Page Nav

HIDE

Grid Style

GRID_STYLE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

তমলুকের বীর সন্তান ডঃ মনিলাল ভৌমিক

১৯৪৭ সাল | তমলুকের শিউরি গ্রাম থেকে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তে আসলেন এক বাঙালি যুবক | বয়স মাত্র ষোলো | জীবনে প্রথমবার পায়ে চটি | শহরের পথে খালি পায়ে হাঁটা কষ্টের, তাই বাধ্য হয়েই চটি কিনতে হয়েছিল। তার আগে খালি পায়েই চার মাইল…

 





১৯৪৭ সাল | তমলুকের শিউরি গ্রাম থেকে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তে আসলেন এক বাঙালি যুবক | বয়স মাত্র ষোলো | জীবনে প্রথমবার পায়ে চটি | শহরের পথে খালি পায়ে হাঁটা কষ্টের, তাই বাধ্য হয়েই চটি কিনতে হয়েছিল। তার আগে খালি পায়েই চার মাইল হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন | 


হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান | কিন্তু অসম্ভব মেধাবী | কৃতিত্বের সাথে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক এবং পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কিংবদন্তি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন অধ্যাপনা করতেন স্কটিশ চার্চ কলেজে | তাঁর নজরে আসেন এই ছাত্রটি | অনুপ্রেরণা দেন উচ্চশিক্ষার | ছাত্রটি ভর্তি হল আই আই টি খড়্গপুরে | তিনিই  ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদার্থবিদ্যায় প্রথম ডক্টরেট। সালটা ১৯৫৮। গবেষণা করেছিলেন Resonant Electronic Energy Transfer-এর ওপর |


১৯৫৯ সালে স্লোন ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ লাভ করে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় গবেষণার সুযোগ আসে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলসে। কিন্তু বাঁধ সাধল অর্থ | আমেরিকা যাওয়ার বিমানভাড়া তখন অনেক | সেই সামর্থ্য তাঁর নেই | পাশে দাঁড়ালো গ্রামের লোকেরা | তারাই চাঁদা তুলে বিমান ভাড়ার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমেরিকায় যখন পৌঁছলেন, তখন তাঁর পকেটে মোটে তিন ডলার।


###


১৯৬১ সালে তিনি জেরক্স ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল সিস্টেমস-এর কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রনিক বিভাগে একজন লেসার বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন।এর পাশাপাশি তিনি লং বিচের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় অধ্যাপনাও চালিয়ে যান। ১৯৬৮ সালে তিনি নর্থরপ রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন, যেখানে পরবর্তীকালে তিনি লেসার টেকনোলজি ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর হন এবং একটি দলের নেতৃত্ব দেন, যা এক্সাইমার লেসার প্রযুক্তির গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৯৭৩ সালের মে মাসে এই গবেষণার ওপর লিখিত প্রবন্ধ অপ্টিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকা কলোরাডো অধিবেশনে পেশ করা হয়।


তিনি এক্সাইমার লেজার আবিষ্কার করেছেন। ওই লেজার রশ্মি প্রাথমিকভাবে সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য আবিষ্কৃত হলেও পরে তা দিয়ে লেজিক নামে এক চোখের অপারেশন শুরু হয় | বর্তমানে চোখের ছানির শল্যচিকিৎসায় যা এক অতি পরিচিত নাম | ওই অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি পরিমার্জিত করা যায় খুব সহজেই | চশমা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করার আর প্রয়োজন হয় না | এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ ওই অপারেশন করিয়েছেন | কলোরাডো অধিবেশনে তিনি প্রথমবার পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ সাপেক্ষে দেখান যে, এক্সাইমার লেসার এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকরী করা যেতে পারে তার ব্যাবহারিক প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। তাঁর নতুন ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেসার উদ্ভাবনের ফলে তাঁর সতীর্থরা তাঁকে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও ইন্সটিটিউট অফ ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সদস্যপদের জন্য নির্বাচিত করেন। ডজন খানেক লেসার-এর ‘পেটেন্ট’ তাঁর গবেষণা ও মেধার ফল। বহু পেশাদারি পত্রিকায় পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি। 


