============================দক্ষিণেশ্বর মন্দির কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। কলকাতার জানবাজারের বিখ্যাত রাণী রাসমনি ১৮৫৫ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। রানির কথায়, কাশী যাওয়ার পথে স্বয়ং দেবী কালী স্বপ্নে …
============================
দক্ষিণেশ্বর মন্দির কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। কলকাতার জানবাজারের বিখ্যাত রাণী রাসমনি ১৮৫৫ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। রানির কথায়, কাশী যাওয়ার পথে স্বয়ং দেবী কালী স্বপ্নে তাঁকে বলেন, “ কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দিরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে জ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি পূজা কর। সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই আমি পূজা গ্রহণ করব।” এই স্বপ্নের পর রানি গঙ্গাতীরে জমি ক্রয় করেন এবং মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। আসুন জেনে নিই এই মন্দিরের কিছু অজানা তথ্য।
১] স্বপ্নাদেশ পাওয়া মাত্র কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়েন রাণী। আর কাজে নামামাত্র তিনি একটার পর একটা বাধার সম্মুখীন হন। প্রথম বাধা আসে জমি নিয়ে। অগত্যা জমির খোঁজ জ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি
শুরু হল পূর্বপাড়ে। প্রথমে ভাটপাড়ায়। সেখানে বলরাম সরকার জমি দিতে রাজি হলেন। কথাবার্তা পাকা। কিন্তু শেষমুহূর্তে ভাটপাড়ার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের চাপে তিনি বেঁকে বসলেন। এক বিধবা মন্দির তৈরি করবে, এটা মেনে নিতে পারেনি গোঁড়া হিন্দুসমাজ।
২] শেষমেশ জমি কেনা হল দক্ষিণেশ্বর গ্রামে। প্রাচীনকালে এই জায়গাটার নাম ছিল শোণিতপুর। বানরাজার রাজত্বের মধ্যে ছিল ওই গ্রাম। বানরাজাই নাকি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দক্ষিণেশ্বর। সেখানেই পাওয়া গেল জমি। জমির মালিক ছিলেনজ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি তখনকার কলকাতার সুপ্রীম কোর্টের অ্যাটর্নি জন হেস্টি। ২০ একর জমি কিনতে খরচ হল ৫৫ হাজার টাকা। লোকমুখে জায়গাটি পরিচিত ছিল সাহেবান বাগিচা নামে। এর একটি অংশ ছিল কচ্ছপাকার মুসলমান গোরস্থান। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
৩] প্রথমে ঠিক হয়েছিল, দেশীয় মিস্ত্রিদের দিয়ে তৈরি হবে মন্দির। তাদের বরাতও দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ এগোতে লাগল ধীরগতিতে। তার মধ্যে গঙ্গার প্রবল বানে সব নষ্ট। তখন খানিকটা বাধ্য হয়েই রাণী বরাত দিলেন সাহেবি নির্মাণ সংস্থা ম্যাকিনটসবার্ন কোম্পানিকে। ১৮৫০ সালে তারা মন্দির তৈরির কাজ শুরু করে।
৪] মন্দিরটি একটি বিশাল বিস্তৃত ইমারত। সিঁড়িযুক্ত একটি উঁচু বেদির উপর এটি অবস্থিত। দক্ষিণমুখী তিনতলাবিশিষ্ট এ মন্দিরেরজ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি
নয়টি মোচাকৃতি চূড়া আছে। এগুলিই উপরের জ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি
দুটি তলা জুড়ে স্থাপিত। চূড়াগুলির ছাদ চমৎকার শিরাল পিড়ার মতো। মন্দির কক্ষের সংলগ্ন একটি অপ্রশস্ত আচ্ছাদিত বারান্দা দর্শকের কক্ষ হিসেবে ব্যবহূত হয়।
৫] এই মন্দির তৈরি করতে তখনকার দিনে রাণীর খরচ হয়েছিল ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে মূর্তিপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ঐতিহ্যগত নবরত্ন রীতিতে নির্মিত এই বর্গাকার জ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি
মন্দিরটির প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য ১৪.২ মি এবং এর উচ্চতা প্রায় ৩০.৪৮ মি। এটি কলকাতার অন্যতম বৃহৎ মন্দির।
৬] মন্দিরের সামনে একটি দীর্ঘ ও প্রশস্ত নাটমন্দির (নাচঘর) আছে। এছাড়া এ মন্দির এলাকায় আরও কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির রয়েছে।
৭] মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রাণীকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত।
৮] রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তাঁর সাধনক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। এই সময় থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে অবস্থান করেন। তাঁর অবস্থানের কারণে পরবর্তীকালে এই মন্দির একটি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়।
৯] মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। মূল মন্দিরটি তিন তলা। উপরের দুটি তলে এর নয়টি চূড়া বণ্টিত হয়েছে। মন্দির দক্ষিণমুখী। একটি উত্তোলিত দালানের উপর গর্ভগৃহটি স্থাপিত। এই দালানটি ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত ও ১০০ ফুট উঁচু।
১০] গর্ভগৃহে সহস্র পাঁপড়ির রৌপ্য-পদ্মের উপর শায়িত শিবের বুকের উপর দেবী দক্ষিণা কালীর মূর্তি দন্ডায়মান। এক খণ্ড পাথর কুঁদে তৈরি হয়েছে এই দেবীমূর্তি। এখানে মা পূজিতা হন ভবতারিণী কালী রূপে।
১১] কালী মন্দিরের পশ্চিমে হুগলি নদীর তীরে চাঁদনী স্নানঘাটের উভয় পার্শ্বে ছয়টি করে মোট বারোটি সারিবদ্ধ পূর্বমুখী শিব মন্দির বাংলার আটচালা রীতিতে দণ্ডায়মান।
১২] মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরে একটি রুপোর সিংহাসনে সাড়ে একুশ ইঞ্চির কৃষ্ণ ও ষোলো ইঞ্চির রাধামূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এবং রানী রাসমণির গৃহদেবতা(রঘুুবীর, জনার্দন(কৃষ্ণ) , নাড়ু- গোপাল) বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরে অধিষ্ঠান করছেন।
১৩] মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁর পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে, যা আজ পুণ্যার্থীদের কাছে ধর্মস্থানরূপে বিবেচিত হয়।
১৪] মন্দির এলাকার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ঘিরে আছে অতিথি কক্ষ এবং অফিস কক্ষসমূহের সারি। মূল কালী মন্দির এবং সংলগ্ন অন্যান্য মন্দিরে কোনো শিলালিপি নেই। জ্যোতিষার্ণব শ্রী সৌম্যজ্যোতি
পোড়ামাটির ফলকে নির্মিত কয়েকটি ফুলেল নকশা আর মূল মন্দির ও নাটমন্দিরের গায়ে প্লাস্টার দিয়ে করা কিছু অলংকরণ ছাড়া এতে তেমন কোনো অলংকরণের চিহ্ন দেখা যায় না।
১৫] শ্রী রামকৃষ্ণ বাসও করতেন মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে, আজ যা মহাতীর্থ। রোজ হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন তাঁকে প্রণাম জানাতে। কাছেই পঞ্চবটি (অশ্বথ, বট, বিল্ব, অশোক ও আমলকী)। শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে নিয়মিত সাধনায় বসতেন।
১৬] মন্দির চত্বরে ঢোকার আগে রয়েছে রাণী রাসমণির মন্দির। আর গঙ্গার পাড় ধরে রয়েছে দ্বাদশ শিবমন্দির। সুবিস্তীর্ণ মন্দির প্রাঙ্গণে আরেক দ্রষ্টব্য লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির।
No comments