস্থ স্বাভাবিক শারীর বৃত্তিয় প্রক্রিয়াকেও অশুচি বলে আখ্যায়িত করতে চায়, ভারতবর্ষের  অনেক মন্দির যখন ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ রুখতে চায়, তখন কি আমরা বিস্মৃত হই যে, কোন সেই সুদূর অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাতৃ শক্তির ঋতুচক্রের প্রতীক , ছোট ছোট লাল কাপড়ের টুকরোকে কেমন অবলীলায় ভক্তি ও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হননি।

আগে অম্বুবাচীর দিনে বাংলার অনেক ঘরেই কলাগাছের মান্দাস নির্মাণ করা হত। এর উপরে কলাপাতা  ঢাকা দিয়ে, সেই কলাপাতার উপরে একটি কাদামাটির ঢেলা বা ঢিপি তৈরি করে, সেই ঢিপির উপরে সিঁদুরের ফোটা , আতপ চাল, ধুপ, ধান দূর্বা, তুলসী পাতা ইত্যাদি দিয়ে লক্ষ্মী পুজো করা হত। পুজোর নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হত অনেক রকমের কাটা ফলমূল এবং কাঁচাদুধ। পুজো শেষ করে প্রসাদ বিতরণের পরে , মান্দাসটিকে ভাসিয়ে দেওয়া হত। এখন আধুনিকতার গ্রাসে আর এরকম উৎসব পালন হয়না।

ধরিত্রী মাতাকে প্রনাম করে বলি- 

মাতা জননী ধরিত্রী, দয়াদ্র হৃদয়া সতী।

দেবীভ্যো রমণী শ্রেষ্ঠা নির্দ্দোশা সর্বদুঃখ হারা।

তথ্যসূত্র- বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ, গুপ্তযুগ, সেনযুগ থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। দেশ প্রকাশন।


No comments