Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শুধুই কি সতীদাহ রদ?’ রানা চক্রবর্তী

১৮০৯ খ্রীস্টাব্দ। পয়লা জানুয়ারি। স্থান - ভাগলপুর। বেলা পড়ে এসেছে। ঘড়িতে তখন চারটে। তখন রাস্তাঘাট পিচঢালা ছিল না। ধুলো উড়ত, জলে কাদায় কাদা হয়ে যেত। সেই ধুলোওড়া রাস্তা দিয়ে একটি পাল্কি যাচ্ছিল। পাল্কিই তখন ছিল যাতায়াতের অভি…

 





                                

১৮০৯ খ্রীস্টাব্দ। পয়লা জানুয়ারি। স্থান - ভাগলপুর। বেলা পড়ে এসেছে। ঘড়িতে তখন চারটে। তখন রাস্তাঘাট পিচঢালা ছিল না। ধুলো উড়ত, জলে কাদায় কাদা হয়ে যেত। সেই ধুলোওড়া রাস্তা দিয়ে একটি পাল্কি যাচ্ছিল। পাল্কিই তখন ছিল যাতায়াতের অভিজাত গাড়ি। ধুলো উড়ছিল। পাল্কির দরজা ছিল বন্ধ। পাল্কি চলছিল দ্রুত চালে। পাল্কির সঙ্গে ছিলেন পরিচারকরা। তাঁরাও যাচ্ছিলেন বেহারাদের সঙ্গে সঙ্গে। পাল্কি ভাগলপুরের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিল। রাস্তায় লোকজন ছিল না। থাকবেই বা কোত্থেকে। তখন রাস্তায় বেরোলেই তো ছিল সাদা সাহেবের হুঙ্কার। কালো আদমি তাঁদের ভয়েই জড়সড় থাকতেন। সেলাম সেলাম। তাতেও রেহাই ছিল না। দু’এক ঘা চাবুক যখনতখন নেমে আসতে পারত। তাই খুব জরুরি কাজ থাকলে রাস্তা থেকে নেমে মাঠপথ ধরতেন সাধারণ মানুষ। মোঘল আমল থেকে ওরকমই চলে আসছিল। বাদশা হুকুম দিয়েছিলেন তাঁর কর্মচারী যখন রাস্তা দিয়ে যাবে তখন তাঁকে কুর্নিশ করতে হবে। সেই কুর্নিশ করা মানুষটির দিকে রাজকর্মচারী তাকাতেও পারেন, নাও পারেন। সেই ব্যবস্থাই চলে আসছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলেও। তবে সেই আমলে অবস্থাটা যেন আরও ভয়ংকর আকার নিয়েছিল। সভ্যদেশের মানুষ ইংরেজ। অসভ্য ভারতের মানুষকে তাঁরা মানুষ বলে গণ্য করবে কেন? কিন্তু তাঁদের কিছু জানার তখনও বাকি ছিল। মোঘল আমল থেকে ছাতা মাথায় অথবা ঘোড়ায় চড়ে কিংবা পাল্কিতে চড়ে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর সামনে দিয়ে যাবার উপায় ছিল না। নিয়ম ছিল - ছাতা বন্ধ করো - ঘোড়ার থেকে নেমে পড়ো - পাল্কি থেকে উঠে এসো - যাও এবারে। সেই রাস্তা দিয়ে পাল্কি যখন চলছিল তখন সেখানকার কালেক্টর স্যর ফ্রেডরিক হ্যামিলটন একটা ইঁটের পাঁজার উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সামনে দিয়ে চাপরাশি বরকন্দাজ নিয়ে একজন চলে যাবে? কী দুঃসাহস! কী আস্পর্ধা! হ্যামিলটনের মর্যাদায় ঘা লেগেছিল। পাল্কির আরোহী তো নামেন নি। রেগে আগুন হয়েছিলেন হ্যামিলটন। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে নিয়ে পাল্কিকে আটকেছিলেন! ভেতরের আরোহী নেমে এসেছিলেন। তিনি ভদ্রভাবে নমস্কার জানিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেছিলেন। সাহেবের রাগ দেখে আরোহী যত বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন হ্যামিলটন তত রেগে উঠছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাঁর পরিচারকরা সাহেবকে দেখতে পাননি। দেখলে তাঁকে সম্ভ্রম জানানো হত। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কী করেন আরোহী মানুষটি। তাঁরও তো মর্যাদা আছে। রায়রায়ান বংশের ব্রাহ্মণ ছিলেন তিনি। তাঁর মেলামেশা ছিল দেশী-বিদেশী অভিজাতদের সঙ্গে। তাই কথা না বাড়িয়ে সাহেবকে উপেক্ষা করে আবার তিনি পাল্কিতে উঠেছিলেন। চলে এসেছিলেন ভাগলপুরে। কিন্তু ঘটনাটাকে হালকা ভাবে নেন নি মানুষটি। বুঝেছিলেন এর প্রতিবাদ করতে হবে। নইলে এঁদের দাপট বেড়েই যাবে। সূর্যের চেয়ে বালির তাত বেশি - এই যারা ভাবে, তাঁদের শিক্ষা দিতে হবে। কিছুদিন পর তিনি লর্ড মিন্টোর কাছে ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে সেটির প্রতিকারের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁকে মোঘল আমলের ছেঁড়া তমশুককে বাতিল করতে বলেছিলেন। মিন্টো এর পরই আদেশ দিয়েছিলেন হ্যামিলটন যেন ভবিষ্যতে এরকম অসদ্ব্যবহার না করেন। যে আইন মানুষের পক্ষে অবমাননাকর সেটাকে বাতিল করার প্রতিজ্ঞা সেদিন সেই মানুষটি নিয়েছিলেন। তিনি পেরেওছিলেন আইনের সংশোধন করতে, নতুন আইন তৈরি করার পরামর্শ দিতে। সেই মানুষটিই ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ঘৃণ্য সতীদাহ প্রথা রদ করায় প্রধান ভূমিকা নেওয়া নিঃসন্দেহে রামমোহন রায়ের জীবনের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। কিন্তু এছাড়া কি ইতিহাসে তাঁর অন্য কোন অবদান নেই? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। রামমোহন যেভাবে একজন যোদ্ধার মতন তৎকালীন হিন্দু সমাজের পচা-গলা শবকে চিতায় তুলে দিয়ে সৎকারের মহৎ কাজ করার সাহস দেখিয়েছিলেন, তাঁর আগে কেউ তা করে দেখাতে পারেননি। প্রথা ভাঙার জন্যই যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল।

