Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সাহিত্যসম্রাটের আদিপর্ব’ রানা চক্রবর্তী

সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা গদ্য সাহিত্যের পিতামহ ভীষ্ম বললে কোন অত্যুক্তি করা হয় না। অথচ এই বঙ্কিমচন্দ্রই তাঁর সাহিত্য জীবন গদ্য দিয়ে নয়, পদ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন। শুরুতে তিনি যে গদ্য সাহিত্য লিখতেন সেটার ভাষ…

 





সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা গদ্য সাহিত্যের পিতামহ ভীষ্ম বললে কোন অত্যুক্তি করা হয় না। অথচ এই বঙ্কিমচন্দ্রই তাঁর সাহিত্য জীবন গদ্য দিয়ে নয়, পদ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন। শুরুতে তিনি যে গদ্য সাহিত্য লিখতেন সেটার ভাষা ছিল অপাঠ্য ও বিষম! শুধু তাই নয়, নিজের সাহিত্য জীবনের শুরুর দিকের একটা সময়ে তিনি বাংলা চর্চা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে ইংরেজি সাহিত্য ও চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, এমনকি একটা আস্ত ইংরেজি উপন্যাসও লিখেছিলেন। তাঁর সাহিত্য জীবন নিয়ে ইতিহাসের পাতা উল্টালে পাওয়া যায় বেশ কিছু অদ্ভুত ও অজানা তথ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-সাধনার যে মুদ্রিত ইতিহাস পাওয়া যায়, সেটা থেকে দেখা যায় যে, তিনি ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে (তখন তাঁর বয়স ছিল, ১৩ বছর ৮ মাস) লিখতে শুরু করে, ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে (৫৫ বছর ৯ মাস) অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে লেখার কাজ থেকে বিরত হয়েছিলেন; অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র নিজের জীবনের ৪২ বছর ধরে সরস্বতীর সেবা করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-জীবন তাঁর ছাত্র জীবন থেকে শুরু হয়ে, তাঁর সমগ্র কর্মজীবন অধিকার করে তাঁর শেষ জীবনের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-জীবনকে মোটামুটি চারিটি পর্বে বিভক্ত করা যেতে পারে - (১) আদিপর্ব: ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ তাঁর রচনা প্রকাশ থেকে আরম্ভ করে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র প্রকাশকাল পর্যন্ত ১৩ বছর, (২) উদ্যোগপর্ব: ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শনে’র প্রকাশকাল পর্যন্ত (বৈশাখ ১২৭৯ বঙ্গাব্দ) ৭ বছর, (৩) যুদ্ধপর্ব: ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘প্রচার’ পত্রিকার বিদায়কাল পর্যন্ত ১৭ বছর, (৪) শান্তিপর্ব: ১৮৮৯ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল তারিখে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ৫ বছর। প্রথম দুই পর্বে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন লেখক, তৃতীয় পর্বে ছিলেন সম্পাদক ও সমালোচক এবং চতুর্থ পর্বে তিনি হয়েছিলেন মহাভারতের পিতামহ ভীষ্মের মতন উপদেষ্টা।