বিপুল বৈভবের মধ্যে থাকতে থাকতে হঠাৎই একদিন তাঁর মাথায় আধ্যাত্মিক চিন্তা আসে | কিন্তু বিজ্ঞানীর মন – সহজে আধ্যাত্মবাদকে মেনে নিতে চায়নি কারন বিজ্ঞান আর আধ্যাত্মবাদ তো দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে | কিন্তু গবেষণা করতে করতে তিনি উপলব্ধি করেন যে , একসময়ে যে বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে শিখিয়েছিল, অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই বিজ্ঞানই আবার আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে – কোয়ান্টাম ফিজিক্স – কসমোলজি – বিজ্ঞানের এইসব শাখার মাধ্যমে | এই প্রচেষ্টারই ফসল হল তাঁর বহু প্রবন্ধ, কোড নেম গড (বাংলায় ‘বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত’) ও দ্য কসমিক ডিটেক্টিভ-এর মতো বই এবং কসমিক কোয়ান্টাম রে-র মতো টিভি প্রোগ্রাম। 


####


জন্ম ১৯৩১ সালের ৩০ মার্চ | শিক্ষার আলো থেকে বহুদূরে থাকা মেদিনীপুরের তমলুকের শিউরি গ্রামে | হতদরিদ্র পরিবার | সবদিন ভালোভাবে খাওয়াও জুটতো না। বাবা গুণধর ভৌমিক স্কুলশিক্ষক | এর বাইরেও তাঁর একটি পরিচয় ছিল। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সৈনিক। পুলিশের তাড়ায় প্রায়ই বাড়ির বাইরে অজানা ডেরায় আত্মগোপন করে থাকতে হত তাঁকে। বাবার খোঁজে প্রায়ই পুলিশ তাদের বাড়িতে এসে তল্লাশির নামে জিনিসপত্র তছনছ করত, মারধর করত।


ছোট্ট ছেলেটি ভর্তি হলেন কৃষ্ণগঞ্জ কৃষি শিল্প বিদ্যালয়ে | পড়াশোনায় সে বরাবরের তুখড় | সকালবেলায় গরু চড়াতে হত | তারপরে খালি পায়েই চার মাইল হেঁটে স্কুলে যাতায়াত | পড়াশোনা করতেন প্রদীপের আলোয় | ছোটবেলায়, রাতের অন্ধকারে আকাশের তারাগুলো দেখতে দেখতে অনেক সময়েই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে ওই চাঁদ, তারা – এগুলো কীভাবে তৈরী হল! সে প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়েছিলেন পরবর্তীতে কসমোলজি নিয়ে গবেষণা করার সময় |


###


তিনি মণি ভৌমিক | বাংলা ও বাঙালির গর্ব | দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে মেধা়ই যে তাঁর একমাত্র হাতিয়ার সেটা তিনি সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন | এই বাঙালি সেবাব্রতী খড়্গপুর আইআইটি-কে ১৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছেন | স্নাতক স্তরে তিনি যেখানে পড়াশোনা করেছিলেন, সেই স্কটিশ চার্চ কলেজের নবনির্মিত মিলেনিয়াম ভবনের জন্য ২০০০ সালে তিনি প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। ওই ভবনেরই একতলায় মণি ভৌমিকের নামে একটি অডিটোরিয়ামও তৈরি হয়েছে | 


মার্কিন মুলুকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা গবেষক, পদার্থবিজ্ঞানী মণি ভৌমিক ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুদানের পরিমাণ ১১ মিলিয়ন ডলার। মানে, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭৪ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানের পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগ এর আগে কোনও দিন এই পরিমাণ আর্থিক অনুদান পায়নি। সেটা এল তাঁরই হাত ধরে। 


ভোলেননি নিজের গ্রামের কথাও | আজও প্রায় রোজদিন ফোন করেন বাড়িতে | পরিবারের সকলের খোঁজ নেওয়ার পরেই এখনও উনি জানতে চান এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা কেমন চলছে। এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থাই বা কেমন। মণি ভৌমিক এখন চেষ্টা করছেন বাংলায় দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করতে |


বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বেভার্লি হিলস এর বাসিন্দা | আমরা এই মহান মানুষটির দীর্ঘায়ু কামনা করি |


তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা , বি বি সি নিউস বাংলা, হলদিয়া বন্দর


No comments