                                ©️রানা©️

নবাবী আমল। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রাম। সেই গ্রামের তখন খুব নামডাক ছিল। সেখানে বাস করতেন ‘রায়রায়ান’ বংশের মানুষেরা। নবাবের কাছে তাঁদের খাতির ছিল। নবাবের কর্মচারী হিসাবে ছোটখাট জমিদার ছিলেন তাঁরা। প্রচুর জমির মালিক রায়রায়ান বংশের ছিল প্রচুর বিত্ত। রামমোহন ছিলেন সেই বংশেরই ছেলে। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৭৭৪ খ্রীস্টাব্দের ২২শে মে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন রামমোহনের জন্ম ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে। তাঁর পিতা রামকান্ত রায়ের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন তিনি। তাঁর মাতা ছিলেন তারিণী দেবী। রামকান্ত রায়ও নবাবের কর্মচারী ছিলেন। অর্থে, প্রতিপত্তিতে তিনি তখন ছিলেন একজন কীর্তিমান পুরুষ। রামকান্ত রায়ের তিন স্ত্রী-র মধ্যে তারিণী দেবী ছিলেন দ্বিতীয়। সেই মহিলা তেজস্বিনী, প্রখর বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠাবতী ছিলেন। রামমোহনের জীবনে তাঁর মায়ের প্রভাব পড়েছিল। রামমোহনের শিক্ষার আরম্ভ সেই রাধানগর গ্রামেই হয়েছিল। তখন নবাব দরবারে চাকরি করতে গেলে আরবি-ফারসি শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। তাই রামমোহনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাটনায়। আরবি-ফারসিতে রামমোহন কেবল বিদ্যাচর্চাই নয়, একেবারে মজে গিয়েছিলেন। সেই দুই ভাষাকে তিনি এমন আয়ত্ত করেছিলেন যে সেই ভাষায় কথা বলতে, আলোচনা করতে, চিন্তাভাবনা করতে তাঁর কোনো অসুবিধাই হত না। এমনকী কঠিন জিনিসকে পর্যন্ত তিনি সহজ করে বলতে লিখতে পারতেন আরবি ও ফারসিতে। পাটনায় তিনি কতদিন ছিলেন সেটা আজও জানা না। রামমোহনকে তারপর সংস্কৃতশিক্ষার জন্য কাশীতে চলে যেতে হয়েছিল। সেখানেও তিনি কতদিন ছিলেন তা আজও অজ্ঞাত। অ্যাডাম (রামমোহনের বন্ধু) সাহেব লিখেছিলেন কাশীতে রামমোহন দশ বছর ছিলেন। তখন কাশী ছিল সংস্কৃতচর্চার বিখ্যাত জায়গা। সেই সময় বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের বাস ছিল সেখানে। ওই দশ বছরে সংস্কৃত সাহিত্যভাণ্ডার লুঠ করে নিয়েছিলেন রামমোহন। বেদবেদান্ত, মীমাংসা, স্মৃতিশাস্ত্র, কাব্যশাস্ত্র তখন ছিল তাঁর নখদর্পণে। সেই দুই ভাষায় বিদ্বান রামমোহন যে সমাজে ও রাজদরবারে সম্মানিত ব্যক্তিরূপে পরিচিত হয়েছিলেন তাতে ঐতিহাসিকদের কোনও সন্দেহ নেই। সেই পড়াশোনার সময়েই ধর্ম সম্পর্কে রামমোহনের মনে জিজ্ঞাসা জেগেছিল। আর এতকাল ধর্ম বলে হিন্দু-মুসলমান যা মেনে এসেছিলেন সেটি সম্পর্কেও রামমোহনের সন্দেহ জেগেছিল। ষোল বছর বয়সে নাকি তিনি একটি ছোটো প্রবন্ধও লিখে ফেলেছিলেন। আর একেশ্বরবাদের দৃষ্টি নিয়ে ১৮০৪ খ্রীস্টাব্দে লিখেছিলেন ‘তুফাৎ উল মুয়াহিদিন’ নামে চাঞ্চল্যকর একটি বই। রামমোহন প্রথম জীবনে চোদ্দ বছর বাড়িতে ছিলেন। সেই সময়ে তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারকে। নন্দকুমার তখন ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক, পরে হয়েছিলেন তন্ত্রসাধক। তখন তাঁর নাম হয়েছিল হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধৃত। রামমোহন তো বসে থাকবার লোক ছিলেন না। তিনি নন্দকুমারের কাছে সংস্কৃত বিদ্যার পাঠ নিয়েছিলেন। আর নন্দকুমারের ঝোঁক ছিল তন্ত্রসাধনার দিকে, ফলে রামমোহনও তন্ত্রবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তন্ত্রের হাড়হদ্দ জেনে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর তিনি গিয়েছিলেন তিব্বতে। সেখানে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পথের কষ্ট সহ্য হয়েছিল। কিন্তু যেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তিব্বতে লামাদের ঈশ্বর বলে পুজো করা হচ্ছে, তাঁর মন বিদ্রোহ করে উঠেছিল। এ কেমন কথা? ঈশ্বর তো এক। সেখানে লামারা সকলেই ঈশ্বরের জায়গা নিয়েছিলেন। রামমোহন প্রতিবাদ করেছিলেন। এতে মৌচাকে ঢিল পড়েছিল। রামমোহনকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা শুরু হয়েছিল। তিনি পালিয়ে আসার পথ পাননি। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তিব্বতের মেয়েদের দয়ায়। তাঁরাই রামমোহনকে ভারতে ফিরে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রামমোহন জীবনে ভুলতে পারেননি সেই তিব্বতি মায়েদের কথা। রামমোহন যে পরে নারীর জন্য এত ভেবেছিলেন সে তো তিব্বতের মেয়েদের কাছ থেকেই তাঁর শেখা। এরপরে রামমোহন রাধানগরের বাড়ি ছেড়ে তাঁর বাবার সঙ্গে লাঙুলপাড়ায় চলে এসেছিলেন। সেখানে তাঁর বাবা রামকান্ত রায় নতুন করে ভিটে তৈরি করেছিলেন। সেটা ১৭৯১ খ্রীস্টাব্দের কথা। সকলের সঙ্গে রামমোহনও বাবার বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন ওই সময়ে। হঠাৎ কী হয়েছিল সেটাকে জানা যায় না - রামকান্ত রায় একটি উইল করে তাঁর বিষয়সম্পত্তি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। রামমোহনের