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য জীবনের উদ্যোগপর্বে তাঁর গুরু ছিলেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’ এবং তাঁর সতীর্থ ‘দীনবন্ধু মিত্র’ ও ‘দ্বারকানাথ অধিকারী’ প্রভৃতি ব্যক্তিরা। বঙ্কিমচন্দ্র তখন ‘হুগলী কলেজের’ ছাত্র ছিলেন। সেই সময়টায় কলকাতার সাহিত্য সমাজে ‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’র বড় প্রাধান্য ছিল; সাহিত্যযশোলোলুপ ছাত্রসমাজের উপর তাঁর অসীম প্রভুত্ব ছিল। তাঁরা তাঁকেই আদর্শ করে তখন গদ্য ও পদ্য লিখতেন। পরে সেই বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছিলেন, “বাঙ্গালা সাহিত্যের তখন বড় দুরবস্থা। তখন প্রভাকর সর্বোৎকৃষ্ট সংবাদপত্র। ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গালা সাহিত্যের উপর একাধিপত্য করিতেন। বালকগণ তাঁহার কবিতায় মুগ্ধ হইয়া তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য ব্যগ্র হইত। ঈশ্বর গুপ্ত তরুণবয়স্ক লেখকদিগকে উৎসাহ দিতে বিশেষ সমুৎসুক ছিলেন। হিন্দু পেট্‌রিয়ট (হিন্দু পেট্রিয়ট) যথার্থই বলিয়াছিলেন, আধুনিক লেখকদিগের মধ্যে অনেকে ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য। ... দীনবন্ধু প্রভৃতি উৎকৃষ্ট লেখকের ন্যায় এই ক্ষুদ্র লেখকও ঈশ্বর গুপ্তের নিকট ঋণী।” বঙ্কিমের সেই শিষ্যত্বের ফল হয়েছিল ‘সংবাদ প্রভাকরে’ প্রকাশিত তাঁর লেখা কয়েকটি ঋতুবর্ণনা অথবা উত্তর-প্রত্যুত্তরমূলক কবিতা, কবিতাকারে একটি ‘বিচিত্র’ ও একটি ‘বিষম বিচিত্র’ নাটক এবং দুই-একটি টুকরো গদ্য রচনা। সেই সময়ে তাঁর লেখা ‘ললিতা ও মানস’ কাব্যও ছিল সেই প্রভাবের ফল। সেই সময়ের রচনা থেকে ভবিষ্যৎ বঙ্কিমচন্দ্রের সম্ভাবনা আবিষ্কার করা দুরূহ বিষয়; কারণ, তাঁর তখনকার লেখাগুলো ছিল ‘পয়ারে’ বা ‘ত্রিপদী’তে ঈশ্বর গুপ্তের ব্যর্থ অনুকরণ, তাঁর লেখা রচনাগুলো ছিল জায়গায় জায়গায় অস্পষ্ট এবং জায়গায় জায়গায় স্পষ্টতঃ অশ্লীলতা দোষদুষ্ট। পরবর্তীকালে যে প্রতিভা এক দিন সমগ্র বঙ্গদেশকে বিস্মিত ও চমকিত করেছিল, সেটার কোনও আভাস সেগুলিতে পাওয়া যায় না। তবে একজন চৌদ্দ বা পনেরো বছর বয়সের বালকের পক্ষে সেই ধরণের রচনা যে বিস্ময়কর, তাতে কোন সন্দেহ নেই; আর কিছু না থাকুক, সেগুলোতে বঙ্কিমের ‘অকালপক্বতার নিদর্শন’ অবশ্যই পাওয়া যায়। ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘ললিতা ও মানস’ প্রকাশিত হওয়ার পরে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর তথাকথিত কাব্যচর্চা এক রকম প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। নিজের উপন্যাসের মাঝে মাঝে তিনি দুই একটি ছড়া অথবা সঙ্গীত জুড়ে দিতেন, অথবা ‘বঙ্গদর্শনে’ কদাচিৎ কখনও তিনি দুই-একটি গাথা অথবা ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা লিখেছিলেন। পরবর্তী কালে ছন্দোবদ্ধ কাব্যসরস্বতীর সঙ্গে এটাই ছিল তাঁর একমাত্র সম্পর্ক। কিন্তু যতি ও মিলের সংশ্রব ত্যাগ করলেও বঙ্কিমের কবিপ্রকৃতি কখনও স্বধর্মচ্যুত হয়নি; তাঁর উপন্যাস মাত্রেই কাব্যধর্মী, তাঁর গদ্য - গদ্যকাব্য। বঙ্কিমচন্দ্রের কবি মন বিশেষকে ত্যাগ করে সামান্যকে আশ্রয় করেছিল বলেই তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্য এতখানি ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত হতে পেরেছিল৷ শেষে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-জীবন ও কাব্য-জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। অতি শৈশব থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের বাণীপ্রকৃতি প্রকাশের যে সুযোগ খুঁজছিল, ঈশ্বর গুপ্ত’র দেখানো পথে এবং তাঁর আদর্শে সেটা সার্থকতা লাভ না করলেও “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” তখনই ঘটেছিল; কারণ সৃষ্টিরহস্যের সন্ধান পেয়ে তাঁর ভিতরের আবেগ তখন পুষ্টিলাভ করেছিল। তবে বঙ্কিমের সাহিত্য জীবনে “ঈশ্বর গুপ্তের প্রদত্ত শিক্ষার ফল” সম্ভবতঃ “স্থায়ী বা বাঞ্ছনীয়” হয়নি, সেকালের শিক্ষিত সমাজের রুচি ও শিক্ষার মাপকাঠিতে ঈশ্বর গুপ্তের “রুচি তাদৃশ বিশুদ্ধ বা উন্নত” ছিল না বলেই “তাঁহার শিষ্যেরা অনেকেই তাঁহার প্রদত্ত শিক্ষা বিস্মৃত হইয়া অন্য পথে গমন করিয়াছেন।” (বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী) বঙ্কিমচন্দ্রও অন্য পথে গিয়ে গুরুর ঋণ অস্বীকার করেননি। তিনি ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিতে’ লিখেছিলেন, “প্রভাকর বাঙ্গালা রচনার রীতিও অনেক পরিবর্তন করিয়া যান। ... আর একটা ধরণ ছিল, যা কখন বাঙ্গালা ভাষায় ছিল না, যাহা পাইয়া আজ বাঙ্গালার ভাষা তেজস্বিনী হইয়াছে। নিত্য নৈমিত্তিকের ব্যাপার, রাজকীয় ঘটনা, সামাজিক ঘটনা, এ সকল যে রসময়ী রচনার বিষয় হইতে পারে, ইহা প্রভাকরই প্রথম দেখায়। ... আর ঈশ্বর গুপ্তের নিজের কীর্ত্তি ছাড়া প্রভাকরের শিক্ষানবিশদিগের একটা কীৰ্ত্তি আছে। দেশের অনেকগুলি লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ লেখক প্রভাকরের শিক্ষানবিশ ছিলেন।” বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-সাধনার আদিপর্বের ইতিহাসে ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর অপর দুই শিষ্য - ‘দীনবন্ধু মিত্র’ ও ‘দ্বারকানাথ অধিকারী’র নামও বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমস্যা হল, সেই যুগের ইতিহাস সম্পূর্ণ জানবার কোন উপায় এখন নেই; অধুনা দুষ্প্রাপ্য ‘সংবাদ প্রভাকরে’র পৃষ্ঠায় সেটার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। শিষ্যেরা নিজেদের লেখা পাঠাচ্ছেন আর তাঁদের গুরু সেগুলো ‘উৎসাহবাচক টিপ্পনী’ সমেত নিজের সংবাদপত্রে প্রকাশ করছেন, কখনও কখনও উপদেশও দিচ্ছেন, এই রীতি এই যুগে আর দেখা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র সেই উৎসাহ পেয়েছিলেন। তৎকালীন ‘হুগলী কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেব’, ‘রংপুরের তুষভাণ্ডারের জমিদার রমণীমোহন চৌধুরী’ ও ‘কুণ্ডি পরগণার ভূস্বামী কালীচন্দ্র রায় চৌধুরী’ - বঙ্কিমচন্দ্রকে নানা ভাবে উৎসাহিত করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সব উৎসাহের মূলে ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত নিজে; তিনি শুধুমাত্র পিঠ চাপড়ে দিতেন না, সাথে পথও দেখাতেন। কথিত আছে, তিনিই বঙ্কিমচন্দ্রকে পদ্য ছেড়ে গদ্য-রচনায় উৎসাহিত করেছিলেন।                            