ভাগে পড়েছিল - বাড়ির কিছু অংশ ও আশি বিঘের মতো জমি। রামমোহনের ভাগে রামকান্ত রায়ের কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িটিও পড়েছিল। রামকান্ত এরপরে বর্ধমানরাজের চাকরি নিয়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। রামমোহন মা-কে নিয়ে লাঙুলপাড়াতেই থেকে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে বর্ধমানে যেতেন। বিষয়কর্মের জন্য কলকাতায়ও গিয়েছিলেন কয়েকবার। ভুরশুটেও তাঁর জমিদারি ছিল। সেখানেও যেতে হত রামমোহনকে। রামমোহন তাঁর জমিদারির এলাকা বাড়িয়েই চলেছিলেন। কিনে নিয়েছিলেন গোবিন্দপুর ও রামেশ্বরপুরের দুটি তালুক। সেজে তালুক দুটির আয় ছিল বছরে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। এরপরে রায়পরিবারে নেমে এসেছিল দারুণ দুর্যোগ। রামকান্ত দেনার দায়ে পরেছিলেন। তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। রামমোহনের দাদা জগমোহনও দেনার দায়ে জেলে গিয়েছিলেন। রামমোহনের বিচক্ষণতা এসব বিপদ থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিল। তিনি কিছুকালের মধ্যেই কলকাতা ঘুরে এসেছিলেন এবং রংপুরে দেওয়ানি পাবার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। সেই উপলক্ষে রামমোহনকে সেকালের সাহেবসুবোরা ভালো সুপারিশপত্র দিয়েছিলেন। ১৮০১ খ্রীস্টাব্দেই রামমোহন কলকাতায় জন ডিগবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। জন ডিগবি ছিলেন উঁচু পদের ইংরেজ সিভিলিয়ান। রামমোহনের শিক্ষাদীক্ষা এবং আধুনিক চিন্তা গঠনে গুরুতর ছিল তাঁর প্রভাব। কলকাতায় এসে রামমোহন রোজগারে মন দিয়েছিলেন। উডফোর্ড সাহেবের দেওয়ান ছিলেন কিছুদিন। ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে তাঁর পিতা রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হয়েছিল। রামকান্তের শ্রাদ্ধ কে করবেন সেটক নিয়ে গোলমাল দেখা দিয়েছিল। ঘোঁট পাকানো হয়েছিল। শেষে রামমোহন কলকাতায় শ্রাদ্ধ করেছিলেন, তাঁর মা তারিণী দেবী লাঙুলপাড়ায় শ্রাদ্ধ করেছিলেন আর জগমোহন শ্রাদ্ধ করেছিলেন মেদিনীপুর জেলে। আমাদের মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার কী বিচিত্র গতি! রামমোহন তখন সম্পন্ন ব্যক্তি। সে তো সহজেই বোঝা যায়। পৈতৃক সম্পত্তি, নিজের কেনা জমির আয়, দেওয়ানি করার সূত্রে অর্থলাভ, কোম্পানির কাগজপত্র কেনাবেচা করে আয়। কম কী! ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত রামমোহন ডিগবির কাছাকাছি ছিলেন। তিনি জন ডিগবির সেরেস্তাদার এবং দেওয়ান ছিলেন। রামগড়, যশোহর, ভাগলপুর, রংপুর এই সব জায়গায় তিনি ডিগবির সঙ্গে ছিলেন। আসলে ডিগবির অধীনে রামমোহন যে চাকরিই করেছিলেন এমন নয়, চাকরি চলে গেলেও ডিগবি তাঁকে ছাড়েননি। ডিগবির মুনশি হয়ে ছিলেন রামমোহন বেশির ভাগ সময়। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্র ছিল দৃঢ়। লোকে রামমোহনকে বলত ‘ডিগবির দেওয়ান’। এবারে রামমোহনের ভুটানযাত্রার কথা বলা যাক। জলপাইগুড়ির কাছে ভুটানের সীমান্ত মরাঘাটের সীমানা নিয়ে গণ্ডগোল চলছিল। রামমোহন ডিগবির সঙ্গে সেই সীমানা বিরোধের সমাধানের জন্য কুচবিহার গিয়েছিলেন। কিন্তু ডিগবি শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেননি। ভুটানের রাজা বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। সেবারে সেরেস্তার কর্মচারী কৃষ্ণকান্ত বসুর সঙ্গে রামমোহন দূত হয়ে ভুটানে গিয়েছিলেন। ভুটানের পথও ছিল দুর্গম। আর দুর্গম পথে যাবার আগ্রহ তো রামমোহনের ছিলই। ভ্রমণ আর ভ্রমণ - এই নেশাই তাঁকে বিশ্বপথিক করে তুলেছিল। গোয়ালপাড়া থেকে বিজনি, বিজনি থেকে সিডলি আর চেরঙ্গ - সেই পথে পাচু মাচু উপত্যকা পেরিয়ে ভুটানের রাজধানী পুনাখ। কিন্তু দু’মাস রামমোহন সেখানে বসে ছিলেন। রাজার সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছিল না। পরে তিনি রাজার দেখা পেয়েছিলেন এবং দূত হিসেবে সফলও হয়েছিলেন। যে দু’মাস তিনি সেখানে বসেছিলেন, সে ক’দিন নিশ্চয়ই তিনি ভুটানের সাধারণ মানুষজনের সংস্কৃতির খোঁজখবর নিয়েছিলেন। রামমোহনের বিষয়সম্পত্তি ও চাকরিবাকরির কথা একটু বেশি বলা হল এটা বোঝাবার জন্যে যে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বাস করার জন্য টাকার জোগাড় না করে মনস্থির করতে রামমোহনের সময় লেগেছিল বেশ কিছুকাল। দ্বিতীয়তঃ, দেখা যাচ্ছে যে, চাকরিবাকরির সূত্রে ইংরেজ সিভিলিয়ান এবং কর্মচারীর সংস্পর্শে এসে ইংরেজি আদবকায়দা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, বিশ্ব রাজনীতি এবং চিন্তাধারার সঙ্গে রামমোহন পরিচিত হতে পেরেছিলেন। দেশের আইনকানুন সম্বন্ধেও তাঁর জ্ঞান হয়েছিল ভালোরকমের। ইংরেজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে তাঁর বন্ধুমহলের চৌহদ্দিও বেড়ে গিয়েছিল। কলকাতার গণ্যমান্য বিদেশীরা এলে রামমোহনের সঙ্গে দেখা না করে যেতেন না। কোনো কোনো বিদেশীর মনেও হয়েছিল যে রামমোহনই যথার্থ ভারত আবিষ্কারক।