সাহিত্য জীবনের আদিপর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের কবিতা যদি বা পড়া যেত, তাঁর গদ্য ছিল অপাঠ্য ও বিষম! একটা নমুনা দেখা যাক -  “যে লপনেন্দু শত২ শশধর সঙ্কাশ শোভা পাইতেছে, সে বদন কদম মণ্ডিত হওত মৃন্মণ্ডলে পতিত থাকিবেক, যে নয়নে অনুরেণু অসি অনুমান হয় বায়স বায়সী নখাঘাতে সে নয়নোৎপাটন করিবেক। যে রসনা প্রমদাধর রসনা পান করিয়া অন্য রস পান করে না, সে ওষ্ঠ নষ্ট হইয়া লোষ্ট্র ভক্ষণে কষ্ট পাইবেক।” কিছু বোঝা গেল কি? বর্তমানে এই ধরনের বাংলা গদ্য পড়লে কেউ কি আর বাংলা পড়তে চাইবেন? ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘কমলাকান্ত’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘সীতারাম’ - লেখকের উপরোক্ত রচনা আজকের দিনে পাঠক-পাঠিকার মধ্যে যে ভীতি ও বিস্ময়ের উদ্রেক করবে সেটা বলাই বাহুল্য৷ ঈশ্বর গুপ্তের নিজের গদ্য রচনা প্রাঞ্জল ছিল না, কিন্তু বঙ্কিমের সেই সময়ের রচনা পড়ে তিনিও শঙ্কিত হয়ে লিখেছিলেন - “ইহার লিপিনৈপুণ্য জন্য অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলাম, কিন্তু যেন অভিধানের উপর অধিক নির্ভর না করেন ...। (বঙ্কিম) রচনায় আর সমুদয় বঙ্কিম করুন, তাহা যশের জন্যই হইবে, কিন্তু ভাবগুলীন্‌ প্রকাশার্থ যেন বঙ্কিমভাষা ব্যবহার না করেন ...।” তবে সুখের কথা হল, বঙ্কিমের সেই জাতীয় গদ্য ও পদ্য রচনা ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই সম্ভবতঃ সমাপ্ত হয়েছিল। তাঁর ‘ললিতা। পুরাকালিক গল্প৷ তথা মানস’ নামক কাব্যগ্রন্থখানিও ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের রচনা। ছাত্র জীবনে বঙ্কিমের উপরে দীনবন্ধু মিত্রেরও কিছু প্রভাব পড়েছিল। ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মানব-চরিত্র’ শীর্ষক দীনবন্ধুর একটি কবিতা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “উহা আমাকে অত্যন্ত মোহিত করিয়াছিল। আমি ঐ কবিতা আদ্যোপান্ত কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম, এবং যত দিন সেই সংখ্যার সাধুরঞ্জনখানি জীর্ণগলিত না হইয়াছিল, তত দিন উহাকে ত্যাগ করি নাই। সে প্রায় সাতাইশ বৎসর হইল; এই কাল মধ্যে ঐ কবিতা আর কখন দেখি নাই; কিন্তু ঐ কবিতা আমাকে এমনই মন্ত্রমুগ্ধ করিয়াছিল যে অদ্যাপি তাহার কোন কোন অংশ স্মরণ করিয়া বলিতে পারি।” (দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) বঙ্কিমচন্দ্র সম্ভবতঃ তখনও ‘প্রভাকরে’ লিখতে আরম্ভ করেন নি। দীনবন্ধুর রচনা তাঁকে কাব্যরচনায় উৎসাহিত করে থাকতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম গ্রন্থ ‘ললিতা। পুরাকালিক গল্প। তথা মানস’ ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হলেও সেটা ছাপা হয়েছিল ১৮৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে৷ বঙ্কিমচন্দ্র তখনও ‘হুগলী কলেজ’ ছেড়ে ‘প্রেসিডেন্সী কলেজে’ যাননি। এর পরে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র প্রকাশকাল পর্যন্ত বঙ্কিমের বঙ্গবাণী-সেবার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ সেই সময়ের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র একটু বেশি পরিমাণ ‘ইংরেজীনবিশ’ হয়েছিলেন, কলেজে ইংরেজীতে তাঁর অসাধারণ অধিকার জন্মেছিল, সেই সময় সংস্কৃত-কাব্য ও ইউরোপীয় ইতিহাস তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং সেই সময় যে তিনি ইংরেজী রচনার দিকে ঝুঁকেছিলেন, সেটার প্রমাণ ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘Indian Field’ নামক সাপ্তাহিকে প্রকাশিত তাঁর ইংরেজী উপন্যাস ‘Rajmohan’s Wife’-এ পাওয়া যায়। ‘ললিতা ও মানসে’ও তাঁর ইংরেজীনবিশির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে তিনি ‘শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের’ কাছে বলেছিলেন, “বরাবর বাঙ্গালা অপেক্ষা ইংরেজী লেখা ও বলা তাঁর পক্ষে অধিক সহজসাধ্য।” (‘সাধনা’, শ্রাবণ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ) ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা রচনার একটিমাত্র পৃষ্ঠার সমসাময়িক মুদ্রিত নিদর্শন বর্তমানে পাওয়া যায়। সেটাও আবার ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর নিজের লেখা ‘ললিতা ও মানসে’র বিজ্ঞাপনের একটি পৃষ্ঠা। বঙ্কিম সেটা গদ্যেই লিখেছিলেন, এবং সেই গদ্যও ছিল ভয়াবহ। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনার কিছু আগে তিনি স্বরচিত ইংরেজী উপন্যাস ‘Rajmohan’s Wife’-এর বঙ্গানুবাদ নিজেই শুরু করেছিলেন, সেটা তাঁর মৃত্যুর ২৫ বৎসর পরে ‘শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ প্রণীত ‘বারিবাহিনী’ নামক উপন্যাসে যুক্ত করা হয়েছিল। বঙ্কিমের নিজের লেখা ‘ললিতা ও মানসে’র বিজ্ঞাপনটির একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। তাই বিজ্ঞাপনটি এখানে উল্লেখ করা দরকার।

“সুকাব্যালোচক মাত্রেরই অত্র কবিতা দ্বয় পাঠে প্রতীতি জন্মিবেক যে ইহা বঙ্গীয় কাব্য রচনা রীতি পরিবর্তনের এক পরীক্ষা বলিলে বলা যায়। তাহাতে গ্রন্থকার কতদূর সুত্তীর্ণ হইয়াছেন তাহা পাঠক মহাশয়েরা বিবেচনা করিবেন। তিন বৎসর পূর্ব্বে এই গ্রন্থ রচনা কালে গ্রন্থকার জানিতে পারেন নাই যে তিনি নূতন পদ্ধতির পরীক্ষা পদবীরূঢ হইয়াছেন। এবং তৎকালে স্বীয়মানস মাত্র রঞ্জনাভিলাষজনিত এই কাব্য দ্বয়কে সাধারণ সমীপবর্ত্তী করিবার কোন কল্পনা ছিল না কিন্তু কতিপয় সুরসজ্ঞ বন্ধুর মনোনীত হইবায় তাঁহাদিগের অনুরোধানুসারে এক্ষণে জন সমাজে প্রকাশিত হইল। গ্রন্থকার স্বকৰ্ম্মার্জিত ফলভোগে অস্বীকার নহেন কিন্তু অপেক্ষাকৃত নবীন বয়সের অজ্ঞতা ও অবিবেচনা জনিত তাবৎ লিপিদোষের এক্ষণে দণ্ড লইতে প্রস্তুত নহেন।