                              ©️রানা©️

রামমোহনের স্বাস্থ্য ছিল খুব মজবুত। তিনি দিনে আঠারো ঘন্টা পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁর খাওয়ার বিলাসিতা ছিল। বারো সের দুধ আর চার সের মাংস তিনি একবারেই খেতে পারতেন। পঞ্চাশটা ডাবের জলে নিজের তেষ্টা মেটাতেন। চল্লিশটা আম দিয়ে জলযোগ সারতেন। নাচ-গান-পার্টি ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেছিলেন অনেকে। ফিসক্লারেন্স (আর্ল অব মানচেস্টার), ফরাসি বৈজ্ঞানিক ভিক্টর জাকমঁ ও ইংরেজ মহিলা ফ্যানি পার্কার এসেছিলেন রামমোহনের কাছে। ফ্যানি পার্কার রামমোহনের বাড়িতে একটি উৎসবে হাজির ছিলেন। সেটা একটা সন্ধেবেলার পার্টি ছিল। ধনী বাঙালিদের সমাবেশ হয়েছিল। বাড়ির সামনের অংশ আলো দিয়ে সাজানো আর চমৎকার বাজি পোড়ানো হচ্ছিল। ঘরে ঘরে নাচওয়ালী নাচ-গান করছিল। সেই গান যে পার্কারের খুব ভালো লেগেছিল এমন নয়। সেই নাচওয়ালীদের মধ্যে সেকালের নিকী বাঈজীও ছিলেন। রামমোহন মুসলমানি আদবকায়দা কিছু কিছু পছন্দ করতেন। তিনি জোব্বা চাপকান পরতেন। সেই পোষাকেই তাঁকে মানাত। কেউ কেউ মনে করতেন রামমোহন মুসলমানদের সঙ্গে পানভোজন করতেন। সেটা অবশ্য ঠিক নয়। রামমোহন সেই কথাটাকে গ্রাহ্যই করতেন না। তিনি নিজের মুসলমান বন্ধুদের সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বারবার বলেছিলেন হিন্দু মুসলমান দুয়েরই দেশ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং দেশপ্রেম সমান। রামমোহনের পৈতৃক বাড়িতে ছিল বৈষ্ণব বিগ্রহের অধিষ্ঠান। পরম বৈষ্ণব ছিলেন সেই বংশের মানুষেরা। তাঁর মাতা তারিণী দেবী একাকিনী শ্রীক্ষেত্র চলে গিয়েছিলেন। ১৮২২ সালে বৈষ্ণবের তীর্থস্থানেই তারিণী দেবীর মৃত্যু হয়েছিল। রামমোহন অবশ্য বৈষ্ণবতায় আর বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মন্ত্র ছিল - ওঁ তৎসৎ। এমনকি নিজের মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও তাঁর শেষ কথা ছিল - ওঁ তৎসৎ।