গ্রন্থকার।”

পরে এই রচনাটি নিয়ে ‘অক্ষয়চন্দ্র সরকার’ বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “অতি অল্প বয়সেই বঙ্কিমচন্দ্র ইংরাজি কবিতার রস উপভোগ করিতে পারিতেন। এই সময় হইতেই তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চ্চা করিতে থাকেন; কিন্তু সংস্কৃত অপেক্ষা ইংরাজি সাহিত্যে তিনি অধিকতর প্রবেশ লাভ করেন।” (বঙ্কিম- প্রসঙ্গ, পৃ. ১২৭, ১৩১) ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের আগে বাংলা গল্প-সাহিত্যের কিন্তু নিতান্ত দুরবস্থা ছিল না। অক্ষয়চন্দ্র লিখেছিলেন, “১৮৫৬ সালের বঙ্কিমবাবুর বিজ্ঞাপন পাঠে মনে হয়, এই গদ্য-সম্পৎ বঙ্কিমবাবু একান্ত উপেক্ষা করিয়াছিলেন। ... সমস্ত লেখাটী পড়িলেই মনে হয়, সাগরী যুগের রঙ্গ এই লেখার একটুও প্রতিফলিত হয় নাই। সেই অপূর্ব্ব গদ্যের প্রসাদগুণের প্রভাব এই বিজ্ঞাপনে প্রকাশ পায় নাই। মনে হয়, গ্রন্থকার সেই গদ্যের প্রভাব তখন অনুভব করেন নাই - প্রত্যুত সেই গদ্য একান্ত উপেক্ষাই করিয়াছেন।” (বঙ্কিম- প্রসঙ্গ, পৃ. ১২৭, ১৩১) ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্কিমের সাহিত্য-সাধনার যাবতীয় নিদর্শন তাঁর ‘ললিতা ও মানস’ পুস্তকে ও ‘সংবাদ প্রভাকরে’র পৃষ্ঠায় রক্ষিত ছিল। পরে ‘সংবাদ প্রভাকর’ থেকে বঙ্কিমের কয়েকটি গল্প ও পদ্য রচনা ‘শচীশচন্দ্রের’ ‘বঙ্কিম-জীবনী’তে পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছিল; বাকি যতগুলি সংগ্রহ করতে পারা গিয়েছিল, সেগুলো ‘বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী’র ‘বিবিধ’ খণ্ডে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।                          

বঙ্কিমের কনিষ্ঠ সহোদর ‘পূর্ণচন্দ্র’ বঙ্কিমের বাল্যশিক্ষার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “শৈশবে মেদিনীপুরে অবস্থানকালে তিনি স্থানীয় স্কুলের হেড মাস্টার মিঃ টীড ও স্থানীয় ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ মলেটের গৃহে খুব বেশী যাতায়াত করিতেন; টীড-পত্নী ও মলেট-পত্নী তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং আপন আপন ছেলেমেয়েদের লইয়া তাঁহার সহিত প্রায়ই গল্পগুজব করিতেন। ইহার ফলে তাঁহার ইংরেজী শিক্ষার ভিত্তিপত্তন একটু দৃঢ় ভাবেই হইয়া থাকিবে।” তারপর হুগলী কলেজে, বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি লিখতে ও পড়তে এত দূর দক্ষ হয়েছিলেন যে, ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বাংলা ভাষার চর্চা করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁর মনোবৃত্তি কি ধরনের ছিল, সেটা তিনি নিজেই পরবর্তী কালে (১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে) ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনে’ দেওয়া “A Popular Literature for Bengal” বক্তৃতায় এইভাবে বর্ণনা করেছিলেন - “আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের মাতৃভাষায় পুস্তক রচনা করিতে অভিলাষী নহেন। ... যে তীব্র বুদ্ধি, তেজস্বী বাঙ্গালী যুবক ঠিক ইংরেজের মতন ইংরেজী ভাষায় কথা কহিতে ও লিখিতে পারে, সে মনে করে, বাঙ্গালা ভাষায় পুস্তক রচনা করা হীনবৃত্তি-মাত্র। ...” (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ, সাহিত্য, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৯৮-৯৯) এরপরে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর লেখা ‘বেনামী’ একটা প্রবন্ধে তিনি সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে লিখেছিলেন, “অৰ্দ্ধ-শিক্ষিত ক্ষিপ্র লেখকগণই বাঙ্গালা গ্রন্থেব প্রণয়নে ব্রতী। এই কাৰ্য্যে শিক্ষিত বাঙ্গালীর বিজাতীয় ঘৃণা আছে, এবং ইহারা মাতৃ ভাষায় লেখা নিতান্ত অপমানজনক মনে করেন।” (মন্মথনাথ ঘোষের অনুবাদ, বাঙ্গালা সাহিত্য, পৃ. ১৫) বঙ্কিমচন্দ্রের সেই যুগের ইংরেজী রচনার কোন অস্তিত্ব বর্তমানে পাওয়া যায় না৷ ‘বঙ্কিম-জীবনী’র লেখক ‘শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’, তাঁর গ্রন্থে, বঙ্কিমের লেখা ‘Adventures of a Young Hindu’ বলে একটা ইংরেজি লেখার কথা উল্লেখ করেছিলেন (পৃ. ১.৮), কিন্তু সেই লেখার অস্তিত্বের প্রমাণ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি। ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে বঙ্কিমের কাব্যচর্চা ছেড়ে দেওয়ার যে কারণ দেখিয়েছিলেন, সেটা হল - “সন্ধিস্থলে বঙ্কিমচন্দ্র আবির্ভূত হইলেন। তিনি যৌবনের প্রারম্ভে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া পদ্যরচনাতে সিদ্ধহস্ততা লাভ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু মধুসূদনের দীপ্ত প্রভাতে আপনাকে পরীক্ষা করিয়া জানিতে পারিলেন যে সে পথ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে হইবে। কিন্তু তিনি শুভক্ষণে গদ্যরচনাতে লেখনী নিয়োগ করিলেন৷ অচিরকালের মধ্যে বঙ্গের সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল তারকার ন্যায় বঙ্কিক দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। বঙ্গবাসীর চিন্তা ও চিত্তের উম্মেষ পক্ষে যত লোক সহায়তা করিয়াছেন তন্মধ্যে ইনি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি।” (পৃ. ২৫২) ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলন’, সপ্তম অধিবেশনের (কলকাতা, ১৩২০ বঙ্গাব্দ) অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ তাঁর অভিভাষণে বঙ্কিমের সেই যুগের সাধনার কথা এইভাবে উল্লেখ করেছিলেন - “বঙ্কিমবাবু ইতিহাস ও নবেল পড়িতে বড় ভালবাসিতেন। তখন ভারতবর্ষের ইতিহাস ছিল না ও হয়ও নাই৷ বঙ্কিমবাবু ইউরোপের ইতিহাস খুব ভাল জানিতেন। ভারতবর্ষের মুসলমান ও ইংরাজ অধিকারে যে সকল ইতিহাস ছিল, তাহা সমস্তই তিনি পড়িয়াছিলেন। কলেজে তিনি সংস্কৃত পড়েন নাই। টোলে সংস্কৃত কাব্য ও নাটক অনেকগুলি পড়িয়াছিলেন। তিনি যখন স্কুলে পড়েন, তখন ঈশ্বর গুপ্তের খুব প্রভাব। তাঁহার সংবাদ প্রভাকর সকলেই পড়িতেন। বঙ্কিমবাবু, দীনবন্ধুবাবু ও জগদীশ তর্কালঙ্কার - এই তিন জন ঈশ্বর গুপ্তের নিকট বাঙ্গালা লেখার শিক্ষানবিশী করিতেন। এই শিক্ষানবিশীতে পরিপক্ব হইযয়া বঙ্কিমবাবু বাঙ্গালা নবেল লিখিতে আরম্ভ করেন।” ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাস থেকে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কলকাতার ছাত্র জীবন। সেই সময়ে তিনি সম্ভবতঃ পড়াশুনা ও পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে তাঁর চাকরি জীবন আরম্ভ হয়েছিল। যশোহরে গিয়েই ‘দীনবন্ধু মিত্রের’ সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এবং সেই পরিচয় পরে ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর নব আসক্তির মূলে সেই ঘনিষ্ঠতা কতখানি কাজ করেছিল, এখন সেটা কেবলমাত্র আন্দাজ করা যেতে পারে; কিন্তু ‘যশোহর’ থেকে ‘নেগুয়াঁ’ হয়ে ‘খুলনা’য় আসা পর্যন্ত সেটার কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। খুলনায় তিনি ‘Rajmohan’s Wife’ রচনা করেছিলেন ও ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে সেটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক গবেষণার দিকে তখন পর্যন্ত যে তাঁর ঝোঁক ছিল, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন, ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট থেকে তাঁকে কলকাতা ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র সভ্যতালিকাভুক্ত হতে দেখা গিয়েছিল; ‘মধুসূদন-বন্ধু’ ‘গৌরদাস বসাক’ ঐ বছরের ১লা জুলাই তারিখে তাঁর নাম প্রস্তাবিত করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সভ্যরূপে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খুলনা থেকেই অর্থাৎ ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের আগেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ভবিষ্যৎ বঙ্কিমের সূচনা দেখা দিয়েছিল। নিষ্ঠার সঙ্গে বিমাতার সেবা করে মাতৃভক্ত বঙ্কিমের তৃপ্তি হয়নি, ‘Rajmohan’s Wife’ ইংরেজিতে রচনা করে তাঁর মনে সম্ভবতঃ ধিক্কার জন্মেছিল। কিন্তু তাঁর কল্পনা তখনও দিগন্তবিস্তারী ছিল না, মূলধনও ছিল কম - তাই বঙ্কিমচন্দ্র প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ নিজেই নিজের ইংরেজী উপন্যাসের অনুবাদ করতে বসেছিলেন৷ এক অধ্যায়, দুই অধ্যায়, তিন অধ্যায় – অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন পুরুষের পক্ষে কোনও কিছুর পুনরাবৃত্তি সুখপ্রদ ও সহজসাধ্য নয়৷ এরপরে আর তাঁর অনুবাদ এগোয় নি। ‘রাজমোহনের স্ত্রী’ সূত্রপাতেই বিনষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পাতাগুলো রয়ে গিয়েছিল - সেগুলো ছিল বঙ্কিমের সন্দিগ্ধ ব্রীড়াবনতা প্রতিভার প্রথম লজ্জারুণ বিকাশ! একটা অদ্ভুত ব্যাপার সেই কয়েকটি পৃষ্ঠায় লক্ষ্যণীয়। ‘সংবাদ প্রভাকরে’র আদর্শে যে ভাষা বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র অবলম্বন ছিল, ‘রাজমোহনের স্ত্রী’ লিখতে বসে বঙ্কিমচন্দ্র সেই ভাষাকে নির্মমভাবে ত্যাগ করিবার চেষ্টা করেছিলেন। ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ অর্থাৎ ‘প্যারীচাদ মিত্র’র ‘মাসিক পত্রিকা’ এবং ‘আলালের ঘরের দুলাল’ তখন তিনি দেখেছিলেন এবং পরবর্তী কালে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “... ‘আলালের ঘরের দুলালের’ দ্বারা বাঙ্গালা সাহিত্যের যে উপকার হইয়াছে, আর কোন বাঙ্গালা গ্রন্থের দ্বারা সেরূপ হয় নাই এবং ভবিষ্যতে হইবে কি না সন্দেহ। ... উহাতেই প্রথম এ বাঙ্গালা দেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাঙ্গালা সর্ব্বজন মধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থরচনা করা যায় ...। এই কথা জানিতে পারার পর হইতে উন্নতির পথে বাঙ্গালা সাহিত্যের গতি অতিশয় দ্রুতবেগে চলিতেছে। বাঙ্গালা ভাষার এক সীমায় তারাশঙ্করের কাদম্বরীর অনুবাদ, আর এক সীমায় প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। ইহার কেহই আদর্শ ভাষায় রচিত নহে। কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলালের’ পর হইতে বাঙ্গালি লেখক জানিতে পারিল যে, এই উভয় জাতীয় ভাষার উপযুক্ত সমাবেশ দ্বারা এবং বিষয়ভেদে একের প্রবলতা ও অপরের অল্পতা দ্বারা আদর্শ বাঙ্গাল গদ্যে উপস্থিত হওয়া যায়।” (বাঙ্গালা সাহিত্যে ৺প্যারীচাদ মিত্রের স্থান, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) সেই “বাঙ্গালি লেখক” ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র নিজে। বিষয় ও প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যাসাগরী রীতি (‘কাদম্বরী’ এর চরমতম উদাহরণ) এবং আলালী রীতির সমন্বয় সাধন করে বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে রক্ষা করেছিলেন। ‘Rajmohan’s Wife’-এর অনুবাদটুকু সেই অপূর্ব সমন্বয় চেষ্টার প্রথম নিদর্শন হিসাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাচীন ও নবীন রীতির সেই দ্বন্দ্বের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য জীবনের আদিপর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল এবং ভবিষ্যৎ বঙ্কিম-প্রতিভার স্ফুরণ দেখা দিয়েছিল। তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনা এগিয়ে চলেছিল। আয়োজন এবং উপকরণ সম্পূর্ণ ছিল; ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস ও ভাষায় অসামান্য দখল, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অধিকার, বিদ্যাসাগর ও টেকচাঁদের আদর্শ, যুগাবতারের প্রতিভাস্পর্শে যে সৌধের ভিত্তিপত্তন হয়েছিল, সমগ্র বাঙালী জাতিকে যে সেটা এক দিন আশ্রয় দেবে, সেই আলো-অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে কেউ কি সেটা কল্পনা করতে পেরেছিল?                             

(তথ্যসূত্র:

১- বঙ্কিম-প্রসঙ্গ, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি।

২- সঞ্জীবনী সুধা, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

৩- বঙ্কিম জীবনী, শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

৪- সাহিত্য সাধক চরিতমালা, শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

৫- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী।

৬- বঙ্কিম রচনাবলী।)

No comments