রামমোহনের লেখাপড়ার ব্যাপারটা বলা যাক। তার আগে সেকালে দেশগাঁয়ে লেখাপড়া চলত কীভাবে সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক। টোল-চতুষ্পাঠী আর মক্তব মাদ্রাসাতে ছেলেরা পড়াশোনা করত। সে শিক্ষা ছিল খানিকটা একঘেয়ে। অ-আ-ক-খ, কিছুটা নামতা, কিছু হিসেবনিকেশের নবিশি। ব্যস, তারপর সারাজীবন অপরের কথামতো অথবা সমাজের নির্দেশ মেনে চলা। কাজীর বিচার আর ব্রাহ্মণের বিচারকে ভগবানের নিয়ম বলে ধরে নেওয়া। আরও বেশি এগোতেন যাঁরা, তাঁরা পড়তেন কলাপ ব্যাকরণ, ন্যায়স্মৃতিশাস্ত্র। অন্যদিকে মৌলভিরা যা পড়াতেন সেখানেও ছিল লেখাপড়ার ঐরকম পাঠ। তখন মৌলভি আর পুরোহিত-ই ছিলেন সবকিছুর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রামমোহনের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল টোলচতুষ্পাঠীতেই। কিন্তু তিনি ছিলেন মনোযোগী ছাত্র। আর সবকিছুকে খুঁটিয়ে, তন্নতন্ন করে জানবার ইচ্ছা ছিল তাঁর মধ্যে প্রবল। মনে কোন সন্দেহ ঢুকলেই তিনি সেটা দূর করতেন আরও পড়ে, আরও জেনে। খুব সামান্য কাজ চালানো গোছের ইংরেজি তখন কেউ কেউ অবশ্য পড়তেন। রামমোহন সে পথে তখন পর্যন্ত যাননি। আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে ইংরেজি শেখার যে নমুনা পাওয়া যায় সেটা দেখে এবং শুনে এখন হাসি পাওয়ার কথা। রামমোহন এর পরে চলে গিয়েছিলেন পাটনা। পাটনা ছিল সে সময়ে আরবি-ফারসি শেখার রাজধানী। রামমোহন আরবি-ফারসি ভাষায় পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। আর সেই সূত্রে ইসলাম ধর্মের সব কিছু রামমোহন জেনে নিয়েছিলেন। কোরান শরীফ পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি প্রতিমাপূজায় আর বিশ্বাস করতে পারেননি। এরপরে একেশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলেন রামমোহন। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। ইসলাম ধর্মের উপাসকদের মধ্যে মুতাজিলা সম্প্রদায় নামে একটা গোষ্ঠী ছিলেন যাঁরা তর্কবিতর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা বিচার করতেন। বড়ো কথা হল তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ মানতেন না। রামমোহন তাঁদের কাছে পেয়েছিলেন এক উদার ধর্মের রূপ। সে ধর্মে ছিল সকলের মিলেমিশে থাকার কথা। কিছুকাল পরে তিনি সূফী মরমিয়াদের ধর্মকে জেনে আরও খুশি হয়েছিলেন। হাফিজ, রুমি তাঁর কন্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। আরবি-ফারসিতে কথা বলতে তাঁর বিন্দুমাত্র আটকাত না। রামমোহনকে কি মৌলভি বলতে পারি আমরা? আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। রামমোহনের শিষ্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই মরমিয়া কবি ধর্ম প্রচারকের গান এবং লেখা পড়ে নিজের ধর্মমত গঠনে বেশ উৎসাহিত হয়েছিলেন। আর সূফী সাধকদেরই একটা সম্প্রদায় হলেন আমাদের বাউল সাধকরা। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে মানুষের ধর্মবোধের বিকাশে এই বাউলদের কথা টেনে এনেছিলেন। তাঁর ভাবনাচিন্তায় উঠে এসেছিল মানুষের ধর্মের এক উদার মন্ত্র। বাউল বলেছিলেন, ‘‘হে সাঁই, তোমার পথ ঢেকে দিয়েছে মন্দির আর মসজিদে।’’ রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ সেই ঢাকা পথকে আলোর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রামমোহন চলে গিয়েছিলেন কাশীতে। বেদ, বেদান্ত, পুরাণ চর্চার কেন্দ্র ছিল কাশী। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যও কাশীতে এসেছিলেন। কাশীতে প্রকাশানন্দের সঙ্গে বিচার করে রামমোহন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মানুষকে মানতে হবে। মানুষকে ছাড়া ঈশ্বরের চলে না। রামমোহনের তখন মন তৈরি হচ্ছিল একেশ্বরবাদের দিকে একমেবাদ্বিতীয়ম্। তিনি ভারতের জ্ঞানের ভাণ্ডার উপনিষদের পাঠ নিয়েছিলেন। ব্রহ্মসূত্র পড়েছিলেন। গীতাকে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন। উপনিষদ পড়ে তিনি সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলেন প্রতিমাপূজার কোনো মানে হয় না। প্রতিমাপূজা সম্পর্কে তাঁর যেটুকুও বিশ্বাস ছিল সেটাও একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল উপনিষদের জ্ঞান লাভ করে। কেবল কি তাই? হিন্দুধর্মের যত ধর্মশাস্ত্র ছিল, সেগুলোর সবই তিনি পড়েছিলেন। পড়েছিলেন ষড়দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতিনিবন্ধ। অন্যদিকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তন্ত্রকে অধিগত করেছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রম নিয়ে। পড়ার জন্যেই পড়া নয়, পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি বুদ্ধি আর অনুভব দিয়ে জানতেও চেয়েছিলেন, মানুষের জীবনে অধ্যাত্মভাবনার স্থান কোথায়। বিভেদবুদ্ধির কারণ কী। অসংখ্য দেবদেবীর কল্পনার মোহ কেন এল। তিনি বুঝেছিলেন - জ্ঞান আর জ্ঞানের প্রসার চাই। তাহলেই ঝাপসা ভাবটা কেটে যাবে, অন্ধকার চলে যাবে, ফুটে উঠবে আলো। রামমোহনের মানিকতলার বাড়িতে একবার এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসেছিলেন। সেদিন সেখানে আর্নট সাহেবও ছিলেন। রামমোহন তাঁর সঙ্গে সারা দিন বিচার-বিতর্ক করেছিলেন। আগের দিনে শাস্ত্রবিদরা বেরিয়ে পড়তেন দিগ্বিজয়ে। বড় বড় পণ্ডিতকে বিচারে পরাজিত করে তাঁরা দিগ্বিজয়ী বনে যেতেন। রামমোহন ঘরেবাইরে সেই দিগ্বিজয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ‘বজ্রসূচী’ বইটি বাংলা অনুবাদ করে রামমোহন প্রকাশ করেছিলেন। জৈনদের ‘কল্পসূত্র’ বইটিও তিনি পড়েছিলেন। রামমোহনের জ্ঞানার্জনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু ভ্রমণসূত্রে উত্তরভারতের সঙ্গে রামমোহনের যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮২৩ সালে তাঁর লেখা ‘প্রার্থনাপত্রে’। তাতে তিনি বলেছিলেন হিন্দুদের দশনামা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়, গুরু নানকের সম্প্রদায় আর দাদূ ও কবীর-পন্থী এবং সন্তমতের সাধকরা একেশ্বরবাদ ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁরা আমাদের ভাই। তাঁদের বাদ দিলে ধর্ম মিথ্যা হবে। তখন মাত্র ষোল বছর বয়স ছিল রামমোহনের। ঐ বয়সেই তাঁর মনে হয়েছিল অনেক দেবতা নেই। আছেন এক দেবতা। তিনি ব্রহ্ম। বুঝতে অসুবিধে হয় না রামমোহনের সেই ভাবনার সঙ্গে সে সময়ের মানুষের ভাবনার মিল হচ্ছিল না। হিন্দুধর্মে কত দেবতা! তাঁরা সব বাদ যাবেন আর থাকবেন ব্রহ্ম, একা? সেটা মানতে পারেননি তাঁর দেশের মানুষ আর আত্মীয়স্বজন। এমনকী রামমোহনের বাবাও ছেলের উপর চটে গিয়েছিলেন। রামমোহন আর কী করেন, তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ বয়সেই রামমোহনের ছিল নিজের ভাবনার উপর প্রবল বিশ্বাস। তিনি তো অনেক বিচার করে সেই কথা বলেছিলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন - তাঁর ভুল যদি কেউ দেখিয়ে দেন তবে তিনি খুশি হবেন, নচেৎ নিজের বিশ্বাসকেই মেনে চলবেন। তাঁর ষোল বছর বয়সের লেখাটা তিনি ছাপতে পারেননি। কী করেই বা পারবেন? তখন বাংলা ছাপাখানা তো খুব বেশি ছিল না। কিন্তু আরও পড়ে আরও বিচার করে তিনি তিরিশ বছর বয়সে একখানা ফারসি বই লিখেছিলেন এবং সেটা প্রকাশও করেছিলেন। বাংলায় না লিখে ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন কেন? যাঁরা আরবি ভাষা জানতেন না তাঁদের কাছে তিনি পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন ফারসি ভাষার সাহায্যে। এর আগে আরবি ভাষায় ওই রকম একটি বই তিনি লিখেছিলেন। সেটা বোধহয় সকলের কাছে পৌঁছয় নি। এখন যেমন ইংরেজি ভাষা, সে-আমলে তেমনি ছিল ফারসি ভাষার কদর। রামমোহন লিখেছিলেন ‘তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদিন’ গ্রন্থ। সেই বইতে রামমোহন দেখিয়েছিলেন, কিছু মানুষ ধর্মগুরু সেজে বসেন। তাঁদের চেলাচামুণ্ডাও জুটে যায়। আর ধর্মকে এমনভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেন যাতে তাঁদের প্রভুত্ব বজায় রাখবার সুবিধে হয়। সত্যকে গোপন করে মিথ্যার জাল দিয়ে মানুষকে তাঁরা বোকা বানান। আর সাধারণ মানুষও মনে করে পাথরই বুঝি দেবতা, গাছই বুঝি ঈশ্বর। এমনই তাঁদের ক্ষমতা যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁরা নানারকম শাস্তির ব্যবস্থা করেন। রামমোহন এটাও দেখেছিলেন যে ভারতে তখন ধর্মের এমনই অবস্থা ছিল। কিছু ব্রাহ্মণ ধর্মের নামে মানুষকে ভুলভাল বোঝাতেন, শাস্ত্রকে তাঁদের মতো করে ব্যাখ্যা করতেন। খ্রিস্টান পাদ্রিরাও ভুল বোঝাতেন মানুষকে। এমনকি ইসলামের ধর্মগুরুদের মধ্যেও ওই রকম ভণ্ডদের দেখা পাওয়া যেত। রামমোহন খুব জোর দিয়েই বলেছিলেন, ঈশ্বর কোনো দূত বা অবতার পাঠাননি পৃথিবীতে। আমরা নিজেরাই বিচার করে সত্যকে খুঁজে বার করব। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিনই তিনি খুঁজেছিলেন সত্যকে। কষ্ট পেয়েছিলেন, ধৈর্য হারাননি। তাঁকে গালমন্দ করেছিল তাঁর শত্রুরা, কিন্তু তিনি ভদ্র থেকেছিলেন আর হাফিজের কথা মনে রেখে বলেছিলেন - কারও অনিষ্ট কোরো না, তুমি নিজে যা ভাল মনে কোরো তাই করে যাও, কারণ অন্যের অনিষ্ট করার মতো পাপ আর কিছু নেই। এইরকম কথাই বলতেন রামমোহন সব সময়। সেই বইটির সম্বন্ধে পরে তিনি বলেছিলেন, যদিও তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন তবু প্রতিমাপূজা মূর্তিপূজা মানতে পারেননি। এ সব কথা বলার জন্য তিনি বিপদেও পড়েছিলেন। বাপ-মা-র কাছ থেকে তিরস্কারও পেয়েছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত আত্মীয়স্বজনেরা তাঁকে ঘৃণা করেছিলেন, এমনকি দেশের মানুষও তাঁকে সহ্য করতে পারেননি।

                                ©️রানা©️

রামমোহনের জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দের শেষের দিকে, ১৭৭২/১৭৭৪ সালে। সে সময়ে ইংরেজ ধীরে ধীরে ভারতে তাঁদের শাসন শুরু করেছিল। গোটা ভারতকেই জয় করবার স্বপ্ন দেখছিল ইংরেজ। ইংরেজদের কাছাকাছি এসে ভারতবাসীর চোখ খুলতে শুরু করেছিল। ভারতবর্ষে বাস করছে নানা জাতি। নানা ধর্মের দেশ ভারতবর্ষ। ভেদ বিভেদের শেষ নেই। কিন্তু রামমোহনের জন্মের বহুকাল আগে থেকেই সেই ভেদ-বিভেদকে মানেননি একদল মানুষ। তাঁরা তীর্থভ্রমণে বের হতেন। মানুষের সঙ্গে মিশতেন খোলামেলাভাবে। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের তফাৎ মানতেন না তাঁরা। হিন্দু ধর্মের নাম করে ছত্রিশ বর্ণের যে মিথ্যা ভাগ করা হয়েছে সেটার ভণ্ডামিকেও তাঁরা বরদাস্ত করতেন না। কবীর, দাদূ, রজ্জব, নানক, চৈতন্য বারবারই বলেছিলেন মানুষে মানুষে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই। আসলে তাঁরাও যে নতুন কোন কথা বলেছিলেন এমন নয়। ভারতের মন্ত্রই তো ছিল এক হয়ে চলব, এক হয়ে বলব, সকলের মনকে এক বলে জানব। দাদূও বলেছিলেন সেই কথা - ‘‘আমি জানি দুই নেই, আমার পথ এক।’’ কবীর তো বলতেন - ‘‘আমি ভারতপথিক। অর্থাৎ ভারত একটি পথই জানে সে পথে সকলের সঙ্গে আমরা এক।’’ রজ্জব বলেছিলেন, ‘‘গুরুর কাছে বলেছি হিন্দু-মুসলমান যেন মিলে যায়।’’ ভেদ-বিভেদের কথা ভুলে গিয়ে মিলনের কথাই বলেছিলেন ঐ পথিকেরা। রামমোহন সেকালে সেই পথের পথিক ছিলেন। একেই আমরা বলি আধুনিক কাল। এটাও দেখতে পাওয়া যায় যে, সেকালের ধর্ম নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভারতবর্ষের নানা জায়গায় এমন কী ভারতের বাইরেও গিয়েছিলেন সেই পথকে জানবার জন্যে। দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতী, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি - নামের তালিকাটা অনেক দীর্ঘ। রামমোহনের ভ্রমণের নেশা ছিল। বিদ্যালাভের জন্য, ধর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার জন্যে, চাকরি, ব্যাবসা প্রভৃতির জন্যে রামমোহন অল্প বয়স থেকেই ভারতের নানা জায়গায় গিয়েছিলেন। তাঁর ‘তুহফাৎ-উল-মুয়াহ্‌হিদিন’ বইতে তিনি বলেছিলেন যে তিনি ভারতের দূর-দূরান্তে গিয়েছিলেন। এমনকী পাহাড়-পর্বতেও তাঁর যাতায়াত ছিল। পাটনা, কাশী আর উত্তর ভারতের নানা জায়গায় তিনি ছিলেন। তিব্বতে গিয়েছিলেন। ভুটানেও তিনি কষ্ট করে গিয়েছিলেন। রংপুরে ছিলেন কিছুকাল। কলকাতায় তো তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। অবাক লাগে লাঙুলপাড়া-রাধানগরের গ্রামের ছেলে কেবল মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য ভারতের সব জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছিলেন। তারপর তাঁর মনে জেগেছিল ইউরোপ-ভ্রমণের কথা। সেখানেও তিনি যেতে চেয়েছিলেন ইউরোপবাসীর আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, ধর্মপ্রাণতা আর রাজনীতিকে বোঝবার জন্যে। রামমোহনের সময়ে কালাপানি পেরিয়ে ইউরোপ যাওয়া সহজ ছিল না। কেননা দেশের মানুষ তাহলে রামমোহনকে একঘরে করে দিতেন। রামমোহন ভ্রূক্ষেপ করেননি কোনো কিছুকেই। ইউরোপভ্রমণে তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুসলমান বাবুর্চি। বিদ্যাসাগরও লণ্ডন যাবার কথা ভেবেছিলেন। তবে তাঁর যাওয়ার ভাবনার উদ্দেশ্য ছিল, মহারানী ভিক্টোরিয়াকে জিজ্ঞাসা করা, কেমন করে মেয়ে হয়েও ভারতবর্ষে বিধবাদের দুঃখ-কষ্ট তিনি সহ্য করছেন। রামমোহনও তো সতীদাহে নারীহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন ইউরোপে আর দেশবিদেশে ঘুরে তিনি সেই একটা কথাই তো বলতে চেয়েছিলেন - মানুষে মানুষে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই। পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে মিলনের মন্ত্রই প্রচার করেছিলেন তিনি।


রংপুরে থাকতেই ডিগবির দেওয়ান রামমোহন কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে স্বদেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। স্বদেশের ডাক যেন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। আর তিনি চাকরি করেননি। কলকাতায় চলে এসেছিলেন ১৮১৪ সালে। তার আগেই কেনা ছিল বড়ো বড়ো বাড়ি। মানিকতলার বাড়িতে তিনি এসে উঠেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বদেশব্রতে আরও কিছু মানুষ চাই। মিশনারিরা মিলেমিশে কাজ করেন, সেটা তিনি দেখেছিলেন। তাঁরা সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠা করতেন। ১৮১৫ সালে, রামমোহন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আত্মীয়সভা’। এখানে আসতেন গোপীমোহন ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ মুনশি, নন্দকিশোর বসু, বৃন্দাবন মিশ্র, ব্রজমোহন মজুমদার, নীলরতন হালদারের মতো সেকালের আধুনিক চিন্তাভাবনায় উৎসাহী মানুষরা। ‘আত্মীয়সভা’? হ্যাঁ, রামমোহন বন্ধুদের আত্মীয় বলেই মানতেন। সেই সভায় সকলের ছিল অবারিত দ্বার। সভায় ধর্ম, শিক্ষা, সমাজসমস্যা নিয়ে তর্কাতর্কি হত। কেউ কোনো প্রশ্ন পাঠালে সেটার উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ‘আত্মীয়সভা’ কলকাতায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা ছিলেন নতুন, তাঁরা ছিলেন চঞ্চল, তাঁরা প্রাণের বেগে চলতেন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ এতে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তার আগে বেশ নিশ্চিন্তে ছিলেন তাঁরা। দোল, দুর্গোৎসব, নন্দোৎসব, কীর্তন, রথযাত্রা - ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবে দান, তীর্থে ভ্রমণ, উপোস করে থাকা, এটাই ছিল তখনকার ধর্মের বিধান - আমাদের সকল পাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়। চড়কের বাণফোড়া, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন - এগুলোও নাকি তখন পাপ থেকে মুক্তি এনে দিত। আর নূতন নূতন জমিদাররা তাঁদের ছেলেদের পাঠাতেন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু সাহেবের স্কুলে। তাঁদের ছেলেরা সেখানে পড়ত কিনা জানা যায় না, কিন্তু অঢেল টাকাপয়সা পেয়ে যত রকমের বেলেল্লাপনা তখনকার সময়ে ছিল - সেগুলোতে তাঁরা দক্ষ হয়ে উঠত। সেইসব ছেলেরা ছিল সেকালের বাবু। আত্মীয়সভা এর প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিল। আগে রামমোহন আরবিতে-ফারসিতে লিখেছিলেন, পরে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন বেদান্ত গ্রন্থ। সেই বইটির নামপত্রে রামমোহন বেদান্তকে শ্রেষ্ঠ সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এটাও লিখেছিলেন যে একমাত্র তিনিই (ব্রহ্ম) আমাদের পূজ্য। ১৮১৫ সালে সেই বই বেরোবার পরেই রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের ঘুম ভেঙেছিল। রামমোহনের লেখার জবাব তাঁরা দিয়েছিলেন। রামমোহনও থেমে থাকেননি। বেদান্তের সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর সেই কাজে তাঁর মতো দক্ষ সেকালে আর কেউ ছিল না। রামমোহনের বেদান্তের ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্তকে ভুল বলে প্রতিবাদীপক্ষ বই লিখেছিলেন। মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন প্রমুখ বড়ো বড়ো সংস্কৃতজানা পণ্ডিত রামমোহনকে আক্রমণ করেছিলেন জোরালো ভাষায়। আর রামমোহন তাঁদের পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন। সেইরকম শাস্ত্রবিচার ঊনিশ শতকে খুব বেশি দেখা যায়নি। রামমোহনের বিরোধীরা তাঁকে আক্রমণের সময় কখনও কখনও ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন। এমনকি তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। ঠাট্টাবিদ্রূপ তো করেছিলেনই। গালিগালাজ করেছিলেন এমন ভাষায় যে রামমোহন প্রতিবাদের সময়ে বলেছিলেন, সে ভাষা লেখা যায় না। রামমোহনের ভাষা একটু শোনা যাক, ‘‘মৃত্যুঞ্জয় বেদান্তচন্দ্রিকার প্রথম শ্লোকে কলিকালীয় তাবৎ ব্রহ্মবাদীর উপহাসের দ্বারা মঙ্গলাচরণ করিয়াছেন এবং পরে ২ অশ্বচিকিৎসা ও গোপের শ্বশুরালয় গমন ইত্যাদি নানাপ্রকার ব্যঙ্গ ও দুর্বাক্য কথনের দ্বারা গ্রন্থকে পরিপূর্ণ করিয়াছেন এবং ইহাতে ইতো ভ্ৰষ্টস্ততো নষ্টঃ চালে ফলতি কুষ্মান্ডং।’’ হাটারি বাজারি কথা নয়। এই প্রতিবাদের ভাষা জোরালো এবং মর্মভেদী। রামমোহন জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘‘বিবেচনা করিবেন যে বেদান্তশাস্ত্রে প্রসিদ্ধরূপে শুনা যায় যে কীট পর্য্যন্তকেও ঘৃণা করিবেক না এবং ব্রহ্ম একমাত্র আর যাবৎ নামরূপ সকল প্রপঞ্চ।’’ এই হচ্ছেন রামমোহন। কেবল মানুষ নয়, সর্বজীবের প্রতি ভালোবাসা বেদান্তের নির্দেশ। এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রামমোহনকে মৃত্যুঞ্জয় বলেছিলেন, ন্যাবার চিকিৎসায় তিনি ঘোড়ারোগের প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন তো রামমোহনকে পাষণ্ড বলেছিলেন। রামমোহন কাশীনাথকে সেটার উত্তর দিয়েছিলেন ‘পথ্যপ্রদান’ বই লিখে। রক্ষণশীল পণ্ডিতরা শাস্ত্রের বিচার না করে শাস্ত্রে যা বলা হয়েছে তারই ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁদের মনে কোনো জিজ্ঞাসা জাগেনি। কিংবা শাস্ত্র লিখেছিলেন যাঁরা, তাঁদের বিভিন্ন শাস্ত্রকারের মধ্যে যে মতভেদ ছিল এবং একজনের সঙ্গে আর এক জনের বিস্তর পার্থক্য ছিল, সেটাও বিরোধীরা দেখিয়ে দেননি। রামমোহন কিন্তু পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের মতামত যাচাই করেছিলেন, পণ্ডিতদের নিজেদেরই যে একে অপরের সঙ্গে মতামতের গরমিল ছিল রামমোহন সেগুলি পরীক্ষা করেছিলেন। রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা সেই পুরোনো যুক্তি বা বিশ্বাস প্রচার করেছিলেন। রামমোহন বাংলা ভাষায় শাস্ত্র আলোচনা করেছিলেন। পণ্ডিতদের চোখে সেটা ছিল অতি অন্যায় কাজ। রামমোহন তাই তাঁদের কাছে ছিলেন অধার্মিক, পাপী। কারণ, তিনি নাকি ম্লেচ্ছ, অস্থানে তাঁর যাতায়াত আছে। রামমোহনকে বলা হয়েছিল ধর্মসংহারক। রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সব গেল, সব গেল - রব উঠেছিল। রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দেবতার মূর্তিপূজা নাকি বন্ধ করতে চাইছেন রামমোহন। আর বহুদেবতার অস্তিত্বকে তো রামমোহন মানতেনই না। তাঁরা এটাও লক্ষ্য করছিলেন, যে ধর্মকে আশ্রয় করে অতদিন মানুষ নিশ্চিন্ত ছিল, সেটার বিরুদ্ধে রামমোহন জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। সমাজের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে অতদিন যে শান্তি ছিল, সেটা ভেসে যাচ্ছিল। সহমরণ বিষয়ে রামমোহনের আধুনিক চিন্তার পরিচয় পেয়ে তাঁরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সুতরাং আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতি-আঘাত হানতে তাঁরা পিছপা হননি। সাধারণ মানুষ কিন্তু এত শত চিন্তা করতেন না। তাঁরা প্রাচীন শাস্ত্রকে মেনে নিয়ে চারিদিকে প্রাচীর তুলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন। রামমোহনের লেখায় ছিল সেই ঘুমভাঙানিয়ার ডাক। সকলকে তিনি বলেছিলেন, ঝগড়ার বিরুদ্ধে গালিগালাজ করে লাভ নেই। বিচার তর্ক আর জ্ঞান দিয়েই তিনি মানুষকে জাগাবেন। তিনি ভাগবতের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, পরমেশ্বরের প্রেম, সকলের জন্য বন্ধুত্ব, মূর্খদের জন্য কৃপা এবং বিরোধীদের প্রতি উপেক্ষা দেখানোই সব দিক থেকে ভালো হবে। রামমোহন যখন প্রেম, বন্ধুত্ব, কৃপার কথা বলেছিলেন, তখন বুঝতে পারা যায় যে তিনি মানুষের কথাই ভেবেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন অজ্ঞানতা থেকে কীভাবে মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে আসবেন। রামমোহন ছিলেন আলোকিত মানুষ। রামমোহনের সহযোগী বন্ধুদের কথা আগেই বলা হয়েছে। তাঁরা রামমোহনের ধর্মচিন্তাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন নানাভাবে। তাঁদের সকলেই যে রামমোহনের সব মত মেনে নিয়েছেন এমন নয়। কিন্তু রামমোহনের প্রগতিশীল চিন্তাকে তাঁরা সমর্থন করেছেন। রামমোহন নানা সূত্রে বলেছিলেন, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনে এদেশে এমন এক শ্রেণীর মানুষের দেখা পাওয়া গিয়েছিল যাঁরা সকল কাজে, চিন্তায় প্রাচীন ভাবনা-চিন্তার যা তখন আর গ্রাহ্য ছিল না, সেটাকে বর্জন করতে উৎসুক ছিলেন। সেই শ্রেণীর মানুষই রামমোহন চেয়েছিলেন। ওই শ্রেণীকেই বলা যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শেষ করার আগে আরও একটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় রামমোহন যখন লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তখন বাংলা গদ্যের চর্চা খুব বেশি দূর এগোয়নি। মানুষ কাজেকর্মে কিছু গদ্যভাষা ব্যবহার করত ঠিকই। তাতে গদ্যের একটা চেহারাও ফুটে উঠেছিল। এরপরেই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতমুনশিরা বাংলা গদ্যে বই লিখেছিলেন ইংরেজদের জন্য। সেগুলি সবই পাঠ্য বই ছিল। সেগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিশেষ যোগ ছিল না। রামমোহন লিখেছিলেন সকলের জন্য। সেগুলো স্কুলের বা কলেজের পাঠ্য বই ছিল না। বাংলা গদ্যকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন রামমোহন। তাঁর গদ্য প্রধানতঃ ছিল তর্কের গদ্য। কীভাবে যুক্তিকে সাজাতে হয় রামমোহন সেটা জানতেন। রামমোহনের লেখা থেকে বুঝতে পারা যায়, সে সময়ের গদ্যে বিভিন্ন পদের অন্বয় ঠিকমতো হত না। তিনি লিখেছিলেন ক্রিয়াপদের সঙ্গে কর্তৃপদের যেন যোগটা সোজাসুজি হয়। অনর্থক বাক্যকে লম্বা করে এই সোজাসুজি যোগকে নষ্ট করা উচিত হবে না। রামমোহন তুলনামূলক ধর্মের সমালোচনা করেছিলেন। এর ফলে বাংলা গদ্যে বিষয়েরও নূতনত্ব দেখা দিয়েছিল। তিনি যে বাংলা ভাষা নিয়ে গভীর চিন্তা করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ বইতে।

                               ©️রানা©️

(তথ্যসূত্র:

১- রাজর্ষি রামমোহন: জীবনী ও রচনা, অনিলচন্দ্র ঘোষ।

২- মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার উপদেশ ও মতামত - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত।

৩- সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।)

               

No comments